#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৪
বেলা রিমির গালে আবারও থাপ্পড় দেয়ার ভয় দেখিয়ে বলে,” আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে দেখো। তোমার ভাই বউ রেখে আরেকটা বিয়ে করেছে সেদিকে দেখো, যেখানে কিছু নেই সেখানেই দ্বিতীয়বার কাদা ছুড়াছুঁড়ি করবে না। চলে যাওয়ার আগে পি*টিয়ে সোজা করে দিয়ে যাব বলে দিলাম। যাও রুম থেকে বেরোও। নোংরা মস্তিষ্ক নিয়ে একদম আমার সামনে আসবে না। আমার ব্যাপারে যদি মানুষের সামনে আবার নাক গলিয়েছ নাকের বদলে গলা কে**টে রেখ দেব। আমাকে তুমি এখনো চেনোনি। নতুন ভাবির খাতির যাত্ন কর যাও। যাও, বেরোও। ”
” তোমার খারাপ সময় শুরু হয়েছে। অপেক্ষা করো শুধু। তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তারপর আমার শান্তি হবে।”
” বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সুযোগ পাবে না। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার যোগ্যতাও তোমার নেই। আমি নিজেই চলে যাব। এই কারা*গারে থাকার একটু ইচ্ছেও আমার নেই৷ ”
রিমি আর কোন কথা না বলে মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। বেলার এসবে হয়তো খারাপ লাগার কথা তবু মোটেও খারাপ লাগছে না তার। যেখানে তার বর নিজেই সবচেয়ে খারাপটুকু করে ফেলেছে সেখানে পৃথিবীর সবাই যত খারাপই করুক না কেন সেটা বেলার কাছে তুচ্ছ। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে। পাঁচটা বছর সবকিছু মেনে নিয়ে যার সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখলো সেই মানুষটা এত বাজেভাবে ঠকাল! অন্যকাউকে ভালো লেগে গেলে বুঝি বিবেক হারিয়ে ফেলে মানুষ!
**
রিমি নিজের রুমে গিয়ে দেখে লিলি একা একা রুমে বসে আছে। হাতে ফোন নিয়ে হয়তো ফেসবুক স্ক্রোল করছে। রিমিকে দেখেই ফোনটা বিছানায় রেখে তার কাছে আসতে বলে। রিমি গিয়ে বিছানায় লিলির পাশে বসে।
স্মিত হেসে বলে,” আপনার সাথে কথাই হলো না ভাবি। ”
লিলি হেসে বলে,” এই যে এখন গল্প করব। তোমার নাম তো রিমি, তাই না? তোমার ভাইয়া তোমার কথা অনেক বলে। তুমি আমার সাথে তুমি করেই বলতে পারো।”
” ভাইয়া আমার কথা বলেছে!”
নড়েচড়ে বসে রিমি। আগের মতোই হেসে জিজ্ঞেস করে,” আচ্ছা তোমাদের সম্পর্কটা হলো কীভাবে বলো তো? ভাইয়া যে বিয়ে করেছে সেটা আমরা কেউই জানি না। আমাদের পাশের বাসায় এক মেয়ে আছে, নাম সুমু। সুমু ঢাকায় পড়াশোনা করে। তোমাদের সে-ই দেখেছিল, বাসায় এসে জানিয়েছে। ”
লিলি বেশ আগ্রহের সাথে বলে,” তোমার ভাইয়া আর আমি এক জায়গাতেই জব করতাম। ওখান থেকেই ভালো লাগা আর তারপর ভালোবাসা। আমরা বিয়ে করেছি বছর খানেক হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল তারপর ওর দেশে আসার কথা শুনে আমিও চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। আর কত দিন বিদেশে থাকব? ভাবলাম এবার আমি একটু সংসারে মন দিই। মাস খানেক আগে জানতে পেরেছি তোমার ভাইয়া আগে থেকে বিবাহিত ছিল মানে আমি তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। তোমার ভাইয়ার সাথে খুব ঝামেলা হয়েছে কিছুদিন তারপর ভেবে দেখলাম প্রথম বউ নিয়ে সে হয়তো সুখী না তাই আমাকে বিয়ে করেছে। ডিভোর্স দিতে বলার পর বলল সে নাকি ফোনে তালাক দিয়েছে কয়েকজনকে সাক্ষী রেখে অথচ এখানে এসে অন্য ঘটনা দেখছি। ”
” দোয়া করি তোমরা দুজন সব বাধা পেরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এক হও।”
রিমি কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলে ওঠে,” আমার চিন্তা হচ্ছে, ওই মেয়ে যদি এ বাড়ি না ছাড়ে? তোমাদের যদি এক না হতে দেয়? ওকে আমার একটুও পছন্দ না, সবসময় টাকার গরম। কথায় কী বিশ্রী তেজ! আমি তোমাদের বিয়েতে খুশি হয়েছি দেখে আমাকে সকালে থা*প্পড় দিয়েছে। ”
লিলি অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,” কী! তোমার গায়ে হাত তুলেছে? কিছু বলতে পারলে না? আমি হলে ওই হাত ভেঙে গুড়িয়ে দিতাম।”
” তোমার মতো হতে পারলে বেশ হতো। আচ্ছা শোনো, ভাইয়া কোথায়? ওর যাওয়ার ব্যবস্থা কেন করছে না?”
লিলি বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলে,” তোমার কি মনে হয় আমি শুধু শুধু এখানে বসে আছি? তোমার ভাই টাকার ব্যবস্থা করতে গেছে, লোকও আজই ডাকবে। আজই সব ঝামেলা শেষ করব আমি। আচ্ছা একটা কথা…”
” হ্যাঁ বলো।”
” তোমার ভাইয়া যে তার প্রথম বউয়ের থেকে টাকা নিয়েছে সেটা কেউ জানে? প্রমাণ না থাকলে শুধু কাবিনের টাকা দিয়েই বিদায় করা যেত।”
রিমি মুখ কালো করে বলে,” এটাই তো হবে না ভাবি। ওই বহুত চালাক। টাকা দিয়ে ভাইয়া, আম্মা, আরও কয়েকজনকে দিয়ে সাক্ষী রেখে সিগনেচার করিয়ে নিয়েছে স্ট্যাম্পপেপারে। ”
রিমি ঠোঁট প্রশস্ত করে বলে,” উমমম হাড়ে হাড়ে বুদ্ধি দেখছি। আচ্ছা, তোমার ভাইয়াকে বারো লাখ টাকা দিয়েছে, এত টাকা ও কোথায় পেয়েছে? মানে ওর বাপের বাড়িতে কে কে আছে?”
” বাড়ি আবার আছে নাকি? আছে একটা সৎভাই। মা বেঁচে থাকতে বাপ আরেকটা বিয়ে করে সেই পক্ষের ছেলেটাই তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে থাকে। সৎভাইয়ের চার পাঁচ বছরের ছোটো। বিয়ের পর দুই একবার ওই বাড়িতে গিয়েছে তারপর আর যায়নি। ভাইয়ের বউ পছন্দ করে না।”
লিলি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,” মা মা*রা গেছে? বাপ কোথায়?”
” এই মহিলা ছোটো থাকতেই মা ম*রে গেছে। বিয়ের আগে বাপটাও মর*ছে। সৎমা অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে। ”
” নিজের আর কোন ভাই-বোন নাই?”
” সঠিক জানি না। এসব নিয়ে তেমন কিছু শুনিনি। একবার বোধ হয় শুনেছিলাম তার একটা ভাই আছে, কোথায় আছে কেউ জানে না। ধরতে গেলে তার কেউই নেই। ওহ হ্যাঁ, ভাইয়ের কথা বলেছিল, দেশে থাকে না হয়তো। ছবি দেখেছিলাম একবার।”
” ওহ আচ্ছা।”
লিলি নিজের ব্যাগ থেকে কিছু নিত্যব্যবহার্য জিনিস বের করে রিমিকে দিয়ে বলে,” এগুলো তোমার জন্য নিয়ে এসেছি আমি৷ আর শোনো আম্মার জন্যও এনেছি। আম্মা কি নেবে কোন জিনিস আমার থেকে?”
” নেবে না মানে? অবশ্যই নেবে। আম্মাও ঠিক বুঝতে পারছে এতক্ষণে তার ছেলের বড়ো বউ কী জিনিস!”
রিমি জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখে আন্তরিকতার সঙ্গে বলে,” ধন্যবাদ নতুন ভাবি। আর শোনো একদম চিন্তা করিও না আমি সর্বদা তোমার দলে।”
লিলি গিয়ে রিমির দুইহাত ধরে মৃদু গলায় বলে, ” আমার পাশে তো থাকতেই হবে। আমি বলে কথা!”
দুজনে একসঙ্গে হেসে ওঠে।
****
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বেলা মাগরিবের নামাজ আদায় করে কুরআন পড়ছে অনেকক্ষণ। সে বিকেল থেকেই নিজের ঘরে ছিল, এক মুহুর্তের জন্য আর নিজের রুম থেকে বের হয়নি।
কুরআন আর জায়নামাজ তুলে রেখে ফোনটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে সূরা আর রাহমান তিলাওয়াত শুনতে থাকে। চোখ জ্ব*লছে তার, দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে কানের কাছে গেলেই সেটা মুছে ফেলে। নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও যেন ব্যর্থ হওয়ার পথে সে। স্বামী প্রথম বউ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, প্রথম বউয়ের সামনের ঘরেই দ্বিতীয় বউয়ের অবস্থান। বাড়ির মানুষগুলো সেখানেই আড্ডা জমিয়েছে এতকিছু হয়তো কোন মেয়ের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব কোন ব্যাপার না।
কারো উপস্থিতি টের পায় বেলা, ঘরের দরজায় শব্দ হতেই চোখ মুছে সেদিকে তাকায়। ঘরে পুরুষ মানুষের উপস্থিতি এ সময়ে অবাক করে দেয় বেলাকে।
লোকটা ঘরের দরজা আস্তে করে বন্ধ করে দিতেই বেলা তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। ভ্রুযুগোল প্রসারিত করে বলে,” আপনি এখানে! দরজা আটকাচ্ছেন কেন? দরজা খুলুন।”
লোকটা দুইহাত সামনের দিকে বাড়িয়ে বেলার সামনে এগিয়ে আসে। বলে,” প্লিজ ভাবি চিৎকার করবেন না। আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।”
” একটা মেয়ে রুমে একা আছে, সেখানে এসে দরজা বন্ধ করে আপনি কী বলতে এসেছেন? বলদ লাগে আমারে? দরজা খুলেন বলছি।”
” ভাবি, ভাবি প্লিজ আমার কথাটা শুনেন৷ আপনার তো ডিভোর্স হয়েই যাচ্ছে শুনলাম। আমি আপনাকে অনেক পছন্দ করি সেটা তো জানেনই। এবার তো আমার আর আপনার মাঝে কোন বাধা নাই। আগে আমারে মানেন নাই ঠিক আছে কিন্তু এখন তো মানতেই পারেন, তাই না?”
” বে*শ্যা লাগে আমারে? দরজা খুলবি নাকি আমার অন্যরূপ দেখাব আমি? আমার শরীরে কালো দাগ লাগাতে এসেছিস, না? কে পাঠিয়েছে তোকে? ধ্রুব তাই না? টাকা দেয়ার ভয়ে এতকিছু! ওরে তো আমি দেখে নিচ্ছি। তুই আগে রুম থেকে বের হ’।”
লোকটা বেলার দিকে এগুতে শুরু করলে বেলা সাথে সাথে তার হাটুতে লা*ত্থি দিতেই লোকটা মেঝেতে বসে পড়ে। বেলা সাথে সাথে বিছানার নিচে থেকে ধাঁরালো একটা ছু*ড়ি বের করে সেই লোকের দিকে তাক করে বলে,” এই ওয়াজিহাকে সস্তা কোন মেয়ে ভেবে ভুল করেছিস। আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো সস্তা কেউ নই৷ তোকে যদি আমি এখন খু*নও করি কোন আদালত আমার একটা চুলও ছিড়তে পারবে না। এখন উঠে গিয়ে দরজা খুলবি। আর তোকে এখানে কে পাঠিয়েছে বল। না বললে এটা একদম গলায় বসিয়ে দেব আল্লাহর কসম।”
লোকটা দাঁড়িয়ে বেলার কথার জবাবে বলে,” হ্যাঁ, পাঠিয়েছে কেউ কিন্তু আমি আমার কাজ শেষ না করে এখান থেকে যাচ্ছি না। টাকা তো উশুল করে নিতে হবে তাই না? আপনার কি মনে হয় আপনার এই ফাঁকা আওয়াজে আমি ভয় পেয়ে যাব? হুহ! মেয়ে মানুষ হলো নরম মোমের পুতুল, ধরতেই গলে পড়ে যাবে। ”
” ভুল করছিস জাওয়াদ। আমাকে আমার দ্বিতীয় রূপে আসতে বাধ্য করিস না৷ আমি যদি শা*স্তি দেয়া শুরু করি তাহলে সবকিছু ধ্বং*স করে দেব বলে দিলাম।”
জাওয়াদ বেলার কথায় পাত্তা না দিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বেলার দিকে এগুতে থাকে৷ বেলার হাতে স্পর্শ করতেই বেলা তড়িৎ গতিতে জাওয়াদের হাতে ছু*ড়ি বসিয়ে দেয়। জাওয়াদের অ*ন্ড*কো*ষ বরাবর লা*ত্থি দিতেই সে একটা জোরে চিৎকার দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। বেলা গিয়ে দরজা খুলে জাওয়াদের শার্টের কলার ধরে টেনে হিচড়ে বাহিরে নিয়ে এসে এক নাগাড়ে পেটে, বুকে, হাটুতে, পায়ের পাতায় আ*ঘাত করতে থাকে আর চিৎকার করে করে ধ্রুবকে ডাকতে থাকে।
চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে,” আমাকে সহজভাবে নিয়ে খুব বড় ভুল করে ফেললি তোরা, এবার দেখতে থাক এই ওয়াজিহা কী কী করতে পারে।”
#চলবে….