মেঘে ঢাকা জোৎস্না পর্ব – ৩

0
949

#মেঘে ঢাকা জোৎস্না
লেখক – সিরাজুম মনিরা
পর্ব-৩য়

বিসিএস এর প্রিলি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। আমি টিকে গেলাম, কিন্তু অপু বাদ পড়ে গেলো। অপু ঠিক খুশি হয়েছিল বলে মনে হলো না। পরের কয়দিন ঠিক করে কথাও বলেছিল না। তবে কিছুদিন গেলে যেন একটু স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আমার বাবা বলেন, সব সমস্যাকে নির্দিষ্ট সময় দিতে হয়, সব কিছুই একটা সময় পরে ঠিক হয়ে যায়।

লিখিত হলো, তাতেও টিকে গেলাম। শেষমেশ ভাইভাতেও টিকে গেলাম। আমার চাকরী হলো সরকারি কলেজে। সময় গুলো কেমন যেনো আগের মতো আর দ্রুত কাটে না। সময় কোথাও যেন থেমে যাচ্ছিল।

অপুর হঠাৎ মনে হলো আমাদের একটা সন্তান চাই। আমিও ওর সাথে সহমত হলাম, কারন অপুকে আমি এতোদিনে চিনে গেছি। ও বেশ জেদি ছেলে। যা বলবে তা ওর চাই।

আমি রোজ সকালে অপুর দেয়া শাড়ি পরে কলেজে যেতাম। ঠিক ওর পছন্দ মতো সেজে। সব কিছু ম্যাচিং করে পরে যেতাম। পড়াতাম ভালো তাই অল্পদিনে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে বেশ একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছিলো।

কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা এতো চেষ্টা করেও কোন সুখবর পেলাম না। অর্থাৎ বেবি কনসিভ হলো না। এমন ভাবে সময় গুলো কাটতে শুরু করলো। আমারও মনে হতে শুরু করলো যে আমার একটা বাচ্চা দরকার। যে আমাকে মা বলে ডাকবে, খেলবে, আবদার করবে।

এর মাঝে দেবর সবার অমতে বিয়ে করেছে। শাশুড়ী প্রথমে মেনে না নিলেও পরে মেনে নিয়েছিল। তবে ওরা ঢাকাতেই সেটেল হলো। বাসায় বেশিদিন থাকেনি।

আমার শাশুড়ী প্রায়ই বলতে শুরু করলেন, একটা নাতি নাতনীর জন্যে। আমরা ডাক্তার দেখালাম। অপু বাসায় ফেরার পর বলেছিল,
-ধরো বৌ, আমার সমস্যা ধরা পড়লো! তুমি আমায় ছেড়ে যাবে?

অপুর কোলে মাথা রেখে বলেছিলাম,
-যদি আমার সমস্যা হয় তাহলে তুমি কি আমায় ছেড়ে যেতে পারবে?

অপু আমার মুখ চেপে ধরে বলেছিল, তুমি আমার নি:শ্বাস। শ্বাস না নিলে মানুষ বাঁচে বুঝি? এমন কথা কখনও বলবে না। তোমায় ছাড়া আমার সবকিছুই অন্ধকার। আমার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে যদি তুমি না থাকো।

সেদিনটা ছিল ঘোর অমাবস্যা। গুমোট একটা সন্ধ্যা। অপু ব্যবসার কাজে বাহিরে ছিল, ফিরতে রাত হবে। তাই আমি একাই গিয়েছিলাম রিপোর্ট দেখাতে ডাক্তারের কাছে। ডা: সেলিনা আহম্মেদ আমার হাতটা ধরে বললেন, অপু কই। অপুর তোমার পাশে থাকাটা খুব জরুরী ছিল এখন।

আমি হেসে বললাম, আপনি নির্দ্ধিধায় বলেন। আপনার বন্ধুর ফিরতে দেরি হবে। উনি আমার হাতটা ধরে বললেন, বোন তোমার অনেক সমস্যা আছে। তবে চিকিৎসা করলে বাবু হতেও পারে।

অন্ধকার সেই রাতটা যেনো আরও বেশি আধারে ছেয়ে গেলো। কোথাও যেন প্রলয় হয়ে যাচ্ছে যার খবর কারো জানা নেই। হাটতে যেয়ে যেন হাটতে পারছি না। তারপর কেমন যেন আবছা সব কিছু! আমি যেন দৌড়াচ্ছি! দৌড়াচ্ছি! কোথাও কোন মানুষ নেই। সব অন্ধকার। আমি চাইলেও থামতে পারছি না। অপু ক্ষীন কন্ঠে আমায় ডাকছে, বৌ, বৌরে বৌ। এই শখ কথা বলো……..

চোখ খুলে দেখি অপুর মুখটা আমার মুখের উপর। অপু কাঁদছে আর আমাকে ডাকছে। কেমন দূর্বল লাগছে। উঠতে চাইলেও উঠতে পারলাম না। মাথায় ব্যাথা করছে। আমি ডা: সেলিনা আপুর চেম্বারের বেডে শুয়ে আছি। আপু বললেন, আমি নাকি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।

বাসায় ফিরে আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না, শাশুড়ী মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সত্যটা বলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম উনার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদবো। কিন্তু ভরসার এই স্থানটা যেন নড়ে গেলো।

পৃথিবীর কিছুই যেন আমার আর ভালো লাগে না। আমার একটা সন্তান চাই, চাই-ই চাই!

অপু দিন গুলোতে আমাকে আগলে রাখতো, বোঝাতো। আড়ালে একা নিভৃতে কাঁদতো। আমাকে দেশের বাহিরে নিয়ে গেলো, ইন্ডিয়ায়। সেখানে ডাক্তার আমার ছোট একটা অপারেশন করলো। তারপর কিছু ঔষধ দিলেন। আমরা দেশে ফিরলাম, সাথে নিয়ে এক বুক আশা।

ঠিক তিন মাসের মাথায় আমার কেমন যেনো সন্দেহ হলো, আমি প্রেগনেন্সি টেস্ট করলাম। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ডা: সেলিনাকে জানালাম। এরপর নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আমি অন্তঃসত্ত্বা, আমি মা হতে চলেছি। আমি চিৎকার দিয়েছিলাম খুশিতে। আমার একটা ছোট্ট সোনা আসতে যাচ্ছে আমার কোলে।

সেদিন আমার শাশুড়ী শশুর খুব খুশি হয়েছিলেন। অপু যেন আকাশ পেয়েছে হাতে। খুশিতে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। পরে লজ্জাও পেয়েছিল। এরপর থেকে বাসার সবাই আমার খুব যত্ননিতেন। অপু আমাকে একধাপ হাটতে দিতো না। আমিও বিছানা থেকে সহজে উঠতাম না। মা এসে কিছুদিন থেকে গেলো। এর কিছু দিন পর ছোট বোনের বিয়ে হলো, অপু সরাসরি যেতে না করলে আমিও আর কথা বাড়াইনি। যাইনি বোনের বিয়েতে।

আমার যখন ছয় মাস চলছিল হঠাৎ পেটে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো। সারা রাত ব্যাথা, অসহ্য যন্ত্রনায় রাত পার করলেও শেষ রাতে যেনো অস্থির লাগতে শুরু করলো। ভোরে হসপিটালে নিলে ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে বলল, আমার বাবুটা পেটের মধ্যে মরে গেছে। কেন? কিভাবে? কোন উত্তর পেলাম না।

বাবুটা ছেলে বাবু ছিল। অপুর হাতটা ধরে বলেছিলাম, একবার সোনাটাকে আমাকে দেখাও প্লিজ। অপু আমার সোনাটাকে এনেছিল আমার কাছে। অপুর হাতটা কাঁপছিল। মুখটা কালো আর শুকনো ছিল। আমি বললাম,

– অপু, ও কার মতো হয়েছে গো দেখতে?
অপু ওর হাত গুলো কতো ছোট দেখেছো?
অপু ওর মাথায় তোমার মতো চুল হয়েছে, তোমার যেমন মাথার উপর চুল কম ঠিক তেমন। অপু ওকে কবর দিও কিন্তু। প্লিজ ওকে কবর দিও। আমি যেনো ওর কাছে গিয়ে কাঁদতে পারি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে