মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-২৭

0
608

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৭

ওপাশ থেকে অচেনা গলায় অচেনা পুরুষ বলে ওঠে,” ওয়াহাজের যেতে একটু দেরি হচ্ছে, ভাবি। আমরা হাসপাতালে।”

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মৌয়ের। তার ভাই তো সবসময় হাসপাতালে থাকে কই আগে তো হাসপাতালের কথা শুনে খারাপ লাগেনি তবে আজ কেন লাগছে?

মৌ ভাঙা ভাঙা শব্দে উচ্চারণ করে,” ক কী হ হয়েছে উ উনার? উনি ঠ ঠিক আছেন তো? ”

ওপাশের ব্যক্তিটি মৌকে আশ্বস্ত করে বলে,” ভাবি মিথ্যে মিথ্যে ভয় পাবেন না। ওয়াহাজ ঠিক আছে। আসলে আমার কাজিনের বউ প্রেগন্যান্ট। ব্লা*ড প্রয়োজন ছিল তাই ওয়াহাজকে নিয়ে এসেছিলাম। ”

হাঁপ ছেড়ে বাঁচে মৌ। কথা শেষ করে বিছানায় চলে যায়। অপেক্ষা করতে থাকে ওয়াহাজের জন্য।

রাত দুইটার দিকে ফোনটা বেজে ওঠে। মৌ ওয়াহাজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ফোনটা বেজে ওঠায় ঘুম ভেঙে যায় তা। হাতড়ে ফোনটা খুঁজে পেয়ে রিসিভ করলেই ওপাশ থেকে ওয়াহাজ বাসার দরজাটা খুলে দিতে বলে।

মৌ সাথে সাথে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই ওয়াহাজ ভেতরে এসে বলে,” আমার জন্য একটু খাবার গরম করে দাও না, প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। ”

মৌ রান্নাঘরে যেতে যেতে বলে,” আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

খাওয়া দাওয়া করতে বসলে মৌ জিজ্ঞেস করে,” আপনি আমাকে কল দিয়ে কেন জানাননি যে আসতে দেরি হবে? আপনার বন্ধু কল রিসিভ করে বলে আপনি হাসপাতালে, আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ”
ওয়াহাজ এক লোকমা ভাত মৌয়ের মুখে দিয়ে বলে,” একটাবার কি ডাটা অন করেছিলে?”

মৌ খাবার মুখে নিয়েই এবড়োখেবড়োভাবে বলে,” ডাটা কেন অন করতে হবে?”
” অন করলে দেখতে আমি অনেকগুলো মেসেজ আর কল দিয়েছিলাম।”
” আজ আমার অনলাইনে যাওয়া হয়নি। স্যরি..”
” হুম, খেয়ে নাও এখন।”
” আপনার বন্ধুর স্ত্রীর কী অবস্থা এখন?”
” আলহামদুলিল্লাহ।”
___

দুদিন হয়ে গেছে মৌ বাসা থেকে নতুন বাসায় ফিরেছে। ও বাসা থেকে আসার পর থেকেই বেলার জন্য টুকটাক কেনাকাটা শুরু হয়েছে। বেলার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা অনেক বড়ো। সে হিসেবে কয়েকদিন লেগেই যাবে। বাসার ড্রয়িংরুমটা সাজানো হচ্ছে। আগামীকাল বেলার জন্মদিন। মৌয়ের পরিবারকে ইনভাইট করা হয়েছে। মৌ আর ওয়াহাজ মিলে সবকিছুর ব্যবস্থা করছে বেলা নিষেধ করা সত্ত্বেও তার কথা কেউ শোনেনি। ড্রয়িংরুমে কী কী করছে সেটাও বেলাকে দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। বেলাকে কথা দিতে হয়েছে সে বাহিরের কিছুই দেখবে না। এত বছর বয়সী মেয়ে, যা যা ঘটে গিয়েছে তারপর এসব যেন তার কাছে বোকামি বা বেশি বেশি লাগছে।

বেলা একপাশে বসে নিজের নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিষয়ক ভিডিয়ো দেখছে। তার ভাই যেদিন তাকে প্রথমে অতীত থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল তার কিছুদিনের মধ্যে থেকেই সবকিছুর প্রিপারেশন শুরু হয়েছিল বেলার। ভাষা থেকে সবকিছু তার আয়ত্ত্বে নিতে হয়েছে। কোন নতুন জায়গায় অবস্থানের জন্য সেখানকার ভাষা এবং পরিবেশ সম্পর্কে জানা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।

বেলা বসে বসে ওয়াহাজের ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল নিজের রুমে বসে। ওয়াহাজ রুমে নক করতেই বেলা সেদিকে তাকায়।

ওয়াহাজ মৃদু হেসে বলে,” আসবো? ”

বেলা ল্যাপটপটা পাশে রেখে বলে,” হ্যাঁ এসো না। ভাবি কোথায়? কী করছে?”
” ফ্রেশ হচ্ছে। বাহিরে যেতে হবে তৈরি হও।”
” বাহিরে কেন?”
” মৌ-এর বাবা, মা আসছে আগামীকাল সকালে। মৌ বলল ফ্রিজে ফলমূল, নাশতার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ভাবলাম তোমাদের দুজনকে নিয়েই বের হই। তুমি সেদিন বলছিলে ফুসকা খেতে যাবে। ”

বেলার মুখে হাসি ফুটে যায়। সাগ্রহে বলে ওঠে,” ফুসকা!”

বাহিরের দিক থেকে মৌ রুমে আসতে আসতে বলে,” হ্যাঁ ফুসকা। দেখব কে বেশি খেতে পারে? আমার সাথে পারবে না।”

বেলা মৌ-এর দিকে ফিরে মৃদু হেসে বলে,” আমাকে হারাবে তুমি? ভাইয়া জানে আমি কেমন ফুসকা খাই। ”

মৌ এসে ওয়াহাজের পাশে বসে। বলে,” তুমি, তোমার ভাই কেউ জানো না আমি কেমন ফুসকা খেতে পারি। আজ দেখা যাবে।”

ওয়াহাজ দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলে,” এই তোমরা মেয়েরা কোনোকিছুতে না আটকালেও ফুসকাতে ঠিকই আটকে যাও। আজ যত পারো খেয়ে নাও, আমি খাওয়াবো।”

মৌ উচ্ছ্বসিত হয়ে বেলাকে বলে,” ওয়াজিহা, তুমি আজ শাড়ি পরবে। আমিও পরব। তোমার কালো রঙের শাড়িটা আজ পরবে। ”

বেলা আর মৌকে ফিরিয়ে দেয় না। মৌয়ের এক কথায় সে রাজি হয়ে যায়। ফোনে সময় দেখে বলে,” আধাঘণ্টার মধ্যে রেডি হলে হবে? দেরি হবে না তো?”

মৌ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে,” আধাঘণ্টায় শাড়ি পরে সাজগোজ করা কমপ্লিট হবে তোমার?”

বেলা হেসে বলে,” আমার শাড়ি পরার অভ্যেস আছে, ভাবি। তুমি যাও রেডি হয়ে নাও।”

ওয়াহাজ মৌকে বলে,” আমার বোন অলরাউন্ডার। তুমি আধাঘণ্টায় শেষ করে দেখাও। ”

ওয়াহাজ বাহিরে যেতে যেতে বলে,” তোমরা রেডি হও। আমি নিচের স্টল থেকে চা খেয়ে আসি। আর হ্যাঁ, ড্রয়িংরুমে লাইট অন করবে না।”
তিনজনের বের হতে হতে সাতটা বেজে যায়। চারদিকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। তিনজন বেড়িয়ে একটা অটো নিয়ে সামনেই একটা মাঠের দিকে রওয়ানা দেয়। সেখানে বিভিন্নধরনের খাবার পাওয়া যায় সাথে ফুসকাও।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অটো মাঠের পাশেই এসে দাঁড়ায়। দুজন নেমে পাশে দাঁড়ায়। ওয়াহাজ ভাড়া মিটিয়ে দুজনকে নিয়ে মাঠের মাঝে একটা টেবিলে গিয়ে বসে।

মৌ এদিক ওদিক দেখে বলে,” চারপাশ একদম অন্ধকার রাত হয়ে গেছে। এত সুন্দর করে রেডি হলাম আর ছবি তুলতে পারব না। ”

বেলা বলে,” ছবি উঠে আর কী করবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় তো আর দাও না।”
” ছবি উঠলেই কেন মানুষকে দেখাতে হবে? নিজের ফোনের গ্যালারিতে রেখে দেব। আর তাছাড়া তোমার সাথে তো আমার বেশি ছবিই নেই। ”
” ভাবি! অনেকগুলো ছবি আছে। সেই তোমার বিয়ের আগে থেকে ছবি উঠছি তোমার সাথে।”

” তোরা ছবি নিয়ে পড়ে থাক, আমি যাই ফুসকা অর্ডার দিয়ে আসি।” বলেই ওয়াহাজ ফুসকা অর্ডার দিতে চলে যায়।

বেলা বলে,” এখানে অন্ধকার আর আলো মিলিয়ে ছবি কিন্তু সুন্দর আসবে। ফোন দাও আমি ছবি তুলে দেই।”
” ঠিক বলেছ। নাও কয়েকটা তুলে দাও তো।”

দুজন ছবি তোলায় ব্যস্ত এমন সময় একজন মৌ-এর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে টেবিলে হাত দিয়ে শব্দ করতেই দুজনে সেই ব্যক্তির দিকে তাকায়। মৌ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে,” ভাইয়া, তুই এখানে! ”

ফারাজ চেয়ারটা দেখিয়ে বলে,” দাঁড়িয়েই থাকব নাকি বসতে বলবি।”

মৌ ব্যস্তভঙ্গিতে বলে,” বসে পড় কিন্তু তুই এখানে কেন? কাউকে নিয়ে এসেছিস?”

ফারাজ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,” সেদিন আম্মাকে এখান থেকে চিকেন ফ্রাই নিয়ে খাইয়েছিলাম। আজ আমাকে আবার পাঠিয়ে দিয়েছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হাসপাতাল থেকে আবার এখানে আসতে হলো। তোদের দেখে এগিয়ে এলাম। ভাইয়া আসেনি?”
” এসেছে তো। ওই যে ফুসকা অর্ডার দিতে বলতে গেল।”

দুই ভাইবোনের মাঝে বেলা আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে। ফারাজ বেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আপনি চুপচাপ আছেন কেন? মন খারাপ?”

বেলা মাথা নাসূচক নাড়িয়ে বলে,” না না মন খারাপ কেন হবে? আপনারা কথা বলছিলেন তাই আমি….”
” দেখা হলে ভালোমন্দ তো জানতে চাইতেই পারেন, ভালো না হয় না-ই বাসলেন।”

ফারাজের কথা কানে যেতেই বেলা মৌ-এর দিকে তাকায়। মৌ ইশারায় কিছু মনে করতে নিষেধ করে ফারাজকে বলে,” ভাইয়া, তুইও বোস আমাদের সাথে। ফুসকা খাবি?”
” ফুসকা তোদের মেয়েদের খাবার। আমাদের মতো সুপুরুষের নয়।”

বেলা মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,” আসছে আমার ফুসকা না খাওয়া সুপুরুষ!”

ফারাজ বেলার বিড়বিড় করা দেখে বলে,” কিছু বললেন?”
” না কিছু না, একদমই না।”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে