মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-২৬

0
631

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৬

দুপুর এগারোটা বেজে গিয়েছে বেলার এখনো ঘুম ভাঙেনি। মৌ ডাকতে চাইলেও ওয়াহাজ ডাকতে নিষেধ করে বলেছিল,” মাথাব্যথা হওয়া সত্ত্বেও ও কোনোভাবে ঘুমিয়ে গেলে নিজে থেকে না উঠলে আবারও মাথাব্যথা করে।”

মৌ বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। একটু পরেই হয়তো ফারাজ আসবে তাদের নিতে। মৌ আর ওয়াহাজ দুজনকেই যেহেতু একসাথে নিয়ে যাবে তাই বেলাকেও ওদের সাথেই নিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মৌ সকালে বেলার রুমে গিয়েছিল একবার। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় কপালে হাত পড়তেই সে বুঝলো বেলার জ্বর এসেছে।

মৌ ছোটো একটা ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড়গুলো নিয়ে নিচ্ছে আজ নিজের বাড়িতে গেলে ফিরতে ফিরতে আগামীকাল প্রায় রাতই হয়ে যাবে। ওয়াহাজ বেলার রুম থেকে এসে খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়লো।

ফোনটা পাশে রেখে বলল,” বারোটা বেজে যাচ্ছে, মেয়েটা ঘুম থেকে উঠছেই না কেন বলো তো? আমার তো এখন চিন্তা হচ্ছে।”

মৌ উঠে এসে পাশে বসে। বলে,” মাথাব্যথা কমে যাওয়ায় একটু শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। চিন্তা করবেন না আপনি। ”
” এতবেলা পর্যন্ত তো ঘুমায়না কখনো।”
” একটু অসুস্থ তাই হয়তো ঘুম বেশি হয়েছে।”

ওয়াহাজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,” হয়তো ঠিক হয়ে যাবে ঘুম থেকে উঠলে।”

ফারাজ বারোটার দিকেই মৌ-দের নিতে আসতে চেয়েছিল। মৌ নিজেই একটু দেরি করে আসতে বলায় ফারাজ একটার দিকে এসে কলিংবেল বাজায়। মৌ রুম থেকে বাহির হয়ে তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয়। হাসিমুখে ভেতরে প্রবেশ করে ফারাজ।

এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,” ভাইয়া কোথায়? তুই এখনো রেডি হোসনি কেন?”

মৌ ফারাজকে নিজের রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলে,” ওয়াজিহা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। গতকাল মাথাব্যথায় প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। সকালে ওর রুমে গিয়ে দেখি জ্বরও এসেছে। এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।”

মৌয়ের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে যায় ফারাজ। ওয়াহাজ দৃষ্টিতে আসতেই ফারাজ নিজেকে সামলে নেয়।

ওয়াহাজকে দেখেই হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলে,” কেমন আছেন, ভাইয়া?”

ওয়াহাজ এসে ফারাজের সাথে কোলাকুলি করে বলে ওঠে,” সম্পর্কে তো তুমি আমার বড়ো, বয়সে আমি তোমার বড়ো। সম্পর্ক কি আগের মতোই থাকবে নাকি বদল হবে?”

ফারাজ হেসে বলে,” সমস্যা নেই, ভাইয়া। আগের মতোই থাকুক সবকিছু। তাছাড়া আমি মৌয়ের চেয়ে বড়ো, আপনার থেকে তো না। ভবিষ্যতে আপনার আমার অবস্থা সেম সেম হতে পারে।”

ফারাজের কথা ওয়াহাজ বুঝতে পারে না। মৌয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মৌ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ফারাজকে বলে,” ভাইয়া, খেয়েছিস কিছু? আমি রুটি বানিয়েছি সকালে গতকালের গোরুর মাংস আছে।”

ফারাজ চেয়ারে বসতে বসতে বলে,” ক্ষিধে পেয়েছে। জলদি নিয়ে আয়।”

ওয়াহাজ হেসে বলে,” আমার জন্যও নিয়ে এসো। আবার খেতে হবে।”

মৌ রুম থেকে যাওয়ার সময় বেলা এসে সামনে দাঁড়ায়। মৌ বেলার কপালে হাত দিয়ে চেক করে দেখে জ্বরটা ছেড়েছে।

