#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২২
মৌ হাটতে হাটতে বলে ওঠে,” ভাইয়া, তুই ওয়াজিহাকে ভালোবাসিস?”
মৌয়ের প্রশ্নে ফারাজ বেশ হকচকিয়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায় সে। মৌ আবার বলে,” দাঁড়াবি না। হাটতে হাটতেই বল। আমি আশা করব তুই আমাকে মিথ্যা বলবি না, ভাইয়া।”
ফারাজ হাটা শুরু করে। বেশ সাধারণভাবে জবাব দেয়,” হ্যাঁ, ভালোবাসি।”
” তুই ওকে বিয়ে করতে চাস? আমি আম্মা- বাবার সাথে কথা বলব?”
” আমি ওকে ভালোবাসি কিন্তু নিজের করে আর পেতে চাই না। একটা মানুষকে আর কতভাবে চাইলে সে সেই মানুষটার হয় জানি না। ওয়াজিহা আমার ভাগ্যে নেই হয়তো। ওয়াজিহা বরাবরই সঠিক ছিল। ও সমাজ আর আমাদের পরিবার, তোর সাথে নতুন সম্পর্ক এসবের জন্য কখনোই আমার হবে না। ও চায় না আমাদের পরিবারের কেউ তাকে ভালোবাসা কমিয়ে দিক৷ ঠিকই তো বলেছে সে। ”
” আমি বাবার সাথে কথা বলি ভাইয়া? আমিই ভুল ছিলাম এতোদিন। আম্মা যখন বলছিল যে তুই কোনো ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করবি, ভালোবাসিস তখন খুব রাগ লেগেছিল কিন্তু গতরাতে তোদের কথা শুনে এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছে আমার অবস্থা যদি ওয়াজিহার মতো হতো তাহলে আমি কী করতাম! তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারছিলাম না আমি, ভাইয়া।”
ফারাজ মুচকি হেসে বলে, ” তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি তাকে ভালোবাসি, তাকেই ভালোবাসব। তাকে দেখিয়ে দেব, না পেয়েও ভালোবাসা যায়৷ ”
” পারবি না ভাইয়া। এটা সারাজীবনের ব্যাপার।”
” ভালোবাসলে সবই পারা যায়। আমি তার জন্য অপেক্ষা করব। ”
” ভাইয়া….”
” গত কয়েকদিন তোর ভাইয়া খুব বেহায়া হয়ে গিয়েছিল বুঝেছিস? আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। কতবার, কতভাবে আমি তার কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়েছি আর সে ফিরিয়ে দিয়েছে সমাজের ভয়ে।”
” ভাইয়া এখানে তো আমরা চারজন ছাড়া কেউই জানে না ওয়াজিহা ডিভোর্সি। আমরা না জানালেই হলো।”
” এসব বাদ এখন৷ আজকে থেকে এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলবি না। আমি চাই আমার ভালোবাসার মানুষ আর অস্বস্তিতে না পরুক। দোয়া কর সে যেন আমার সামনে না আসে। ”
মৌ আর কিছু বলে না৷ চুপচাপ ভাইয়ের সাথে হাটতে থাকে। কিছু সময় পরপর শুধু ভাইকে তাকিয়ে দেখছে সে। ভাইয়ের জন্য তার কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
______
বেলা নামাজ শেষ করে কুরআন পড়ছিল। ছোটোবেলায় মায়ের কাছে সে কুরআন শিখতে শুরু করেছিল। মা বিকেলবেলা দল করে আট নয় বছরের বাচ্চাদের আরবি পড়া শেখাতো। বেলাকেও শিখতে হতো।
কুরআন পড়তে পড়তে বেলার স্বর ভারী হয়ে আসে। চোখ ঝাঁপসা হয়ে লেখাগুলো স্পষ্ট দেখতে পায় না সে। কুরআন বন্ধ করে বুকে জড়িয়ে নেয়। মায়ের কথা মনে করে ফুঁপিয়ে কান্না করে ওঠে।
মনে মনে বলে ওঠে,” আমি সব হারিয়েছি মা, আমার হারানোর কিছুই নেই এজন্যই হয়তো পৃথিবীটাকে এতো বড়ো বড়ো লাগে। সারা পৃথিবী কেমন খাঁ খাঁ করছে। কোথাও যেন কেউ নেই। জানো মা মাঝেমাঝে হারানোর ভয় হয় কিন্তু আমার তো হারানোর মতো কিছুই নেই কেউ ভয়ও দেখায় না তবুও হারানোর ভয় হয়। ”
পৃথিবীতে সবকিছুর উর্ধ্বে যে সম্পর্কটি রয়েছে সেটি হলো মা সন্তানের সম্পর্ক। যে সন্তানটি মাকে হারিয়েছে একমাত্র সে জানে মা না থাকাটা আসলে কেমন! যার মা নেই তার এই মা না থাকার যন্ত্রণায় ফেলা দীর্ঘশ্বাসে যেন পৃথিবী প্রতিনিয়ত বিষা*ক্ত হতে থাকে।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে বেলা জায়নামাজ, কুরআন ঠিক জায়গায় রেখে দেয়। রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা তৈরি করে ভাইয়ের রুমে চলে যায়। বেলা চা আর নুডলস নিয়ে ওয়াহাজের রুমে ঢুকে দেখে ওয়াহাজ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে।
বেলা নাশতা টি-টেবিলের ওপর রাখে। ওয়াহাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,” কখন উঠেছ,ভাইয়া?”
ওয়াহাজ ল্যাপটপেই চোখ রেখে বলে,” তোমার পরেই উঠেছি। আমি ভাবছিলাম এখনই নাশতা বানাতে যাব আর তুমি চলে আসলে। ”
” নাও, চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেয়ে নাও। দেখো তো নুডলস কেমন হয়েছে?”
ওয়াহাজ চায়ের কাপ আর নুডলস নিয়ে বলে,” তোমার বানানো চা আর নুডলসের সাথে কারো তুলনা হবে না। ”
মৃদু হাসে বেলা। এতদিন রান্নাবান্না করেছে সে। কেউই কখনো খারাপ বলতে পারেনি৷ মেয়েরা সংসার শুরু করলে কতকিছু শিখে যায়!
ওয়াহাজ নাশতা করতে করতেই বলে,” আমাকে ওই টিম থেকে আবার নক করেছে। জয়েন করতে বলছে।”
বেলা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,” কোন টিম? যেটার হয়ে আগে কাজ করতে?”
” হ্যাঁ। ”
” ওরা কি আসলেই দেশের মানুষের হয়ে কাজ করে? সুযোগ পেলেই তো টাকাওয়ালাদের হয়ে যায়। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তরা কাকে ভরসা করবে? ওদের? তুমি ওসবে আর জড়াবে না। তাদের কাজ কি অন্যা*য়ের শা*স্তি দেওয়া। তারা কি সব অন্যা*য়কারীকে শাস্তি দিচ্ছে? দিচ্ছে না।”
” আমিও এসবে আর জড়াবো না। নিজে যেভাবে পারি সাহায্য করব তবুও ওদের সাথে জড়াবো না। তোমার বাহিরে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। খুব তাড়াতাড়িই চলে যেতে হবে তোমার। তুমি চলে গেলে এখান থেকে আমরা স্থানান্তর হবো। সিলেটে একটা চাকরির কথা চলছে। ”
বেলা ইতস্ততভাবে বলল,” তাহলে বাড়ি পালটানো বোকামি হয়ে গেল না, ভাইয়া?”
” দুদিন আগে কথা হয়েছে। আগে জানলে পাল্টাতাম না। ওখান থেকেই চলে যেতাম কিন্তু সেটা তো হয়নি।”
” আচ্ছা। ”
” ফারাজ তোমাকে আর কিছু বলেছে?”
অকস্মাৎ এমন প্রশ্নে বেলা থতমত খেয়ে যায়৷ ভাবতে থাকে ভাইকে বলা কি ঠিক হবে? এমনিতেই নতুন সম্পর্ক হতে চলেছে। তার ভাই ফারাজকে ভীষণ পছন্দ করে কিন্তু বেলার সাথে পছন্দ করতে পারে না করার কথাও নয়।
ওয়াহাজ আবার বলে,” ফারাজ তোমাকে নিতে এসেছিল গতকাল, কিছু বলেছে কি? তুমি ওকে নিয়ে একদম ভাববে না। তুমি ওকে নিয়ে ভাবলে নিজের ভালো থাকা হারাবে। ”
” যে যোগ বিয়োগের মাঝে অবস্থান করে তাকে হারানোর ভয় দেখানো বোকামি। একজন মানুষ সবকিছু হারিয়ে তবেই শূণ্যতায় পূর্ণ হয় তখন আর পাওয়া, না পাওয়াতে যায় আসে না। আমার জীবনে আর কেউ যুক্ত হবে না ভাইয়া। আমার জীবনে আমি একা ভালো থাকব আর তোমরা তো আছোই।”
বেলা চায়ের কাপ আর ছোটো প্লেট দুইটা নিয়ে চলে যায়। ওয়াহাজ নিজের কাজে আবার মন দেয়।
_____
মৌ সকাল সকাল গোসল সেরে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। ভাইকে বলল তাকে পার্লারে রেখে আসতে। সকাল সকাল সেখানে না গেলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে না।
ছোটোবোনের কথা ফারাজ যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। মৌকে নিয়ে বের হওয়ার সময় এক আত্মীয় বলেই ফেলল,” কালকে হলুদের সাজ তো সুন্দর ছিল। আজও বাড়িতেই সাজতো। পার্লারে কেন যেতে হবে? দিন দিন ঘরোয়া সব আনন্দ যেন রসাতলে যাচ্ছে। মেয়েদের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে।”
ফারাজ মৃদু হেসে বলে,” ঠিকই বলেছেন কিন্তু মেয়েদের ইচ্ছেমতো সাজার এই একটা দিন। বাড়িতে থেকে সে-ই বা কী আনন্দ করতো? চুপচাপ বসেই থাকতে হতো। ওকে ছাড়াই সবাই সবকিছু করতো, করবেও। এতো চাপ নেওয়ার কিছু নেই বারোটার মধ্যে চলে আসবে।”
ফারাজ মৌকে মন খারাপ করতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি করে নিচে চলে এসে পার্লারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
বেলাদের নতুন বাসার সামনে বেলাক দাঁড়িয়ে থাকার কথা। মৌ রাতেই বেলাকে বলে রেখেছিল তার সাথে যাওয়ার কথা। বাসার কাছাকাছি আসতেই সে বলে, ” ভাইয়া, সামনে ওয়াজিহা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নিয়ে যাব।”
ফারাজ সামনেই চোখ স্থির রেখে বলে,” আচ্ছা।”
মৌ আবার বলে,” আগেই ওর সাথে কথা ছিল ও আমার সাথে পার্লারে সাজবে৷ সেদিন ওর জন্য আমি আরেকটা শাড়ি নিয়েছি। গাঢ় খয়েরী রঙের। কী দারূণ যে শাড়িটা৷ ওকে আজ এটা পরতে বলব। একটা ননদ বলে কথা। ওকে আজ আমি আমার ইচ্ছেমতো সাজাতে বলব।”
ফারাজ বেলাকে দেখে গাড়ি থামালে। জানালা দিয়ে মৌ মুখ বের করে দেয়। সহাস্যে বলে, ” ভেতরে এসো। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে।”
বেলা ভেতরে গিয়ে মৌয়ের পাশে বসে। দুজনের কথা শুরু হয়। কীভাবে কী করবে, কোন সাজটা দেবে, শাড়ি কীভাবে পরবে ইত্যাদি। ফারাজ একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। কোনোদিকে তার নজর নেই শুধু মনটা বেলার কাছে পড়ে আছে। নজর না থাকলেও মনটা যেন শুধু বেলাতেই আবদ্ধ।
মৌ কথার মাঝেমাঝে বারবার ভাইকে দেখে যাচ্ছে। একটাবারের জন্যও সে বেলার দিকে তাকায়নি। ভালোবাসার মানুষকে না চেয়ে ভালোবাসার মানুষের ভালো ক’জনে চায়! ভাইয়ের এই অবস্থায় যেন দমবন্ধ লাগছে তার। বেলাকে অনুরোধ করে বলতে ইচ্ছে করছে- প্লিজ ওয়াজিহা, আমার ভাইয়ার কাছে থেকে যাও না। আমার ভাইয়া তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে। খুব কম পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য কান্না করে, আমি ওকে তোমার জন্য দমবন্ধ করা কান্নাকাটি করতে দেখেছি কাল।”
কিছু বলতে পারে না মৌ। বেলার পক্ষেও ফারাজকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যে মেয়ে এতো বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছে সে কীভাবে এতো সহজে নতুন জীবন শুরু করবে!
মৌ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পাশে থেকে একটা ব্যাগ বেলার হাতে দিয়ে বলে,” এই যে রায়বাঘিনী, এটা তোমার জন্য। আজ তুমি এটাই পরবে।”
বেলার ব্যাগের ভেতরে গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি দেখে মৃদু হাসে। মৌকে বলে,” তুমি আমার জন্য পছন্দ করে কিনেছ আমি না পরে পারি? আমি এটাই পরব।”
বেলা ফারাজের দেওয়া সবুজ রঙের শাড়িটা নিয়ে আসেনি। যদিও সে সেদিন শাড়িটা নিতে বাধ্য হয়েছিল, আজ সেটা পরার কথা ছিল তবুও সে সেটা নিয়ে আসেনি। তার মনে হয়েছিল শাড়িটা বেলার গায়ে দেখলে ফারাজ আবার কোনো আশায় প্রজ্জ্বলিত হতে পারে। কাউকে সে আশায় রাখতে চায় না, একদম চায় না, কখনোই চায় না।
#চলবে…….