#মেঘে ঢাকা জ্যোৎস্না
লেখক – সিরাজুম মনিরা
পর্ব – ৪র্থ
এরপর আমার দিন গুলো কেমন ধোয়াসা ছিল। অপুর সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগতো না। কলেজে গিয়ে ক্লাস নিতাম, কিন্তু আগের মতো আমার ক্লাসে আর প্রান থাকতো না। আমি কেন যেন বাবুকে ছাড়া কোন গল্প পেতাম না। শুধু বাবুর গল্প করতেই ভালো লাগতো। বাবুর জন্যে জিনিস কিনতে ভালো লাগতো। আর কিছু ভালো লাগতো না।
অপু আবারও আমাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে গেলো। আগের বার অনেক আশা নিয়ে ফেরত এসেছিলাম, কিন্তু এবার যেনো সব কিছুই কেমন ধোয়াসা।
এই দোলনাটা আমার জীবনের না বলা বহু কথার সাক্ষী যেন। এই বেলকনিতে আমার নির্ঘুম রাত গুলো ঐ আকাশের সঙ্গী হয়েছে যেন। আমার হৃদয় বাগানে কোন গাছে আর ফুল ফোটে না, পাখি ডাকে না। হাহাকারের তাপদাহে এ যেন শুধুই ক্ষরা।
আমি যেন স্বপ্ন দেখতেও ভূলে গেলাম। নদীর বুকে ভাঙ্গন আসে, কূল ভেঙ্গে যায়। কখনও বা ঘর ভাঙ্গে। সে কি বোঝে ঘর ভাঙ্গার কষ্ট যে কখনও নদীই দেখেনি!
আমার শাশুড়ী মেয়ে মানুষ হলেও আমরা কষ্ট কখনও বুঝেছো বলে মনে হয়নি। সে তার স্বামী দুই ছেলে নিয়ে কি করে বুঝবে আমার কষ্ট। সে দোষ কখনও তাকে দেইনি আমি।
একদিন সকালের ক্লাসে আমি যাইনি কলেজে। সবাই ভেবেছে আমি কলেজে চলে গেছি। আমার আর অপুর রুমটা দোতলায়। ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচ তলায় শশুর শাশুড়ী থাকেন। দোতলায় আমি আর দেবরের রুম। গেষ্ট রুমও আছে। আমি সিঁড়িতে পা দেবো তখনই কানে আসলো শাশুড়ী মা অপুকে বলছে,
– অপু তোকে বললাম যে আরেকটা বিয়ে কর। আর কতোদিন অপেক্ষা করবি। বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেলো। আর কতোদিন অপেক্ষা করবি। আরেকটা বিয়ে কর। তোর ছোট ভাই পরে বিয়ে করে বাচ্চা হয়ে গেলো। আর তোর কি হলো? এই লেখা ছিল তোর কপালে?
অপু কোন কথার উত্তর না দিয়ে নাস্তা করে চলে গেলো। আমি নিচে নামলে আমার শাশুড়ী যেন কিছুই বলেনি এমন ভাব করে বসে রইলেন। নিজেকে নিজের কেমন ঘিন্না লাগছিল। এই মহিলাকে আমি মায়ের মতো সম্মান করতাম। খুব ভালোবাসতাম। উনি আজও আমাকে শখ বলে ডাকেন। আমি মনে করি উনি ভালোবেসে ডাকেন। কিন্তু আজ বুঝলাম, সব মিথ্যে। সবই লোক দেখানো। উনার ভালোবাসা আসলে মরীচিকার মতো।
নাস্তা না করেই ডা: সেলিনা আপুর কাছে গেলাম। অনেক অনেক কাঁদলাম। আপু আমাকে অনেক বোঝালেন। আর বল্লেন উপরওয়ালার উপর ভরসা রাখতে। অনেক দোয়া শিখিয়ে দিলেন। আমল শিখিয়ে দিলেন।
এরপর থেকে আমি ঔষুধ নিয়মিত খেতে শুরু করলাম। সেই সাথে নামাজ নিয়মিত পড়া শুরু করলাম। তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে কতো কেঁদেছি।
তবে অপুকে সময় সময় কেমন অপরিচিত লাগতো, আবার কখনও সেই আগের অপু। জীবনে যখন অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন ভোরের আলোকেও কেমন ধোয়াসা লাগে মনে হয়।
অপুকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি, আমি জানি অপুও আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের হাসি কান্না যাপিত জীবনে মুক্তোর মতো আর সুর তোলে না আগের মতো। অপুর ভালোবাসায় তৃপ্ত আমি কিন্তু অপু…….
হঠাৎ কয়দিন থেকে শরীরটা ভালো লাগছে না। কেমন যেন গা গোলাচ্ছে। ক্ষুধা লেগে থাকলেও খেতে পারছি না।
অপুকে এসব বলতেই অপু আমাকে টেস্ট করতে বললো। বুকের মধ্যে উত্তাল ঝড় যেন এক নিমিষে বয়ে গেলো। পা কেমন ভারি লাগছে। হাত ঠান্ডা হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অশ্রু ভেজা চোখে অপুকে বল্লাম, অপু পজেটিভ দেখাচ্ছে।
বহুদিন পর যেনো অপু আমায় পরম মমতায় আগলে নিলো ওর বুকের ভেতর। আমার হৃদয় আকাশে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো। শিতল হলো আমার মন। এই একটা খবর পাবার জন্যে কতো কস্ট, কতো চাওয়া বিধাতার কাছে।
অপু কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, বিছানা থেকে এক পা নামবে না। আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো। যখন পারবো না তখন লোক রাখবো। তবুও তুমি বিছানা থেকে নামবে না।
আমি নামিনি, এক পা কোথাও ফেলিনি। অপু আমার সবটা কাজ করতো। সব দেখা শোনা করতে। একটা মেয়ে রাখলো, যখন অপু থাকতো না মেয়েটা আমার সব দেখতো। শাশুড়ীও আমার দেখা শোনা করতেন। কিন্তু উনাকে আর আগের মতো আমি গ্রহন করতে পারছিলাম না, তারপর একটা সময় সব ভূলে গেলাম।
তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন, যার অপেক্ষায় আমরা ছিলাম। আমার ছোট্ট পরি সোনা চলে এলো। সেদিনও ছিল পূর্নিমা, জ্যোৎস্নার আলোয় ছেয়ে ছিল যেদিন আমার চাঁদমুখ আমার কাছে আসে। কিন্তু জন্মের পরপরই সোনাটাকে আমি আমার বুকের কাছে পাইনি। কারন জন্মের সময় জান বাচ্চাটার শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। ওকে হসপিটালে নিয়ে চলে গেলো অক্সিজেন দেবার জন্যে। আবারও যেনো হাযারও ভয় আমার শিরদারা বেয়ে গেলো। নিজের কষ্ট কিছুই মনে হলোনা। শুধু মনে হলো, বিধাতা যেন আজ আমার জীবন নিয়ে হলেও আমার জান বাচ্চাটাকে বাঁচায় রাখো।
পরের দিন বিকেল বেলায় সোনাটা আমার কোলে আসলো। আমার পুরো পৃথিবী আমার হাতের উপর। আমি মা, আমি মা হয়েছি। আমার সন্তান আমার জান বাচ্চাটা আমার কাছে। অপু দেখো আমাদের সন্তান, অপু যেনো আনন্দে আত্নহারা হয়ে আছে। পুরো ক্লিনিকে মিষ্টি খাইয়েছে। এতিম খানায় মিষ্টি পাঠিয়েছে। মেয়ের জন্যে কতো কিযে কিনে এনেছে! এমনকি সোনার গহনাও বাদ দেইনি!