মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-২৫

0
650

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৫

রাত দশটা।
মৌ বেলার মাথার কাছে বসে তেল-পানি বসিয়ে দিচ্ছে। ওয়াহাজ বাহিরে গিয়েছে বেলার জন্য ওষুধ নিয়ে আসতে। বেলা মাথা ব্যথা করছে বলার পড় ওয়াহাজ আবিষ্কার করল বাড়িতে প্যারাসিটামল ওষুধ একটাও নেই তাই সে তাড়াতাড়ি করে ওষুধ নিয়ে আসতে বাহিরে গিয়েছে। বেলার মাইগ্রেন চার বছর আগে থেকে, মাথাব্যথা সে কোনোমতেই সহ্য করতে পারে না।

রুমে জিরোবাল্ব জ্বা*লিয়ে মাথার পাশে বসে আছে মৌ। আলো সহ্য হচ্ছে না বেলার। মাথায় মৌয়ের হাতের ওপর হাত রেখে হাত থামিয়ে বেলা বলল, ” ভাবি, আ’ম স্যরি৷ আমার জন্য তোমাদের আজ প্রথম রাতের সময়টা নষ্ট হচ্ছে। তোমরা ভালো একটা সময় কাটাতে পারতে। আমার মাথাব্যথা কমেছে। তুমি প্লিজ নিজের রুমে যাও ভাইয়া একা আছে।”

মৌ বেলার হাত সরিয়ে আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ” তুমি অসুস্থ আর তোমার ভাইয়া রুমে বসে থাকবে? ওষুধ নিয়ে আসতে গিয়েছে তোমার ভাইয়া। আর তোমার কি মনে হয় তুমি অসুস্থ দেখেও আমি নিজের রুমে যাব? আমি অমানুষ নই, ওয়াজিহা। আমার ননদ আগে,বাকিসব পরে। ”

বেলা চোখ বন্ধ করেই বলে,” আমাকে যারা ভালোবাসে তারা এতো বেশি ভালোবাসে কেন? আমাকে বেশি ভালোবেসো না তো ভাইয়াকে ছেড়ে যাওয়ার মতো তোমাকে ছেড়ে যেতেও যে আমার কষ্ট হবে। মাথা ব্যথা করলেই তো আমার আজকের কথা মনে পড়বে তখন তোমাকে কোথায় পাব আমি?”
” যেও না তবে। আমি তোমার ভাইকে রাজি করাই, আমার পরিবারকে রাজি করাই ভাইয়ের বউ হয়ে থেকে যাও।”
” ভাবি…”

দুজনের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ কথা চলে। ওয়াহাজ বাড়িতে ফিরে টেবিলের ওপর থেকে পানির বোতলটা নিয়ে সোজা বেলার রুমে চলে আসে। বেলাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে সেখানেই বসে নিজেই কতক্ষণ বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বেলা বারবার তাদের দুজনকে যেতে বললে ওয়াহাজ রক ধমকে বেলাকে চুপ করিয়ে দেয়, তাকে ঘুমোতে বলে। প্রায় আধাঘণ্টার মধ্যে বেলা ঘুমিয়ে গেলে ওয়াহাজ আর মৌ নিজেদের রুমে চলে আসে।

রুমে এসে মৌ কালো রঙের একটা শাড়ি আর তোয়ালেটা নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,” আপনি অপেক্ষা করুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। মেকআপ উঠানো হয়নি শুধু চুল ঠিক করা হয়েছে। ”

ওয়াহাজ হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলে,” সমস্যা নেই। ফ্রেশ হয়ে এসো। ”

মৌ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে প্রায় আধাঘণ্টা সময় ব্যয় করলো।

” বিয়ের আগে যে মেয়েটার দিকে চোখ তুলে তাকাতাম না পর্যন্ত সেই মেয়েকে বিয়ের রাতে এতো আকর্ষনীয় কেন লাগছে বলো তো? কেন আলতো করে গালে ঠোঁট ছুইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে? বিয়ের পর পুরুষসমাজ কি তার ব্যক্তিগত নারীর প্রতি একটু বেশিই আকর্ষণ অনুভব করে?”

মৌ বাহিরে এসে চুল মুছছিল। ওয়াহাজের হঠাৎ করে বলা কথায় লজ্জা পেয়ে যায় সে। মুচকি হেসে অন্যদিকে ফিরে তাকায় সে। ওয়াহাজ মৌয়ের অবস্থা দেখে অনেক কষ্টে হাসি আটকে চুপচাপ বসে থাকে।

মৌ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানো শুরু করে। ওয়াহাজ খাটে হেলান দিয়ে মৌকে দেখে যাচ্ছে। আয়নায় সেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মৌ। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই মৌ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,” ইশ! এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না তো। ”

ওয়াহাজ খাট থেকে নেমে এসে মৌকে একটানে টুল থেকে কোলে তুলে নেয়। আচমকা ওয়াহাজের আচরণে ভয় পেয়ে যায় মৌ৷ বুকের ওপর টিশার্ট খামচে ধরে সে। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে।

ওয়াহাজ মুচকি হেসে বলে,,” লুক অ্যাট মি।”

মৌ তাকালে ওয়াহাজ আবার বলে,” এভাবে তাকালে কী হবে শুনি?”

মৌ কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নেয়৷ ওয়াহাজ মৌকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,” এখন আর কিছু করতে হবে না, এমনিতেই নজর ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না।”
” ছি, কী বাজে আপনি!”
” স্বামীরা বাজেই হয়, ধোয়া তুলসিপাতা কেউই হয় না। ”

ওয়াহাজ মৌয়ের সামনে বসে আছে। মাথা চুলকে বলে,” বউ এরকম কালো শাড়ি পরে ফর্সা…..”
ওয়াহাজ কথা শেষ না করতেই মৌ তাড়াতাড়ি করে নিজের শাড়ি ঠিক করে নেয়। ওয়াহাজ শব্দ করে হেসে ওঠে।

ড্রয়ার থেকে একটা বক্স বের করে সেটা থেকে সুন্দর একটা ব্রেসলেট বের করে মৌকে বলে,” দাও, হাতটা এদিকে দাও৷ এটা তোমার জন্য নিয়েছিলাম।”

মৌ হাত এগিয়ে দিলে ওয়াহাজ নিজেই ব্রেসলেটটা মৌয়ের হাতে পরিয়ে দিয়ে হাতের উল্টোপাশে একটা চুম্বন করে। প্রিয় মানুষের এই প্রথম ছোয়ায় শিউরে ওঠে মৌ।

হাতের ব্রেসলেটটা নেড়েচেড়ে দেখে বলে,” আপনার পছন্দ কিন্তু খারাপ না। সুন্দর হয়েছে।”
” ওয়াজিহা পছন্দ করে দিয়েছে এটা।”

মৌ পা গুটিয়ে বসে বলে ওঠে,” তাই তো বলি এতো সুন্দর ডিজাইন আপনি পছন্দ করেছেন! সন্দেহটা ঠিক হলো।”

ওয়াহাজ এবার মৌয়ের দুইহাত নিজের হাতের মাঝে নেয়। মৌ তার দিকে তাকাতেই বলে ওঠে,” যদি আমার বোনের বয়স প্রায় তেইশ বছর। দুদিন পর ওর জন্মদিন৷ তেইশ হবে। তবুও সে আমার কাছে সেই ছোটো বোনটিই আছে। তোমার আগে দুটো নারী আমার জীবনে এসেছে। প্রথমজন আমার মা আর দ্বিতীয়জন আমার বোন। মা তো আমাদের দুই ভাইবোনকে একা করে চলে গিয়েছে রবের ডাক পেয়ে। আছে শুধু আমার বোনটা। আমি ছাড়া এ পৃথিবীতে ওর কেউ নেই আমার তবু তুমি হলে। ওয়াজিহা খুব বুঝদার মেয়ে। সে ননদ হিসেবে নিজে থেকে কোনো ঝামেলা করবে না সে তোমাকে খুব পছন্দ করে৷ তোমাদের দুজনের ভালো একটা সম্পর্ক দেখেই আমি কিন্তু বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। তুমি শুধু আমার বোনটাকে ভালোবেসো আমি তোমার জীবনের খুশির বন্যা বইয়ে দেব দেখো তুমি।”

মৌ ওয়াহাজের চোখে চোখ রেখে বলে,” ওয়াজিহা আমার ছোটো বোনের মতো। ও আমাকে সাহায্য না করলে আজ হয়তো আপনাকে নিজের করে পেতাম না৷ আমার সাহস ছিল না নিজের মনের কথা মুখে নিয়ে আসা। আমি আমার এই সুন্দর জীবনের জন্য মেয়েটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থাকব। ও সবসময় আমার ভালোবাসাতেই থাকবে।”

ওয়াহাজ মৌয়ের হাত ছেড়ে বলে, ” এসো একটু জড়িয়ে ধরি আমার বউকে। ”

মৌ মুচকি হেসে ওয়াহাজের বুকে মাথা রাখে। ওয়াহাজ শক্ত করে জড়িয়ে নেয় মৌকে। নতুন এক জীবন শুরু হয় তাদের।
_____

রাত একটা।
একটা একটা করে সাতাশটা ছবি যোগ হলো ফারাজের ফোন মেমরিতে। জোরজবরদস্তি করে ফটোগ্রাফারের কাছে থেকে ছবিগুলো নিয়েছে সে। যে ছবিগুলোতে বেলাকে দেখা যাচ্ছে সে ছবিগুলোই নিয়েছে সে। ছবিগুলো আসার সাথে সাথে গ্যালারিতে চলে যায় সে। একেএকে ছবিগুলো দেখতে থাকে৷ স্ক্রিনে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকে সে। সাতটা ছবিতে ফারাজ, বেলা আর নতুন বর বউ। পাঁচটা ছবি তাদের দুজনের একসাথে বাকিগুলোতে বেলা আছে এমন ছবি।

ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় ফারাজের। ফারাজ হাসছিল আর বেলা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটা সাথে সাথে ওয়ালপেপারে অ্যাড করে দেয় সে। এক ছবিই বারবার দেখতে থাকে সে।

ছবিতে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বলে,” আপনি আমারই হবেন, ওয়াজিহা। আমার মন বলছে আপনি আমারই হবেন। ভেতর থেকে একটা সাঁড়া পাচ্ছি। আমার রব শেষমেশ আমার মুখে হয়তো হাসিই ফুটাবেন, চোখে পানি আসতে দেবে না। আপনি অন্যকারো হওয়ার আগেই তিনি আপনাকে আমার করে দেবেন৷ আমি ছাড়া অন্যকেউ আপনার মাথায় আসতেই পারবে না জীবনে তো অনেক দূরের ব্যাপার। আজ হোক কাল হোক বা চার বছর পর হোক, আপনি শুধু আমার হবেন আর সেটা একদিন, দুদিনের জন্য না আজীবনের জন্য। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। কথায় আছে অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”

# চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে