#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১০+১১
মৌ দরজা খুলে বাহিরে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে,” এখানে কি? তুই এখন এখানে কেন? আমার পিছে পিছে নজর রাখতে চলে এসেছিস?”
ফারাজ ভারী গলায় বলে,” আমি তোর ওপর নজর রাখতে আসিনি। আম্মা আমাকে পাঠালো, দুপুরে আমাদের বাসায় ওয়াহাজ ভাইদের নিমন্ত্রণ। আম্মার একথাই বলতে পাঠাল।”
” আচ্ছা আমি বলে দেব। ”
” বাসায় নতুন মেয়ে আসছে গতরাতে। তার সাথে আড্ডা জমিয়েছিস নাকি?”
” হ্যাঁ, তাতে তোর কী? যা এখান থেকে।”
” শোন আমি তোর চেয়ে বড়ো। এরকম করে মানুষের সামনে কথা বললে তোর জিভ আমি ছি*ড়ে ফেলব বলে দিলাম। ”
” অ্যাহ আসছে আমার সম্মানীয় ব্যক্তি, আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন স্যার?”
মৌ-এর কথায় কিছু না বলে ফারাজ নিজেদের বাসায় চলে যায়। মৌ দরজা আটকে পিছনে ফিরতেই দেখে ওয়াহাজ দাঁড়িয়ে৷
ওয়াহাজ এতক্ষণে বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে বেরিয়েছে নিজের রুম থেকে। তার রুমের পাশেই ফ্ল্যাটের মেইন দরজা।
ওয়াহাজ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,” কে এসেছিল?”
মৌ ওয়াজিহার রুমের দিকে এগুতে এগুতে বলে,” ফারাজ এসেছিল। বলল, আম্মা পাঠিয়েছিল। ”
ওয়াহাজও মৌ-এর সাথে আসতে আসতে বলে,” কেন?”
” দুপুরে আমাদের ওখানে আপনাদের নিমন্ত্রণ। আপনি কি এখন বের হবেন?”
” হ্যাঁ, আজ থেকে অফিসিয়াল কাজ শুরু হবে আমার। এখনই বের হতে হবে।”
দুজন একসাথে রুমে প্রবেশ করে৷ ওয়াজিহা চায়ের কাপ পাশে রাখে। ওয়াহাজকে ফরমাল ড্রেসআপে দেখে বলে,” কোথাও যাচ্ছ, ভাইয়া?”
ওয়াহাজ সামনে চেয়ার টেনে বসে। ওয়াজিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আমার আজ থেকে অফিসিয়াল কাজ শুরু। নয়টা/ সাড়ে নয়টা থেকে একদম বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। তোমার একা একা লাগলে তুমি মৌ-এর সাথে গিয়ে থাকতে পারো।”
ওয়াজিহা ভাইয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে ওঠে,” আপুকে আমাদের বাসায় একেবারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেই তো পারো। আর কতদিন বাসা ফাঁকা থাকবে?”
ওয়াহাজ ভ্রু কুচকে তাকায় ওয়াজিহার দিকে। বোনের কথাটা ঠিক বোধগম্য হয়নি তার কাছে।
ওয়াহাজের মুখের অবস্থা দেখে মৌ বলে ওঠে,” ওয়াজিহা, তুমি এখন আমার সাথে আমাদের বাসায় চলো। আম্মা দুপুরের দাওয়াত দিয়েছে। ভাইয়া তো অফিসে যাবে। তোমার বাসায় একা থাকতে হবে।”
ওয়াহাজ বলে,” হ্যাঁ, তুমি চাইলে ওই বাসায় যেতে পারো।”
ওয়াজিহা রাজি হয়ে যায়। বাসায় একা, অচেনা পরিবেশে তার দমবন্ধ হয়ে আসবে। কান্না পাবে। তাই সে বলে,” আচ্ছা ঠিক আছে।”
ওয়াহাজ কিছু একটা ভেবে বলে,” আচ্ছা, আমি গাড়ি রেখে যাই। মৌ তুমি তো গাড়ি ড্রাইভ করতে পারো, ওয়াজিহাকে নিয়ে একটু বের হও দশটার পর। ওর জন্য তুমি পছন্দ করে কিছু পোশাক কিনে দাও। ওর নতুন পোশাক প্রয়োজন। প্রয়োজনে একটু পার্লারে নিয়ে যাবে, যা যা প্রয়োজন সেগুলো করাবে। ওয়াজিহা প্রতিদিন যা করে তার বাহিরে কিছু করলে ওর ভালো লাগবে। আমি টাকা দিয়ে যাচ্ছি।”
ওয়াহাজ টাকা বের করে ওয়াজিহাকে দিতে যাবে তখনই ওয়াজিহা বলে ওঠে,” ভাইয়া, আমার এতগুলো টাকা রয়েছে, তোমার কোনো খরচ করতে হবে না। আমি এতো টাকা দিয়ে কী করব?”
” যেটা তোমার সেটা তোমারই, যেটা আমার সেটাও তোমার। দশ বছর বাহিরে থেকে এসেছি। পড়াশোনার পাশাপাশি জব করেছি, পড়াশোনা শেষ করে ভালো বেতনের জব করেছি। আমার গুলোই বা আমি শেষ করব কীভাবে? ”
ওয়াজিহা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষ এতো ভালোও হয়! এই ভাইটা হয়তো অতীতের সেই সমস্যার জন্য হারিয়ে না গেলে সবকিছু অন্যরকম হতো। তার শরীরে ডিভোর্সি ট্যাগ লাগতো না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ওয়াজিহা।
ভাইয়ের দেওয়া টাকা হাতে নিয়ে বলে,” তাই বলে এতো টাকা?”
ওয়াহাজ মুচকি হেসে বলে,” এখানে ত্রিশ হাজার আছে। শহরে জিনিসপত্রের দাম তোমার জানা নেই। মৌকে জিজ্ঞেস করে দেখো, ভালো কিছু জিনিস, পোশাক কিনতে গেলে এই টাকাটা খুব কম। ”
মৌ পাশে দাঁড়িয়ে দুই ভাইবোনের কথা শুনছে আর ভাবছে ওয়াহাজ আর ওয়াজিহা তাদের দুই ভাইবোনের চেয়ে একদম আলাদা। ফারাজের কিছু কান্ড মনে পড়তেই মুচকি হাসে মৌ।
মৌ দুই ভাইবোনকে চুপ করিয়ে বলে ওঠে, ” টাকাটা রাখো ওয়াজিহা, সব টাকা লেগে যাবে।”
ওয়াহাজের দিকে তাকিয়ে বলে,” আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না? আমি ওয়াজিহাকে এখনই নিয়ে যাই। আমার সাথে সকালের নাস্তা করে নেবে তারপর দুজন একসাথে বের হবো।”
ওয়াহাজ কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। ওয়াজিহা মৌকে অপেক্ষা করতে বলে ব্যাগ থেকে পোশাক বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় পোশাক পাল্টাতে।
মৌ বিছানায় বসে বসে ভাবছে ওয়াজিহার কথা। ওয়াহাজও কেমন গোলকধাঁধার মতো। তার বোনের কথা কবে বলেছিল সেটা মনে নেই। বোন যে আছে সেটাই শুধু বলেছিল আর আজ তাকে বাসায় নিয়ে চলে এলো। এর আগে কোথায় ছিল? মেয়েটা এতো মনমরা কেন?
হঠাৎ মৌ-এর ফোনে মেসেজের শব্দ হয়। মেসেঞ্জারে যেতেই দেখতে পায় ওয়াহাজ মেসেজ করেছে তার আগে একটা ভয়েজ দিয়েছে। মৌ মেসেজটা পড়ে।
” ওয়াজিহা পাশে থাকলে ভয়েজটা ওপেন করার প্রয়োজন নেই।”
মৌ ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে ভয়েজ মেসেজটা অন করে শুনতে থাকে। দুই মিনিটের অডিয়ো ভয়েজ শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মৌ। ফোনটা সাথেসাথে পাশে রাখে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,” এতো কিছু সহ্য করছে মেয়েটা! এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে কোনো পুরুষ এভাবে ঠ*কাতে পারে! ”
মৌ-এর সারা শরীর যেন কাঁপছে। ওয়াশরুমের দরজায় শব্দ হতে বুক কেঁপে ওঠে তার। ওয়াজিহাকে দেখে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে সে। ফোনটা হাতে নিয়ে ওয়াজিহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
মৌ ওয়াজিহাকে সাথে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশে ফারাজ সাদা শার্ট, কালো ফরমাল প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফারাজ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,” ওই বাসায় থেকে গেলেই পারতি। এখানে আসলি কেন?”
পাশে ওয়াজিহা মৌ-এর দিকে এগিয়ে আসতেই ফারাজ সেদিকে তাকিয়ে ওয়াজিহাকে দেখে আবার মৌ-এর দিকে তাকায়। ওয়াজিহা এসেছে জানলে সে এসব কিছুতেই বলত না। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে ফারাজ।
মুখে মিথ্যে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে,” ভালো আছেন? আসুন ভেতরে আসুন।”
মৌ ফারাজের অবস্থা দেখে হাসি চেপে রেখে ওয়াজিহাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়।
ফারাজ বাড়িতে আর বেশি সময় না থেকে নিজেও তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হয়। মাকে বলে বের হবে জন্য রান্নাঘরে গিয়ে দেখে তার মায়ের সাথে ওয়াজিহা আর মৌ দাঁড়িয়ে আছে।
ফারাজ বাহিরে থেকেই তার মাকে ডেকে বলে,” আম্মা, আমি হাসপাতালে চলে গেলাম। কল এসেছিল তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”
ফাহমিদা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে,” নাস্তা বানিয়েছি। খেয়ে যাবি তো।”
” আমি হাসপাতালে নাস্তা করে নেব। এখন তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তোমরা নাস্তা করে নিও।”
” এটা কোনো কথা হলো? আমি সকাল সকাল নাস্তা বানালাম।”
” আম্মা, আমি বের হচ্ছি। এখন কথা বলারও সময় নেই। ”
ফারাজ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়। ফাহমিদা বেগম রান্নাঘরে ফিরে আসে। নাস্তা বানানো শেষ হলে দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত করছিলেন তিনি।
ওয়াজিহার সকালে ছাদে যাওয়ার কথা মনে পড়তেই বলে,” আন্টি, সকালে আমি ছাদে গিয়েছিলাম। চিলেকোঠার পাশে একজন শুয়ে ছিল জায়নামাজ বিছিয়ে…”
ওয়াজিহা কথা শেষ না করতেই মৌ বলে ওঠে,” ওটা বাবা। প্রতিদিন ফজরের নামাজ ছাদে গিয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক ওখানে থেকে তারপর বাসায় আসে।”
তিনজনের মধ্যে টুকটাক কথা চলতে থাকে। মৌ তার মাকে আগেই বলে দিয়েছে ওয়াজিহার অতীত নিয়ে যেন কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে। মৌ আরও বলে রেখেছে ওয়াজিহার ব্যাপারে সে পরে সব বলবে।
ফাহমিদা বেগম, মৌ, ওয়াজিহার কথাবার্তা চলতে থাকে। ওয়াজিহা অবাক হয়ে মৌ-এর হাসি দেখতে থাকে। মেয়েটা কী সুন্দর করে হাসতে পারে। পরপর দুইবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াজিহা। মনে মনে ভাবতে থাকে – ও বাড়িতে কী হচ্ছে এখন? তারা নিশ্চয়ই খুব আনন্দ করছে! আনন্দ করারই তো কথা, সবকিছু তো এখন ঝামেলামুক্ত। তার বিছানায় নিশ্চয়ই ধ্রুব আর তার স্ত্রী রাত্রিযাপন করেছে! ছুঁয়েছে তাকে ছাড়া অন্য নারীর শরীর!
#চলবে…….
#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১১
প্রায় চারমাস কেটে গিয়েছে।
ওয়াজিহা হন্তদন্ত হয়ে ওয়াহাজের ঘরের দরজায় টোকা মারল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়াহাজ ভেতর থেকে দরজা খুলে দিতেই ওয়াজিহা ওয়াহাজের কাছে গিয়ে বলল,” ভাইয়া ছবিটা দেখো। ”
ওয়াহাজ ওয়াজিহার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ভালোভাবে ছবিটা দেখল। ওয়াজিহার হাতে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,” কী হয়েছে? সুই*সাই*ড করেছে?”
ওয়াজিহা কপাল বিস্তৃত করে বলে,” হ্যাঁ, ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহ*ত্মা করেছে। উনাকে আমি দেখেছিলাম। ”
ওয়াহাজ বাহিরে আসতে আসতে বলে,” কোথায় দেখেছ?”
” ফারাজ সাহেবের হাসপাতালের পাশে যে রেস্টুরেন্ট আছে না? ওখানে দেখেছি। আমি আর মৌ আপু ওখানে গিয়েছিলাম দুদিন আগে৷ ওখানে এই ছেলেটাকে দেখেছিলাম। ”
” একবার দেখেই মনে আছে?”
” মনে থাকার মতো বিষয় ঘটেছিল ভাইয়া, এজন্য মনে আছে।”
ওয়াহাজ সোফায় বসতে বসতে বলে,” মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছিল? কী ঘটেছিল? ”
ওয়াজিহা গিয়ে ওয়াহাজের সামনে সিঙ্গেল সোফায় বসে। মাথা চুলকে কিছু মনে করার চেষ্টা করে বলে,” ছেলেটার নাম বোধ হয় জোভান। উনার সাথে যে মেয়েটা ছিল, ওই মেয়ে হয়তো এই নামই উচ্চারণ করেছিল।”
” সম্পূর্ণ ঘটনা ক্লিয়ার করে বল। একদম প্রথম থেকে বলবে।”
ওয়াজিহা কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে সব ঘটনা সাজিয়ে নেয়। তারপর নিজের ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে কিছুক্ষণ ছবি, ভিডিয়ো দেখতে থাকে৷ এক পর্যায়ে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ভিডিয়ো পেয়ে ওয়াহাজকে দেখিয়ে বলে,” এই দেখো। ছেলেটার সাথে এই মেয়ে ছিল। মৌ আপু বলেছিল একটা ছোটো ভিডিয়ো করতে যেন সে স্টোরিতে দিতে পারে। আমি ভিডিয়ো করার সময়েই দেখি ছেলেটা কান্না করছে। বারবার চোখ মুছছিল। কেন জানি না ওদের বিষয়ে আগ্রহ জেগেছিল কারণ খুব কম পুরুষকে আমি কান্না করতে দেখেছি। কথা শুনে বুঝতে পারি মেয়েটা এই ছেলের সাথে প্রতা*রণা করছিল। ছেলেটা বুঝতে পেরেছিল তবুও মেয়েটাকে অনুরোধ করছিল সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য। মেয়েটা কিছুতেই মানতে চায়নি। এক পর্যায়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। ”
ওয়াহাজ, বোনের কথা শুনে বলে,” তাহলে তুমি বলতে চাইছ যে প্রেমিকার জন্য ছেলেটা সু*ই*সা*ইড করেছে?”
” হ্যাঁ, আমার সেটাই মনে হচ্ছে।”
” প্রেমিকাকে না পেয়ে ছেলেটা সু*ই*সাই*ড করেছে। তোমার কি মনে হয় এসবের কোন শা*স্তি আইন দিতে পারবে? ”
ওয়াজিহা বলে ওঠে,” তুমি আছ কেন? এই মেয়ের শা*স্তি চাই ভাইয়া। এই ছেলের জায়গায় চারমাস আগে আমিও ছিলাম। আমি ছেলেটার মতো দূর্বল মনের হলে হয়তো আজ তোমার সামনে আমি বসে থাকতাম না।”
ওয়াহাজ মৃদু হেসে বলে,” আমার কাজ সম্পর্কে তোমার আইডিয়া আছে? আমি কীভাবে তাকে শা*স্তি দেব কীভাবে?”
ওয়াজিহা কিছুক্ষণ নিরব থেকে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,” ভাইয়া আমি সবকিছু জানি।”
” কী জানো তুমি?”
” তুমি যে কাজটা করো সেটা সম্পর্কে জানি তার জন্যই তোমাকে বলছি।”
ওয়াহাজ এবার শব্দ করে হেসে ওঠে। দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ওপরের দিকে তাকায়। ভাইয়ের এরকম অস্বাভাবিক আচরণ ওয়াজিহা এক পলকে দেখতে থাকে।
ওয়াহাজ এবার স্বাভাবিক হয়ে দুই হাটুর ওপর হাত রেখে বলে,” তোমাকে চারমাস ধরে আমি কেন তৈরি করলাম নতুন করে? কেন আমি তোমাকে বেলার বিপরীত বানালাম? কেন আমি তোমাকে এই সমাজের উপযোগী করলাম? এর পরিবর্তে তুমি আমাকে কী দিলে? তোমার উচিৎ না আমাকে এর প্রতিদানস্বরূপ কিছু দেয়া?”
ওয়াজিহা বড়ো উৎকন্ঠায় জিজ্ঞেস করে,” কী করতে বলছ আমায়?”
” আগাছা পরিষ্কার। ”
” কী?”
” আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।”
” বুঝতে পারছি না।”
ওয়াহাজ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, “বাদলের মতো আগাছাকে সমাজ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সমাজের এই নোংরা মানুষগুলোকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে হবে।”
” আম্মা যেমন করেছিল?”
” আম্মার শেষ না করা কাজটা আমি করছি আর সেটা তোমাকেও করতে হবে। আমাদের শৈশব নষ্ট হয়েছে, অন্য বাচ্চাদের শৈশব নষ্ট হওয়ার হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে হবে।”
” কিন্তু আম্মা তো….”
” আম্মা যা করেছিল সেটা একদম ঠিক করেছিল ওয়াজিহা। আম্মার কাজে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। যেমেন কু*কুর ঠিক তেমনই মুগুর।”
ওয়াহাজ থেমে ওয়াজিহার দিকে তাকায়। ওয়াজিহা তখন মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে।
ওয়াহাজ নিজের ফোনটা বের করে ওয়াজিহাকে কিছু স্ক্রিনশট পাঠিয়ে বলে,” স্ক্রিনশটগুলো দেখে নিও সময় করে। আশা করছি তোমার জন্য ভালো হবে। আমাদের কাজটা কোনো অ*ন্যায় না, আমাদের কাজটা হলো সমাজ থেকে অ*ন্যায় উপড়ে ফেলা। শুধু আমি নই এটা সমস্ত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আইন সম্মুখে যেটা করতে না পারে আইন অন্ধকারে সেটা করে। আমরা আইনের বাহিরে নই, আমাদের কাজগুলো আইন থেকেই আসে। সো, এতে তোমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই৷ শুধু ভাবো একটু আর আমাকে ‘ হ্যাঁ ‘ বা ‘ না’ জানাও।”
ওয়াহাজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রুমের উদ্দেশ্যে যেতে শুরু করে আবার থেমে যায়। ফিরে ওয়াজিহার দিকে তাকিয়ে বলে,” সমাজ এক কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। আর এই সমাজ থেকে মেঘ বিয়োগের কাজে আমরা তোমাকে নিশ্চয়ই পেতে চলেছি।”
ওয়াজিহাও বসে থেকে দাঁড়ায়। ওয়াহাজের দিকে এগিয়ে এসে বলে,” ভাইয়া, আমারও একটা শর্ত আছে। আমি তোমার কথা রাখব কিন্তু তার আগে আমার একটা কথা তোমার রাখতে হবে।”
ওয়াহাজ, বোনের দুই বাহুতে হাত রেখে বলে,” এখানে কোনো শর্ত প্রযোজ্য নয়। তুমি কী চাও সেটা বলো।”
” মৌ আপু তোমাকে পছন্দ করে৷ আমার সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিনই আমাকে বলেছিল। তোমার আড়ালে, তোমার সূত্রে আমি তাকে বউমনি বলে ডাকি।”
ওয়াহাজ কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মৌ যে তাকে পছন্দ করে সেটা ওয়াহাজ নিজেও জানে কিন্তু সে এসবে প্রশ্রয় দিতে চায় না। সম্পর্ক ভাঙতে দেখে দেখে কোনো সম্পর্কে জড়াতেও ভয় লাগে তার।
ওয়াহাজকে চুপ থাকতে দেখে ওয়াজিহা বলে,” তুমি যে দুনিয়ায় আছ সেখানে হয়তো শুধু সংসার ভাঙে কিন্তু তোমার সেই দুনিয়া থেকে বের হয়ে দেখো সমাজে আরও অনেক সংসার যুগ যুগ ধরে টিকে আছে।”
” আচ্ছা আমি ফারজানার সাথে কথা বলব।” বলেই ওয়াহাজ সেখান থেকে হাটা দেয়।
পিছন থেকে ওয়াজিহা বলে ওঠে,” ফারজানা কে? বলে তো যাও।”
ওয়াহাজ রুমের দরজা আটকাতে আটকাতে বলে,” ফারজানা মৌ।”
***
রাত আটটা।
রুমে বসে বসে ভালো লাগছিল না জন্য মৌকে মেসেজ দেয় ওয়াজিহা। ওপাশ থেকে সাথে সাথে আসে- ছাদে যাও, আমি আসছি।
ওয়াজিহা রুম থেকে বের হয়ে দেখে ওয়াহাজ ড্রয়িংরুমে বসে বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।
ওয়াজিহা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওয়াহাজ ফোনটা মিউট করে বলে,” কিছু বলবে?”
ওয়াজিহা ফোনের সাইড বাটন চেপে সময় দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,” মৌ আপু ছাদে যেতে বলল। যাব?”
” যাও। শোনো ভয় নেই। এ বাড়িতে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই।”
” আচ্ছা।”
ওয়াজিহা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে চলে আসে।
বাসার দারোয়ানের সাথে দেখা হলে ওয়াজিহা আগে সালাম দেয়। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,” কোথায় গেছিলেন, চাচা?”
” একটু দরকার ছিল আম্মা। আমার আবার নিচে যাওয়া লাগবে তাড়াতাড়ি। আমি যাই, আম্মা?”
” আচ্ছা ঠিক আছে যান।”
সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে যায় ওয়াজিহা। ছাদে পা রাখতেই নিচের দিক থেকে আওয়াজ আসতে থাকে। কেউ ছাদে আসছে, সিঁড়িতে পা ফেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওয়াজিহা সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে মৌকে দেখতে পায় না সে। ভাবে মৌ হয়তো আসছে তাই সে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। সিঁড়ি থেকে শব্দ তখনো আসছে। ওয়াজিহা আবার ফোনে সময় দেখে রাত আটটা সতেরো।
এমন সময় ছাদের উত্তর পাশে থেকে মৌ-এর গলা শুনে সেদিকে তাকায় ওয়াজিহা। মৌ ছাদে, তাকে সেখানে যাওয়ার জন্য ডাকছে। ওয়াজিহা মৌ- এর দিকে পা বাড়াবে ঠিক এমন সময় কেউ ওয়াজিহার পিঠে কিছু একটা ঠেকিয়ে বলে ওঠে,” এক পা নড়ার চেষ্টা করবেন না। বাড়াবাড়ি করলেই পস্তাতে হবে।”
#চলবে…..