মেঘ বলেছে যাব যাব পর্ব-২২+২৩+২৪

0
5
মেঘ বলেছে যাব যাব হুমায়ূন আহমেদ

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব(পর্ব :২২)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

রীনা ভালো আছে কি না তা সে এখনো বুঝতে পারছে না। দিনের বেলায় সে বেশ ভালোই তাকে। দিনটা শুরু হয় ব্যস্ততার ভেতর শেষও হয় ব্যস্ততার ভেতর। সন্ধ্যার পর থেকে কিছু করার থাকে না। বুকে হাঁপ ধরার মতো হয়। সে বসে থাকে টিভির সামানে। টিভিতে ক্ৰমাগত হিন্দি গানের নাচ হতে থাকে। নাচের মুদ্রা কুৎসিত। নাচের সঙ্গে যে গান হয়। সেই গানের সুর একই রকম। তারপরেও নাচ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। কারণ গৃহকর্তা মনসুর সাহেব এই অনুষ্ঠানটাই দেখেন। রীনা এ বাড়িতে আছে আশ্ৰিতের মতো। একজন আশ্ৰিতের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতে পারে না।

শ্যামলী রিং রোডের এই বাড়ি রানার বান্ধবী আফরোজার। আফরোজা রীনার সঙ্গে এক সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। পাস করার পর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। দশ বছর পর আবার যোগাযোগ হয়েছে। কাকতলীয়ভাবেই হয়েছে। আফরোজা স্কুলে থাকতেও হড়বড় করে কথা বলত–এখনো হড়বড় করেই বলে। সে রীনাকে জড়িয়ে ধরে হড়বড় করে যে কথা বলল তা হচ্ছে–তুই পাগলির মতো এইসব কী বলছিস? স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিস। চাকরি খুঁজছিস। আমি তোর জন্যে চাকরি কোথায় পাব? কাকে আমি চিনি? তবে চাকরি দিতে না পারলেও তোকে থাকতে দিতে পারব। চলে আয় আমার বাড়িতে। রিং রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। চার বেডরুমের ফ্ল্যাট। একটা গেষ্টরুম খালি পড়ে থাকে। ওইখানে থাকবি।

রীনা বলল, তোর হাসবেন্ড কিছু বলবে না?

কিছুই বলবে না। আমার হাসবেন্ড হচ্ছে টবের গাছের মতো। কথাবার্তা কিছুই বলে না। সন্ধ্যাবেলা টিভির সামনে বসে। মাঝখানে একবার ভাত খাওয়ার জন্যে ওঠে। বারটা বাজলে ঘুমোতে যায়।

উনি করেন কী?

ব্যবসা পাতি করে। কী ব্যবসা তাও জানি না। ও কী করে না করে তা নিয়ে ভাবতে হবে না–তুই আয় তো। কথা-বালিশ নিয়ে উঠে আয়।

রীনা রিং রোডে আফরোজার ফ্ল্যাটবাড়িতে গিয়ে উঠল। সুন্দর গোছানো ফ্ল্যাট। দামি হোটেলের মতো সব কিছু ঝকঝকি করছে। যে গেষ্টরুমে রীনাকে থাকতে দেয়া হয়েছে সেখানেও এসি আছে। মেঝেতে দামি কাপেট। আফরোজা বলল, গরম লাগলে এসি ছাড়বি। কোনো রকম কিন্টামি করবি না। নিজের বাড়ি মনে করে থাকবি। পরের বাড়িতে আছিস বলেই যে কিছু কর্ম করবি–চা বানাবি, রান্না করবি তাও না। তিনটা কাজের মানুষ। কাজ না করে করে ওদের হাতে পায়ে জং ধরে গেছে। রীনা বলল, তোর ছেলেপুলে কী?

ছেলেপুলে কিছু নেই। আমার নাকি কী সব সমস্যা আছে। ও বলছিল টেসটিউব বেবি নিতে। শুনেই আমার ঘেন্না লাগল। টেস্টটিউব অদল বদল হয়ে যাবে–কার না কার দিয়ে দেবে। ছিঃ। তারপরও কোলকাতা গিয়ে দু’মাস ছিলাম। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে–ডাক্তাররা খোঁচাখুঁচি করে যন্ত্রণার চূড়ান্ত করেছে। বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া আমি ভালোই আছি। পালক নেবার কথা মাঝে মাঝে ভাবি। দেখা যাক। আমার এত গরজ নেই।

আফরোজার স্বামীর নাম নুরউদ্দিন। থলথলে ধরনের শরীর। দেখেই মনে হয় এই মানুষটার জন্ম হয়েছে আরাম করার জন্যে। ফ্ল্যাটে যখন থাকে বেশিরভাগ সময় চেয়ারে পা তুলে বসেই থাকে। হয় খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকে নয়তো টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাঁটা চলা করতে মনে হয় কষ্ট হয়।

আফরোজা রীনাকে তার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল-এ হচ্ছে স্কুল জীবনে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড–রীনা। রীনা আমাদের ফ্ল্যাটে কিছুদিন থাকবে। কতদিন এটা বোঝা যাচ্ছে না। মাসখানেকও হতে পারে-আবার বছরখানেকও হতে পারে। বুঝতে পারছি?

নুরুউদ্দিন বলল, হুঁ।

আফরোজা বলল, রানার দিকে তাকিয়ে হুঁ বল। অন্য দিকে তাকিয়ে ই বলছি কেন? আরেকটা কথা শোন–তুমি তোমার পরিচিত সবাইকে বলে দেবে রীনার জন্যে যেন একটা চাকরির খোঁজ করে। ও বি.এ. পাস করেছে। সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। অতি সুইট মেয়ে।

আচ্ছা।

বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর সঙ্গে দুটা কথা বল। ভদ্রতাও তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? বেচারি মনে করবে কী?

নুরউদ্দিন রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

আফরোজা বিরক্ত গলায় বলল, ভাবি ডাকছ কেন? তুমি নাম ধরে ডাকবে। বয়সে তুমি আমার দশ বছরের বড়। রীনার চেয়েও দশ বছরের বড়। নাম ধরে ডাকবে কোনো অসুবিধা নেই।

আচ্ছা।

ওর নাম কী জান?

না।

ওর নাম রীনা।

ও আচ্ছা রীনা।

তুমি রীনার জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করে দেবে।

আচ্ছা।

রীনা লক্ষ করল মানুষটা আসলেই টবের গাছের মতো। ফ্ল্যাটে যখন থাকে বসে বসেই সময় কাটিয়ে দেয়। নিজের কথা বলে না। অন্যের কথা শোনার আগ্রহও তার নেই। মাঝে মাঝে রীনার মনে হয়–আফরোজা যে তাকে ফ্ল্যাটবাড়িতে এনে তুলেছে। সে তার নিজের গরজেই এনে তুলেছে। আফরোজার কথা বলার মানুষ দরকার। মুখ সেলাই করে দুজন মানুষ দিনের পর দিন পাশাপাশি বাস করতে পারে না। রীনার মাঝে মাঝেই মনে হয়-সংসারে ছেলেপুলে থাকাটা যে কত দরকার তা মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর জন্যে আল্লাহ এই সংসারটা তৈরি করেছেন।

তবে কথা না বললেও রীনার নুরউদ্দিনকে পছন্দ হয়েছে। পুরুষদের স্বভাবই হচ্ছে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে আশপাশের মেয়েদের শরীরেব ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়া। এই মানুষটি তা থেকে মুক্ত। তার ভদ্রতাবোধও ভালো। মানুষটা টিভি সেটের সামনে বসে থাকে খালি গায়ে। রটনা ঘরে এলে পাশে খুলে রাখা পাঞ্জাবিটা চট করে গায়ে দেয়। রীনা বলেছে-আপনার যদি খালি গায়ে থাকতে আরাম লাগে আপনি সেইভাবে থাকুন। আমি কিছু মনে করব না। নুরুউদ্দিন খালি গা হয় নি। তাছাড়া রীনাকে সে রীনা নামেও ডাকছে না। ভাবিই ডাকছে। এটিও রীনার পছন্দ হয়েছে। বান্ধবীর স্বামী তাকে নাম ধরে ডাকবে এটা ভাবতে তার ভালো লাগে না।

নুরুউদিনের যে ব্যাপারটা রীনার খারাপ লাগে তা হচ্ছে ভদ্রলোকের মদ্যপানের অভ্যাস আছে। সবদিন না–মাঝে মাঝে। প্রথম দিন মদ্যপানের দৃশ্য দেখে আতঙ্কে রীনার হাতপা নীল হয়ে যাবার উপক্রম হলো। মদ্যপানের ব্যাপােটা বড় বড় হোটেলে হয়, এবং অপরিচিত লোেকরা মদ্যপান করে—এই ছিল তার ধারণা। পরিচিত একজন মানুষ চেয়ারে পা তুলে মদ খাবে এই দৃশ্য রানার কল্পনাতেও ছিল না। আফরোজা এই দৃশ্য দেখেও কিছু বলছে না। এতেই বীনা খুব অবাক হচ্ছে। সে বলেই ফেলল, আফরোজা তুই কিছু বলছিস না?

আফরোজা বলল, কী বলব?

উনি যে ড্রিংক করছেন।

বদ অভ্যাস করে ফেলেছে, বলে কী হবে। শুরুতে বলেছি কাজ হয় নি–এখন আর বলি-টালি না। তাছাড়া কোনো সমস্যা করে না। নিজের মনে খায়। মদে। ওর কিছু হয় না। টাল না হয়ে পুরো এক বোতল ভদকা সে খেতে পারে।

টাল না হয়ে মানে কী?

টাল হলো–মাতাল। মদভর্তি চৌবাচ্চায়। ওকে ডুবিয়ে দে ও চৌবাচ্চার সব মদ খেয়ে বের হয়ে এসে বলবে–ভাত দাও। ক্ষিধে হয়েছে।

কী আছে। এর মধ্যে যে উনি এত আগ্রহ করে খাচ্ছেন?

কিছুই নেই। তিতকুট একটা জিনিস, খেলে মাথা ঘোরে।

তুই খেয়ে দেখেছিস?

হুঁ। একবার রাগ করে খেয়েছিলাম–অতি অতি অতি কুৎসিত। তুই একবার খেয়ে দেখিস।

সর্বনাশ!

সর্বনাশের আবার কী? ছেলেরা খেতে পারলে আমাদের খেতে অসুবিধা কী।

মদ্যপানের পর নুরউদ্দিনের তেমন কোনো পরিবর্তন রীনার চোখে পড়ে নি। শুধু একটা পরিবর্তন হয়–টুকটাক দু-একটা কথা বলে। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। যেমন একদিন রীনা বলল, আপনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচ দেখেন আপনার ভালো লাগে?

নুরউদ্দিন গ্লাসে হালকা চুমুক দিয়ে বলল, না। মনে হয় একদল ছেলেমেয়ে পিটি করছে।

ভালো লাগে না তো দেখেন কেন?

কিছু করার নেই। এইজন্যে দেখি। দেখিও ঠিক না, তাকিয়ে থাকা আর দেখা এক না।

গল্পের বইটই আপনি পড়েন না?

কলেজ জীবনে দু-একটা পড়েছি। এখন আর পড়ি না।

পড়েন না কেন?

সব বই তো একই রকম–একটা পড়লেই সব পড়া হয়। একটা ছেলে থাকবে, একটা মেয়ে থাকবে। তাদের প্রেম হবে। তারপর হয় তাদের বিয়ে হবে নয়। বিয়ে হবে না। এই তো ব্যাপার।

আপনার বন্ধুবান্ধব খুব কম?

হুঁ। বন্ধু কম, শক্রও কম। যাদের বন্ধু বেশি তাদের শত্ৰুও বেশি! যাদের কোনো বন্ধু নেই, তাদের কোনো শক্ৰও নেই।

রীনার চাকরি নুরউদ্দিনই যোগাড় করে দিল। এক কথায়— মাসে ছ হাজার টাকা বেতনের চাকরি তো সহজ ব্যাপার না। রীনার বিস্ময়ের সীমা রইল না। যে লোকটার প্রধান কাজ সন্ধার পর থেকে টিভির সামনে বসে মদ্যপান করা সে এক কথায় চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে এটা রীনা ভাবে নি। হাসান বছরের পর বছর ঘুরে চাকুরি পায় নি। তার সে দশ দিনের মাথায় চাকরি পেয়ে গেল। থলথলে শরীরে খালি গায়ে মানুষটার ক্ষমতা অবশ্যই আছে।

চাকরি রীনার ভালো লাগছে। সুন্দর ছিমছাম অফিস। ভালো ব্যবসা হচ্ছে। অফিসের লোকজনদের মুখ দেখেই তা বোঝা যায়। সবার ভেতরই ব্যস্ততা। রীনার বসকেও তার পছন্দ হয়েছে। স্মার্ট মানুষ। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। টকটকে লাল গেঞ্জি গায়ে দিয়ে একদিন অফিসে এসেছিলেন। তাকে পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েসী। যুবকের মতো লাগছিল। ভদ্রলোকের কথাবার্তা মার্জিত। অফিসের বসরা সব সময় গোমড়া মুখে থাকেন। ভদ্রলোকের মুখে গোমড়া না–কথায় কথায় রসিকতা করেন। রসিকতা যখন করেন–এমন গভীর ভঙ্গিতে করেন যে প্রথম কিছুক্ষণ বোঝাই যায় না–রসিকতা।

প্রথম দিন রীনা তার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দরজায় পেতলের দুটা অক্ষর A.H. –আজিজুর হকের আদ্যক্ষর। নামের বদলে কেউ শুধু আদ্যক্ষর দরজায় লাগিয়ে রাখতে পারে রীনা ভাবে নি। সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ভদ্রলোক বললেন, রীনা কী খবর?

রীনা বলল, জ্বি স্যার ভালো।

কাজ বুঝে নিয়েছেন?

জ্বি।

আপনার কাজটা কী বলুন তো?

রীনা হকচাকিয়ে গেল। তাকে রিসিপশনে বসতে বলা হয়েছে। এর বেশিকিছু বলা হয় নি। ভদ্রলোককে সেটা বলা কি ঠিক হবে? রীনা ইতস্তত করতে লাগল। হক সাহেব বললেন, ওরা আপনাকে কী করতে বলেছে, আমি জানি না। আপনার প্রধান কাজ হচ্ছে রোজ একবার এসে আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ হাসিমুখে গল্প করা। অফিসের বেশিরভাগ মানুষ গোমড়া মুখে বসে থাকে। আমার অসহ্য লাগে।

রীনা খানিকটা হকচাকিয়ে গেল। ভদ্রলোকের এ জাতীয় কথা বলার মানে কী? মেয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে অফিস বসদের নানান ধরনের গল্প শোনা যায়। এর রকমই কি? উনি কি অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছেন?

রীনা।

জ্বি।

আমার কথা শুনে মোটেই ঘাবড়াবেন না। রসিকতা করছি। তবে আমি সত্যি সতি্যু হাসিমুখ দেখতে পছন্দ করি। নকল হাসিতেও আমার আপত্তি নেই। সত্যি কান্নার চেয়েও নকল হাসি আমার কাছে অনেক ভালো। ঠিকমতো কাজ শিখুন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি–মেয়েরা যখন অফিসে কাজ করতে আসে তখন তারা হয় দারুণ কাজের হয়, নয়তো নিতান্তই অকাজের হয়। মাঝামাঝি কিছু মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না, শুধু পুরুষদের মধ্যেই দেখা যায়। আমি কর্মী মহিলা চাই। গল্পবাজ মহিলা না যাদের প্রধান কাজ ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে লিপষ্টিক বের করে ঠোঁটে ঘষা। প্রথম দিনে অনেক কথা বলে ফেললাম—আর না।

রীনা প্ৰথম কাজ শুরু করেছিল রিসিপশনে–এখন তাকে দেয়া হয়েছে ফরেন করেসপনডেন্স ডেস্কে। যে বুড়ো ভদ্রলোকের কাছে তাকে কাজ শিখতে হচ্ছে তিনি খিটখিটে এবং বদমেজাজি। কথায় কথায় তিনি রীনাকে ধমক দেন। তবে প্ৰায় প্রতিদিনই বলেন–তোমার মাথা পরিষ্কার। অন্যরা যে কাজ এক বছরে শিখেছে তুমি তা শিখেছ এক মাসে।

এই জাতীয় কথা শুনতে আনন্দ লাগে। বুড়ো ভদ্রলোক রীনাকে শুধু যে আনন্দ দেবার জন্যে এই কথাগুলো বলছেন–তা যে না, রীনা নিজেও তা বুঝতে পারে। কাজ করতে তার ভালো লাগে। হক সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে একদিন বললেন, আপনার কাজের খুব সুনাম শুনি। আপনি স্পোকেন ইংরেজি কেমন জানেন?

রীনা বলল, ভালো জানি না স্যার।

ভিসিআরে বেশি বেশি ইংরেজি ছবি দেখে স্পোকেন ইংলিশ বানিয়ে নিন। আপনাকে আমরা আমাদের লন্ডন অফিসে পাঠিয়ে দেব। দেশের বাইরে যেতে আপত্তি নেই তো?

জ্বি না স্যার।

আপনার পারিবারিক আনফরচুনেট অবস্থার কথা আমাকে বলা হয়েছে। পারিবারিক বিধিনিষেধ নেই তো?

জ্বি না।

ভালো করে ভেবে বলুন। সব ঠিকঠাক করে আপনার বাইরে যাবার ব্যবস্থা হলো হলো–তারপর আপনি বেঁকে বসলেন বা আপনার স্বামী বেঁকে বসলেন। এমন হবে না।

জ্বি না।

হুট করে কিছু বলতে হবে না। আপনি সপ্তাহখানিক ভাবুন। তারপর বলুন।

রীনা এক সপ্তাহ ভেবেছে। কখনো তার কাছে মনে হয়েছে–না সম্ভব না। দেশে সে আছে বলেই অন্তত সপ্তাহে একবার সে টগর-পলাশকে দেখতে পারছে। আবার কখনো মনে হয়েছে–সব ছেড়েছুড়ে দূরে চলে যেতে। একবার মনে হলো তারেক যদি শোনে সে লণ্ডন চলে যাচ্ছে তাহলে সে কী বলবে? টেলিফোনে আলাপ করবে না সরাসরি তার অফিসে চলে যাবে? অফিসে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তারেক যদি ভাবে সে আসলে এসেছে ঘরে ফিরে যেতে? ভাবলে ভাবুক। যদি সে সত্যি সত্যি লন্ডনে চলে যায়–যাবার আগে একবার দেখা করাও তো উচিত।

বুধবার দুপুরবেলা রীনা তারেকের অফিসে উপস্থিত হলো। তারেক লাঞ্চ সেরে পান চিবোচ্চিল, রীনাকে দেখে বিস্মিত-অবাক কিছুই হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, রীনা কী খবর?

রীনা বলল, ভালো।

আজ আমার ব্যাডলাক, সকালে এসে দেখ ফ্যান নষ্ট। সকাল থেকে গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। মিস্ত্ৰি আনতে লোক গেছে। এগারটার সময় গেছে–এখন দুটা। মিস্ত্রিও নেই, লোকও নেই। নো ম্যাংগো, নো গানিব্যাগ। আমিও নেই ছালাও নেই।

রীনা বলল, তুমি কেমন আছ?

ভালো।

বাসার খবর কী?

বাসার খবরও ভালো। পলাশ গতকাল রেলিঙের ওপর পড়ে একটা দাঁত ভেঙে ফেলেছে। রক্তটক্ত কিছু বের হয় নি। কট করে দাঁতের একটা কণা ভেঙে গেল।

তোমার চাকরি কেমন চলছে?

ভালো।

প্রথম প্ৰথম চাকরি খুব ভালো লাগে। কিছুদিন পর আর ভালো লাগে না। আমার তো রোজ সকালে অফিসে এসে একবার করে ইচ্ছা করে ফাইল টাইল সব জ্বলিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরি।

কোন দিকে হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে, চিটাগাঙের দিকে?

হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে এই পর্যন্তই। তুমি চা খাবে?

না।

পান খাবে? মিষ্টিজর্দা দেয়া পান আছে। দুপুরে খাবার পর একটা পান খেতে ভালো লাগে৷ পান হচ্ছে পিত্তনাশক এবং হজম সহায়ক।

রীনা অবাক হয়ে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। কী আশ্চৰ্য–দু’মাস পর দেখা–মানুষটা কত সহজেই না কথা বলছে। যেন কিছু যায় আসে না। রীনা বলল, আমাদের অফিসের একটা ব্ৰাঞ্চ আছে লন্ডনে। আমাকে খুব সম্ভব সেখানে পাঠাবে।

কবে?

জানি না কবে।

বেতন কত দেবে? দেশে যে বেতন দেবে বাইরে সে বেতন দিলে তো হবে না। ফরেন করেন্সিতে বেতন হওয়া উচিত।

উচিত হলে নিশ্চয়ই ফরেন কারেন্সিতে বেতন দেবে। তোমার ওই মেয়ের খবর কী?

লাবণীর কথা বলছ? ভালোই আছে। গত সপ্তাহে চিটাগাং গিয়েছিলাম–ওদের কক্সবাজার ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছি। লাবণীর মেয়েটা আগে সমুদ্র দেখে নি। এই প্ৰথম দেখল। খুব খুশি।

তুমি এইভাবে ঘোরাফেরা করছি লোকজনের চোখে লাগছে–তুমি মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেল না কেন?

তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, এক বউ থাকতে আরেক বউ ঘরে আনব কীভাবে?

আইনে বাধা আছে?

ইসলামি আইনে বাধা নেই–কিন্তু দেশে তো পুরোপুরি ইসলামী আইন নেই—

থাকলে তোমার সুবিধা হতো। তাই না?

তারেক সিগারেট ধরাল। রীনার কান্না পাচ্ছে। এখানে আসা তার উচিত হয় নি। মানুষটার সঙ্গে তার বাসায় চলে যেতে ইচ্ছা করছে। একবার যদি সে বলত–রীনা তুমি চল আমার সঙ্গে–সে নিশ্চয়ই যেত। রীনা ক্লান্ত গলায় বলল, যাই কেমন?

দাঁড়াও পিয়নকে সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। রিকশা ঠিক করে দেবে। দুপুরবেলায় রিকশা-বেবিট্যাক্সি কিছুই পাওয়া যায় না।

রীনা বলল, রিকশা লাগবে না।

অফিস থেকে বের হয়ে রীনার ইচ্ছা করল আবার তারেকের সঙ্গে দুটা কথা বলতে ওকে খুব রোগ লাগছে। ওর কি ঘুম হচ্ছে না?

পর্ব ২২ শেষ 📌

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব ২৩)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

আজ লায়লার বিয়ে।

দায়সারা টাইপ বিয়ে। বর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে। কয়েকজন আত্মীয়স্বজন থাকবে। কাজি সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। বিয়ে পড়ানো হবে। তারা কনে নিয়ে চলে যাবে। পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহর। এক লাখ উসুল।

এটা কী রকম বিয়ে? গায়ে হলুদ না, কিছু না। লায়লা ঠিক করে ফেলেছে দুপুরে সে পালিয়ে যাবে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করে নি। কল্যাণপুরে তার এক বন্ধবী থাকে। তাদের বাড়িতে ওঠা যায়। সেখানে টেলিফোন আছে। টেলিফোনে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।

বিয়ের দিনটা অন্যরকম থাকে। অথচ তার বিয়ের দিন অন্য দিনগুলোর চেয়ে মোটেও আলাদা না। সবকিছু আগের মতো শুধু টগর-পলাশ স্কুলে যাচ্ছে না। তারা বারান্দায় মহা উৎসাহে ফুটবল খেলছে।

তারেকও অফিসে যায় নি। সে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে ছেলেদের খেলা দেখছে। তারেক বলল, লায়লা আমাকে চা দে।

লায়লা চা বানাতে গেল। কমলার মা বলল, বিয়ার দিন চুলার ধারে যাইয়েন না আফা। ঘরে গিয়া টাইট হইয়া বইয়া থাকেন। চা আমি বানাইতেছি।

লায়লা তাকে ধমক দিয়েছে–বেশি কথা বলবে না। কমলার মা। এত কথা আমার ভালো লাগে না।

চা বানাতে গিয়ে লায়লার চোখে পানি এসে গেল। তার কত শখ ছিল অল্প বয়েসী, লম্বা পাতলা সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। যার সঙ্গে সে নানান ধরেনের আহ্লাদী করবে। আহ্লাদী করতে তার খুব ভালো লাগে। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তার সঙ্গে সে আহ্লাদী কী করবে? হেডমাস্টার চেহারার একজন মানুষ। আগে বিয়ে হয়েছে। সেই পক্ষের ছেলে আছে। কে জানে ছেলেও হয়তো বাবার বিয়েতে বরযাত্রী আসবে।

মানুষটার কথাবার্তাও গা জ্বালা ধরনের–শুনুন প্লেইন এন্ড সিম্পল বিয়ে হবে। কোনো অনুষ্ঠান না কিছু না। অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে আমি যেতে চাচ্ছি না।

তুই অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে যাবি কিরে গাধা? তোর একটুও চক্ষুলজ্জা নেই! দুদিন পরে পরে বিয়ে করছিস!

লায়লা তার বিয়ের খবর কাউকে জানায় নি। কোন লজয় জানাবে? সবাই হাসাহসি করবে না! হয়তো বলবে–গাছে না। উঠতেই এক কাদি? বিয়ের আগেই এত বড় ছেলে?

ভাইয়া চা নাও।

তারেক চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বল, মা-বাবা কেউ তো এখনো আসছে। না? মা বোধহয় রাগ করেই বসে আছে। আমাকে গিয়ে রাগ ভাঙিয়ে আনতে হবে। বড়বুবুরই বা ব্যাপারটা কী? সব ঠিকঠাক করে—তারই খোঁজ নেই।

লায়লা জবাব দিল না। তারেক বলল, চা ভালো বানিয়েছিস। একটু কড়া হয়েছেআরেকটু কড়া হলে ভালো হতো।

রকিব কি তোর বিয়ের খবর জানে?

আমি জানি না।

হাসানকে বলেছিলাম খবর দিতে। দিয়েছে হয়তো। লায়লা যা আমার জন্যে আরেক কাপ চা আন।

লায়লা চা আনতে গেল। সেখান থেকেই দেখল হাসান বের হচ্ছে। এই সকালে চা-টা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছে। লায়লা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। হাসানকে ডাকবে না ডাকবে না করেও ডাকল, ভাইয়া শোন। যাচ্ছে কোথায়?

রহমানদের বাড়িতে। তার দাদির অবস্থা নাকি খুব খারাপ। রাতে খবর পাঠিয়েছে। যেতে পারি নি। চট করে দেখে আসি।

চা খাবে?

চা হচ্ছে নাকি? চা হলে দে। তোর মুখ এমন শুকনা লাগছে কেন? রাতে ঘুম হয় নি?

না।

বিয়ে নিয়ে টেনশান করছিস?

তোমরা কেউ টেনশন করছ না, আমি শুধু শুধু টেনশান করব কেন?

রাগ করেছিস নাকি?

আমি রাগ করব কেন? আমার রাগ করার কী আছে? তুমি ভাইয়ার কাছে বোস আমি চা নিয়ে আসছি।

লায়লার চোখে আবার পানি আসছে। হাসানকে সরিয়ে দিতে না পারলে সে তার চোখের পানি দেখে ফেলবে। কী দরকার চোখে পানি দেখানোর।

লায়লা!

হুঁ।

আমি দেরি করব না। যাব আর আসব–যেতে-আসতে যা সময় লাগে। এই ধর দুঘণ্টা। তোর কিছু লাগবে?

না আমার আবার কী লাগবে?

হুট করে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল–এইজন্যে আর উৎসব হচ্ছে না। এটা নিয়ে মন খারাপ করবি না। উৎসব বড় ব্যাপার না। যার সঙ্গে সারা জীবন থাকিবি সেই মানুষটা বড় ব্যাপার। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়েছে।

ভালো।

এখন তুই খুব রেগে আছিস–তোর পছন্দ হবে সবচেয়ে বেশি। তুই আমাদের সামনেই ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আহ্লাদী করবি–দেখে রাগে আমার গা জ্বলে যাবে।

এই নাও তোমার চা।

লায়লা আজ সকালে কি তুই আয়নায় নিজেকে দেখেছিস?

আয়নায় নিজেকে দেখার কী আছে।

তোকে আজ খুবই সুন্দর লাগছে। যা আয়নায় নিজেকে দেখে আয়।

ভাইয়া প্লিজ আহ্লাদী করবে না। লায়লা তারেকের চায়ের কাপ নিয়ে বের হয়ে গেল। আসলেই আয়নার সমানে আজ দাঁড়ানো হয় নি। হাসান যখন বলেছে তখন একবার নিজেকে দেখতেই হয়। লায়লা নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন চোখে পড়ল বাসার সামনে ট্যাক্সি থামল। ট্যাক্সি ভর্তি মানুষ। বড়বুবু সবাইকে নিয়ে চলে এসেছেন। পেছনে আরেকটা ট্যাক্সি সেখান থেকে মা-বাবা নামছেন। সবার মুখ হাসি হাসি। এ কী! উৎসব শুরু হয়ে গেল নাকি? লায়লার বুকে সামান্য কঁপন লাগল। ছোটবেলায় ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই যেমন মনে হত আজ। ঈদ এবং বুকে কাঁপন লগত তেমন কাঁপন।

টগর এবং পলাশ দাদিমা দাদিমা বলে বিকট চিৎকার করছে। বড়বুবু হাতে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে নামছেন। কে জানে প্যাকেটগুলাতে কী আছে।

আম্বিয়া খাতুন আবারো একটা ভেলকি দেখিয়েছেন। হাতপা, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছিলেন। এক সময় শ্বাস নেয়া স্তিমিত হয়ে গেল। সেকান্দর আলী ‘ও আমার মারে’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠতেই আম্বিয়া খাতুন ক্ষীণ গলায় বললেনগাধাটা চিল্লায় কেন? আম্বিয়া খাতুনের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিয়মিত শ্বাস পড়তে লাগল। তিনি পানি খেতে চাইলেন। আত্মীয়স্বজনরা দল বেঁধে এসেছিলেন তারা চলে যেতে চাচ্ছিলেন, সেকান্দর আলি বললেন— এখন যাবেন না। মৃত্যুর আগে আগে হঠাৎ শরীরটা ভালো হয়ে যায়। তাই হচ্ছে। আপনারা চলে যাবেন, ঘটনা ঘটে যাবে। আপনাদের মনে থাকবে আফসোস–শেষ সময়ে কাছে থাকতে পারলেন না। আত্মীয়স্বজন বেশিরভাগই থেকে গেলেন। সব অপেক্ষই যন্ত্রণাদায়ক, মৃত্যুর অপেক্ষাও তাই।

হাসান যখন পৌঁছলো তখন লোকজনে বাড়ি গমগম করছে। উৎসব উৎসব ভাব। ছোট বাচ্চারা উঠোনে খেলছে। বয়স্করা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন। ট্রেভর্তি চা এসেছে। চা নেয়া হচ্ছে। সবার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব। শুধু সেকান্দর আলি বিরসমুখে বসে আছেন। রাত্রি জাগরণের কারণে তার শরীর খারাপ করেছে। সামান্য হাঁপানির টানও উঠছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে হতো। সেটা ভালো দেখায় না। মারা এখন তখন অবস্থা আর পুত্র এসি ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে! তার যেসব আত্মীয়স্বজন একটু পর পর তাকে বলছে ‘সেকান্দর তুমি যাও শুয়ে একটু রেষ্ট নাও, তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না’–তারাই তখন নানা কথা ছড়াবে। দরকার কী?

হাসানকে দেখে সেকান্দর আলি বললেন, কী খবর হাসান?

হাসান বলল, জ্বি চাচা ভালো।

মার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তোমাকে দেখতে চাচ্ছিলেন। এসেছ ভালো করেছ। যাও দেখা দিয়ে এস।

রহমান কোথায়?

ওকে টঙ্গী পাঠিয়েছি। একজন কাউকে তো ব্যবসাপতি দেখতে হবে।

জ্বি দেখতে তো হবেই।

শোন হাসান, তোমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। গ্রামের দিকে যেতে হবে। স্কুলমাস্টারি। শিক্ষকতা পেশা হিসাবে খারাপ না। গ্রামে থাকবে ফ্রেশ। আলোবাতাস, ফ্রেশ সবজি। সবাই শহর। শহর করলে গ্রামগুলো চলবে কীভাবে?

জায়গাটা কোথায়?

আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমারই দেয়া আমার মায়ের নামে স্কুল—আম্বিয়া খাতুন গার্লস হাইস্কুল।

ও আচ্ছা।

নদীর পাড়ে স্কুল। অতি মনোরম পরিবেশ। মেয়েদের হোস্টেল আছে। শিক্ষদের থাকার জায়গা আছে। বেতন যা দেয়া হয়। খারাপ না। সরকারি ডিএ তো আছেই। আনম্যারিড কোনো শিক্ষক ওই স্কুলে দেয়া হয় না–তোমার বেলায় নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। গ্রামে যাবে?

জ্বি ভেবে দেখি।

হ্যাঁ ভেবে দেখ। আর যদি যাবার সিদ্ধান্ত নাও তাহলে বিয়ে করে ফেল। বউ নিয়ে থাকবে। সুখে থাকবে। তোমরা ঢাকা শহর ঢাকা শহর করা। কী আছে। এই শহরে! পলিউশন। বেবিট্যাক্সির ধোঁয়া খেয়ে মানুষের গড় আয়ু কমেছে পাঁচ বছর। ঠিক না?

জ্বি।

আচ্ছা যাও মার সঙ্গে দেখা করে আস। একটি কথা শোন–মা তোমার জন্যে এত ব্যস্ত কেন?

জানি না চাচা।

বুঝলে হাসান, মাের এই ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝি না। আমি অতি মাতৃভক্ত ছেলে। মা যা বলছে করেছি। স্কুল বানাতে বলেছে, বানিয়েছি। শীতের সময় আসে মা বলে, গ্রামের গরিব-দুঃখীকে শীতের কম্বল দে, পুরনো কম্বল দিবি না।—নতুন কম্বল। দেই নতুন কম্বল। অমুক এতিমখানার ছেলেপুলেদের ঈদের কাপড় দে। এতিমখানায় কি ছেলেপুলে একটা-দুটা থাকে? শত শত ছেলেপুলে। উপায় কী-মাতৃআজ্ঞ; তাদের দেই। কাপড়–অথচ দেখ আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। আচ্ছা তুমি যাও দেখা করে আস। চাকরির ব্যাপারে কোনো ডিসিশান নিলে আমাকে জানাবে।

জ্বি আচ্ছা।

হাসান ভেতরের দিকে রওনা হলো।

আম্বিয়া খাতুনকে আধশোয়া করে বসানো হয়েছে। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে চামচে করে তাঁকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি তাকে দেখে খুবই বিরক্ত মুখে তাকাল। আম্বিয়া খাতুন বললেন, কী রে হাসান তোর সময় হলো শেষ পর্যন্ত?

কেমন আছেন দাদিমা?

ভালো আছি। দেখছিস না। সুপ খাচ্ছি। তোর চাকরি-বাকরি কিছু হয়েছে?

জ্বি না।

যার যা ক্ষমতা আল্লাহপাক তাকে তাই দেন। যার ক্ষমতা চোর হবার তাকে তিনি চোর বানান। যার কিছুই করার ক্ষমতা নেই তাকে কিছুই বানান না–সে তোর মতো পথে পথে ঘোরে। বুঝেছিস?

জ্বি।

সেকান্দরকে বলেছি তোর চাকরির জন্যে।

দাদিমা আমার চাকরির জন্যে আপনি ব্যস্ত হবেন না।

ব্যস্ত তোকে কে বলেছে? তোর চাকরি হলেই কী আর না হলেই কী? যা আমার সামনে থেকে। যাবার আগে সেকান্দরের সঙ্গে দেখা করে যাবি।

জ্বি আচ্ছা।

তোকে স্কুলের চাকরি গছিয়ে দিতে চাইবে। খবরদার নিবি না। কোনো মতে একটা চালাঘর তুলে দিয়েছে–না আছে। ছাত্র না আছে কিছু। মাস্টাররা বেতন পায় না। বুঝেছিস?

জ্বি।

বিয়েটিয়ে করবি না?

হাসান চুপ করে রইল।

না করাই ভালো। বউ তো আর তোর মতো বাতাস খেয়ে থাকবে না। তোকে না। চল যেতে বললাম, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজকাল কি কানেও শুনতে পাস না?

যে মেয়েটি স্যুপ খাওয়াচ্ছিল সে শুকনো গলায় বলল, আপনি এখন যান। উনাকে আর বিরক্ত করবেন না। স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছি।

হাসান বের হয়ে এল। এই বৃদ্ধার মেহের কোনো কারণ সে জানে না। কোনোদিন জানবেও না। ঘর থেকে বের হবার সময় হঠাৎ তার মনে হলো, এই বৃদ্ধর সঙ্গে আর দেখা হবে না। এ রকম মনে হবার কোনো কারণ নেই। তবু মনে হলো। গুরুতর অসুস্থ যে কোনো মানুষের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় এ রকম অনুভূতি হয়–যার আসলে তেমন গুরুত্বই নেই।

সেকান্দর সাহেব বলেলেন, হাসান চলে যাচ্ছে নাকি?

জ্বি।

মা কী বলল?

তেমন কিছু বলেন নি।

আচ্ছা ঠিক আছে। স্কুলের ব্যাপারে কোনো ডিসিশান নিলে জানাবে। স্কুলের চাকরি খারাপ না। স্যাটিসফেকশান আছে। একটা ভালো কাজ করছ, তার স্যাটিসফেকশন।

জ্বি।

সন্ধ্যার দিকে সময় পেলে একবার এসো। মার জন্যে খতমে শেফা পড়াচ্ছি। বাদ মাগরেব দেয়া হবে।

বাসায় একটা কাজ আছে চাচা।

কাজ থাকলে আসার দরকার নেই।

সেকান্দর আলি বিমর্ষমুখে সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে তিনি কোনো স্বাদ পেলেন না।

লায়লার বিয়ে হয়ে গেল।

তার মন খারাপ ভাবটা বিয়ের পর পুরোপুরি কেটে গেল। যতটা দায়সারা বিয়ে হবে বলে সে ভেবেছিল দেখা গেল বিয়েটা সে রকম দায়সারা হয় নি। ওরা বিয়ের শাড়িই এনেছে তিনটা। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। এর মধ্যে একটা নীল শাড়ি দেখ লায়লা মোহিত হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, ভাবি নীল শাড়িটা কেমন লাগছে?

বিয়ে উপলক্ষে রীনা এসেছে। সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই আছে। টগর-পলাশ মাকে দেখে বেশ স্বাভাবিক আছে। তাদের মধ্যে বাড়তি কোনো আবেগ বা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না।

রীনা বলল, শাড়িটা তো খুবই সুন্দর।

এখন বল শাড়ি কোনটা পরব?

সবচে’ সুন্দরটাই পর। নীলটা পর।

কিন্তু ভাবি লাল শাড়ি ছাড়া বিয়ে কেমন কেমন জানি লাগছে।

তাহলে থাক লালটাই পর। বিয়ে পড়ানো হোক–তারপর বদলে নীলটা পরলেই হবে।

গায়ে হলুদ হয় নি বলে। লায়লার মনে যে খুঁতখুঁতনি ছিল সেটা দূর হয়েছে–রীনা দুপুরে এসেই গায় হলুদের ব্যবস্থা করেছে। লায়লা খুবই আপত্তি করছিল, কী ছাতার বিয়ে তার আবার গায়ে হলুদ! ভাবি তুমি বরং কিছু শুকনা মরিচ পিষে গায়ে ডলে দাও। গায়ে মরিচ হয়ে যাক!

রীনা ধমক দিয়েছে–ঝামেলা করবে না তো। এস বলছি। লায়লা আর ঝামেলো করে নি। খুশি মনেই গিয়েছে। বিয়ের শাড়ি পরানোর পর লায়লার খুব ইচ্ছা করতে লাগল কোনো একটা পার্লারে গিয়ে চুল বেঁধে আসতে। ভুরুও প্লাক করা দরকার। তুরু প্লাক সে নিজে নিজে করে। বিউটি পার্লারে ওরা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে করবে। কিন্তু কথাটা সে বলবে কাকে? বলতে লজ্জাও লাগবে। তার বান্ধীরা কেউ থাকলে বলত। কাউকেই আসতে বলা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে আসতে বললে ভালো হতো। নীল শাড়িটা সবাইকে দেখাতে ইচ্ছা করছে।

বরযাত্রীদের কাজি নিয়ে আসার কথা। তারা আনতে ভুলে গেছেন। গাড়ি পাঠানো হয়েছে কাজি আনতে। লায়লা সেজোগুজে অপেক্ষা করছে। মাথার চুল বাধাটা নিয়ে তার মনটা খুঁতখুঁত করছে। আচ্ছা লজ্জার মাথা খেয়ে সে কি ভাবিকে বলে ফেলবে? ভাবি আবার তাকে বেহায়া ভাববে না তো? লায়লা ক্ষীণস্বরে ডাকল, ভাবি।

রীনা বলল, কী ব্যাপার বল? লায়লা তোমাকে কিন্তু খুবই সুন্দর লাগছে। আয়নায় দেখেছি নিজেকে।

চুল বাঁধাটা মনে হয় ঠিক হয় নি ভাবি। কেমন ফুলে ফুলে আছে। রীনা বলল, লায়লা চল একটা কাজ করি। এখনো তো হাতে সময় আছে চল কোনো পার্লারে গিয়ে বেঁধে আসি।

যাব কী করে ভাবি? বেবিট্যাক্সি করে? বিয়ের শাড়ি পরে বেবিট্যাক্সি করে যাওয়া বিশ্ৰী দেখাবে না?

বেবিট্যাক্সি করে যাব কেন? তোমার বরের গাড়ি নিয়ে যাব। তোমার বরের গাড়ি তো তোমারই গাড়ি।

দেখ ভাবি তুমি যা ভালো বোঝ। কী ছাতার বিয়ে–এর জন্যে আবার পার্লারে গিয়ে চুল বাঁধা!

লায়লা তোমার গয়নাগুলো দেখেছি। একটা নীল পাথরের সেটও আছে। তোমার নীল শাড়ির সঙ্গে খুব মানাবে।

ওইসব তুমি দেখ ভাবি, আমার কিছু দেখতে ইচ্ছে করছে না।

দেখতে ইচ্ছা করছে না বললেও লায়লা পাথরের সেটটা আগেই দেখেছে। উফ! এত সুন্দর।

যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সেই মানুষটাকেও সে এক ফাঁকে দেখেছে। বাহ্‌! পায়জামাপাঞ্জাবিতে খুব মানিয়েছে! আর আগে একবার দেখেছিল শার্ট-প্যান্ট পর্যা–তখন এত ভালো লাগে নি। আশ্চর্যের ব্যাপার–লোকটার ছেলের জন্যেও তার মায়া লাগছে। বাচ্চা একটা ছেলে–মারা ভালবাসা পাচ্ছে না। ছেলেটাকে সে অবশ্যই আদর করবে। সে বেচারা তো কোনো দোষ করে নি। তাকে এরা কোথায় একা একা রেখে এসেছে কে জানে। মনে করে নিয়ে এলেই হতো। লোকে কী বলবে? বলুক। লায়লা মানুষের কথার ধার ধারে না।

লায়লার বান্ধবীরাও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে এসে যুক্ত হলো। বিউটি পার্লার থেকে লায়লা তাদের টেলিফোন করে দিয়েছিল। দু’জনের বাসায় টেলিফোন ছিল না। লায়লা চিঠি লিখে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য এই গাড়িটা তাদের ভাবতেও ভালো লাগছে। সে যখন ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে বলল, এই দু’জনকে আমার চিঠি দিয়ে আসতে পারবেন? ড্রাইভার বলেছে, অবশ্যই পারব ম্যাডাম। ড্রাইভারের মুখে ম্যাডাম শব্দ শুনতে এত ভালো লাগল!

বর-কনে চলে যাবার পর মনোয়ারা রীনাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন। গভীর গলায় বললেন, শোন বউমা তুমি যে এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি দশ রাকাত নফল নামায পড়ে তোমার জন্যে দোয়া করেছি। মা তুমি কি থাকবে না চলে যাবে?

আমি চলে যাব। হাসানকে বলেছি ও পৌঁছে দেবে।

এক কাজ করলে কেমন হয় মা, আমি তারেককে ডাকি ও কানে ধরে তোমার সামনে দশবার উঠবোস করুক।

ছিঃ মা! কী বলছেন এসব!

ভুল বলছি না। ঠিকই বলছি। ও কানে ধরে উঠবোস করলে তোমার রাগটা একটু পড়বে।

মা এইসবের কোনো দরকার নেই।

তারেক যে কাণ্ড করেছে তারপরে তোমাকে আমি থাকতেও বলতে পারি না। বুড়ো মার একটা কথা তুমি রাখি। আজ রাতটা থাক কাল সকালে চলে যেও।

একটা রাত থাকলে কী হবে?

গাধাটার সঙ্গে কথা বল। কথা বলে তোমার যদি মন গলে।

আচ্ছা ঠিক আছে মা আজ রাতটা থেকে যাচ্ছি।

একটু বস আমার সামনে। তোমার সঙ্গে গল্প করি। লায়লাকে কেমন মনে হলো মা–খুশি?

হ্যাঁ, খুব খুশি।

একেবারে গাধা মেয়ে। শাড়ি-গয়না দেখে এলিয়ে পড়েছে। যে যা চায় আল্লাহ তাকে তাই দেন। ও শাড়ি-গয়না চেয়েছিল, আল্লাহ তাকে শাড়ি-গয়না দিয়েছেন। আমার একেকটা ছেলেমেয়ে হয়েছে একেক পদের।

তারেক শুয়ে পড়ছিল। রীনা ঘরে ঢুকতেই উঠে বসে সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এটা পান দাও তো।

যেন কিছুই হয় নি। সব আগের মতো আছে। রীনা পান এনে দিল। তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, বাতি নিভিয়ে আস। তুমি ছিলে না মশারি তুলে ফেলেছিলাম। মশারি খাটিয়েছি।

ভালো।

মশা অবশ্যি নেই বললেই হয়। কয়েকদিন ঝড় হয়েছে তো বেশিরভাগ মশার পাখা ঝড়ে ছিঁড়ে গেছে। ওরা উড়তে পারে না।

ভালো।

রীনা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, লাবণী কেমন আছে?

ভালো আছে। ওর মেয়েটার নিউমোনিয়ার মতো হয়েছে। খুব টেনশানে আছি। নিউমোনিয়া খারাপ ধরনের অসুখ। চিকিৎসার চেয়ে যত্নটা বেশি লাগে। লাবণী অফিস নিয়ে ব্যস্ত, বাচ্চাটার যত্ন হচ্ছে কি না কে জানে।

ডাক্তার দেখছে না?

দেখেছে। রসিফিন দিচ্ছে। রসিফিন ভালো এন্টিবায়োটিক। নিউ জেনারেশন ড্রাগ। ঠিকমতো ওষুধ পড়ছে কিনা কে জানে।

তুমি চলে যাও। দেখে শুনে ওষুধ দেবে।

যাব। বৃহস্পতিবার নাইটকোচে চলে যাব। শুক্ৰ-শনি ছুটি আছে। নাইট কোচগুলো ভালো করেছে। পাঁচ ঘণ্টা লাগে যেতে। গাড়িতে টয়লেটের ব্যবস্থা আছে।

তারেক মশারির ভেতর থেকে বের হবার উপক্রম করল। রীনা বলল, যাচ্ছ কোথায়?

তারেক চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে। আগুনের ফুলকি উঠছে–নোমছে। রীনা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। এই মানুষটাকে ছেড়ে সে কাল ভোরে চলে যাবে। কিন্তু তার কী প্ৰচণ্ড ইচ্ছাই না করেছে মানুষটার সঙ্গে থাকতে। একটা জীবন সুখে-দুখে পার করে দিতে।

রীনা চোখের জল সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

২৩ পর্ব শেষ 📌

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব(পর্ব :২৪)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

নাম হাসান, হাসানুজ্জামান

আপনার নাম?

জ্বি আমার নাম হাসান। হাসানুজ্জামান।

আপনি কী করেন?

কিছু করি না–বেকার বলতে পারেন। সম্প্রতি অবশ্য একটা চাকরি পেয়েছি।

কী চাকরি?

স্কুল টিচারের চাকুরি। ঢাকার বাইরে।

আপনি ধূমপান করেন?

জ্বি।

নিন। একটা সিগারেট খান।

ওসি সাহেব সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। হাসান সিগারেট নিল। তার অস্বস্তি বাড়ছে। তাকে থানায় ডেকে আনার কারণ স্পষ্ট হচ্ছে না। তারাও ভেঙে কিছু বলছেন না। ওসি সাহেবকে বেশ ভদ্র মনে হচ্ছে। পুলিশের চাকরি না করে এই ভদ্রলোক কোনো কলেজের শিক্ষকতাও করতে পারতেন। খাকি পোশাকে তাকে মানাচ্ছে না।

চা খাবেন?

জ্বি না। আমাকে কেন ডেকেছেন দয়া করে বলবেন?

আপনার ছোট ভাই আছে না–রকিব?

জ্বি।

তার সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ নেই?

যোগাযোগ থাকবে না কেন? আছে তো। মাঝখানে বেশ কিছুদিনের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল।

শেষ কবে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

শেষ কবে দেখা হয়েছে। হাসান মনে করতে পারল না। লায়লার বিয়েতে আসে নি। এটা মনে আছে। তাকে খবর দেয়া হয়েছিল, সে নিজেই খবর দিয়ে এসেছে।

দিন তারিখ বলতে হবে না। মোটামুটি একটা সময় বললেই হবে।

শেষবার সে এসেছিল খুব সম্ভব দিন পনের আগে। কেন বলুন তো?

এর মধ্যে সে কি কোনো খবর পাঠিয়েছে?

জ্বি না। পাঠালেও আমি জানি না।

সে কি বাসায় আপনাদের কারো কাছে টাকা-পয়সা রাখতে দিয়েছে?

জ্বি না।

এমনকি হতে পারে যে কারো কাছে রাখতে দিয়েছে আপনি তা জানেন না? ব্যাপারটা গোপনে ঘটেছে।

আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না। এই প্রশ্নগুলো আপনি কেন করছেন জানতে পারলে আমার উত্তর দিতে সুবিধা হতো।

চা দিতে বলি–এক কাপ চা খান। চা খেতে খেতে কথা বলি। দিতে বললো?

বলুন।

ওসি সাহেব চা দিতে বললেন। হাসান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। রকিব কি কোনো ঝামেলায় পড়েছে? ঝামেলাটা কোন ধরনের? বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কোনো কারণ নই। রকিব রগচটা কিন্তু ভালো ছেলে।

চা নিন হাসান সাহেব।

হাসান চা নিল। ওসি সাহেব বললেন, আমি বেশি কিছুদিন আগে একজন এস.আইকে পাঠিয়েছিলাম। ও আপনার বাবার সঙ্গে রকিব সম্পর্কে কথা বলেছিল। এক ধরনের সাবধানবাণী বলতে পারেন। উনি কি ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ডিসকাস করেন নি?

আমাকে কিছু বলেন নি। মনে হয় অন্য কারো সঙ্গে বলেন নি। বাবা কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। সমস্যার কথা একেবারেই বলেন না।

আপনার ছোট ভাই রকিব বাজে ধরনের সমস্যায় জড়িত ছিল। তার মধ্যে একটা হচ্ছে মানি এক্সটিরশন?

কী বললেন?

বিত্তবান লোকজন আটকে রেখে টাকা চেয়ে পাঠানো।

কী বলছেন এসব?

তার বিরুদ্ধে একটা হত্যা মামলাও আছে।

আপনাদের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে।

জ্বি না ভুল হচ্ছে না।

আমার মনে হয় শক্রিতাবশত তার সম্পর্কে এই জাতীয় কথা বলা হচ্ছে। সে ছাত্র রাজনীতি করে—তাকে বিপদে ফেলার জন্য এইসব হয়তো ছড়াচ্ছে। সে খুবই ভালো ছেলে। পড়াশোনায় ভালো। চিকেন পক্স নিয়ে এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিল–তারপরেও চারটা লেটার নিয়ে এস.এস.সি. পাস করেছিল।

বুঝলেন হাসান সাহেব–দেশের পরিবেশ এখন এমন রাতারাতি একজন ভালো মানুষ নষ্টমানুষ হয়ে যায়।

নষ্ট হবার একটা সীমা থাকে। সীমার নিচে নষ্টও হওয়া সম্ভব না। আপনি কী করে বললেন রকিব হত্যা মামলার আসামি?

আপনার চা কি শেষ হয়েছে?

জ্বি।

চলুন আমার সঙ্গে।

কোথায় যাব?

আপনি একটা ডেডবডি আইডেনটিফাই করবেন।

হাসান হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল। খাকি পোশাক পরা এই মানুষটা এইসব কী বলছে। সে ডেডবিডি আইডেনটিফাই করবে। কেন? কার ডেডবডি?

হাসান সাহেব!

জ্বি।

বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে দেয়া ডেডবডি। চেনার অবস্থা না পচেগলে গিয়েছে। নিকট আত্মীয়স্বজনরা মাথর চুল দেখে জামাকাপড় দেখে হয়তো আইডেনটিফাই করতে পারবেন। এই জন্যই আপনাকে আনা।

আপনার কী করে ধারণা হলো এটা আমার ভাইয়ের ডেডবডি?

আপনার ভাইয়ের একজন সহযোগীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তার স্বীকারোক্তি থেকে জেনেছি। সে বলছে রকিবকে ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়–তারপর ডেডবিডি ইটসহ বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

হাসানের মনে হলো–খাকি পোশাক পরা এই মানুষটা আসলে মানুষ না, পিশাচ। এর হৃদয় বলে কিছু নেই। সে নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলছে। তার মন বলে কিছু নেই? তার কি বাসায় ভাইবোন নেই? ছেলেমেয়ে নেই? সে কি স্ত্রীর সঙ্গে বসে টিভিতে নাটক দেখে না? ঘন বর্ষায় কি তার বাড়িতে খিচুড়ি ইলিশ মাছ রান্না হয় না?

হাসান সাহেব!

জ্বি।

নিন আরেকটা সিগারেট নিন।

জ্বি না সিগারেট নেব না।

তাহলে চলুন।

কোথায় যাব?

মেডিকেল কলেজে। ডেডবডি মেডিকেল কলেজের মৰ্গে রাখা হয়েছে। আপনি আইডেনটিফাই করার পর সুরতহাল হবে। যদিও সুরতহাল অর্থহীন। তবুও নিয়ম রক্ষার জন্যে করতে হবে।

আপনি যে ডেডবিডি আমাকে দেখাতে যাচ্ছেন সেটা আমার ভাইয়ের ডেডবডি না। আপনারা মস্তবড় ভুল করছেন।

ভুল হতেও পারে। ভুল হচ্ছে কি না তা জানার জন্যই আপনাকে নিয়ে যাওয়া।

লাশের পাশে একজন ডোম দাঁড়িয়ে। তার নাক গামছা দিয়ে বাঁধা। তার হাতে একটা লাঠি। সে লাঠি দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখাচ্ছে।

ওসি সাহেব বললেন, দেখলেন!

হাসান জবাব দিল না।

দাঁতগুলো দেখুন। ওপরের প্রথম দাঁতটা ভাঙা। হাতের রিস্টওয়াচটা দেখুন।

হাসান বলল, এটা আমার ভাইয়ের ডেডবডি না।

ও আচ্ছা ঠিক আছে–চলুন যাই।

ঘর থেকে বের হয়েই হাসান বলল, আমার মাথা ঘুরছে শরীর কেমন যেন করছে। আমি বমি করব।

বারান্দায় গিয়ে বমি করুন। কোনো অসুবিধা নেই। আমি পানি এনে দিচ্ছি।

হাসান মুখ ভর্তি করে বমি করল। তার মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরটা পুরোপুরি মুখ দিয়ে বের হয়ে যাবে। সে হয়ে যাবে উল্টো মানুষ। শরীরের বাইরের অংশ চলে যাবে ভেতরে। ভেতরের অংশ চলে আসবে বাইরে।

হাসান সাহেব।

জ্বি।

এখন কি একটু ভালো বোধ করছেন?

জ্বি।

নিন পানি দিয়ে মুখ ধোন। একটা পান খান।

আমি কি চলে যেতে পারি?

জ্বি পারেন। চলুন আমি আপনাকে একটা রিকশা করে দি। পুলিশের গাড়ি করে পাঠাতে পারতাম সেটা ঠিক হবে না। প্রতিবেশীরা নানান কথা বলতে পারে।

আপনাকে রিকশা করে দিতে হবে না। ধন্যবাদ।

ওসি সাহেব বললেন, কুৎসিত একটা দৃশ্য আপনাকে দেখিয়েছি— সামান্য ভদ্রতা আমাকে করতে দিন।

ওসি সাহেব!

জ্বি।

ডেডবডিটা আমার ছোট ভাইয়ের।

আমি জানি।

আমি কাউকে বলতে চাচ্ছি না। কাউকে না। বাবা-মা কাউকে না। তাতে কোনো অসুবিধা আছে?

অসুবিধা নেই।

সবাই জানবে একটা ছেলে ছিল, হারিয়ে গেছে। কত মানুষ তো হারিয়ে যায়।

তা যায়।

আমার ভাইয়ের কি জানাজা হবে? কবর হবে?

হ্যাঁ হবে। আপনি কাঁদবেন না।

ওসি সাহেব আপনার নামটা কি জানতে পারি?

কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে আমার নামও রকিব। হাসান সাহেব কাঁদবেন না প্লিজ। আর ভাই শুনুন–আই অ্যাম সরি।

জ্বরে হাসানের গা পুড়ে যাচ্ছে।

বাড়িতে কেউ নেই। তারেক গিয়েছে চিটাগাং। রীনা এসে টগর-পলাশকে নিয়ে গেছে। লায়লা তার শ্বশুরবাড়িতে। হাসানের মা তার বড় মেয়ের বাড়িতে। শুধু হাসানের বাবা আশরাফুজ্জামান সাহেব আছেন। তবে এই মুহুর্তে তিনি বাড়িতে নেই। চায়ের স্টলে বসে আছেন। গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। তিনি জিলাপি খাচ্ছেন। রসে তার মুখ মাখামাখি। এত ভালো জিলাপি তিনি অনেক দিন পর খাচ্ছেন। মাখনের মতো মোলায়েম হয়েছে। মুখে দেয়ামাত্র গলে যাচ্ছে।

কমলার মা গোঙানির শব্দ শুনে হাসানের দরজার সামানে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ভীত গলায় ডাকল, ভাইজান?

হাসান চোখ মেলল। তার চোখ টকটকে লাল। হাসান ভারি গলায় বলল, কে?

কমলার মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ভাইজান আমি।

হাসান আবারো বলল, কে?

ভাইজান আমি কমলার মা। আপনের কী হইছে ভাইজান?

মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে কমলার মা।

খুব বেশি?

হ্যাঁ খুব বেশি।

হাসান চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে জেগে আছে অথচ সেই বিশ্ৰী স্বপ্নটা আবার শুরু হয়েছে। একদল হাঁস যাচ্ছে। সে হাঁটছে। হাঁসের সঙ্গে। হাঁসিরা শামুক গুগলি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। ঝিনুকের খোল খুলতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা হাঁস তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাঁসটার চোখ মানুষের চোখের মতো বড় বড়।

জেগে থেকেই সে এই স্বপ্নটা দেখছে কেন? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? এই দুঃস্বপ্নের কথা সে তিতলী ছাড়া আর কাউকে বলে নি।

স্বপ্নের কথা শুনে তিতলী বলেছিল। খিচুড়ি দিয়ে ভূনা হাঁসের মাংস খেলে তোমার হাঁসের স্বপ্ন দেখার এই রোগ সেরে যাবে। শীতকাল আসুক আমি নিজে তোমাকে ভুনা হাঁসের মাংস খাওয়াব। তুমি কি জান আমি খুব ভালো রাধুনি?

না জানি না।

আমার অনেক কিছুই তুমি জান না। একেক করে জানবে। আর মুগ্ধ হবে। এই পৃথিবীতে মটরশুঁটি দিয়ে কই মাছের ঝোল আমার চেয়ে ভালো কেউ রাঁধতে পারে না। শীতকাল আসুক তোমাকে মটরশুঁটি আর কই মাছের ঝোল খাওয়াব।

আচ্ছা।

মাছের ঝোল রান্নার গোপন কৌশল কি তুমি জান?

জানি না।

জানতে চাও?

না।

জানতে না চাইলেও বলব। মাছের ঝোল রান্নার আসল কৌশল হলো–অনেকক্ষণ নাড়াতে নাড়তে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। তবু চামচ নাড়ানো বন্ধ করবে না। বুঝেছ?

হুঁ।

শীতকাল আসতে কত দেরি? এখন কোন কাল? বর্ষা শেষ হয়ে গেছে না?

হাসান চোখ মেলল।

কমলার মা বলল, ভাইজান মাথাত পানি ঢালমু?

হাসান বলল, না।

যন্ত্রণা কি আরো বাড়ছে ভাইজান?

হুঁ।

মাথা বিষের বড়ি খাইবেন?

না। তুমি এখন যাও।

হাসান চোখ বন্ধ করছে না। চোখ বন্ধ করলেই হাঁসের পাল চলে আসবে। চুড়ির শব্দ হচ্ছে। কে এসেছে চুড়ি পরে? তিতলী না তো? হাসান জানে কেউ নেই তারপরেও বলল, কে তিতলী! আশ্চর্য ব্যাপার। মাথার ভেতরে তিতলী কথা বলে উঠল।

হুঁ।

কেমন আছ?

ভালো।

তোমাকে অনেক দিন থেকে মনে মনে খুঁজছি।

কেন?

ওই যে একটা গান করেছিলে বুড়িগঙ্গায় ওই গানের লাইনগুলো কী?

আমি তো গান করি নি।

তিতলী শোন!

শুনছি।

আমি খুব একটা অন্যায় করেছি। তোমাকে বলা হয় নি।

বল।

নাদিয়া এত ভালো রেজাল্ট করেছে, ওকে কনগ্রাচুলেশনস জানানো হয় নি। আমি ওর জন্যে একটা গিফট কিনে রেখেছিলাম। সেই গিফটটাও তাকে দেয়া হয় নি।

একদিন বাসায় গিয়ে ওকে দিয়ে এসো।

তুমি রাগ করবে না তো?

আমি রাগ করব কেন?

তিতলী!

বল শুনছি।

হাঁসের স্বপ্নটা আমি এখনো দেখি।

ও আচ্ছা।

স্বপ্নটা দেখার সময় মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়।

ও আচ্ছা।

তিতলী আমার মনটা সারাক্ষণ খুব খারাপ থাকে।

ও আচ্ছা।

তুমি কি জান আমি এখানে, মাঝে মাঝে তোমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি?

ও আচ্ছা।

কয়েকদিন আগে তোমাদের কলেজে গিয়েছিলাম। মনের ভুলে চলে গিয়েছি।

ও আচ্ছা।

এখন আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

ও আচ্ছা।

আশরাফুজ্জামান বাড়িতে ফিরলেন রাত ন’টায়। তিনি ছেলেকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী হয়েছে হাসানের? তিনি ভীত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে? তোর চোখ এত লাল কেন?

হাসান লাল চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে