#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১২
ওয়াজিহা মৌ- এর দিকে পা বাড়াবে ঠিক এমন সময় কেউ ওয়াজিহার পিঠে কিছু একটা ঠেকিয়ে বলে ওঠে,” এক পা নড়ার চেষ্টা করবেন না। বাড়াবাড়ি করলেই পস্তাতে হবে।”
মেয়েলি গলায় কেউ কথাটা বলে ওঠে। সামনে থেকে মৌ বলে ওঠে,” হিয়া, ওকে একদম ভয় দেখাস না। যাকে পাবি তার সাথেই এরকম করবি নাকি? ছাড় ওকে।”
পিছনে থাকা মেয়েটা এবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সামনে এসে বলে,” ভয় পেয়েছেন?”
ওয়াজিহা তখনও চুপচাপ চোখ বড়ো বড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে। হিয়া তখনও হেসেই যাচ্ছে।
ওয়াজিহাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৌ এবার কাছে এসে দাঁড়ায়। একবার হিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার ওয়াজিহার দিকে তাকায়।
নরমস্বরে বলে,” কী হয়েছে, ওয়াজিহা? চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
ওয়াজিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,” আমি ভয় পেয়েছি জন্য চুপ করে আছি এমনটা না। মৌ আপু বলতে দুই সেকেন্ড দেরি করলে তুমি এতক্ষণ কী অবস্থায় থাকতে আমার জানা নেই। আমি তোমাকে যেকোনোভাবে আহ*ত করার অ্যাটেম্প নিয়েছিলাম। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিল।”
ওয়াজিহার কথায় হিয়া আর মৌ দুজনই হেসে উঠল। ওয়াজিহা নিজেও পরিবেশ স্বাভাবিক করতে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে থাকে।
******
ওয়াজিহা কম্পিউটার ক্লাসে দুই মাস ধরে ভর্তি হয়েছে। বেশি দূর না হওয়ায় প্রতিদিন ক্লাস শুরুর বিশ মিনিট আগে বের হয় সে। আজও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। পিছন থেকে কারো হেটে আসার শব্দ শুনে ওয়াজিহা সেদিকে তাকায়। ফারাজ এসে সোজা ওয়াজিহার পাশে দাঁড়ায়।
ওয়াজিহাকে লক্ষ্য করে বলে,” রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন? আপনাদের তো গাড়ি আছে।”
” জি। গাড়ি আমি নিই না। ভাইয়া নিয়েই বের হয়।”
” ক্লাস কয়টায়? ”
” এই তো সাতটায় শুরু হয় প্রতিদিন।”
” সাতটা থেকে আটটা? ”
” হ্যাঁ। ”
” আমার আজ বাড়ি আসা আটটা পনেরোতে। আপনি কি অপেক্ষা করবেন আপনি যেখানে ক্লাস করেন তার বিপরীত পাশে একটা কফিশপ আছে, ওখানে। ”
” আমার আজ এমনিতেও ওখানে যেতে হতো। ”
” কেন? কারো সাথে দেখা করার আছে?”
” না, না। ওখানকার কফিটা সুন্দর। কয়েকদিন হলো যাওয়া হচ্ছে না।”
খালি রিকশা চোখে পড়তেই ফারাজ ডাক দেয়৷ রিকশা এসে সামনে দাঁড়াতেই ফারাজ ওয়াজিহাকে রিকশায় ওঠার ইশারা করে বলে,” আপনি যান, ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে। আমাদের দেখা হচ্ছে তবে।”
” আপনার দেরি হবে না? আপনি চাইলে এই রিকশাতেই আসতে পারেন। ”
” ওই যে পিছনে আরেকটা এসেছে৷ আপনি চলে যান।”
ওয়াজিহা আর কথা না বাড়িয়ে রিকশায় উঠে বসে। ফারাজও গিয়ে পিছনের রিকশাটা থামায়। দুজনই দুজনের গন্তব্যের দিকে যেতে থাকে।
ওয়াজিহা নির্দিষ্ট স্থানে এসে নেমে পড়ে। ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ভাড়া দিচ্ছিল এমন সময় খেয়াল করে একটা মহিলা রিকশাচালককে ধমকে ধমকে কিছু বলছে। ওয়াজিহা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। মহিলার হাতে ফোন, সামনে রিকশাচালকের দিকে ধরে আছে দেখে ওয়াজিহা বুঝতে পারে এখানে লাইভ চলছে। আশেপাশে দুই একজন মানুষ জমতে শুরু করেছে।
ওয়াজিহা ক্যামেরার আড়ালে দাঁড়িয়ে রিকশাচালককে একবার পর্যবেক্ষণ করল। লোকটার বয়স পঞ্চাশোর্ধ। মুখের চামড়া কুচকে গিয়েছে, চুলে হয়তো বেশ আগেই পাক ধরেছে। চোখ দুটো লালবর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দুটো ছোটো ছোটো, পানি টলমল করছে, চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
ওয়াজিহা পাশে থেকে বলে উঠল,” কী হয়েছে চাচা?”
লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে ওয়াজিহার দিকে তাকিয়ে দেখল। বলল,” মা রে গরিব হওয়ার চেয়ে ভিখারি হওয়া ভালো ছিল। মানুষের কাছে চাইলে ভিক্ষা তো অন্তত দিত। ”
কথাটা শুনে যেন বুকের ভেতরটা জ্ব*লেপু*ড়ে যেতে থাকে ওয়াজিহার। ঠিক তখনই মহিলাটি ওয়াজিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” একদম গলে যাবেন না। এরা মানুষ দেখলেই টাকা চাওয়া শুরু করে, এদের জন্য রাস্তায় বের হওয়া যায় না। অসভ্য মানুষগুলো। ”
ওয়াজিহা মহিলাকে শান্ত করে বলে,” আচ্ছা আচ্ছা। লাইভটা বন্ধ করুন৷ উনি আপনার কাছে টাকা চেয়ে ভুল করেছে বুঝতে পেরেছি। তাই বলে এভাবে লাইভে গিয়ে দলবেধে অপদস্ত করার কিছু নেই। টাকা চেয়েছে দিলে দিতেন আর না দিলে উনি তো জোর করে নিতে পারত না। ”
মহিলাটি লাইভ বন্ধ করতে অস্বীকার করলে ওয়াজিহা হাত থেকে ফোনটা নিয়ে লাইভ কে*টে ফোনটা সেই মহিলার হাতে ধরিয়ে দেয়। রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করে,” কী হয়েছে বলেন তো? উনার এত রেগে যাওয়ার কারণ কী?”
লোকটা রিকশা ছেড়ে বলল,” শরীরটা অসুস্থ, বয়স হচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত ঘরে শুয়ে ছিলাম। দুপুরে বউ কইল যে চাউল নাই, বাজারও নাই। রিকশা নিয়ে বের হয়েছি দুপুরে। ছয়শো টাকা পাইছি। রিকশা যেখান থেকে নিই ওখানে ভাড়া দিতে হয় পাঁচশো টাকা। বাকি একশো টাকা দিয়ে কী করব? শরীর দূর্বল এদিকে বাজার না নিয়ে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে। উনার ভাড়া নব্বই টাকা, আমি শুধু বলছিলাম দশ টাকা একটু বেশি দিতে৷ না দিলে না দিত, আমি তো কেড়ে নিতাম না টাকা। এভাবে মানুষের সামনে আমারে অপমান করল।”
লোকটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। মহিলাটি আরও কিছু কথা শুনিয়ে সেখান থেকে চলে গেল৷ লোকজনও ধীরে চলে যেতে থাকে।
ওয়াজিহা নিজের ব্যাগ থেকে দুইটা এক হাজার টাকার নোট বের করে লোকটাকে দিয়ে বলে,” আঙ্কেল এই টাকাটা রাখুন, এটা দিয়ে আজকের বাজার আর ওষুধ কিনে নিবেন। পৃথিবীর সব মানুষ যেমন ধনী হয় না সেরকম পৃথিবীর সব মানুষের সাহায্য করার মানসিকতা থাকে না। এদেশের মানুষ ব্যাংকে টাকা জমাবে, টাকার বিনিময়ে চাকরি নেবে, বিপদে পড়লে হাজার হাজার টাকা পুলিশের হাতে গুজে দেবে কিন্তু কান্না করে খিদের কথা বললে কেউ ভাত দেবে না। অথচ এদেশে নাকি কোনোকিছুর অভাব নেই। ”
লোকটাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ওয়াজিহা সেখান থেকে চলে যায়। লোকটা তাকিয়ে ওয়াজিহার চলে যাওয়া দেখতে থাকে। হাতের টাকাটা দেখে আবারও চোখের পানি ফেলে। দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়৷ ভেতর থেকে ওয়াজিহার জন্য দোয়া বেরিয়ে আসে।
***
কম্পিউটার ক্লাস শেষ করে সবাই বের হয়েছিল আটটা দশে। ওয়াজিহার পরিচিত দুজন আবদার করে আজ তিনজন বসে আড্ডা দেবে। কিছুদূর গেলেই একটা হোটেল পাওয়া যায়৷ সেই হোটেলটা বেশ পরিচিত তাই তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেখানে যাওয়ার। ওয়াজিহা প্রথমে রাজি না হলে তাদের দুজনের জোরাজোরিতে সেখানে যেতে হয়। ফারাজকে কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারায় ভীষণ খারাপ লাগছিল তার।
তিনজনের খাওয়া দাওয়া করে বের হতে হতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে যায়। ওয়াজিহা আগেই ভাইকে জানিয়ে দিয়েছিল। তিনজন বের হওয়ার পর ওয়াজিহাকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে নীতু আর শিমলা আরেকটা রিকশা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
ওয়াজিহার খারাপ লাগছিল ফারাজের জন্য। ব্যাগ থেকে ফারাজের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে সেখানে থাকা নম্বরে কল দেয় সে৷ প্রথমবারে রিসিভ না হলে আবার কল দেয় ওয়াজিহা।
দ্বিতীয়বারে কল রিসিভ হতেই ওয়াজিহা বলে ওঠে,” হ্যালো, আমি ওয়াজিহা বলছি।”
ওপাশ থেকে জবাব আসে,” কোথায় আপনি? ঠিক আছেন তো?”
” হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।”
” আপনি কি বাসায় চলে গিয়েছেন?”
” না, আমার সাথে যারা ক্লাস করে ওখানে দুইটা মেয়ের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। ওরা জোর করে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল খাবার খেতে। আপনি কোথায় এখন? আপনাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে।”
” আমার যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানেই বসে আছি এক ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিট ধরে।”
” ইশ! আচ্ছা আপনি ওখানেই থাকুন আমি আসছি। প্রায় চলে এসেছি।”
” আমি সামনে দাঁড়াচ্ছি। আজ অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। অলরেডি নয়টা পয়তাল্লিশ বেজে গিয়েছে। বাসায় ফিরতে হবে।”
” আচ্ছা। সামনে এসে দাঁড়ান একসাথে বাসায় ফিরব।”
সাত মিনিটের মাথায় ওয়াজিহা কফিশপের সামনে চলে আসে। ফারাজ বাহিরে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওয়াজিহাকে রিকশায় দেখতেই সেখানে এগিয়ে আসে।
ওয়াজিহা রিকশার এক পাশে সরে বসে বলে,” উঠে আসুন।”
” দুজন একসাথে সমস্যা হবে না?”
” না, আসুন তো।”
ফারাজ রিকশায় উঠে বসে। দুজনে এক রিকশায় বসলেও দুজনই ভেতরে ভেতরে বেশ অস্বস্তিবোধ করছে। দুজনই কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে আছে, রিকশা চলছে।
বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে ওয়াজিহা বলে,” আ আমি আপনাকে কীভাবে স্যরি বলব কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তখন এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবে বুঝতেই পারিনি। আপনার নম্বরও ছিল না আমার কাছে। তারপর মনে পড়ল আপনি আমাকে একদিন আপনার ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলেন। ব্যাগে খুঁজতেই পেয়ে গেলাম তারপরই কল দিয়েছি কিন্তু আপনি এতক্ষণ অপেক্ষা করতে গেলেন কেন?”
ফারাজ মৃদু হেসে বলে,” আমি মৌকে কল করেছিলাম। ও’ বলল আপনি বাসায় ফিরেননি। মনে হলো হয়তো বাহিরে কোনো কাজে আটকে গেছেন তাই অপেক্ষা করছিলাম। একদম বিরক্ত হয়নি, খেলা চলছিল বাংলাদেশের। সেটাই দেখছিলাম বসে বসে।”
” কোনো প্রয়োজন ছিল কি? না, মানে আসলে বাহিরে দেখা করতে বলেছিলেন তো….”
” তেমন কিছু না। আপনার সাথে সেরকম করে কথা হয়নি। তাই..”
দুজনের মধ্যে আরও কিছু কথা চলতে থাকে। রিকশা এসে বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে থেমে যায়। ওয়াজিহা ভাড়া দিতে চাইলে ফারাজ সেটা করতে দেয় না। ওয়াজিহাকে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে গিয়ে দাঁড়াতে বলে। ফারাজ গাড়িভাড়া দিচ্ছিল এমন সময় পিছন থেকে ওয়াজিহার চিৎকার শুনতে পেয়ে ফারাজ সেদিকে ঘুরে তাকাতেই দেখে ওয়াজিহা রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে দুই কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছে। ফারাজ দৌঁড়ে কাছাকাছি যেতেই দেখে ওয়াজিহার পায়ের কাছে বড়োসড়ো কিছু পড়ে আছে। ওয়াজিহার কাছে এসে দাঁড়াতেই ওয়াজিহা বলে ওঠে,” বাঁচান, মে*রে ফেলে গেল ওরা। গাড়ি থেকে ফেলেছে। ”
ফারাজ পায়ের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে যায়। সারা শরীর কাঁপতে থাকে তার। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে মাথায় হাত দিয়ে কী করবে ভাবতে থাকে সে।
ওয়াজিহা হাত স্পর্শ করবে ফারাজ ওমনি বলে ওঠে,” ওটা লা*শ, ধরবেন না একদম।”
#চলবে…….