🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :১৯)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
রীনা খুব শান্ত ভঙ্গিতেই তার সুটকেসে কাপড় ভরল
রীনা খুব শান্ত ভঙ্গিতেই তার সুটকেসে কাপড় ভরল। কয়েকটা ব্যবহারি শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকেট। ব্যাস এই তো। নয় বছরের বিবাহিত জীবনে নেই নেই করেও অনেক কিছু জমে গেছে। সবকিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। থাকুক তার স্মৃতি হিসেবে কিছু জিনিসপত্র। সঙ্গে করে সামান্য হলেও কিছু টাকা-পয়সা নেয়া দরকার। সেটা নিতে ইচ্ছে করছে না। ছোট মামার দেয়া সাত শ ডলারের কিছুই নেই। রীনা ভেবেছিল একটা টাকাও সে খরচ করবে না। সব জমা করে রাখবে। অথচ কত দ্রুতই না সেই টাকাটা খরচ হলো। তারেকের অফিসের কিছু দেনা শোধ করা ছাড়া টাকাটা আর কোনো কাজে লাগে নি। তার হাত আজ পুরোপুরি খালি।
বউ হিসেবে যখন সে বাবার বাড়ি থেকে আসে তখনো খালি হাতে এসেছিল। বাবা কয়েকবার বলেছিলেন, মেয়েটার হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দাও। টুকটাক খরচ আছে। ফন্ট করে স্বামীর কাছে চাইতেও পারবে না লজ্জা লাগবে। বিয়েবাড়ির উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত তার হাতে টাকা দেয়ার ব্যাপারটা মনে রইল না। সে গাড়িতে উঠল। এক্কেবারে খালি হাতে। আজ বাড়ি থেকে বিদায় নেবার সময়ও খালি হাতে বিদায় নেয়া ভালো। যেভাবে এসেছি–সেভাবে যাচ্ছি। না তাও ঠিক না। সে স্বামীর কাছে এভাবে আসে নি। তার দরিদ্র বাবা ধারদেনা করে অনেক গয়নাপাতি দিয়েছিলেন। এই নিয়ে বাড়িতে অনেক অশান্তিও হয়েছে। রীনার মা ঝাঁঝালো গলায় বলেছিলেন–এত যে ঋণ করলে শোধ দিবে কীভাবে? টাকার গাছ পুঁতেছ? রীনার বাবা হাসিমুখে বলেছিলেন, মেয়েটা ঝলমলে গয়না পরে স্বামীর কাছে যাচ্ছে এই দৃশ্য দেখতেও অনেক আনন্দ। তোমার এই মেয়ে সুখের সাগরে ডুবে থাকবে।
সুখের সাগরে ডুবে থাকার এই হলো নমুনা। নয় বছর স্বামীর সঙ্গে থেকে আজ সব ফেলে দিয়ে চলে যেতে হচ্ছে।
রীনা তার গলার হারটা সঙ্গে নিল। বাবার দেয়া গয়না একে একে বিক্রি করে সংসারের ক্ষুধা মেটাতে হয়েছে। হারটা রয়ে গেছে। হার বিক্রি করে নগদ কিছু টাকা হাতে নিতে হবে। মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু অর্থ! স্বার্থহীন বন্ধু। যে মানুষের চারদিকে শক্ত দেয়াল হয়ে মানুষকে রক্ষা করে। রানার সে রকম বন্ধু নেই। আশ্রয় দেবার মতো আত্মীয়স্বজনও নেই। সে যার কাছেই উঠবে সে-ই ব্যস্ত হয় উঠবে তাকে তাড়িয়ে দিতে। তাকে উঠতে হবে স্কুল জীবনের বান্ধবীর বাসায়। তারা তাকে তাড়িয়ে দেবে না। স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব অন্যরকম ব্যাপার। এই বন্ধুত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। কখনো কমে না। রীনার সঙ্গে তার স্কুলজীবনের বন্ধুদের কোনো যোগ নেই। কে কোথায় আছে সে জানেও না। একজন থাকে বারিধারায়। সুস্মিতা। তার সঙ্গে নিউমার্কেটে হঠাৎ দেখা হয়েছিল। সুস্মিতা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সুস্মিতা বাড়ির নম্বর, টেলিফোন নম্বর সব একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল। কাগজটা অনেকদিন ছিল টেবিলের ড্রয়ারে। তারপর উড়ে চলে গেল। সুস্মিতার ঠিকানা জানা থাকলে কাজ হতো।
বিকালের মধ্যে রীনা সব গুছিয়ে ফেলল। বিকেলে বাচ্চারা খাবে তার জন্যে নুডলস। রাতের জন্য পোলাও। দুজনই খুব পোলাও পছন্দ করে। রোজ খেতে বসে বলবে, মা পিলাউ’। টগর সব শব্দ উচ্চারণ করতে পারে শুধু পোলাও বলতে গিয়ে বলে পিলাউ। পোলাও থাকলে তার আর কিছু লাগবে না। তরকারি না হলে চলবে। কপি কাপ করে ‘‘পিলাউ খাবে। সেই খাওয়া দেখার ভেতরও আনন্দ আছে। আজ রীনা এই আনন্দ পাবে না। টগর ‘‘পিলাউ খাবে একা একা। না, একা একা নিশ্চয়ই খাবে না–লায়লা থাকবে।
রীনা এক শ টাকার একটা নোট এবং কিছু ভাংটি টাকা সঙ্গে নিল। যেখানেই যাক রিকশা ভাড়া, বেবিট্যাক্সি ভাড়া তো দিতে হবে।
আলমিরা খুলে টগর এবং পলাশের জুতাজোড়া নিল। জন্মের এক মাস পর এলিফ্যান্ট রোডের এক দোকান থেকে রীনা নিজে এই দু জোড়া জুতা কিনেছিল। লাল ভেলেভেটের জুতা। এখনো ঝলমল করছে। জুতা জোড়া কেনার সময় সে বিস্মিত হয়ে ভাবছিল–জন্মের সময় মানুষের পা এতো ছোট থাকে? রীনার অনেক দিনের শখ টগর এবং পলাশের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন কাচের বাক্সে জুতাজোড়া রেখে সেই বাক্সটা মায়ের বিয়ের উপহার হিসেবে সে দেবে। প্ৰতীকী উপহার। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া–দেখ একদিন তুমি এ রকম ছোট ছিলে-আজ বড় হয়েছ। তোমার সংসারে এ রকম ছোট একটা শিশু আসবে। চক্ৰ কোনোদিন ভাঙবে না। চলতেই থাকবে।
এই জীবনে রানার কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় নি। কে জানে এই ইচ্ছাটাও হয়তো পূর্ণ হবে না। টগর-পলাশের বিয়ে হয়ে যাবে সে খবরও পাবে না। রীনার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যেন চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে যায়। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় চোখের পানি ফেলতে নেই। চোখের পানি বাড়ির জন্যে ভয়াবহ অমঙ্গল নিয়ে আসে। রীনা চায় না, এই বাড়ির অমঙ্গল হোক। এ বাড়িতে টগর ও পলাশ থাকে। হাসান থাকে, লায়লা থাকে। তার শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন। এদের সবাইকে রীনা অসম্ভব পছন্দ করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সবচে’ বেশি পছন্দ করে তার শাশুড়ি মনোয়ারাকে। কেন করে সে নিজেও জানে না।
সব গোছানোর পর রীনা মনোয়ারার ঘরে উঁকি দিল। যাবার আগে একটু দেখা করা। তাকে কিছু বলে যাওয়া যাবে না। সেটা সম্ভব না।
রীনা শাশুড়ির ঘরের দরজা ফাঁক করল। মনোয়ারা বললেন, বউমা তোমার শ্বশুর। কোথায় জান?
জানি না মা।
বারান্দায় গিয়ে উঁকি দাও–তোমার শ্বশুরকে দেখবে রাস্তার ওপাশে যে চায়ের স্টল আছে, বিসমিল্লাহ টি-স্টল, ওইখানে বসে আছে।
খবর দিয়ে আনব মা?
না খবর দিয়ে আনতে হবে না। কয়েকদিন ধরেই আমি ব্যাপারটা লক্ষ করছি। বুড়োর ভীমরতি হয়েছে। ঠিক এই সময় বুড়ো চায়ের স্টলে বসে থাকে কেন জানতে চাও?
কেন?
মেয়েস্কুল ছুটি হয়। মেয়েগুলো শরীর দোলাতে দোলাতে রাস্তা দিয়ে যায়। আর আমাদের বুড়ো এই দৃশ্য চোখ দিয়ে চাটে। বুঝলে কিছু?
রীনা চুপ করে রইল।
একটা বয়সের পর পুরুষ মানুষের এই রোগ হয়। চোখ দিয়ে চাটার রোগ। খুবই ভয়ঙ্কর রোগ। আল্লাহপাক এই বিষয়টা জানেন বলেই এই বয়সে চোখে ছানি ফেলে দেন। আমাদের বুড়োর চোেখ পরিষ্কার, ছানি পড়ে নি। তার খুব সুবিধা হয়েছে। রোজ বিকেলে চা খেতে যাচ্ছে। জীবনে তাকে চা খেতে দেখলাম না, এখন চা খাওয়ার ধুম পড়েছে। ভেবেছে আমি কিছু টের পাই নি। কোনো ভরা বয়সের মেয়ে ঘরে এলে বুড়ো কী করে লক্ষ করেছ? তার মা ডাকার ধুম পড়ে যায়। মা মা বলে আদরের ঘটা। মা ডাকলে মাথায় পিঠে, পাছায় হাত বোলানোর সুযোগ হয়ে যায়-। সুযোগ আমি বার করছি। আজ বাসায় ফিরুক। সাপের পা তো কেউ দেখে নাই। তোমার শ্বশুর আজ সাপের পা দেখবে, শিয়ালের শিং দেখবে।
মা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
একা যাচ্ছ?
জ্বি।
একা যাবার দরকার নেই, বুড়ো শয়তানকে সাথে নিয়ে যাও। বুড়ো একদিনে অনেক মেয়ে দেখে ফেলেছে আর না দেখলেও চলবে। যাচ্ছে কোথায়?
আমার এক বান্ধবীর বাসায়।
শয়তানটাকে সাথে নিয়ে যাও। তুমি বন্ধুর বাসায় যেও। শয়তানটাকে রিকশায় বসিয়ে রাখবে। সে রিকশাওয়ালার সঙ্গে গল্প করবে। এটাই তার শান্তি। আর শোন মা তুমি দেরি করবে না। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরবে। বাড়ির বউ সন্ধ্যার পর বাইরে থাকলে সংসারে অমঙ্গল হয়। বাড়ির বউকে দুটা সময়ে অবশ্যই ঘরে থাকতে হয়। সূৰ্য ওঠার সময় এবং সূর্য ডোবার সময়। এই কথাগুলো মনে রাখঘা মা। তোমার ছেলে দুটাকে যখন বিয়ে দিবে তখন তাদের বউদেরও বলবে।
জ্বি আচ্ছা।
রীনা শাশুড়ির ঘর থেকে বেরোল। টগর-পলাশ বারান্দার দেয়ালে মহানন্দে রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছে। দেয়ালে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ কর্ম। এই নিষিদ্ধ কর্মের জন্যে দু ভাই অতীতে অনেক শাস্তি পেয়েছে। আজ পেল না। রীনা তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। দু। ভাই মাথা নিচু করে বসে আছে। ভয়ে কেউ মাথা তুলছে না। রীনার খুব শখ ছিল যাবার আগে ছেলে দুটির মুখ ভালোমতো দেখে যায়। সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না। মাকে দেখে এরা দুজন মাথা আরো নিচু করে ফেলল। দেয়ালে দু মাথাওয়ালা একটা ভূত আঁকা রয়েছে। রীনা ভূতের দিকে তাকিয়ে আছে। রীনা নরম গলায় ডাকল, টগর। টগর মার গলায় বিপদের আভাস পেয়েছে। সে ছুটে দাদিমার ঘরে ডুকে গেল, মুহূর্তের মধ্যেই তাকে অনুসরণ করল পলাশ। মার হাত থেকে মুক্তির এই একটিই উপায়।
ভাবি শোন।
বারান্দায় লায়লা দাঁড়িয়ে আছে। তার গলার স্বর ভারি। মনে হয়। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। চোখে কাজল লেপ্টে আছে।
কী ব্যাপার লায়লা?
তুমি একটু আমার ঘরে আস তো ভাবি।
রীনা লায়লার ঘরে ঢুকতেই লায়লা দরজা বন্ধ করে দিল। রীনা বলল, ব্যাপার কী বল তো?
লায়লা কান্না চাপতে চাপতে বলল, ভাবি তুমি বল আমি কি এতই ফেলনা? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?
ব্যাপারটা কী?
আমি জানি আমার চেহারা ভালো না। রং ময়লা–তাই বলে আমার জন্যে ডিভোর্সড ছেলে খুঁজতে হবে?
কে খুঁজছে ডিভোর্সড ছেলে?
বড়বুবু একটা ছেলের সন্ধান এনেছেন। ডিভোর্সড। আগের ঘরের একটা ছেলে আছে তিন বছর বয়স। আমার চেহারা খারাপ বলে আমার ভাগ্যে বুঝি সেকেন্ডহ্যান্ড হাসব্যান্ড।
বিয়ে তো এখনো হয়ে যায় নি লায়লা।
না হোক বড়বুবু কেন সেকেন্ডহ্যান্ড হাসবেন্ডের খোঁজ আনবে। ভাবি তুমি তো জান সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিসই আমি দু চোখে দেখতে পারি না। নিউমার্কেটে কত সুন্দর সুন্দর সেকেন্ডহ্যান্ড সুয়েটার পাওয়া যায়। আমার বন্ধুরা সবাই কিনেছে। আমি কখনো কিনেছি?
লায়লা চুপ কর তো!
কেন আমি চুপ করব? ভাবি আমি কি মানুষ! আমাকে আগেভাগে কিছু না বলে মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমিও হাসিমুখে সেকেন্ডহ্যান্ডটার সাথে কথা বলেছি। গাধাটা আবার যাবার সময় বড়বুবুকে বলেছে মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আরো গাধা তোর তো যেকোনো মেয়েই পছন্দ হবে।
লায়লা শোন এখানে তোমার পছন্দটাই জরুরি। তুমি তোমার পছন্দ-অপছন্দটা কড়া করে বলবে। তুমি যে জীবন যাপন করবে সেটা তো তোমার জীবন। অন্যের জীবন তো না।
লায়লাকে শান্ত করে রীনা বের হয়ে এল। ভাগ্য ভালো সুটকেস হাতে বেরোতে তাকে কেউ দেখল না।
রীনা রিকশায় উঠেছে। ঢাকায় তার থাকতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যেতে হবে। ময়মনসিংহ চলে গেলে কেমন হয়। রানার বড়মামা ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার। কেউটখালিতে বাসা। বাসে ময়মনসিংহ যেতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগে। সে পৌছবে সন্ধ্যার পর পর। তখন কেউটখালিতে গিয়ে বড়ামামাকে খুঁজে বের করতে হবে। বাসার ঠিকানা রীনার জানা নেই। যদি খুঁজে না পাওয়া যায়। যদি মামা এর মধ্যে বাসা বদল করে থাকেন? দুশ্চিন্তা হচ্ছে। রীনা দুশ্চিন্তাকে আমল দিল না। তার সমস্ত শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। মুখ শুকিয়ে পানির পিপাসা হচ্ছে। কোনো একটা দোকানের সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে সে কি এক বোতল পানি কিনে নেবে? কত দাম এক বোতল পানির?
রিকশাওয়ালা বলল, কই যাবেন?
রীনা বলল, কমলাপুর রেলস্টেশন।
বলেই মনে হলো সে ভুল করেছে। সে যাবে মহাখালি বাসস্টেশন। মহাখালি বাসস্টেশন থেকেই ময়মনসিংহের বাস ছাড়ে। শুধু শুধু কমলাপুর রেলস্টেশন বললে কেন? ভুলটাকে ঠিক করতে ইচ্ছা করছে না। যাক কমলাপুরেই যাক। ময়মনসিংহ যাবার কোনো একটা ট্রেন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর পাওয়া না গেলে একটা রাত রেলস্টশনে কাটিয়ে দেয়া তেমন কঠিন হবে না। স্টেশনে সারা রাত গাড়ি আসা-যাওয়া করবে। অসুবিধা কী? জনতার মধ্যে আছে নির্জনতা।
১৯ পর্ব শেষ 📌
🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :২০)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন সেই চেয়ারে চিত্ৰলেখা বসে আছে। প্রথম দিন অস্বস্তি লেগেছিল–এরপর আর লাগে নি। এমন ব্যস্ততায় তার দিন কাটছে যে অস্বস্তি লাগার সময়ও ছিল না। ব্যস্ত মানুষদের অস্বস্তি বোধ করার সময় থাকে না। চিত্ৰলেখার দিন কাটছে বাবার কর্মপদ্ধতির মূল সূত্রগুলো ধরতে। তাকে কেউ সাহায্য করছে না। যাদের সাহায্য করার কথা তারা এক ধরনের নীরব অসহযোগিতা করছেন। অফিসের প্রধান প্রধান কর্তব্যক্তিরা এগিয়ে আসছেন না। তাদের প্রশ্ন করেও তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না। এ রকম কেন হচ্ছে চিত্ৰলেখা বুঝতে পারছে না। তারা কি চান না। সব আগের মতো চলুক?
চিত্ৰলেখার সামনে তিন কর্মকর্তা বসে আছেন, জিএম আবেদ আলি, এজিএম ফতেহ খান এবং প্রোডাকশান ম্যানেজার নুরুল আবসার। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা বিমর্ষমুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আবেদ আলি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। চিত্ৰলেখা বলল, আপনি সিগারেট ধরাবেন না। সিগারেটের ধোঁয়া আমার পছন্দ না। বন্ধঘরে ধোঁয়া যেতে চায় না। অসহ্য লাগে।
আবেদ আলি সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে রাখলেন। তার মুখ আরো গভীর হয়ে গেল।
চিত্ৰলেখা বলল, আমি যদি কারো চাকরি টাৰ্মিনেট করতে চাই আমাকে কী করতে হবে বলুন তো?
আবেদ আলি কিছু বললেন না, ফতেহ খান বললেন, আপনি যা করবেন কোম্পানি আইন মোতাবেক করবেন। কোম্পানি আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার ক্ষমতা মালিকদের দেয়া হয় নি। মালিক চেয়েছেন বলে চাকরি নেই এই ব্যবস্থা এখন নেই।
প্রাইভেট কোম্পানিতে কোনো একটা ব্যবস্থা তো থাকতেই হবে। সেই ব্যবস্থাটা জানতে চাচ্ছি।
ফতেহ খান বললেন, আপনাকে ল’ইয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। কোম্পানির নিজস্ব ল’ইয়ার আছে তার কাছে জেনে নিন।
আপনারা কিছু জানাবেন না?
আমরা তেমন জানি না।
আপনি জানেন না সেটা বলুন। আমরা বলছেন কেন? আবেদ আলি সাহেব হয়তো জানেন, নূরুল আবসার সাহেবও হয়তো জানেন। অন্যদের দায়িত্ব নেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
নুরুল আবসার বললেন, মিস চিত্ৰলেখা আপনাকে একটা কথা বলি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না, আপনি একসঙ্গে সবকিছু বুঝে ফেলতে চেষ্টা করছেন। আমাদের এই কোম্পানি অনেক বড় কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা দীর্ঘদিন থেকে জড়িত। বছরের পর বছর কাজ করে আমরা যা শিখেছি আপনি এক সপ্তাহে তা শিখে ফেলতে চান, তা কী করে হবে! ধীরে চলার একটা নীতি আছে সেই নীতি মেনে চলাই ভালো।
আমাকে ধীরে চলতে বলছেন?
অবশ্যই ধীরে চলতে বলছি।
আপনাদের ধারণা আমি ধীরে চলছি না?
আমাদের ধারণা। আপনি একসঙ্গে সব জেনে ফেলার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। ছটফট করছেন।
আপনিও বললেন–আমাদের ধারণা। আপনি বলুন আমার ধারণা। নাকি আপনাদের তিন জনের ধ্যান-ধারণা সব এক রকম।
আমরা সব একজিকিউটিভ ডিসিশান মেকিঙে থাকি। আমাদের ধ্যান-ধারণা এক রকম হওয়ারই তো কথা।
গত মাসে কোম্পানি প্ৰায় এক কোটি টাকা লোকসান করেছে। কেন করেছে আবেদ আলি সাহেব। আপনি বলুন?
এক কোটি টাকা না–সত্তর হাজার পাউন্ড। একটা বিশেষ খাতে লোকসান হয়েছে। সেই লোকসান আমরা সামলে উঠব। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। বিজনেস হচ্ছে এক ধরনের গ্যামলিং।
লাভ-লোকসান ব্যবসায় থাকবে তাই বলে ব্যবসা গ্যামলিং হবে কেন? আমরা তো জুয়া খেলতে বসি নি।
আবেদ আলি ভুরু কুঁচকালেন। মনে মনে বললেন–ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল।
চিত্ৰলেখা বলল, আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাই নি–এত বড় একটা লোকসান হলো কেন?
যথাসময়ে এলসি খোলা হয় নি। তারপর আমাদের কিছু ক্রটি ছিল যার জন্যে পেনাল্টি দিতে হয়েছে।
কী ক্রটি?
ম্যাডাম বিষয়টা তো জটিল–চট করে বোঝাতে পারব না। সময় লাগবে।
সময় আপনাকে দিচ্ছি–আপনি বোঝাতে শুরু করুন। কাগজ-কলম লাগবে?
আবেদ আলি বললেন, মিস চিত্ৰলেখা, বসের কন্যাকে প্রাইভেট পড়ানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে না। তারপরও আমি আপনাকে বোঝাব। তবে এখন না। এখন আমাকে যেতে হবে। আমার জন্যে লোকজন অপেক্ষা করছে। আপনাকে আরো একটা কথা বলি মিস চিত্ৰলেখা, যখন-তখন আপনি মিটিং ডাকবেন না। এতে সবারই কাজের ক্ষতি হয়। মিটিং যখন ডাকবেন–এজেন্ডা ঠিক করে ডাকবেন। এজেন্ডা জানা থাকলে আমাদের তৈরি হয়ে আসতে সুবিধা হয়।
আবেদ আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। শুধু ফতেহ খান বললেন, ম্যাডাম তাহলে যাই? চিত্ৰলেখা বলল, আচ্ছা যান। তাকে সূক্ষ্মভাবে অপমান করা হলো তবে সে অপমান গায়ে মাখল না। সে বাবার চেয়ারে কিশোরী মেয়েদের মতো খানিকক্ষণ দোল খেল। তারপরই চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলল।
কিছু মজার মজার ফাইল এই ড্রয়ারে আছে। ফাইলগুলো বাড়িতে ছিল সে নিয়ে এসেছে। প্রতিদিনই সে খুব মন দিয়ে পড়ে। হিশামুদ্দিন সাহেব তার অফিসের প্রতিটা কর্মচারী সম্পর্কে আলাদা আলাদা নোট রেখে গেছেন। পড়তে পড়তে চিত্ৰলেখার প্রায় মনে হয়-বাবা যেন জানতেন একদিন চিত্ৰলেখা এই ফাইল পড়বে। পড়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
ফাইল তৈরি করা ছাড়াও হিশামুদ্দিন সাহেব আরো একটা কাজ করে গেছেন। কোম্পানি পরিচালনা সম্পর্কে দীর্ঘ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। চিঠির মতো করে লেখা এই নির্দেশনামা চিত্ৰলেখা বলতে গেলে প্ৰতিদিনই একবার করে পড়ছে।
মা চিত্ৰলেখা,
তোমার মাথায় বিরাট দায়িত্ব এসে পড়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার মাথায় তিন মণ ওজনের পাথর চেপে বসেছে? তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না?
যদি এ রকম মনে হয় তুমি পাথর ছুড়ে ফেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আমি একটি কর্মকাণ্ড শুরু করেছি। আমার মৃত্যুর পরেও তা চলতে থাকবে এ জাতীয় চিন্তাভাবনা আমার কোনো কালেই ছিল না। এই পৃথিবীতে সবকিছুই সাময়িক।
অবশ্য পুরো ব্যাপারটা তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দেখতে পার। আমার ধারণা তোমার সেই যোগ্যতা আছে। যদি তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও তাহলে তোমাকে আমার কিছু উপদেশ দেবার ইচ্ছা।
পুরনো কালে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধবিগ্ৰহ চলত। দু দল যুদ্ধ করছে। সেনাপতিরা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এই সময় হঠাৎ যদি কোনো কারণে কোনো একদলে সেনাপতি নিহত হয় তখন সেই দল সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়। সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অস্ত্র ফেলে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। এই ব্যাপারটা এখনো আছে৷ এখনো সেনাপতির মৃত্যু মানে যুদ্ধে পরাজয়। সৈন্যরা এখনো যুদ্ধ করে তাদের নিজেদের জন্যে না–যুদ্ধ করে তাদের সেনাপতির জন্যে।
সেনাপতিকে সৈন্যদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই কাজটা সবচে’ কঠিন। তুমি তা পারবে। ভালোভাবেই পারবে।
কোম্পানি পরিচালনা শুরুতে তোমার কাছে জটিল মনে হবে–কাজটা কিন্তু জটিল নয়। ঘোড়ার পিঠে চড়া এবং ঘোড়াটাকে দৌড়ানো শুরু করাটা জটিল, কিন্তু একবার যখন ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে তখন জটিলতা কিছু থাকে না। শুধু দেখতে হয়–পথ ঠিক আছে কি না। পথে কোনো খান্দা-খন্দ পড়ল কি না। অবশ্য আরেকটা জিনিস দেখতে হয় তোমার শেষ সীমাটা কোথায়? গোলটী কী?
তুমি অবশ্যই কোমল হবে। সেই কোমলতার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নির্মমতাও তোমার মধ্যে থাকতে হবে। যেখানে নির্মম হওয়া দরকার সেখানে কখনো কোমল হবার চেষ্টা করবে না। দয়া, করুণা এইসব মানবিক গুণাবলি কোম্পানি পরিচালনার কাজে আসে না বরং কাজ শ্লথ করে দেয়। মনে কর কেউ একটা অন্যায়। করল, কিংবা কারো কোনো কাজে কোম্পানি ক্ষতিগ্ৰস্ত হলো। তুমি যদি তার শাস্তি না দাও। তাহলে এই অন্যায়টি সে আবারো করবে। সে ধরে নেবে যে সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। শুধু সে না। অন্যরাও তাই ভাববে। You have to be cruel, only to be kind. কাজের পুরষ্কার যেমন থাকবে তেমনি অন্যায়ের শাস্তিও থাকবে।
ক্ষমা অত্যন্ত মহৎ গুণ। কোম্পানি পরিচালনায় ক্ষমা একটা বড় ত্রুটি।
কোম্পানির কার্যপ্ৰণালীর প্রতিটি খুঁটিনাটি তোমাকে জানতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি:–কোম্পানির অতি তুচ্ছ কাজ যে কজন করে তাদের একজন হলো রশীদ। রশীদ হলো সাইকেল পিয়ন। তার একটা সাইকেল আছে। হাতে হাতে চিঠি পাঠাতে হলে চিঠি এবং ঠিকানা দিয়ে রশীদকে বললেই সে চলে যাবে। তুমি কি জান রশীদ তার এই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করে। তাকে তুমি ঠিকানা লিখে চিঠি দেবে এবং তা সে পৌঁছাবে না। এটা কখনো হবে না।
একবার কী হয়েছে শোনা –সে একটী চিঠি নিয়ে গেল। যার চিঠি সে বাসায় ছিল না। রশীদ বাসার সামনে রাত তিনটা পর্যন্ত বসে রইল। কোম্পানি ঠিকমতো তখনই চলবে যখন যার যা কাজ তা ঠিকমতো করা হবে।
তোমাকে দায়িত্ব গ্ৰহণ করার পর একটি অপ্রিয় কাজ করতে হবে–কাজটা হচ্ছে জেনারেল ম্যানেজার পদে নতুন কাউকে আনা। অবশ্যই তোমাকে আবেদ আলিকে অপসারণ করতে হবে। কাজটা আমিই করে যেতাম। তোমার জন্যে রেখে গোলাম। আবেদ আলি অত্যন্ত কর্মঠ। সে নিজের কাজ খুব ভালো জানে। তার সমস্যা হলো সে নিজেকে এখন অপরিহার্য বিবেচনা করছে। যখন এই কাজটা কেউ করে তখন নানান সমস্যা হতে থাকে। সে নিজের স্বার্থটিকে প্ৰাধান্য দেয়। কাজকর্মেও হেলাফেলা ভাব চলে আসে। সে তার প্রতি অনুগত একটা শ্রেণীও তৈরি করে নেয়। আবেদ আলি তাই করেছে।
আবেদ আলির চাকরির টার্মিনেশন লেটার আমি তৈরি করে রেখেছি। আইনগত কিছু জটিলতা আছে বলেই তৈরি করে যাওয়া। তুমি যদি কোম্পানির দায়িত্ব নাও তাহলে এই টার্মিনেশন লেটার সই করে তুমি তাকে দেবে। আর তুমি যদি দায়িত্ব না নাও তাহলে যেমন আছে তেমনি থাকবে। তোমার অনুপস্থিতিতে তার প্রয়োজন আছে…
চিত্ৰলেখা আবেদ আলির চাকরির টাৰ্মিনেশন লেটারে নিজের নাম সই করল। তারিখ বসাল। ইন্টারকমে বলে দিল–সাইকেল পিয়ন রশীদকে যেন পাঠানো হয়।
রশীদ এসে দাঁড়াল মাথা নিচু করে। বেঁটেখাটো মানুষ। মালিক শ্রেণীর কারো দিকে চোখ তুলে তাকানো বোধহয় তার অভ্যাস নেই। সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।
কেমন আছ রশীদ?
ভালো।
এই ঠিকানায় একটা চিঠি দিয়ে এসো।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার সাইকেলটি ঠিক আছে?
বেল নষ্ট।
বেল ঠিক করার ব্যবস্থা কর।
কোযারটেকার স্যারকে বলেছিলাম।
উনি ব্যবস্থা করেন নি?
রশীদ চুপ করে রইল। সে কখনো তার ওপরওয়ালাদের বিষয়ে কোনো নালিশ করে না।
আচ্ছা আমি বলে দেব।
আমি চলে যাব? চিঠি দিয়ে এসে আপনাকে রিপোর্ট করব?
দরকার নেই। তুমি যাও। চিত্ৰলেখা কেয়ারটেকারকে ডেকে পাঠাল। কেয়ারটেকারের নাম সালাম। সে
ভীতমুখে সামনে এসে দাঁড়াল।
কেমন আছেন সালাম সাহেব?
জ্বি, আপা ভালো। কাজকর্মে মন বসছে না আপা।
মন বসছে না কেন?
স্যার নাই। কী কাজ করব কার জন্য করব?
আমার জন্যে করবেন।
তা তো অবশ্যই। . আমাদের যে সাইকেল পিয়ন রশীদ তার সাইকেলের বেল নষ্ট। বেল ঠিক হচ্ছে না কেন?
আমাকে তো আপা সে কিছু বলে নাই।
সে বলেছে। যেহেতু আপনার কাজকর্মে মন নাই আপনি শুনতে পান নি। বাবার মৃত্যুতে আপনি এতই ব্যথিত যে, কোনো কিছুই আপনি এখন মন দিয়ে শুনছেন না। আচ্ছা। আপনি যান–আমাদের জিএম সাহেবকে একটু আসতে বলে দিন।
জ্বি আচ্ছা। চিত্ৰলেখা ঘড়ি দেখল। তিনটা বাজে। অফিস আরো এক ঘণ্টা চলবে। সে অফিস থেকে ঠিক চারটায় বের হবে। আজ তার পরিকল্পনা হলো রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটা।
আবেদ আলি বিরক্তমুখে ঢুকলেন।
আমাকে ডেকেছেন?
চিত্ৰলেখা বলল, আবেদ আলি সাহেব বসুন।
মিটিঙের মাঝখান থেকে উঠে এসেছি।
কীসের মিটিং?
এলসি খোলার দেরি এবং ইরেগুলারিটি বিষয়ে একটা তদন্তের ব্যবস্থা করছি।
ও আচ্ছা।
কী জন্যে ডেকেছিলেন?
একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গের জন্যে ডেকেছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন, তারপর বলছি।
আবেদ আলি বসলেন। তার ভুরু কুঞ্চিত। চিত্ৰলেখা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক গলায় বলল, কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে একটি অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে। আপনার সার্ভিস আমাদের আর প্রয়োজন নেই। আমাদের কাছে মনে হচ্ছেকোম্পানির স্বাৰ্থ আপনি এখন আর আগের মতো দেখছেন না। সত্তর হাজার পাউন্ডের যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে—তার দায়-দায়িত্বও সম্পূর্ণ আপনার।
কী বলছেন?
যা সত্যি তা বলছি।
আমাকে ছাড়া আপনি তো সাত দিনও চলতে পারবেন না। আপনি তো সামান্য মানুষ আপনার বাবারও আমি ডানহাত ছিলাম।
আমার বাবা যেহেতু নেই; আমার বাবার ডানহাতেরও প্রয়োজন নেই তাই না? নিন এটা হচ্ছে আপনার জব টামিনেশন লেটার। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন, এই চিঠি বাবাই লিখে টাইপ করে রেখে গেছেন। আমি শুধু নাম সই করেছি। কিছু কিছু মানুষ মৃত্যুর পরেও তাদের উপস্থিতির ব্যবস্থা রেখে যায়।
আবেদ আলি চিঠি পড়ছেন। তার হাত কাঁপছে। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অপ্ৰত্যাশিত।
আবেদ আলি সাহেব!
জ্বি।
আপনার দায়িত্ব আপনি এজিএম সাহেবকে বুঝিয়ে দেবেন।
ম্যাডাম ব্যাপারটা কি আরেকবার কনসিন্ডার করা যায় না?
জ্বি না, যায় না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে। আপনি এখন আসুন।
আপনি বিরাট সমস্যায় পড়বেন। হাতেপায়ে ধরে আবার আমাকেই আপনার আনতে হবে।
আনতে হলে আনব। এই মুহুর্তে আপনাকে আমাদের দরকার নেই।
চিত্ৰলেখা আরেক কাপ চায়ের কথা বলল। অফিসে বসার পর থেকে তার খুব ঘনঘন চা খাওয়া হচ্ছে। অভ্যাসটা কমাতে হবে। মাথা ধরেছে। মাথাধরা কমানোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ওষুধ খেতে ইচ্ছা করছে না। খোলা বাতাসে বসা দরকার। এসি দেয়া বদ্ধঘরে এক সময় দম আটকে আসে। চিত্ৰলেখা এসি বন্ধ করল। জানালার পরদা সরাল। জানালা খুলল। দিনের আলো নিভে আসছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেঘ বলেছে যাব যাব? মেঘেরা কোথায় যেতে চায়? হিমালয়ের দিকে না। অন্য কোথাও? মানুষের পাখা থাকলে ভালো হতো। মেঘদের সঙ্গে উড়ে বেড়াত। মেঘদের সঙ্গে বাস করলেই জানা যাবে মেঘেরা কোথায় যেতে চায়।
আসব?
চিত্ৰলেখা জানালা থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, আসুন। রশীদ তাহলে আপনাকে খুঁজে পেয়েছে। বসুন।
হাসান বসল। সে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই বিশাল অফিসে এই প্রথম এসেছে। তার চোখে বিস্ময়।
চা খাবেন?
জ্বি না।
খেয়ে দেখতে পারেন। এরা চা খুব ভালো বানায়। দার্জিলিঙের চা পাতা এবং বাংলাদেশের চা পাতা সমান সমান নিয়ে একটা মিকচার তৈরি হয়। সেই মিকচার দিয়ে চা বানানো হয়।
তাহলে দিতে বলুন।
আপনাকে ডেকেছি। কী জন্যে জানেন?
জ্বি না।
আপনাকে ডেকেছি। কারণ আজ বিকেলে আপনাকে নিয়ে ঘুরব। গাড়িতে করে না।—হণ্টন।
বৃষ্টি আসছে তো!
আসুক। আমার একটা রেইনকোট আছে–আপনার জন্যে ছাতা আনিয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টির সময় রেইনকোট পরে হাঁটা আমার খুব পুরনো অভ্যাস। নোট করছেন তো?
হাসান বিস্মিত হয়ে বলল, কী নোট করব?
কথাবার্তা যা বলছি। এইসব–এই যে একটু আগে বললাম, আমার পুরনো অভ্যাস হচ্ছে বৃষ্টিতে রেইনকোট পরে হাঁটা। আমি তো আগে একবার আপনাকে বলেছিবাবার মতো আমিও আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে পে করব। কাজেই আপনি যত বেশি সময় আমার সঙ্গে কাটাবেন ততই আপনার লাভ।
হাসান তাকিয়ে আছে। চিত্ৰলেখাকে কেমন যেন অস্থির লাগছে।
হাসান সাহেব!
জ্বি।
অকারণে আপনাকে ডেকে আনায় আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?
জ্বি না।
বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। আমি মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।
আপনার এরকম অবস্থা যখনই হবে খবর দেবেন–আমি চলে আসব।
বৃষ্টি মনে হয় আসছে—তাই না?
জ্বি।
চিত্ৰলেখা মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে।
২০ পর্ব শেষ 📌
🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :২১)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
তারেক মাগরেবের নামায শেষ করে
তারেক মাগরেবের নামায শেষ করে বারান্দায় এসে বলল, লায়লা আমাকে চা দে।
চা তৈরিই ছিল। লায়লা চায়ের কাপ এনে সামনে রাখল। তারেক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোর অবস্থা কী?
লায়লা বিস্মিত গলায় বলল, আমার আবার কী অবস্থা?
পড়াশোনার অবস্থা।
পড়াশোনার অবস্থা খুবই খারাপ। এইবার পরীক্ষা দিলে পাস করতে পারব না।
তাহলে এ বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর দে।
ভাইয়া আর কিছু বলবে?
না। সিগারেটের প্যাকেট আর দেয়াশলাই এনে দে।
লায়লা সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই এনে দিল। তারেক বলল, টগর আর পলাশকে বই নিয়ে বসতে বল। আমি পড়া দেখিয়ে দেব।
তারেক চুকচুক করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। নামাযের সময় সে মাথায় টুপি পরেছিল, সেই টুপি এখনো খোলা হয় নি। টুপি মাথায় তাকে শান্ত সমাহিত মনে হচ্ছে। চা খেতে খেতে সে পা নাচাচ্ছে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যাকালীন এই চায়ের আসর তার ভালো লাগছে।
একমাসের ওপর হলো রীনা নেই। তার অনুপস্থিতিতে বড় ধরনের যে সমস্যার আশঙ্কা করা গিয়েছিল এখন মনে হচ্ছে সে আশঙ্কা অমূলক। সে না থাকায় বরং কিছু সুবিধা হয়েছে। তারেক ঘুমাচ্ছে একা। বেশ হাতপা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারছে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খেতে পারছে। কথা বলার কেউ নেই। টুথপেস্টের মুখ লাগানো হয় নি, ব্রাশটা বেসিনে পড়ে আছে কেন এই নিয়েও বলার কেউ নেই। রীনা মশারি না খাটিয়ে ঘুমাতে পারত না। তারেকের কাছে মশারি ছিল অসহনীয় যন্ত্রণা। এখন মশারি খাটাতে হচ্ছে না। ফুলম্পিডে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে থাকলে মশার কাছে ভিড়তে পারে না। মানুষের কাছে ফ্যানের বাতাসটা আরামদায়ক। মশাদের কাছে সেই বাতাস হলো টর্নেডো; প্রচণ্ড টর্নেডোর সময় মানুষ যেমন ডিনার খেতে বসে না, মশারাও তেমনি রক্ত খেতে আসে না। এই সহজ সূত্র সে রীনাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছে–রীনা বুঝতে চায় নি। এখন আর বোঝাবুঝির কিছু নেই।
মনোয়ারা ছেলের ওপর রাগ করে চলে গেছেন। এটা একটা দুঃখের ব্যাপার হয়েছে। তারেক তার মাকে খুবই পছন্দ করে। মার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা না বললে তার দমবন্ধ লাগে। মা না থাকার একটা ভালো দিকও আছে। মার ঘরটিকে তারেক বর্তমানে নামাযঘর করে ফেলেছে। পাঁচ ওয়াক্তের জায়গায় এখন শুধু দু ওয়াক্ত করে ‘ নামায পড়া হচ্ছে। শুরু হিসেবে এটা খারাপ না।
রানার অভাব লায়লা অনেকটা পূরণ করেছে। রান্নাবান্নার ব্যাপারটা দেখছে। টগরপলাশকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসার কাজও করছে। কলেজে যাচ্ছে খুব কম। মনে হয় এ বছর বি.এ. পরীক্ষা সে ড্রপই করবে। সংসারের জন্যে এটা ভালো। বি.এ. পরীক্ষার চেয়ে সংসার অনেক বড়।
টগর-পলাশের ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। মা নেই কেন? কিবে আসবে?’ এ জাতীয় কথা তারা তারেককে এখনো জিজ্ঞেস করে নি। তবে লায়লাকে এবং হাসানকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করছে। তারা কী জবাব দিচ্ছে কে জানে। সময় এবং সুযোগমতো একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। অবশ্যি জিজ্ঞেস না করলেও হয়। এরা ঝামেলা করছে না। এটাই বড় কথা। এমন কি হতে পারে মা ঘরে না থাকায় তারা আনন্দিত? হতে পারে। খাওয়া নিয়ে তাদের বকাঝকা কেউ করছে না, চড় থাপ্নড় মারছে না। দেয়ালে ছবি আঁকছে। কেউ কিছু বলছে না। প্রায়ই স্কুল কামাই করছে। মা থাকলে সে উপায় ছিল না। স্কুলে যেতেই হতো।
তারেকের আজকাল প্রায়ই মনে হয় মানুষের সংসার না থাকাই ভালো। আর থাকলেও সে সংসার হবে সাময়িক ধরনের সংসার। সেই সংসারে স্ত্রী পুত্ৰ কন্যা সবই থাকবে। মাঝে মাঝে সেখানে বেড়াতে যাওয়া, কয়েকদিন থেকে চলে আসা। সব পুরুষরা থাকবে হোটেলে। সবার জন্যে আলাদা আলাদা ঘর। ঘরে এটাচড বাথ থাকবে, টিভি থাকবে। খাবারের সময় হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যাবে। ছেলের জন্মদিন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সিরি এইসব উৎসবে সংসারে ফিরে যাওয়া! আবার ফিরে আসা।
রীনা চলে যাবার পর লাবণীর সঙ্গে তারেকের আর তেমন যোগাযোগ হয় নি। লাবণী একটা চিঠি লিখেছিল। কেমন আছেন, ভালো আছেন টাইপ চিঠি। চিঠির জবাব দেয়া হয় নি। তারেক রোজই একবার ভাবে চিঠির জবাব দেবে–শেষে আর দেয়া হয় না। রাতে ঘুম পেয়ে যায়। ইদানীং তার ঘুমাও খুব বেড়েছে। ভাত খাবার পর থেকে হাই উঠতে থাকে।
দুই পুত্রকে নিয়ে তারেক পড়াতে বসল। বাচ্চা দুটি বিছু হয়েছে। যমজ বাচ্চারা বিষ্ণু ধরনের হয় এটি সনাতন সিদ্ধ ব্যাপার। এরা দুজন যমজ না হলেও বিক্ষুর ওপরেও এক ডিগ্রি বিষ্ণু। হোমওয়ার্কের খাতায় ভূতের ছবি আঁকা। মাথা থেকে এইসব দুষ্টামি দূর করতে হবে। কঠিন হওয়া যাবে না। কাঠিন্য যে-কোনো সমস্যার বড় বাধা।
কেমন আছিস রে টগর?
গুড আছি বাবা।
পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
গুড হচ্ছে।
কথায় কথায় গুড বলছিস কেন?
মিস বলেছে বাসায় সব সময় ইংরেজি বলতে হবে।
হোমওয়ার্কের খাতায় এটা কীসের ছবি?
ভূতের ছবি। ভূতের গলা এত লম্বা থাকে নাকি?
এটা সাপভূত তো এজন্যে গলা লম্বা। সাপভূতদের গলা লম্বা হয়।
হোমওয়ার্কের খাতায় ছবি আঁকছিস কেন?
ছবি আঁকার খাতা শেষ হয়ে গেছে এই জন্যে।
মিস রোগ করবে।
মিস খুব এংরি হবে। রাগের ইংরেজি হলো এংরি।
এংরি বানান কী?
বানান জানি না।
পলাশ তুই জানিস?
জানি না।
গুড বানান জানিস?
জানি, কিন্তু বলব না।
বলবি না কেন?
তুমি তো আমাদের মিস না। মিস বানান জিজ্ঞেস করলে বলতে হয়।
আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হয় না?
না।
তারেক সিগারেট ধরাল। এদের পড়াশোনা করানো মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। একজন টিচার রেখে দিতে হবে। বাড়তি খরচ, তাতে অসুবিধা হবে না। সংসারে মানুষ কমে গেছে। লায়লার বিয়ে হলে আরো কমবে। তার বেতনও কিছু বাড়বে। খুব শিগগিরই প্রমোশন হবার কথা। পলাশ বলল, বাবা সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়।
কে বলেছে, মিস?
না, মা বলেছে।
মার প্রসঙ্গ চলে আসায় তারেক একটু শঙ্কিত বোধ করল। এই প্রসঙ্গ আলোচনায় না আসাই বোধহয় মঙ্গলজনক। টগর গম্ভীর গলায় বলল, যে সিগারেট খায় সে মারা যায়। আর সিগারেট খাবার সময় আশেপাশে যারা থাকে তারাও মারা যায়। তুমি সিগারেট খেলে আমরা মারা যাব।
কে বলেছে, তোদের মা না মিস?
মা বলেছে। সিগারেট যেমন খারাপ, চকলেটও খারাপ। চকলেট খেলে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। এক রকম পোকা এসে দাঁত খেয়ে ফেলে। দাঁতের ইংরেজি হলো টুথ।
তারেক সিগারেট ফেলে দিল। মার প্রসঙ্গ চলে এসেছে–এখন কি সেই বিষয়ে দুএকটা কথা বলা ঠিক হবে? না পুরো বিষয়টা নিয়ে চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
টুথের বানান কী?
ট-উ-কারে টু, থ—টুথ।
বাংলা বানান না। ইংরেজি?
জানি তোমাকে বলব না।
তারেক ইতস্তত করে বলল, তোর মা যে আসছে না। এ নিয়ে কী করা যায় বল তো?
টগর-পলাশ দুজনই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তারেক বাচ্চাদের দিকে না। তাকিয়ে বলল, তোর মা যে আসছে না, এ জন্যে নিশ্চয়ই তোদের মন খারাপ। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।
পলাশ বলল, দেখা হয় তো।
পলাশের এই কথা বলা মনে হয় ঠিক হয় নি। টগর চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলেছে। তারেক বিস্মিত হয়ে দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
মা’র সঙ্গে দেখা হয়?
হুঁ।
বাসায় আসে নাকি?
না। স্কুলে যায়।
স্কুলে যায়?
একদিন মা তার বাসায় নিয়ে গেল।
বাসায় নিয়ে গেল মানে–বাসা ভাড়া করেছে? বাসা কোথায়?
জানি না।
বাসাটা কেমন?
সুন্দর।
সে একাই থাকে না। আরো লোকজন থাকে?
জানি না।
জানিস না মানে কী? বাসায় আর কাউকে দেখিস নি?
উঁহুঁ।
তোদের মা যে তোদের দেখতে আসে, তোরা যে তার বাসায় গিয়েছিলি এটা এ বাড়ির আর কে জানে?
সবাই জানে। শুধু তুমি জান না।
মার বাসায় কীভাবে গিয়েছিল–সে এসে নিয়ে গিয়েছিল?
চাচু নিয়ে গিয়েছে। আবার নিয়ে এসেছে।
হাসান নিয়ে গেছে?
হুঁ।
তারেক অ্যাশট্রেতে ফেলে দেয়া আধা-খাওয়া সিগারেট তুলে নিল। তার দুই পুত্ৰ তার দিকে তাকিয়ে আছে। টগর বলল, ব্যাটম্যান মানে কী, তুমি জানি বাবা?
তারেক অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, না।
ব্যাটম্যান মানে হলো বাদুরমানুষ। ব্যাট মানে বাদুর। ম্যান মানে মানুষ।
ও।
বাদুরমানুষ কিন্তু উড়তে পারে না। শুধু লাফ দিতে পারে। একটা বাড়ির ছাদ থেকে আরেকটা বাড়ির ছাদে যায়। আর ঘোস্ট মানে কী জান?
হুঁ।
ঘোস্ট মানে ভূত। ভূত কিন্তু পৃথিবীতে হয় না। শুধু কার্টুনে হয়। আমাদের মিস বলেছে। অদৃশ্য মানব কাকে বলে তুমি কি জান বাবা?
না।
অদৃশ্য মানবকে চোখে দেখা যায় না। অদৃশ মানব কিন্তু ভূত না। মানুষ।
হুঁ।
অদৃশ মানব চোখে দেখা যায় না, এই জন্যে এদের ছবিও আঁকা যায় না। কিন্তু পলাশ তো বোকা–এই জন্যে সে অদৃশ্য মানবের ছবি এঁকেছে। ছবি দেখবে বাবা?
তারেক ‘হুঁ’ বলল। কিন্তু উঠে চলে গেল। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না-সবাই মিলে কি তাকে বয়কট করেছে? হাসানের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা দরকার; হাসানের সঙ্গে তার দেখা ইদানীং হচ্ছে না। হাসানের ব্যস্ততা খুব বেড়েছে। কোনো একটা কাজটাজ বোধহয় করছে। কী কাজ তা এখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি। যে কাজই করুক খুব পরিশ্রমের কাজ নিশ্চয়ই। রোদে পুড়ে চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে। সস্তা সিগারেটও মনে হয় প্রচুর খাচ্ছে। হাসান পাশ দিয়ে গেলে মনে হয় তামাকের একটা ফ্যাক্টরি হেঁটে চলে গেল। জর্দা দিয়ে পানও খাচ্ছে–দাঁত লাল–মুখ দিয়ে ভুরিভুরে জর্দার গন্ধ আসে।
হাসান দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তারেক ধাক্কা দিতেই উঠে এসে দরজা খুলল।
ঘুমোচ্ছিলি?
না। শুয়েছিলাম।
দশটা বাজতেই শুয়ে পড়লি, শরীর খারাপ?
জ্বর জ্বর লাগছে।
রোদে রোদে ঘুরলে জ্বর তো লাগবেই-ভদ্রে মাসের রোদে তাল পেকে যায়, মানুষ তো পাকবেই। ভদ্র মাসে রাস্তাঘাটে মানুষ ঘোরে তাদের বেশির ভাগই পাকা মানুষ।
সিগারেট লাগবে ভাইয়া?
না সিগারেট লাগবে না। এক প্যাকেট কিনেছিলাম, সাতটা খেয়েছি। এখনো তেরটা বাকি আছে। এলাম তোর সাথে একটু গল্প-গুজব করি, বাতিটা জ্বালা।
হাসান অনিচ্ছার সঙ্গে বাতি জ্বালোল। তার জ্বর এসেছে। ভালো জুর। দুপুরে সে কিছু খায় নি। রাতেও খায় নি। ক্ষিধেয় নাড়ি পাক দিচ্ছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে কোনো খাবার সামনে আনলেই বমি হয়ে যাবে।
তারেক বসতে বসতে বলল, তোর ভাবি ঝোঁকের মাথায় ফট করে চলে গেল। এই নিয়ে কারো সঙ্গে কথাও বলা হয় নি।
কথা বলার কী আছে?
সেটাও ঠিক কথা বলার কী আছে? লজ্জাজনক ব্যাপার।
তোমার জন্যে লজ্জাজনক তো বটেই। যা ঘটেছে তোমার জন্যেই ঘটেছে।
তোর ভাবি কোথায় আছে কিছু জানিস?
শ্যামলীতে আছে। তার এক বান্ধবীর বাড়িতে।
ও আচ্ছা।
ঠিকানা চাও?
না ঠিকানা দিয়ে কী করব?
তুমি যদি মনে করা–ভাবির সঙ্গে কথা বলে তাকে ফিরিয়ে আনবে।
সেটা ঠিক না। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কোনো কাজের কথা না। আমি তাকে চলে যেতে বলি নি–সে চলে গেছে। আমি যদি তাকে চলে যেতে বলতাম তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার ছিল। যদি আসার হয় নিজেই আসবে।
হাসান হাই তুলতে তুলতে বলল, ভাবি কঠিন জিনিস। নিজ থেকে আসবে না।
না এলে কী আর করা। বাচ্চাদের খানিক সমস্যা হবে–এই আর কী? সমস্যা তো পৃথিবীতে থাকেই। সমস্যা নিয়েই আমাদের বাস করতে হয়।
তুমি কি তোমার অফিসের ওই মহিলাকে বিয়ে করবে?
বিয়ের কথা আসছে কেন?
বিয়ে হচ্ছে না?
তারেক সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সহজ গলায় বলল, টগরের কাছে শুনলাম–ওদের মার সঙ্গে দেখা হয়–এটা ভালো। আর্লি ষ্টেজে মার ভালোবাসা দরকার। মায়ের ভালবাসা ভিটামিনের মতো কাজ করে। যাক।—সময়ে-অসময়ে ভিটামিনটা পাচ্ছে।
হুঁ।
ও কি চাকরি-বাকরি কিছু করছে?
জানি না। হয়তো করছে।
চাকরির বাজার খুবই টাইট–তবে মেয়েদের স্কোপ বেশি। বলিস ভালোমতো যোগাযোগ করতে। পত্রিকা দেখে এপ্লিকেশন করলে হবে না। সরাসরি উপস্থিত হতে হবে।
ভাইয়া আমার মাথা ধরেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
দে একটা সিগারেট খাই। সিগারেটটা শেষ করে চলে যাব।
নিজের ঘরে গিয়ে খাও।
তোর এখানে খেয়ে যাই।
ভাইয়া তুমি কি ভাবিকে টেলিফোন করতে চাও? ভাবি যে বাড়িতে থাকে সেখানকার টেলিফোন নাম্বার আমার কাছে আছে।
টেলিফোন করে কী করব?
কী করবে তা জানি না। টেলিফোন নাম্বার আছে তুমি চাইলে দিতে পারি।
আচ্ছা দে রেখে দেই। তোর এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে রোদে পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে গেছিস। ব্যাপার কী?
কোনো ব্যাপার না।
রোদে বেশি ঘুরবি না। চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট রে খুব খারাপ। ঙ্কিনক্যানসার হয়।
হুঁ। ভাইয়া এই নাও ভাবির টেলিফোন নাম্বার। এখন চলে যাও। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরা–কথা বলতে ভালো লাগছে না।
হালকা ধরনের কথাবার্তা বললে বরং মাথা ধরাটা কমে। লাইট ডিসকাশন ওষুধের মতো কাজ করে।
ভাইয়া আমার বেলায় করে না। তাছাড়া আমাদের ডিসকাশন মোটেই লাইট হচ্ছে न्म।
তারেক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর সঙ্গে আরেকটা জরুরি কথা ছিলএখন মনে পড়ছে না।
মনে পড়লে বলবে।
যখন মনে পড়বে তখন দেখা যাবে তুই পাশে নেই। আর তোর সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন আর জরুরি কথাটা মনে পড়বে না। মানুষের জীবন মানেই এই জাতীয় জটিলতা।
হুঁ।
মানুষের মনে যে বয়সে নানান ধরনের শখ হয় সে বয়সে টাকা-পয়সা থাকে না। বুড়ো বয়সে যখন টাকা-পয়সা হয় তখন আর শখ থাকে না।
তোমার কী শখ?
ব্যাংককে গিয়ে একবার একটা ম্যাসেজ নেয়ার শখ ছিল। এই বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমার পরিচিত কয়েকজন ম্যাসেজ নিয়েছে। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। বিরাট একটা কাচের ঘরের পেছনে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ইয়াং মেয়েরা সেগোগুজে বসে থাকে। প্ৰত্যেকের আলাদা আলাদা নম্বর আছে। তোর একটা মেয়ে পছন্দ হলো–ধর তার নাম্বার তিন শ তের। তুই তিন শতের নাম্বারে একটা কার্ড…।
ভাইয়া চুপ কর। তোমার কাছ থেকে এ সব শুনতে খুবই অস্বস্তি লাগছে। এইসব তুমি কী বলছ?
কী বলছি মানে? খারাপ কী বলছি?
কী বলছি বুঝতে পারছি না? তোমার জীবনের সবচে’ বড় শখ একটা বেশ্যা মেয়ে তোমার গা দলাই মলাই করবে।
বেশ্যা মেয়ে বলছিস কেন? ওরা সব কলেজ-ইউনিভার্সিটির মেয়ে। স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলির মেয়ে। তাছাড়া এটাই যে আমার জীবনের সবচে’ বড় শখ তাও না। অনেকগুলো শখের মধ্যে একটা…।ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ
ভাইয়া আমার খুব মাথা ধরেছে, তুমি এখন যাও।
শ্যাস্পেনের এত নামধাম শুনেছি। খেয়ে দেখার শখ ছিল–একটা বোতলের দামই শুনেছি। দু-তিন হাজার টাকা…।
ভাইয়া প্লিজ আমি আরেকদিন তোমার শখের কথাগুলো শুনবো।
তুই এমন রেগে গেলি কেন?
রাগি নি। আমি তো বললাম, আমার খুব মাথা ধরেছে।
কমলার মাকে বল এক বালতি গরম পানি করে দিতে। গরম পানি দিয়ে হট শাওয়ার নিলে শরীরটা হালকা হবে, ভালো ঘুম হবে।
আচ্ছা আমার যা করার করব তুমি যাও।
ফট করে রেগে গেলি। আশ্চর্য!
তারেক নিজের ঘরে ঢুকল। হাসানকে যে জরুরি কথাটা বলার ছিল সে কথাটা তখনি মনে পড়ল। তাকে গিয়ে সেই কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। অকারণে সে যেমন রেগে গেছে–দরজায় ধাক্কা দিলে সে হয়তো দরজাই খুলবে না। কথাটা হচ্ছে তার অফিসে একটা মেয়ে টেলিফোন করেছে। মেয়েটার নাম চিত্ৰলেখা। সে হাসানকে খুঁজছে। খুব নাকি জরুরি। একবার না, মেয়েটা টেলিফোন করেছে। দু’বার।
ঘুমোতে যাবার আগে তারেক একটা কাগজে বড় বড় করে লিখল–চিত্ৰলেখা। সকালবেলা এই কাগজটা দেখলেই তার মনে পড়বে। হাসানকে খবরটা দেয়া যাবে।
সবচে’ ভালো হতো এখন দিতে পারলে।
রীনাকে টেলিফোন করার কোনো ইচ্ছা তারেকের ছিল না। অফিসে এসে রুমাল বের করার জন্যে পকেটে হাত দিয়ে দেখে রীনার টেলিফোন নাম্বার লেখা কাগজ। টেলিফোন করলে কে ধরবে? রীনার বান্ধবী? নাকি রীনাই ধরবে? তারেক টেলিফোন করবে কী করবে না বুঝতে পারছে না। তারপরেও কী মনে করে করল। দুটা রিঙের ভেতর না ধরলে সে রেখে দেবে।
দুটা রিং বাজতেই রীনা ধরল। গম্ভীর গলায় বলল, হ্যালো কাকে চাচ্ছেন? তারেক বলল, কে রীনা?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
কোনো ব্যাপার না। কেমন আছ?
ভালো আছি।
ও আচ্ছা এইটা জানার জন্যে। বাসার খবর ভালো–টগর পলাশ দুজনই ভালো আছে।
আচ্ছা।
হাসানের শরীরটা মনে হয় খারাপ। কাল রাতে জ্বরটির মনে হয় এসেছে ভাত খায় নি। রোদে রোদে ঘুরে চেহারাটাও খারাপ হয়ে গেছে। আমি বলেছি রোদে কম ঘুরতে।
ভালো।
লায়লার বিয়ের কথা হচ্ছিল–বিয়েটা হয়ে যাবে মনে হয়। ছেলে ভালো। বয়স সামান্য বেশি। ডিভোর্সড।
ও।
রকিব এসেছিল। ও এর মধ্যে দু’মাসের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। ঘুরেটুরে এসেছে। দু’মাসের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। আমি তো জানতামই না। তাজমহল দেখে এসেছে। জয়সলমীরও গিয়েছিল। উটের পিঠে চড়ে ছবি তুলেছে। আমার জন্যে জয়পুরী পাঞ্জাবি এনেছে। তোমার জন্যে একটা শাড়ি এনেছে। আমি হাসানকে বলব তোমাকে দিয়ে আসতে। ও তো তোমার বাসা চেনে।
আর কিছু বলবে?
না।
চিটাগাঙের ওই মেয়ে–লাবণীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
ও দুটা চিঠি দিয়েছিল। আগে জবাব দেই নি–কাল একটার জবাব দিয়েছি।
এর মধ্যে চিটাগাং যাও নি?
না।
কবে যাবে?–ঘুরে আসছ না কেন? লাবণী আর তার মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসা। সমুদ্র দেখিয়ে আন।
তারেক কিছু বলল না। রীনা বলল, টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। তারেক বলল, আচ্ছা! পরে কথা হবে। তুমি ভালো থেকে।
আমি ভালোই থাকব। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আচ্ছা শোন, আমি টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। আমার অফিসের গাড়ি এসে গেছে। হর্ন দিচ্ছে।
অফিসের গাড়ি এসেছে মানে তুমি কি চাকরি করছ নাকি?
সামান্য চাকরি করছি।
রিসিপশনিস্ট? শোন, রিসিপশনিক্টের কাজে কোনো প্রসপেক্ট নেই–অন্য কোনো লাইনে ঢোকার চেষ্টা কর।
আমি এখন রাখলাম।
তারেকের একটু মন খারাপ লাগছে। অফিসের ব্যাপারটা আর ভালোমতো জানা হলো না। কোন অফিস–কত বেতন কিছুই জানা হলো না। অফিসের টেলিফোন নাম্বারটাও নিয়ে রাখলে হতো।
পর্ব ২১ শেষ 📌