#মেঘে ঢাকা জ্যোৎস্না
লেখক – সিরাজুম মনিরা
পর্ব-৬ (শেষ পর্ব)
আজও চাদনী রাত। জোৎস্নার আলোয় সব দিকে যেনো জোৎস্না স্নাত হয়ে আছে। ঝিরি ঝিরি বাতাস আজও বইছে। আজও করপুর গন্ধ ভেসে আসছে। আর আজ এই জ্যোৎস্না রাতে অপুর বাসর রাত।
সব কিছু চলছে যার যার নিজের নিয়মে। শুধু থমকে গেছে আমার জীবন। জীবন ঘড়ির কাটাটা হয়ত জং পড়ে গেছে। নইলে হারিয়ে গেছে ব্যাটারী।
নদীর কূল ভাঙ্গলে সবাই দেখতে পায়, কিন্তু মন ভেঙ্গে গেলে কেউ দেখতে পায় না। তুফান এসে সব ভেঙ্গে গেলে, মানুষ তা নতুন করে গড়ে। কিন্তু মনের তুফানে মন ভেঙ্গে গেলে, সেটাকি কখনও জোড়া লাগে? নাকি কেই বুঝতে পারে?
আমার শাশুড়ী কে জিজ্ঞেস করতে মন চায়, সমস্যা আমার না হয়ে যদি আপনার ছেলের হতো? আপনি কি ছেলে খুঁজে আমার বিয়ে দিতেন? আমার সন্তান আমাকে ছেড়ে গেছে এক বছর হলো না, কিন্তু সান্তনা দেবার জন্যে অপু তুমি একটা বছর থাকলে না! সেতো তোমারও সন্তান!
বহুবছর পর আজ বিয়ের শাড়িটা পরতে খুব ইচ্ছে হলো, রাবেয়া আমার পাশে বসে থেকে ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটা আমাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। ওর বাবা মা বহুবার এসেছে নিতে। মেয়েটা যায় নি। এ কারনেই হয়ত মানুষ বলে” আপনের থেকে পর ভালো, পরের থেকে জঙ্গল ভালো। তবে হয়ত বেশিদিন রাবেয়াকে রাখতে পারবো না। ওকে বিয়ে দেবো আমি।
বিয়ের শাড়িটা পরে, গহনা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পর আয়নায় নিজেকে দেখলাম, বিয়ের শাড়ীতে আমাকে একেবারে বিশ্রী লাগছে। কবে কবে এতো মোটা হয়েগেছি, চুলে পাক ধরেছে। গায়ের রঙ হারিয়ে গেছে কোথায়! চোখের নিচে গাড় কালো দাগ।
কিন্তু এটা-কি আমার পরিচয়। আমার পরিচয় কি আমি নিজে নই। জীবনে সুখে থাকতে, অপুকে সুখে রাখতে আমি কি চেষ্টা করিনি। জীবনের সাথে যুদ্ধ করিনি?
জীবনে ভালোবাসা প্রেম এগুলো আমার স্বপ্ন ছিলনা । এ স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছো। যবে থেকে ভালোবাসতে শিখেছি, তবে থেকে তুমি আমার অভ্যেস। তোমায় ভালোবেসে আমি তৃপ্ত। আমি বেঁচে আছি তোমায় ভালোবেসে, তোমার ভালোবাসার বিশ্বাসে, নি:স্বাসে, আশ্বাসে। ভালোবাসা মানেই তোমার আশ্রয়। আমার কাছে তুমি সেই আগের মতোই আছো, ভালবাসার।
আমার বয়স হয়েছে, অপু তুমিও সেই আগের মতো নেই। তোমারও চুল পেকেছে, যদিও তুমি কলোপ করে তা ঢেকে রেখেছো। পেটের মেদটা তোমারও বেড়েছে। তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। তুমি আমার জীবন সঙ্গী, তুমি যেমনই হয়ে যাও তুমি আমার। কিন্তু তোমার কাছে আমি………..
সেদিন যদি ডা: সেলিনা বলতো, তোমার সমস্যা! আমি-কি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারতাম। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা কি শুধুই সন্তান কেন্দ্রীক।
দীর্ঘ দিন সংসার সামলাতে যেয়ে ভুলেই গেছিলাম আমার নিজের স্বত্ত্বাকে। বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ী, নিজের সন্তান, স্বামী এর বাহিরে আমি মানুষ কিংবা একজন নারী তা আমার স্বরনের অতীত হয়ে গেছিল।
মানুষের অসুস্থ হলে, তার চিকিৎসা হয়। কিন্তু মনে অসুখ হলে তার কি আর চিকিৎসা হয়। তোমার ভালোবাসা মেশানো সংসারে, তুমি আমায় দিয়েছো অনেক শখের শূন্যতা। তোমার শখের বৌ আজ শখের বিষাদে পরিপূর্ন। তা দেখার সময় কোথায় তোমার!
মানুষের জীবন ঘটনা বহুল। কখন কার জীবনে কি ঘটে কেউ বলতে পারে না। আজ যে জীবনে স্বর্গের
মতো সুখ, ক্ষনিকের মাঝে সে জীবনে বিষাদ নেমে আসতে পারে।
আজ যে জীবনে আপন জনের, ভালোবাসার কিংবা মমত্বের অভাব নেই। সেই জীবনে কখন সব হারিয়ে নি:স্ব অসহায় হয়ে পড়বে, কেউ বলতে পারবে না।
আজ আমার জীবনে একাকিত্ব, নিখাদ একাকিত্ব। জীবনের সবচেয়ে সম্পদ হারিয়ে আমি কাঙ্গাল প্রায়। আমার সুন্দর গোছানো জীবনে আজ কালবৈশাখি ঝড়। আকাশে চাঁদের আলোয় জোৎস্না রাত হলেও হৃদয়ে আমার ঘোর অমাবস্যা। অপু জীবনে আসার পর থেকে প্রতিটা সকাল ছিল ফাল্গুনের শুভ্রতায় মতো স্নিগ্ধ, আজ যা চৈত্রের দাবদাহে পরিপূর্ন।
ভালোবাসতে শিখেছি তোমার কাছে। তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে অন্ধের মতো। ভালোবেসে আমায় বানিয়েছিলে মহারানী। আর তোমায় ভালোবেসে আমি হয়ে গেলাম কাঙ্গাল।
দু:খ নেই, সন্তান হারা মায়ের বুকে যে যন্ত্রনা আর হাহাকার! তার চেয়ে বড় কষ্ট আর কি?
কিন্তু নারীর জীবনে স্বামী হারাবার কষ্ট বুঝি আরও বেশি বিষাদময়! বুকের মাঝে কষ্টের নীল বিষাদ কেমন যেন তিক্ত অনুভূতির।
নিজের অজ্ঞাতে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি অসীম। তুমি আমার সয়নে জাগরনে পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। তোমায় ছাড়া নিজেকে ভাবিনি কখনই। তুমি আমার অভ্যেস, আমার বেঁচে থাকার অনুস্বঙ্গ।
হৃদয়ের ঠিক যেখানে তোমার বসবাস, সেখানে আজ তোলপাড়। সাক্ষি এই জোৎস্না। হৃদয়ে অসীম মেঘ জমলেও আকাশে আজ জোৎস্না। যা তোমার ভালোবাসার সাক্ষ্য। তোমার শখের বৌয়ের, আজ জোৎস্না আছে, তুমি নেই। কর্পূরের স্নিগ্ধ গন্ধে তোমায় হারানোর বর্নিল কষ্টেরা আজ দোলনায় দোদূল্যমানতা।
নিজেকে নিয়ে হয়ত ভাবার সময় চলে এসেছে। অপুর সাথে বিয়ের পরের জীবনটাতে নিজেকে নিয়ে এক মূহুর্ত ভাবিনি। ভেবেছি অপু আর ওর পরিবার নিয়ে। অপুর পছন্দ আর ভালোলাগা নিয়ে। মেনে চলেছি ওর প্রত্যেকে-টা বাঁধা নিষেধ। আজ হয়ত আমার মুক্ত হবার দিন।
পরদিন সকালে হেমন্তি ঘুম থেকে উঠে নিরবে নিভৃতে রাবেয়ার হাতটা ধরে চলে গেলো একটা বাবার বাড়ি। বাবা মায়ের পাশে শক্ত ভাবে দাঁড়ানোর, সেবা করার, যত্ন নেবার বড় শখ ছিল হেমন্তির। ছোট বোনটা বিয়ে হয়েছে, সংসার নিয়ে সে ব্যস্ত । ছোট ভাই চাকরি করে চট্টগ্রামে। বাবা মা এই গ্রামেই রয়ে গেছে।
হেমন্তি কলেজে বদলির আবেদন করেছে, বাবার বাসার কাছে যে সরকারি কলেজটা আছে সেখানে আসবার জন্যে। বাবার একটুকরো জমিতে গড়ে তুলতে চলেছে একটা এতিম খানা। যেখানে হেমন্তি অনেক গুলো রুপকথা-দের নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চায়। সে চায়না আর কোন জোৎস্না স্নাত সুন্দর বারান্দায় ঝিরিঝিরি বাতাসে অপুর ভালোবাসা। সে চায় শুধু মা হতে। একটা নয় অসংখ্য সন্তানের মা হতে। একটা নয় অসংখ্য রুপকথার মা হতে। এবং সে তা করতে বদ্ধ পরিকর। পিছু ফিরে তাকাবার মতো সময় আর নেই হেমন্তির।
জীবন আমাকে যেমন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল, যেমন করে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন আকতে শিখিয়েছ্ল, তেমন বিবেকের দাবিতে সেই রঙ্গিন স্বপ্নের ক্যানভাস ভেঙ্গে তছনছ করতেও শিখিয়ে দিয়েছ। হৃদয়ের আঙ্গীনায় যেমন ভালোবাসার প্রাসাদ তৈরী করতে শিখেছিলাম, তেমনি জীবনের প্রয়োজনে সুখের তৈরী প্রাসাদ বালুর পাহাড়ের মতো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারি।
কিন্তু বেলা শেষে নিজের স্বার্থটা আদায় করতে পারিনা। আমি পৃথিবীর বুকে সন্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। কারো অনুগ্রহ বা দয়ায় নয়। তোমার জীবনে নিজের অস্তিত্ব ভীত টুকু নড়ে উঠতে দেখেছিলাম যখন, তখনই প্রতিবাদ করতে পারতাম। কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমি ভিক্ষে রুপে চাইনি! চেয়েছিলাম অধিকার রুপে।
জীবনের সাথে লড়তে লড়তে আমি বুঝে গেছি, আমার আসলে কাউকে দরকার নাই……কাউকে না। বারবার এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে পৃথিবীর প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে আসতে আসতে নিজেকে নিজেই গুছিয়ে নিতে শুখে গেছি।
মানুষের কাছে প্রচন্ড আশা করে, সেখানে থেকে হতাশ হয়ে জীবন আমাকে একা বাঁচতে শিখিয়ে দিয়েছে। বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ফলে, এখন পড়ে গেলেও আর কারও হাতের অপেক্ষা করি না। আমি নিজেই উঠে দাঁড়াতে শিখে গেছি।
আমি আর সেই আমি নেই। কষ্ট গুলো, হতাশা গুলো আমাকে পাল্টে ফেলেছে। আমি এখন আর কথায় কথায় কাঁদতে পারি না! অভিমান করতে পারি না! সেই ইমোশন গুলো কোথাও খুঁজে পাই না! অল্পতেই হতাশ হয়ে সেই দু:খবিলাসী আবেগী মনটা আর নেই।
আমাকে প্রচন্ড রকম কষ্ট দেয়া, পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া তুমিটা যেনে রাখো, তোমার ফেরত আসার আর কোন রাস্তা আজ নেই।
জীবনে পথ চলতে চলতে যদি কখনও আমায় মনে পড়ে, আমার পথে যদি হাটতে মন চায় তোমার! মনে রেখো মুচকি হেসে বলবো তোমায়- আমার বারন্দায় যে চাঁদ ওঠে তা শুধু আজ আমার। এই ঝির ঝির বাতাস, কর্পূর গন্ধ, ঐ জোৎস্না সব সবটা আমার! আর আমার রুপকথার। সেখানে তোমার কোন যায়গা নেই!