বেলা ঘুম ঘুম গলায় বলে,” তোমরা এখনো ও বাড়িতে যাওনি কেন?”
” তোমাকে একা রেখে আমাদের যেতে হবে? একা রেখে যেতে বলছো?”
” আমি কি ছোটো বাচ্চা নাকি? আমার বয়স তেইশ…”
” শোনো মেয়ে, কেউ কেউ পঞ্চাশ পার করলেও কিছু মানুষের চোখে ছোটোই থাকে। যতদিন ছোটো থাকতে পারবে ততদিন ভালো থাকবে বড়ো হলেই তো ধীরে ধীরে আনন্দ শেষ হতে শুরু করে। শোনো তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। ভাইয়া এসেছে আমাদের নিতে। তোমার জন্য এতক্ষণ দেরি করেছি। ভাইয়া মাত্রই এসেছে। তোমাকে নিয়েই যাব। তোমার একা একা এখানে থাকা চলবে না।”
” আমারও তোমাদের সাথে যেতে হবে?”
” জি ম্যাম।”
” আমি ফ্রেশ হয়ে নিই।”
” হুম। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।”
” ঠিক আছে।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে বের হতে হতে আড়াইটা বেজে যায়। চারজন বের হয়ে বাহিরে গিয়ে দাঁড়ায়। ফারাজের গাড়ি বের করা দেখে মৌ বলে,” ভাইয়া, তুই ওয়াজিহাকে নিয়ে চলে যা। আমরা আমাদের গাড়িতে আসছি।”

বেলা পাশে থেকে বলে,” আমিও তোমাদের সাথেই যাই না ভাবি।”
ওয়াহাজ বেলার কথা শুনে বলে,” আমাদের গাড়িটা এখানেই থাকুক। আজ একটা গাড়িতেই যাই। বাসা তো খুব একটা দূরে না। সবসময় তো বাড়ির ভেতরে থাকবও না। বের হলে আমাদেরটা নিয়ে যাব।”

মৌ যেটা ভেবেছিল সেটা আর হলো না। সে মনেপ্রাণে চাচ্ছে ভাইয়ের মন খারাপ দূর করতে, দুজনকে এক করে দিতে কিন্ত সেটা কিছুতেই হয়ে উঠছে না। ওয়াহাজের কথায় তার মন ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ক্ষুণ্ণমনা হয়েই ওয়াহাজের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে,” আলাদা গাড়ি তো নিলেন না। বিয়ে হয়েছে একটু বউয়ের ব্যাপার বুঝবেন সেটাও বোঝেন না। এখন অন্তত আমার পাশে এসে বসবেন। এটার অন্যথা আমি কথা বলব না আপনার সাথে।”

ওয়াহাজ বেলার কাছে গিয়ে বলে,” ফোন, চার্জার ব্যাগে নিয়েছ?”
বেলা ব্যাগটা দেখে নিয়ে বলে,” হ্যাঁ নিয়েছি তো।”
” চলো তবে।”
” আমি কোথায় বসব, সামনে নাকি পিছনে?”
” তুমি সামনেই বোসো৷ ”
” কিন্তু…”
” এসব নিয়ে একদম ভেবো না। আমি জানি তুমি আমার কথাটা মাথায় রাখবে। পাশাপাশি বসলেই কিছু হয়ে যাবে না। আগামী সপ্তাহে তোমার ফ্লাইট। ও বাড়ি থেকে ফিরে তোমার জন্য কেনাকাটা শুরু করতে হবে। মনে রাখবে প্রেম,ভালোবাসা, বিয়ে মানুষের জীবনে এসেই যায়, সাকসেস সবার জীবনে আসে না। ”
” ঠিক আছে।”
” যাও গিয়ে বোসো।”
” ওকে।”

ওয়াহাজ মৌয়ের পাশে গিয়ে বসেই মৌ মৃদু হাসে। ওয়াহাজ বলে,” হয়েছে এখন?”
” জি হয়েছে।”

বেলা গিয়ে ফারাজের পাশের সিটে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। পিছনে নতুন দম্পত্তি এটা ওটা নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। সামনের দুজনের মধ্যে পিনপতন নিরবতা। কেউ কাউকে একটাবারের জন্য দেখতে তাকাচ্ছেও না। মনের দিক থেকে দুজনের মধ্যে কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবার গল্পের আসর বসেছে। দুপুরে তিনজনকে বাসায় রেখে ফারাজ হাসপাতালে গিয়েছিল। ইমার্জেন্সিতে কিছু রোগী ছিল বিধায় বাড়িতে সে দেরি করতে পারেনি। রাতে ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটা বেজে যায়। ফারাজ বাসায় ফিরতেই সবাই খেতে বসেছিল।

রাতের খাবার শেষ করে সবাই আড্ডায় ব্যস্ত। ফারাজ গোসল শেষ করে বাহিরের দিকে আসতেই দেখে ড্রয়িংরুমে চারজন বসে বসে কথা বলছে। ওয়াহাজ সেখানে নেই। ফারাজ নিজের রুমের দরজা থেকেই মৌকে ডাক দিতেই মৌ আর বেলা দুজনই একসাথে ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজের চোখ বেলার দিকে যেতেই বেলা চোখ নামিয়ে নেয়।

মৌ এগিয়ে এসে বলে,” কী হয়েছে?”
” ওয়াহাজ ভাই কই?”
” ওর বন্ধু কল দিল তাই বের হয়ে গেল মাত্র।”
” কোন বন্ধু? গতকাল এসেছিল বিয়েতে?”
” না, এখানে ছিল না। আজ এসেছে তাই হয়তো দেখা করতে ডেকেছে। ”
” এতোরাতে! আচ্ছা যাই হোক, ওয়াজিহার জ্বর কেমন?”
” এখন তো নেই, রাতের কথা বলতে পারছি না। ”
” আমি হাসপাতাল থেকে আসার সময় ওষুধ নিয়ে এসেছি, ওকে খাইয়ে দে।”
” খাইয়ে দিতে হবে!”
” আচ্ছা দিতে হবে না। আমি তোকে দিচ্ছি তুই ওকে গিয়ে বল খেয়ে নিতে।”
” তুই বলতে পারছিস না?”
” জানিস তো সবকিছু তারপরও এসব কথা কেন?”
” দোয়া করি ভাইয়া, তোরা দুজন এক হয়ে যা।”
” আমি তোর ননদের জন্য অপেক্ষা করব। ”
” ও যদি সত্যিই বাহিরে চলে যায়? ওখানে তো তিন চার বছর থাকবেই।”
” যেদিনই হোক ফিরে তাকে আসতেই হবে। আমি অপেক্ষা করব।”

মৌ ভাইয়ের থেকে ওষুধ নিয়ে বেলার কাছে চলে যায়। ওষুধটা দিয়ে খেয়ে নিতে বলে। পাশে থেকে ফাহমিদা বেগম বলেন,” ওয়াজিহা, আম্মা আপনি আমার কাছে আজ ঘুমাবেন। বাহিরে তো চলে যাচ্ছেন, আবার কবে আপনাকে কাছে পাব কি পাব না বলা তো যায় না। ”

মৌ মুচকি হেসে বলে,” রেখে দাও সারাজীবনের জন্য। আমার তো চলে যেতেই হলো তুমি এবার ওকে রেখে দাও।”

বেলা মৌকে মিছে চোখ গরম দেখিয়ে ফাহমিদা বেগমকে বলে,” আচ্ছা আন্টি, আমি আজ আপনার কাছে থাকব। আমাকে কিন্তু গল্প শোনাতে হবে।”

ফাহমিদা বেগম মৃদু হেসে বলেন,” ঠিক আছে তাই হবে। তাহলে ফারাজ্জের আব্বু তুমি ফারাজের কাছে ঘুমোও আজ।”
” ঠিক আছে।” বলে মুহিব সাহেব বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে ফারাজের রুমে চলে যায়। বেলা গিয়ে ফাহমিদা বেগমের কাছে বসে।

মৌ বারবার ওয়াহাজের নম্বরে কল দিয়েই যাচ্ছে। ঘড়ির কাটা বলছে বারোটা বাজে। সবাই কিছুক্ষণ আগেই শুয়ে পড়েছে। ওয়াহাজ আসবে বলে সে জেগে আছে কিন্তু ওয়াহাজের আসার নাম নেই। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বারবার কল করে যাচ্ছে সে কিন্তু কিছুতেই কল রিসিভ হচ্ছে না।

আরেকবার কল দিতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয়ে যায়। মৌ দ্রুত বলে ওঠে,” কোথায় আপনি? বারোটা বাজে, কখন ফিরবেন?”

ওপাশ থেকে অচেনা গলায় অচেনা পুরুষ বলে ওঠে,” ওয়াহাজের যেতে একটু দেরি হচ্ছে, ভাবি। আমরা হাসপাতালে।”

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মৌয়ের। তার ভাই তো সবসময় হাসপাতালে থাকে কই আগে তো হাসপাতালের কথা শুনে খারাপ লাগেনি তবে আজ কেন লাগছে?

মৌ ভাঙা ভাঙা শব্দে উচ্চারণ করে,” ক কী হ হয়েছে উ উনার? উনি ঠ ঠিক আছেন তো? ”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে