#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৬
সুমু ধ্রুবর নতুন বউকে দেখতে তাদের বাড়ি আসছিল। বাড়ির বাহিরে একলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় সে।
বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,” কোথাও এসেছেন আপনি? বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না?”
লোকটা চকিতে বলে ওঠে,” বাজার পার করে তিন নম্বর গোলির আজহার সাহেবের বাড়ি এটা?”
” জি।”
” বেলাকে ডেকে দিবেন একটু?”
” আপনি ভাবিকে চাইছেন? দাঁড়ান আমি ডেকে দিচ্ছি।”
সুমু তাড়াতাড়ি করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বেলার ঘরে চলে যায়। বেলা নিজের জামাকাপড় ভালোভাবে গুছিয়ে নিচ্ছিল।
সুমু বেলার পিছনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,” ভাবি, লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহের এক লোক বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে৷ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
বেলা দ্রুত পিছনে ঘুরে সুমুকে বলে ওঠে,” কোথায় উনি?”
” গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।”
” তুমি ভেতরে আসতে বলেছ? আচ্ছা তুমি বোসো আমি একটু আসছি।”
” সমস্যা নেই তুমি যাও, আমিও বাড়ি যাই।”
” আচ্ছা ঠিক আছে।”
বেলা হাতের কাপড় বিছানায় ফেলে একপ্রকার দৌঁড়ে বাহিরে চলে যায়৷
বেলা বাহিরের গেইটে এসে এদিক ওদিক উঁকি দিতেই দেখতে পায় হাতের ডানপাশে একজন দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের স্ক্রিনে নজর তার। মুখে ফোনের আলো পড়ায় আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।
বেলা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে। নির্জীবগলায় ডাকে,” ভাইয়া!”
লোকটা ফিরে তাকায় বেলার দিকে। বেলাকে আসতে দেখে সে নিজেও বেলার দিকে এগিয়ে যায়। বেলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলে,” ফোন করছিলাম অনেকক্ষণ ধরে, কোথায় ছিলে তুমি?”
বেলা আমতা আমতা করে বলে,” ভাইয়া, ফোন চার্জে বসানো। সাইলেন্ট করা আছে, ফোন আসছে বুঝতে পারিনি।”
” আচ্ছা। সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
” হ্যাঁ হচ্ছে৷ তুমি এসো, ভেতরে এসো। অনেক কথা তোমাকে বলার আছে। কত কথা জমে জমে পাহাড় তৈরি হয়েছে।
” হ্যাঁ চলো। চলো, সব শুনব। তোমার ভাই, আমি ওয়াহাজ চলে এসেছি। আল্লাহ আমাকে তোমার জন্য পাঠিয়েছেন। ”
বেলা তার ভাইকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আস্তে আস্তে মানুষ আসা শুরু করেছে। বাড়ির বাহিরের বড়ো উঠোনটায় তালাকের ব্যবস্থা করা হবে। বসার জায়গা ঠিক করা হচ্ছে। বেলা তার ভাইকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। বেলা নিজের ঘরে যাওয়ার সময় রিমির ঘরের দিকে তাকায়। জানালা খোলা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ধ্রুব আর তার নতুন বউ পাশাপাশি, কাছাকাছি বসে আছে। সামনের চেয়ারটায় জাহিদা বেগম বসে আছে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রিমি। সবাইকে একসাথে দেখে আরও একবার আহ*ত হয় বেলা।
***
” এতোগুলো টাকা যোগার করলি কীভাবে? ব্যাংক তো বন্ধ ছিল তাই না?”
জাহিদা বেগমের প্রশ্নের উত্তরে ধ্রুব বলে,” সবকিছুর ব্যবস্থা করা ছিল। আমি আগেই বুঝেছিলাম বেলা এমন কিছু করবে। টাকা হিসেব করে ব্যাংক থেকে তুলে একজনের কাছে রেখেছিলাম। সে-ই টাকা দিয়েছে। ”
” এতগুলো টাকা দিতে হচ্ছে, আমার গা পু*ড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। টাকা যেন ফেরত দিতে না হয় তাই এতগুলো বছর কী ভালো ব্যবহারটাই না আমি করলাম! ভেবেছিলাম বলব, ওই টাকার কথা ভুলে যেতে, ওটা যৌতুক। এমন কাজ করে বসলি যে ওই টাকার সাথে কাবিনের টাকাও দিতে হচ্ছে। এতগুলো টাকা অন্যকাউকে দিতে হবে ভাবলেই জ্বরজ্বর লাগতেছে।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলেন জাহিদা বেগম।
ধ্রুব মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,” টাকা যেহেতু নিয়েছি, দিতে তো হবেই।”
পাশে থেকে রিমি বলে ওঠে,” আচ্ছা, ভাইয়া তুমি যদি ডিভোর্স না দিয়ে, ওকে ডিভোর্স দেওয়াতে বাধ্য করো তাহলে তো অন্তত কাবিনের টাকা দিতে হবে না৷ ”
লিলি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে,” হ্যাঁ হ্যাঁ, রিমি ঠিক বলেছে৷ এরকম করা যায় না?”
জাহিদা বেগম ভাবুক দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকায়। ধ্রুব কী বলবে সেটা শোনার অপেক্ষায় সবাই তার দিকে তাকায়। ধ্রুব বলে,” তাহলে ওর এখানে থাকতে হবে। ও যা আবদার করবে সেগুলো কিন্তু মানতে হবে৷ ধীরে ধীরে ওকে বাধ্য করতে হবে তালাকের জন্য। রাজি আছ?”
লিলি চকিতে বলে ওঠে,” বারো লাখ দিতে পারলে সাত লাখও পারবে। প্রয়োজনে দুজন আবার বিদেশ যাব। আমি সতীনের ঘর করতে পারব না। ”
জাহিদা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,” ধ্রুব, তোর বড়ো বউ কীসের চাকরি করত তুই কিছু জানিস? আমি তো অশিক্ষিত, এতসব বুঝি না।”
” জানি না, মাথা ঘামাইনি এত।”
” এটা কোনো কথা? বউ কীসের চাকরি করে আর তুই জানিস না?”
” বাদ দাও আম্মা এসব এখন আর এসব জেনে কী করবে? একদিন শুধু এটুকু বলেছিল যে এই চাকরি তাকে অনেকদূর নিয়ে যাবে। সে সফল হবে, এসব।”
ধ্রুব থেমে রিমির দিকে তাকিয়ে বলে,” বেলার ঘরে জাওয়াদকে কে পাঠিয়েছিল? রিমি তুইই পাঠিয়েছিলি?”
রিমি ধ্রুবর দিকে আহ*ত দৃষ্টিতে তাকায়। লিলি আর জাহিদা বেগম চুপচাপ রিমির দিকে তাকিয়ে আছে। রিমি বলে,” হ্যাঁ ভাইয়া, আমার ভুল হয়ে গেছে।”
ধ্রুব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ফোনটা নিয়ে বাহিরে যেতে যেতে বলে, ” দেখ তোকে আবার কী করে! তোদের কি মনে হয় ওই দুইটা থা*প্পড়েই শেষ হয়ে গেছে সবকিছু? আমার তো মনে হচ্ছে কিছু তো এখনো বাকি৷ আমি বলেছিলাম টাকার যোগাড় করা আছে শুধু নিয়ে আসার অপেক্ষা। আমাকে না জানিয়ে একটা কান্ড বাধিয়ে ফেলেছিস এবার বুঝবি।”
ধ্রুব বাহিরে বের হয়ে যায়। রিমি অসহায়ের মতো মা জাহিদা বেগম এবং নতুন ভাবি লিলির দিকে তাকায়। চোখে তার গাঢ় ভয়, কী হবে এবার? আরও কিছু হওয়া বাকি?
***
” ভাইয়া একটু জড়িয়ে ধরি? কতদিন তোমাকে ছুঁয়ে দেখি না আমি! আমার খুব কান্না পাচ্ছে জানো? চারদিক থেকে আমাকে আঘা*ত করছে ওরা। জানো, আমি একটুও ভেঙে পড়িনি তবে মাঝেমাঝে একটু বেশি কষ্ট পেলে কান্না গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ওদের সবাইকে একসাথে দেখে আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। ভাইয়া এই সংসারটা সকাল পর্যন্তও আমার ছিল। এখন! এখন আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব। ”
বেলার মুখে থেকে সবকথা শুনে ওয়াহাজ আর এক মুহূর্তও বোনের কাছে থেকে দূরে সরে থাকতে পারল না। পৃথিবীতে যে নিজের বলতে এই বোনটাই আছে। বোনটা ছাড়া সবকিছুই যে রঙিন ফানুস।
ওয়াহাজ বোনের হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,” ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলে কি কষ্ট একটু কমবে? আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার বোনের যদি কষ্ট কমে তাহলে আমি আমার বোনকে আমার বুক থেকে মাথাটা তুলতেই দেব না। ”
বেলা আর দেরি না করে ভাইকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কান্না করে ওঠে। কান্না করতে করতে বলে,” নারী হয়ে শুধু নিজের পুরুষকেই চিনতে পারলাম না। নিজের মানুষগুলো গিরগিটির মতো রঙ পালটায় সুযোগ পেলেই তাছাড়া কে কোন নজরে নারীর দিকে তাকালো সেটাও নারী একবার দেখেই বুঝতে পারে। আমি এই বাড়িতে কারোর চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখছি না, সবাই এখন স্বার্থান্ধ।”
ওয়াহাজ বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,” তোমার আর কোন নিজের মানুষ থাকতে হবে না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে প্রয়োজন নেই তোমার। আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার দেখাশোনা করতে। আপাতত তুমি এই সম্পর্ক থেকে বের হবে আর কোন সম্পর্ক যেন তোমাকে আকর্ষণ না করে সে বিষয়টা আমলে রাখবে। তোমার ভুলে গেলে চলবে না, তুমি ওয়াজিহা। তোমার দায়িত্ব অনেক আর এখন থেকে বেলার অস্তিত্ব মুছে ফেলে ওয়াজিহা হয়ে উঠতে হবে। ”
বেলা তার ভাইয়ের থেকে আলাদা হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চোখ মুছতে মুছতে বলে,” আমি আর কোনকিছুতে জড়াবো না, ভাইয়া। আমার এই দুনিয়াটাই অসহ্য লাগছে। আমি তাইমুম স্যারকে বলে দেব, আমি আর জব করব না।”
ওয়াহাজ বেলাকে হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায়। বেলার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,” এতকিছুর পর,এভাবে ঠকে গিয়ে একবারও মনে হচ্ছে না এসব বন্ধ করা উচিৎ? আম্মার থেকে শিক্ষা হয়নি? আমাদের শৈশব নষ্ট হয়েছে ওয়াজিহা। আমাদের এই ছোটো প্রচেষ্টাকে সফল করতেই আমি তোমার কোনো ‘না’ শুনব না, ওয়াজিহা।”
” ভাইয়া….”
” উহু, আর কোনো কথা না। তুমি তৈরি আমার সাথে যাওয়ার জন্য? আসার সময় বাহিরে মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল।”
” এখানকার পাঠ চুকিয়ে চলে তো যেতেই হবে ভাইয়া। যেখানে আমি এখন অপশন সেখানে একটারাতও না।”
দুই ভাইবোনের কথা চলছিল এমন সময় দরজার বাহিরে কয়েক জনের গলা শুনতে পায় বেলা। দরজা হাট করে খুলে প্রায় পঁচিশ বছর বয়সী এক মেয়ে কান্না করতে করতে ঘরে প্রবেশ করে। পরনে পুরাতন শাড়ি, আঁচলের কিছু অংশ মাথায় তবুও সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো পড়ে যাবে। মেয়েটার সাথে সাথে কয়েকজন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
মেয়েটি চোখের পানি মুছে বেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” ভাবি, দয়া করে আমার স্বামীকে বাঁচান৷ উনাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে৷”
ওয়াহাজ মেয়েটার কান্না দেখে বেলাকে বলে ওঠে,” কী হয়েছে ওয়াজিহা? উনি কে? তুমি উনার স্বামীকে বাঁচাবে মানে?”
বেলা কিছু বলছে না। সে যা সঠিক মনে করেছিল সেটাই করেছে৷ এত বড়ো অ*ন্যায়ের পর পুলিশের হাতে না দেয়া তখন বোকামি মনে হয়েছিল।
বেলাকে চুপ থাকতে দেখে ওয়াহাজ সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে,” কী হয়েছে বলুন তো?”
মেয়েটা নাক টেনে ওয়াহাজের দিকে তাকায়। বলে,” আমার স্বামী জাওয়াদ। ভাবির কাছে এসেছিল, ভাবি ভুল বুঝে নাকি ওকে মা*রধর করেছে আবার পুলিশকেও বলেছে। পুলিশ কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসে উনাকে নিয়ে গেল, উনি অসুস্থ হয়ে গেছেন তাও নিয়ে গেল।”
বেলা এবার বলে ওঠে,” আমার যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটা আমি করেছি। আজ আমি নরম হলে আমার কী অবস্থা হতো সেটা একবারও ভেবে দেখেছেন? আমি মেয়ে মানুষ বলে কি হাতের পুতুল ভাববে নাকি? আর আপনি কেমন স্ত্রী বলুন তো? আপনার স্বামী অন্য নারীর ঘরে ঢুকেছিল তার সর্ব*নাশ করতে সেই নারী যখন তার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে এখন এসেছেন তাকে বাঁচাতে?”
ওয়াহাজ বেলার কথা শুনে চকিতে বলে ওঠে,” তুমি তার বিরুদ্ধে পুলিশকে জানিয়েছ?”
বেলা নরমস্বরে বলে,” হ্যাঁ ভাইয়া, আমি আমার সাথে হওয়া অন্যা*য়ের মাফ কিছুতেই করব না, আপোষ কিছুতেই করব না। আমার দিকে ইট ছুড়*লে, পাটকেল খেতেই হবে।”
ওয়াহাজ অদ্ভুত আওয়াজ করে সহাস্য বলে ওঠে,” গুউউড!”
#চলবে……