মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-২৪

0
660

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৪

বিয়ে বাড়ি৷ বাড়ির আনাচে কানাচে মানুষের সমাগম। বউ তার মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। গেইটে কয়েকজন দাঁড়িয়ে বরের অপেক্ষা করছে। এবারই হয়তো প্রথম যেখানে বরপক্ষ হিসেবে শুধু বর আর বরের বোন আসবে। ওয়াহাজ আর বেলার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফারাজ ওয়াহাজকে কল লাগায়। কল ধরছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে গেইটের সামনে থেমে যায়। বাসার বয়স্ক যিনি আছেন তিনি নতুন বরকে কিছু উপহার দিয়ে গাড়িতে থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে।

গেইটের ঝামেলা শেষ করে বরকে ভেতরে এনে বসানো হয়। বেলাকে দেখে রূপা তার কাছে এসে দাঁড়ায়।

বেলার দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলে,” তোমাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে, জানো?”
বেলা মৃদু হেসে বলে,” সব মেকআপের খেল বুঝেছ? ”
” মেকআপে কি আর সবাইকে সুন্দর লাগে? তুমি সুন্দর তাই তোমাকে সুন্দর লাগছে। আপার সাথে তুমিই গিয়েছিলে?”
” হ্যাঁ। তোমারও তো যাওয়ার কথা ছিল, যাওনি কেন?”
” আপু নাকি আমাকে ডেকেছিল কিন্তু আমার ঘুম ভাঙেনি। আমি তো তোমাদের ওই আগের ফ্ল্যাটে ঘুমিয়েছিলাম। তারপর শরীরটাও খারাপ লাগছিল তাই যাওয়া হয়নি।”
” বিয়ের সময়ে শরীর খারাপ, ঘুম এসব আবার কী! খেয়েছ?”
” না, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

বেলা হেসে বলে,” আমি তো আজ বরপক্ষ। যাই হোক চলো খেতে বসি। ”
” চলো।”

বাড়ি ভর্তি মেহমান। সবাই কোন না কোনকিছুতে ব্যস্ত। মৌয়ের বাবা মুহিব আহসান একপাশে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি একনজরে মেয়েকে দেখছেন। আজকের পর থেকে এ বাড়িতে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মেয়েকে তিনি আর দেখতে পারবেন না। যখন মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করবে, কথা বলতে ইচ্ছে করবে তখন মেয়ের ঘরে গিয়ে মেয়েকে আর পাবেন না।

চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি। গুটিকয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ওয়াহাজের সামনে দাঁড়ালেন। সামনে শ্বশুরকে দেখে উঠে দাঁড়ায় ওয়াহাজ।

মুহিব সাহেব নির্দ্বিধায় বলেন,” একটু আসবে আমার সাথে? কথা ছিল।”
” জি অবশ্যই।”

মুহিব সাহেব হাটা শুরু করলেন, ওয়াহাজ তার পিছুপিছু হেটে একটা তুলনামূলক ফাঁকা জায়গায় এলো।

দুজন সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে। দুজনই অপেক্ষারত। কেউ কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে আর কেউ কিছু বলার। মুহিব সাহেব হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন,” আমি জানি তুমি অত্যাধিক ভালো একটা ছেলে। যার বোনের প্রতি এতো ভালোবাসা তার জীবনসঙ্গিনীর প্রতিও নিশ্চয়ই মায়া মহব্বত থাকবে। তবুও কিছু কথা বলতে চাই আমি।”

ওয়াহাজ মৃদু হেসে বলে,” জি বলুন।”

মুহিব সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথা গুছিয়ে নেন তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,” মৌ আমার অনেক আদরের মেয়ে। ছোটো থেকে ভীষণ আদরে বড়ো হলেও অন্য মেয়েদের মতো বাদর টাইপ হয়ে যায়নি। যখন যা মুখে আসে তা বলতে পারে না। চেপে যায়। কষ্ট সহ্য করে নিতে পারে খুব। নিজের একটা জিনিস খুব প্রয়োজন না হলে সে বলে না। আমার মেয়েটা খুব সংসারী। তুমি তার একটু খেয়াল রেখো সে তোমার বাড়ি, সংসার, তোমার, ওয়াজিহা আম্মার সবার খেয়াল রাখবে। আমার মেয়ে কোনো ভুল করলে তাকে একটু বুঝিয়ে নিও। আমার মেয়েটা খুব সহজ সরল। এ বাড়ির মায়া ভালোবাসা ত্যাগ করে তোমার ঘরে যাচ্ছে তুমি প্লিজ তাকে একটু ভালোবেসো একটু সম্মান তাকে দিও। ওর যখন ইচ্ছে হয় এ বাড়িতে আসতে তুমি প্লিজ আমার মেয়েটাকে একটু নিয়ে এসো। আমি আমার মেয়েকে ছাড়া কীভাবে থাকব সেটা বুঝতে পারছি না। ও আমার খুব আদরের।”

মুহিব সাহেবের গলা ভারী হয়ে আসে। চোখ দুটো ছলছল করছে। মেয়ের বিয়ের দিন সব বাবারই চোখের কার্ণিশে হয়তো পানি চিকচিক করে।
ওয়াহাজ একধাপ এগিয়ে এসে মুহিব সাহেবকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত ঘষে বলে,” আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ের সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার। আপনার মেয়েকে আমি কষ্টে অন্তত রাখব না। আপনার নজরে যেহেতু আমি ভালো একটা ছেলে আমি ভালো জামাতাও হবো দেখবেন আপনি। আপনি এসব নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না।”

মুহিব সাহেবকে ওয়াহাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। তিনি যে মেয়ের বিষয়ে এই ছেলেটার ওপর আজ থেকে নির্ভরশীল। শক্ত করে জাপটে ধরে বলেন,” আমার মেয়েটাকে শুধু ভালো রেখো বাবা। তোমার কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই। মেয়েটা আমার কলিজা, আজ বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা ছিঁড়ে তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। তুমি নিজের বুকে আগলে রেখো।”

কাজী সাহেব বিয়ের কাজ শুরু করেন। মৌকে কবুল বলতে বলা হলে মৌ বাবার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। মুহিব সাহেব মেয়েকে বারবার কবুল বলতে বলছেন। আশেপাশে থেকে সবাই তাড়াতাড়ি বলে ফেলতে বলছে মৌ তবুও নিশ্চুপ।

অতঃপর সবার জোরাজোরিতে এক সময় মৌ কবুল বলেই ফেলে। চারপাশের সবার মুখে হাসি ফুটে যায়। লোক সমাগম পেরিয়ে খানিকটা দূরে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ। বোনের এই অন্যের হয়ে যাওয়া বিষয়টা সে নিজের চোখে দেখতে পারবে না।
তিনবার কবুল বলার সাথে সাথে মৌ তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। ফাহমিদা বেগম দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। মেয়ে জন্ম দিলে তাকে একসময় পর করতেই হয় আজকের দিনটাই যেন তার প্রমাণ।

ওয়াহাজের কবুল বলার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। হাসি কান্নায় জড়ানো মুহূর্তে বেলার যেন অতীতটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছেই। এভাবেই তো সে একদিন ধ্রুবর হয়েছিল। মানুষটাকে সে অসম্ভব ভালোওবেসেছিল। লোকটা অন্য নারীকে পেয়ে তাকেই ভুলে গেল।
বেলা এটা ভেবে শান্ত হয় যে তার ভাই ওরকম ধাঁচের মানুষ না। মানুষটা এরকম কোনোদিনই করবে না। কোনো কোনো পুরুষ তার ব্যক্তিগত নারীকে পায়ে নয় বুকে জড়িয়ে রাখে। সবরকম বিপদ থেকে আগলে রাখে।

পরিবেশ একটু ঠিক হলে ফটোগ্রাফার বর বউয়ের ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে যায়। বর আসার পরপর ছবি তোলার কথা থাকলেও ফারাজ সেটা নিষেধ করে দিয়েছে। তার একটাই কথা বিয়ে সম্পন্ন না হলে তারা যেহেতু স্বামী-স্ত্রী নয় তাই তাদের একসাথে ছবিও তোলা যাবে না। সে তার আত্মীয়দেরও সাবধান করে দিয়েছে তার বোনের ছবি যেন অনুমতি ছাড়া কোনোভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় না যায়।

বর বউয়ের ছবি তোলার পর বাবা-মার সাথে কয়েকটা ছবি রাখা হয়। যে যার মতো গিয়ে ছবি উঠছে। মৌ রূপাকে ডাক দিয়ে কাছে নিয়ে এসে ফারাজকে একটু ডেকে দিতে বলে। রুপু দৌঁড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে ফারাজের কাছে চলে যায়। ফারাজকে বলতেই ফারাজ ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।

মৌয়ের চোখে চোখ পড়তেই বলে,” কিছু হয়েছে?”
” পাশে এসে দাঁড়াবি না? আমার সাথে তোর ছবি না থাকলে আমার ভালো লাগবে না। আয় না প্লিজ।”

একসময় ওয়াহাজ বেলাকে ডেকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে নেয় যদিও বেলা আগেই ভাই ভাবির সাথে ছবি উঠেছে। এবার চারজনে এক ফ্রেমে বন্দি হয়ে যায়।
ছবি ওঠা শেষে রুপা ফারাজের পাশে এসে দাঁড়ায়। মুচকি হেসে বলে,” ভাইয়া, ওয়াজিহা আপুর সাথে কিন্তু একটা ছবি উঠলেই পারতে। তোমার একমাত্র বেয়াইন বলে কথা! তুমি যে বারবার তাকে দেখছিলে সেটা আমি দেখে ফেলেছি। তোমার মনে কি লাড্ডু ফুটলো নাকি?”

ফারাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,” আস্তে কথা বল। এতো মানুষের মধ্যে তোর এসব কথা এতো জোরে বলতে হবে কেন? ছোটো মেয়ে ছোটো মেয়ের মতো থাকবি বেশি পাকনামি করলে থা*প্পড় দিয়ে বসিয়ে রাখব।”

রূপা আর কিছু না বলে হাসতে থাকে। ফারাজ চলে যেতে শুরু করলে রূপা চিৎকার করে ফটোগ্রাফারকে বলে,” ভাইয়া, এতো ছবি তুললেন অথচ বেয়াই-বেয়াইনের কাপল পিক তুললেন না কেন? এটা কিন্তু ঠিক হয়নি।”

ফটোগ্রাফারও নাছোড়বান্দা দুজনকে জোরজবরদস্তি করে একসাথে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে নেয়।

মৌকে গাড়িতে উঠতে বলা হলেও সে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে। একপর্যায়ে রূপকসহ আরও কয়েকজন মিলে মৌকে গাড়িতে তুলে দেয়। মৌ গাড়িতে উঠে এদিক ওদিক দেখে কান্নাজড়ানো গলায় বলে,” আমার ভাইয়া কোথায়? ও আসবে না আমার সাথে দেখা করতে?”

কেউ একজন ফারাজকে ডেকে নিয়ে মৌয়ের সামনে দাঁড় করায়। মৌ তার ভাইয়ের হাত ধরে কান্না করতে থাকে। আশেপাশের সবাই গাড়ি ছেড়ে দিতে বলছে কারণ এখানে যত দেরি করবে পরিবেশ তত ভারি হতে শুরু করবে।

বেলা বাহিরেই দাঁড়িয়েছিল। সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠবে তখন ফারাজ বেলাকে পিছন থেকে ডাক দিলে বেলা দাঁড়িয়ে যায়।

এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,” জি, বলুন।”
” আমার বোনটাকে একটু দেখে রাখবেন প্লিজ। ও আজ আমাদের বাড়ি অন্ধকার করে আপনাদের বাড়ি আলো করতে যাচ্ছে। ও আমার ভীষণ আদরের।”
” চিন্তা করবেন না। মন কেমন করলে নির্দ্বিধায় আমাদের বাসায় চলে আসবেন। তাছাড়া আপনার বোন কালই আবার আসবে।”
” সাবধানে যাবেন।”
” আল্লাহ হাফেজ। ”

বেলা গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে গাড়ি ছেড়ে দেয় ওয়াহাজ। পিছনে পড়ে থাকে শুধু মায়াজড়ানো কিছু চোখ।

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে