#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৮
ওয়াহাজ এসে ফারাজকে দেখে আন্তরিকতার সাথে বলে,” কেমন আছ? এসে গেছো তো দেখছি। তুমি তো বললে আসবে না।”
ফারাজ হেসে বলে,” আসতে হলো। আম্মাও তো এখান থেকে খাবার নিয়ে যেতে বলেছে। ভাবলাম এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে।”
ওয়াহাজ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে, ” ভালো করেছ। ”
মৌ ভ্রু কুচকে ওয়াহাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আপনি ভাইয়াকে আসতে বলেছিলেন?”
” বললাম তখন চা খেতে নেমে।”
মৌ কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ওয়াহাজের দিকে তাকায়। সে ভাবতেই পারেনি ওয়াহাজ তার বলা কথাগুলো এত তাড়াতাড়ি ভাববে৷ সেদিন রাতে দুজন গল্প করার সময় কথায় কথায় মৌ ফারাজ আর বেলার কথা তুলেছিল। ওয়াহাজ তখন খুব একটা মনোযোগী ছিল না কথা শুনতে। আজ এই সময়ে এসে তার মনে হচ্ছে ওয়াহাজ তখন সাঁড়া না দিলেও এক মুহূর্তের জন্য অমনোযোগী হয়নি।
ফুসকা খাওয়া শেষে বেলা আবদারের সুরে বলে,” আজ আর ভাবিকে রান্না করতে হবে না। ভাইয়া যেহেতু ফুসকা খাওয়ালো, বাহিরে যাওয়া উপলক্ষে আমি ট্রিট দেব। আজ সবাই রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাসায় ফিরব। ”
বেলার কথা শেষ হতেই ফারাজ দাঁড়িয়ে যায়। ওয়াহাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আমি তাহলে আসছি ভাইয়া।”
ওয়াহাজ ফারাজের চলে যাওয়ার বিষয়টা একেবারে নাকচ করে দেওয়ার স্বরে বলে,” সে কি কথা! শুনলে না ওয়াজিহা ট্রিট দিবে? ”
মৌ এক প্রকার জোর করে ফারাজকে নিয়ে যায়। কোনো উপায় না পেয়ে সবার সাথে ফারাজকেও যেতে হয়।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই রেস্টুরেন্টের বাহিরে এসে দাঁড়ায়। ওয়াহাজ একটু এগিয়ে যায় রিকশা ঠিক করতে। সুযোগ বুঝে মৌ নিজেও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায় ফোন আসার বাহানায়। ফারাজ আর বেলা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
ফারাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বেলা বলে ওঠে,” একা পাওয়ায় কোনো সু্যোগ নিবেন না।”
ফারাজ ভ্রু বিস্তৃত করে বলে,” কীসের সুযোগ? আপনার হাত ধরেছি নাকি বাজে ইঙ্গিত দিয়েছি।”
বেলা আমতা আমতা করে বলে,” না তা করেননি কিন্তু আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনি কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন।”
ফারাজ কপালে হাত দিয়ে বলে,” আপনারা মেয়েরা এতো বেশি বোঝেন কেন? ঠোঁট নাড়লেই বুঝে যান কিছু বলব। বললেই বা কি? আমি বললে আপনি আমার মুখ আটকাতে পারবেন?”
” থাকুন আপনি এখানে, আমি ওদিক গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।”
ফারাজ ধমকের সুরে বলে,” চুপচাপ দাঁড়ান এখানে। আর আমি কিছু বলতে গেলেই কেন আপনার গা জ্বালা করে ওঠে বলেন তো?”
” বাজে বকবেন না।”
” কোনোভাবে এক্স হাজবেন্ডকে মনে জায়গা দিয়ে বসে আছেন নাকি? অন্যকাউকে সহ্যই করতে পারছেন না যে!”
” শুনুন, অতীতকে চেয়ে দেখার সময় আমার নেই। আমি নিজের জন্য বেঁচে আছি। আমার আপাতত কাউকে প্রয়োজন নেই।”
” কবে প্রয়োজন হবে?”
” হবে না হয়তো।” বলেই বেলা মৌয়ের দিকে চলে যেতে শুরু করে।
ফারাজ পিছন থেকে ডেকে বলে,” শুনুন, অগ্রিম শুভ জন্মদিন। ”
বেলা থেমে যায় পিছনে ফিরে তাকায়। ফারাজ মৃদু হেসে বলে,” এটাই বলতে চেয়েছিলাম আমি অন্যকিছু না। ভালোবাসি আপনাকে কিন্তু সেটা বারবার বলার প্রয়োজনবোধ করি না। আপনি যদি আমার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে যান আমি আপনার ভালোবাসায় ম*রেছি তাহলে সেটা শব্দব্যয় করে বলতে যাব কেন? আর হ্যাঁ আপনার এখন আমাকে প্রয়োজন না হলেও একসময় প্রয়োজন হবে খুব করে প্রয়োজন হবে। জীবন একা একা কাটিয়ে দেওয়া যায় না শুধু নিঃশ্বাসটুকু নেওয়া যায়। বাঁচার মতো বাঁচতে হলে ভালোবাসতে হয়, ভালোবাসলেই ভালো থাকা যায়। ”
ফারাজ থেমে বেলার দিকে দু’পা এগিয়ে আসে৷ বলে,” আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব, ওয়াজিহা। আপনি নিজেকে নিজের মতো গড়ে তুলুন। অপ্রয়োজনীয় মানুষ দিয়ে জীবন পরিপূর্ণ করার চেয়ে ভালোবাসার মানুষ দিয়ে পরিপূর্ণ করা প্রয়োজন৷ আপনি তো…”
ফারাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওয়াহাজ চলে আসে৷ মৌকে ডেকে বলে,” চলো, রিকশা পেয়েছি।”
মৌ এগিয়ে আসে। বেলা, মৌয়ের হাত খালি দেখে বলে,” পার্সেল ভেতরে রেখে এসেছ তোমরা?”
মৌ ঠোঁট উল্টে বলে,” ভুলে গিয়েছিলাম। দাঁড়ান নিয়ে আসছি।”
ওয়াহাজ মৌকে থামিয়ে দিয়ে বলে,” তোমরা রিকশাতে উঠে বসো। আমি নিয়ে আসছি।”
” ভাইয়া তাহলে আমি চলে যাই, আপনারা বাসায় চলে যান।” ফারাজ ওয়াহাজকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে। ওয়াহাজও সম্মতি জানিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে যায়।
মৌ আর বেলা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজ একটা শপিং ব্যাগ মৌয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অল্পস্বরে বলে,” এটা তোর ননদের বার্থডে গিফট। দিয়ে দিস তাকে।”
____
টানা একদিন পর ড্রয়িংরুমে যাওয়ার পারমিশন পেয়েছে বেলা। মৌয়ের বাবা-মা সকালে এসেছে। বেলার রুমে এসেই অনেকক্ষণ গল্প করেছে। তাদের সাথে রুমের বাহিরে আসতে চাইলে মৌ কড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছে। বেলার কাছে এ সময়ে এসে এসব একদম বাড়াবাড়ি লেগেছে।
সন্ধ্যার দিকে একটা লালরঙা গাউন হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৌ বলেছিল,” এটা পরে রেডি হয়ে নাও। বাহিরে তোমার জন্য অনেককিছু অপেক্ষা করছে। ”
বেলা গোমড়ামুখে বলেছিল,” এতোকিছু পর এগুলো ভালো লাগে বলো? আমি ছোটো বাচ্চা তো নই।”
” শোনো জীবনকে সহজভাবে নাও। তোমার ভাইয়ের কাছে তুমি ডিভোর্সি কোনো নারী নও যার জীবনে শখ আহ্লাদ নেই তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে সেই আগের মতো অতি আদরের ছোটো বোন।”
মৌয়ের কথার ওপর আর কোনো কথা বলতে পারেনি বেলা। চুপচাপ নিজের ইচ্ছেমতো সেজেছিল সে। রাত আটটার দিকে দরজায় নক করার শব্দ পেয়ে বেলা ভেতরে আসার অনুমতি দেয়। ওয়াহাজ ভেতরে এসে বেলাকে দেখে বলে, ” কী সুন্দর লাগছে আমার বোনকে! একদম লালপরী। ”
বেলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলে,” আমি কি বাচ্চা, ভাইয়া? ”
ওয়াহাজ বেলাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,” তুমি আজীবন আমার কাছে সেই ছোটো বাচ্চা মেয়েটাই থাকবে। আচ্ছা এসব বাদ দাও, তুমি রেডি?”
” হ্যাঁ রেডি তো। কেমন লাগছে আমাকে?”
” বাহিরে চলো, সবাই দেখেই বলুক নাহয়।”
ওয়াহাজ বেলাকে নিয়ে বাহিরে চলে আসে। ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। পুরো জায়গাটা অন্যরকম করে ফেলেছে। সাজানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটার পিছনে অনেক সময় দিতে হয়েছে। মাথার ওপরে একটা ঝাড়বাতি লাগানো হয়েছে নতুন। চারদিকে আর্টিফিসিয়াল ফুল দিয়ে সাজানো।
বেলাকে বের হতে দেখে মৌ এবং ফাহমিদা বেগম এগিয়ে আসেন। ফাহমিদা বেগম বেলার গালে হাত দিয়ে আদরের সাথে বলেন,” কী সুন্দর লাগছে আমার মা’টাকে। আল্লাহ তোমার ভালো করুক মা।”
এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির চোখ শুধু লালরঙা পোশাকের মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে সে প্রথমবার দেখেছিল উজ্জ্বলরঙা একটা শাড়িতে অথচ কান্নায় জর্জরিত ছিল তার মুখ। চোখ ফুলে গিয়েছিল। তাতেও কি অপরূপ লেগেছিল তাকে। সেদিন প্রথম যখন মেয়েটার দিকে নজর গিয়েছিল এরপর থেকে আর সে নজর অন্যকারো ওপর যায়নি।
ওয়াহাজ বেলার কাছে এসে বলে,” তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। মেয়েটা তোমার সাথে অনেকদিন ধরে দেখা করতে চাইছিল। আমার নম্বর রেখে দিয়েছিল সেদিন। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই কল করতো তোমার সাথে কথা বলতে। তোমার আগের সিম তো বন্ধ তাই যোগাযোগ করতে পারেনি। ওকে আজ এখানে এনেছি। ”
বেলা জিজ্ঞেস করে,” কে ভাইয়া?”
” বলব না। দাঁড়াও ডেকে পাঠাই।” ওয়াহাজ মৌকে ইশারায় রুম থেকে কাউকে নিয়ে আসতে বলে। মৌ চলে যায় তাকে নিয়ে আসতে। কিছুক্ষণ পর একটা বোরখা পরা মেয়ে বেরিয়ে আসে।
মেয়েটাকে দেখে বেলা স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটা নিজেই বেলার সামনে দাঁড়ায়। চোখদুটো ছলছল করছে তার। বেলা এক পলকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটা চোখ মুছে বলে,” জানো তোমাকে কতো মিস করেছি? ভাইয়াকে কত কল করেছি তোমার সাথে দেখা করার জন্য, কথা বলার জন্য! কী সুন্দর লাগছে গো তোমাকে?”
মৌ ফারাজের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মৌকে ডেকে বলে,” কে এটা?”
মৌ বেলার দিকে তাকিয়েই বলে,” মেয়েটা ওয়াজিহার ননদ। ”
#চলবে……