মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-২১

0
654

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২১

অল্প সময়ের মধ্যে ফারাজ বেলাকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।

ফারাজ ভেতরে প্রবেশ করার আগে বেলাকে ডেকে বলে ওঠে,” আপনি আমার সেরকম একজন মানুষ যাকে দেখলে, না পাওয়ার ব্যথায় বারবার আহত হয়েও ভালোবেসে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। আপনাকে আর কতটুকু ভালোবাসলে আর ভালোবাসতে মন চাইবে না, বলুন তো? আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা ফুরিয়ে যাক, হারিয়ে যাক। গ্লাসের তলায় একফোঁটা পানির ন্যায়ও অবশিষ্ট না থাকুক। ”

বেলা কিছু বলে না। এতো ভালোবাসা সে গ্রহণ করতে পারবে না। তার যে হাত বাঁধা। নিজের কথা ভাবলে যে আশেপাশের মানুষগুলোর ভালোবাসা সে আর পাবে না। একজন মানুষের ভালোবাসার জন্য সবার ভালোবাসা হারানো বোকামি হবে। কোনো ছেলের পরিবারই চাইবে না কোনো ডিভোর্সি মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে করাতে। পাঁচ বছরের একটা হেলদি সম্পর্কটাও যখন কেউ এভাবে ঠকিয়ে ভেঙে দেয় তারপর ভালোবাসার ওপর আর বিশ্বাস আসে না। ভালোবাসা যেন দূর আকাশের চাঁদ, তাকালে দেখা যাবে ঠিকই কিন্তু ছুঁয়ে দেওয়া যাবে না।

কথাটা বলেই ফারাজ হনহন করে ভেতরে চলে যায়।বেলাও ভেতরে গিয়ে ভাইয়ের সাথে দেখা করে।
ফারাজ মাকে খুঁজে বের করে। মা খাবার বেড়ে দিলে সে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।

বেলা বাসায় আসা মেহমানদের সাথে পরিচিত হচ্ছে। বাসায় অনেকেই এসেছে। তার বয়সী কয়েজন আছে। ওয়াহাজের বোন হিসেবে সবাই তার সাথে আলাপে মগ্ন।

রুপা নামের মেয়েটা অনেক মিশুক। বেলাকে দেখার পর থেকে তার সাথে সারাটা সময় কাটিয়েছে। বেলা কম মিশুক হলেও মেয়েটার সাথে তার খারাপ লাগেনি। মেয়েটার খারাপ লাগতে দেয়নি। দুজন গল্প করতে করতে মাঝে রুপা চেয়ার ছেড়ে উঠে তার ভাইয়ের কাছে যায়। তার ভাই রূপক দূরে থেকে তাকে ডাকছিল।

রুপা কাছে এসে দাঁড়ালে সে বলে,” মেয়েটা কে রে? কী সুন্দর দেখতে! ভাবি বানাতে ইচ্ছে করেনি তোর?”

রুপা মৃদু হেসে বলে,” তোর পছন্দ হয়েছে?”

রূপক মাথা চুলকে বলে,” সুন্দর মেয়েকে পছন্দ হবে না?”
রুপা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে,” লাভ নেই।”
” কেন?”
” মৌ আপুর বিয়ের পরপরই ওয়াজিহা আপু ফ্লাইট। বিদেশে যাবে পড়তে।”

” দেখ তো আটকানো যায় কি না।”
” ফালতু বকিস না তো! যা এখান থেকে৷ আজ ওকে ভালো লাগে তো কাল তাকে৷ বদ একটা।”

রুপা আবার বেলার পাশে এসে বসে। বেলা কিছু না জিজ্ঞেস করতেই রুপা বলে ওঠে,” ওটা আমার ভাইয়া ছিল। ”
” ওহ আচ্ছা। তোমরা কয় ভাইবোন?”
” তোমাদের মতোই এক ভাইবোন।”

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত দশটা। মৌয়ের কল আসায় মৌ নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যায়। ফারাজকে অনুষ্ঠানে একটাবারের জন্যও দেখা যায়নি। মৌ মূলত অনুষ্ঠানের ওখানে বসে থেকে বারবার ফারাজকেই কল করছিল। ফারাজকে কলে না পেয়ে ফারাজের এক বন্ধুকে কল করেছিল সে। প্রথমে কল রিসিভ না করতে পেরে পরে সে নিজেই কল দিয়েছে তাই মৌ কথা বলতে একটু দূরে যায়।

ওয়াহাজ বেলাকে জানায় তারা এখন বাসায় ফিরবে। ওয়াহাজ নিজে মৌয়ের বাবা-মা এবং আত্মীয়দের কাছে থেকে বিদায় নেয়৷ বেলা মৌকে আশেপাশে না দেখে তাকে খুঁজতে যায়। মৌয়ের রুমসহ আশেপাশে না পেয়ে ফারাজের রুমে নক করে। দরজা খোলা দেখে ভেতরে উঁকি দেয়। আজ সারা সন্ধ্যায় সে ফারাজকে দেখেনি। হয়তো সে বেলার জন্যই অনুষ্ঠানে থাকেনি।

বেলা রুমের মধ্যে পা রাখবে এমন সময় পিছন থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে দেয়। বেলা টাল সামলে কোনো মতো সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। পিছনে তাকিয়ে ফারাজকে দেখতে পায় সে।

আমতা আমতা করে বলে,” আ আপনি এখানে?”
” আপনি আমার রুমে কী করছেন?”
” আমি আপনার রুমে কী করব?”
” উঁকি দিচ্ছিলেন কেন?”
” না মানে ভাবিকে খুঁজছিলাম। ”
” আপনার ভাবি এখানে আসেনি।”
” আচ্ছা আমি আসছি।”

বেলা বের হবে ঠিক তখনই ফারাজ বলে ওঠে,” আপনি জানেন? আপনাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না?”

থেমে যায় বেলা। ফারাজের দিকে ফিরে বলে,” আপনাকে আমি নিষেধ করেছি, ফারাজ। নেক্সট টাইম আমাকে আর এসব বলবেন না। অস্বস্তি লাগে আমার। আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আপনার পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করার। আপনার বাবা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি। এরপর আপনার পরিবারের ভালোবাসা পেয়েছি। এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবেন না প্লিজ। আপনার বোন, সে কিন্তু আমাকে ননদ কম বন্ধু আর ছোটোবোন ভাবে বেশি। আমি তার এতো সুন্দর অনুভূতিতে আঘা*ত করতে পারব না। শুধুমাত্র একজনের ভালোবাসা পেতে এতোগুলো মানুষের চক্ষুশূল আমি হতে পারব না। ফ্যান্টাসি থেকে বাস্তবে ফিরে আসুন, ফারাজ। আপনার এই ভালোবাসা ছাড়াও পৃথিবীতে অনেকধরণের ভালোবাসা আছে। ”
বেলা সেখানে আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে আসে।
ফারাজ টাল সামলাতে পারছে না। দরজা আটকে দেয় সে। নিজের রুমের ছোটোবক্সে গান চালিয়ে দেয়। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। এতো কোলাহল তার সহ্য হচ্ছে না। সহ্য হচ্ছে না কাউকে, নিজেকে। গান চলতে থাকে সাথে সাথে সে নিজেও গাইতে থাকে।

তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
একটু চোখের পলক পড়তে
লাগে যতক্ষণ
তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন।

ভালোবাসার সাগর তুমি
ভালোবাসার সাগর তুমি
বুকে অথৈ জল
তবু পিঁপাসাতে আঁখি
তবু পিঁপাসাতে আঁখি
হয়রে ছলছল….

গানের সাথে তাল মিলিয়ে আর গাইতে পারে না ফারাজ। দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে কানে এসে পৌঁছায়। এক ঝাঁকিতে ঝেরে ফেলে সেসব। আশেপাশে অন্ধকার। বাহিরে থেকে ছিঁটেফোঁটা আলো আসছে৷ একাকিত্বে বুক ভারী লাগছে তার৷ বারবার বেলার কথা মনে পড়ছে তার। চোখ বন্ধ করে শব্দ করে কান্না করে ওঠে সে৷

বারান্দায় কারো ছায়া দেখা যায়। নজর তার ফারাজের দিকে।
___

বেলা আর ওয়াহাজ গাড়িতে উঠেছে। বেলার চেষ্টা করছে ভেতরের মন খারাপ বাহিরে প্রকাশ না করতে। ওয়াহাজ ড্রাইভ করতে করতে বেশ বুঝেছে বেলার মন খারাপ।

সামনে নজর রেখেই ওয়াহাজ বলে ওঠে,” তোমার মন খারাপ, ওয়াজিহা? কিছু হয়েছে?”

বেলা এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ফারাজের কথা ভাবছিল। লোকটা মরিয়া হয়ে উঠেছে তাকে পেতে।

ওয়াহাজের কথায় বাস্তবে ফিরে আসলেও ওয়াহাজের কথা সে শুনতে পায়নি। সোজা হয়ে বসে ভাইয়ের দিকে তাকায় সে।

” কিছু বললে, ভাইয়া?”
” কোথায় ছিল তোমার মন?”
” না মানে..”
” কী হয়েছে তোমার?”
” কিছু হয়নি তো?”
” অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছো। মন খারাপ। কী হয়েছে?”
” না ভাইয়া সেরকম কিছুই না। মন খারাপ কেন হবে?”
” আমার কাছে লুকিও না। ফারাজ কিছু বলেছে?”
” নাহ। ফারাজ কী বলবে?”
” কিছু হলে আমাকে বলতে পারো। চেপে রেখো না। আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার কিছু হয়েছে।”
” ওই ছেলেগুলোর কী খবর?”

ওয়াহাজ বেশ বুঝতে পারে তার বোন কথা পাল্টাতে চাইছে। সেও আর জোরাজুরি না করে বলে,” কোর্টে কেস চলছে। যাবজ্জীবনের ব্যবস্থা করছি।”
” ওহ। আমার বাহিরে যাওয়ার ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি করো ভাইয়া।”
” কেন? আমার কাছে ভালো লাগছে না? আমার তো এতদিন পর তোমাকে পেয়ে আর ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না।”

ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হাসে বেলা। বলে,” তাহলে রেখে দাও। যেতে দিও না।”
” ফিরে এসো। একেবারে রেখে দেব আমার কাছে।”
_____

ভোর পাঁচটা। মৌ নামাজ পড়ে জায়নামাজেই বসে আছে। গতরাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। সারারাত চিন্তা হয়েছে তার।

দরজায় নক করার শব্দে সেদিকে তাকায় মৌ। ফারাজ দাঁড়িয়ে। কী অদ্ভুত লাগছে লাগে। চুলগুলো এলোমেলো, চোখদুটো যেন কোটরে চলে গেছে।

বেলাকে জায়নামাজে দেখে বলে,” আচ্ছা থাক। তুই তো নামাজে।”
” দাঁড়া।” বলেই মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ভাজ করে তুলে রাখে সে।

ফারাজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,” কিছু বলবি?”
” চল৷ হেটে আসি। তোর সাথে তো এভাবে হাটতে বের হওয়ার আর সুযোগই পাব না। ”
” পাবি না কেন? আমি আর তুই আগের মতোই হাটতে বের হবো। ”
” তোর বর ছাড়বে?”
” তুই আমার ভাই, ওর ও আগে।”
” আয় বের হই।”

দুজন রাস্তায় নেমে এসেছে। ভোর হচ্ছে, চারপাশে মানুষ তাদের মতোই নামাজ শেষ করে হাটতে বের হয়েছে। বেশির ভাগই মধ্যবয়সী মহিলা। মাঝেমাঝে কয়েকটা মধ্যবয়সী পুরুষের দেখা মিলছে।

মৌ ফারাজের পাশে হাটছে আর তাকে দেখে যাচ্ছে। একরাতেই কী অবস্থা হয়ে গেছে তার ভাইয়ের। কাউকে না পেয়ে কান্না করার মতো ভালোবাসে তার ভাই একজনকে। পুরুষ মানুষ না খেতে পেয়েও কান্না করে না কিন্তু শখের নারীকে না পেয়ে হয়তো একবার না বারবার কান্না করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না কিছু।

মৌ হাটতে হাটতে বলে ওঠে,” ভাইয়া, তুই ওয়াজিহাকে ভালোবাসিস?”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে