#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_25
#Ariyana_Nur
মৃত মানুষ যখন হঠাৎ সামনে জীবিত অবস্থায় উপস্থিত হয় তখন কেমন রিয়েক্ট করতে হয় তা রাই এর জানা নেই।রাই ফ্যালফ্যাল নয়নে সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।না চাইতেও চোখের কোনে এসে ভিড় জমেছে নোনা জল।চোখের জলের কারনে সামনের দাড়িয়ে থাকা মানুষটা মুখশ্রী অস্পষ্ট দেখা গেলেও রাই একি ভাবে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে রেয়েছে।এটা সত্যি নাকি কল্পনা রাই এর জানা নেই।যদি সত্যি না হয়ে কল্পনা হয় তাহলে তো চোখের পলক ফেললেই লোকটা বিলিন হয়ে যাবে।তাই তো রাই অস্রুভেজা নয়নেই এক ধ্যানে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।থাক না কিছু ঘোটালে কল্পনা।তাতে সমস্যা কি?
তীব্র আজ জোর করে রাইকে চেকাপ করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।ডাঃ দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় সামনে অতি পরিচিত একজন কে দেখে রাই এর পা থেমে যায়।
—কেমন আছিস রাই?
সামনের মানুষটার শীতল গলার কথা শুনে রাই ধ্যান ভাঙলো।গুটিগুটি পায়ে সামনের মানুষটার দিকে আরো দু’কদম বাড়ালো।মানুষটাকে ছুড়ে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে কাপাকাপা হাতে তার গাল স্পর্শ করল।মানুষটাকে ছুতে পেরেই রাই এর চেহারায় খুশির ঝিলিক চলে এল।না এটা কোন মিথ্যে বা কল্পনা নয়।সে তার অতি কাছের একজন কে পূনরায় ফিরে পেয়েছে।রাই প্রফুল্য কন্ঠে বলে উঠল,
—দিশা আপু!সত্যি তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে আছো?তুমি আমাদের কাছে ফিরে এসেছো?
রাই এর খুশি দেখে দিশা মলিন হেসে হাত বাড়িয়ে দিতেই রাই দিশাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করে দিল।এতো বছর পর আদরের বোনটাকে কাছে পেয়ে দিশার চোখেও পানি চলে এল।
দিশা রাই এর চাচাতো বোন।দিশা ছোট থেকেই ফাহাদ বলতে পাগল ছিলো।ফাহাদের জন্য ছোট থেকে কম পাগলামো করেনি দিশা।তার পাগলামোর জন্য দিপা বেগম, ফাহাদ এর হাতে অনেক মার খেয়েছে।তার পরেও তার শিক্ষা হয়নি।সে তার পাগলামো চালিয়েই গিয়েছে।দিশার পাগলামি দেখে অতিষ্ঠ হয়ে ফাহাদ এক সময় দিশাদের বাড়িতে যাওয়া ছেড়ে দেয়।তাতেও কোন কাজ হয় না। দিশা নিত্য নতুন পাগলামো নিয়ে ফাহাদ এর সামনে হাজির হয়ে যেত।ফাহাদ এর বকা চাড়-থাপ্পড় না খেলে তার পেটের ভাতই হজম হত না।এক সময় ফাহাদ দিশার পাগলামো সহ্য করতে না পেরে বাহিরে চলে যায়।কয়েক বছর পর বাহির থেকে এসে দিপা বেগম এর সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর রাই কে দিপা বেগম এর বাসায় দেখে ফাহাদ এর চোখ রাইতেই আটকে যায়।আস্তে আস্তে শুরু হয় রাইকে নিয়ে ফাহাদ এর পাগলামো।এই সব যেন দিশার সহ্য হচ্ছিলো না।নিজে যাকে ছোট থেকে পাগলের মত ভালোবেসে এসেছে তাকে তারই সামনে অন্য মেয়ের জন্য পাগলামো করতে দেখলে কিভাবেই বা তার সহ্য হবে।রাইকে নিয়ে ফাহাদ এর পাগলামো দিন দিন বাড়তে থাকে।আর এসব দেখে এক সময় দিশা রাইকে সহ্য করতে না পেরে রাই এর সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে দেয়।ফাহাদ এসব জানতে পেরে দিশাকে অনেক মারধর করে।রাই এর থেকে দিশাকে দূরে রাখতে দিশাকে জোর করে বাহিরে পাঠিয়ে দেয়।দিপা বেগম ফাহাদ এর কাজে কোন রকম বাধা দেয়নি উল্টো তাকে সাপোর্ট করেছেন।দিশা মায়ের কাছে অনেক আকুতি মিনতি করেছে বাহিরে না যাওয়ার জন্য।কিন্তু তিনি দিশার কোন কথাই শুনেন নি।দিশা সকলের প্রতি রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে দেশের মাটি ত্যাগ করে।বাহিরে গিয়ে দিশা সবার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়।কয়েক মাস পর দিশা ইচ্ছে করেই সবার কাছে মিথ্যে খবর পাঠায় যে সে গাড়ি এক্রিডেন্টে মারা গেছে।খবর পেয়ে দিপা বেগম পুরো পাগলের মত হয়ে যায়।তারপর থেকে যেন রাই আরো তার চোখের বিষ হয়ে যায়।দিশার মৃত্যুর জন্য সে রাইকে দোষারোপ করতে থাকে।দিশার মৃত্যুর সব দোষ রাই এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।দিশা ফাহাদ কে ভোলার জন্য সকল কৌশল অবলম্বন করে কিন্তু কিছুতেই সে ফাহাদকে ভুলতে পারে না।ফাহাদ কে যত বেশি ভোলার চেষ্টা করে ততই যেন দিশা ফাহাদ এর প্রতি আরো তীব্র ভাবে দূর্বল হতে থাকে।শেষে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে তার এক ফ্রেন্ড এর সাহায্য নিয়ে নিজের চেহারা নিজের নাম পাল্টে দেশের মাটিতে পা রাখে।দেশে আশার পর যখন জানতে পারে ফাহাদ জোর করে রাই কে নিজের সাথে বেধে রেখেছে।রাই এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাইকে বিয়ে করতে চাচ্ছে।তখন যেন তার ভিতরের হিংস্ররুপটা বের হয়ে আসে।ফাহাদ যদি ভালোবেসে জোর করে আরেকজনকে তার সাথে আটকে রাখতে পারে তাহলে সে কেন ফাহাদকে জোর করে তার সাথে আটকাতে পারবে না।রাই এর বিয়ের আগে দিশা নিজের পরিচয় গোপন করে দিপা বেগম এর কাছে ফোন করে বলে,তার মেয়ে দিশা বেচে আছে।যদি সে রাই আর ফাহাদ এর বিয়েটা থামাতে পারে তাহলেই দিশা তাদের সামনে আসবে তা না হলে চিরতরে তারা দিশাকে হাড়িয়ে ফেলবে।যে মেয়েকে মৃত ভেবে এতোদিন প্রতিনিয়ত দিপা বেগম চোখের জল ফেলেছে তাকে একটা নজর দেখার লোভ দিপা বেগম সামলাতে পারেনি।তাই তো মনজুর মা রাই এর বিয়ের দিন রাইকে পালাতে সাহায্য করছে জানা সত্যেও কিছু বলেনি।উল্টো সে আরো রাস্তা ক্লিয়ার করে দিয়েছে।
—দিশা আপু এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে?তুমি বেচে থাকা সত্যেও কেনই বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করনি।
রাই এর কথা শুনে দিশা মুখে কিছু না বলে শুধু মলিন হাসল।
__________
রেস্টুরেন্টে কোনার এক টেবিলে ফাহাদ এর মুখোমুখি হয়ে বসে রয়েছে রাই।রাই নিজ থেকেই আর ফাহাদকে খবর দিয়েছে দেখা করার জন্য।ভিতরে ভিতরে রাই এর মধ্যে ভয় কাজ করলেও মুখে কঠিনত্য ফুটিয়ে রেখেছে।অপর দিকে ফাহাদ এতোদিন পর নিজের প্রিয় মানুষটাকে এতো সামনের থেকে দেখতে পেয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার পাখির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।তার পাখি বললে ভূল হবে তার পাখি তো অনেক আগেই তার পিঞ্জর ভেঙে ঊড়ে চলে গিয়ে আরেক জনের মনের কুঠরিতে বাসা বেধেছে।ভাবতেই ফাহাদ এর ভিতরটা হাহাকার করে উঠে।ফাহাদকে নিজের দিকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাই এর অস্বস্থি হচ্ছে।রাই নাড়াচাড়া করে বসে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।কি দিয়ে কথা শুরু করবে তা ভাবতে লাগলো।
—কেমন আছো রাই পাখি?
ফাহাদ এর শীতল কন্ঠের কথা শুনে আজ আর রাই ভয় পেল না।নাই বা দমে গেলো।রাই তার কথায় কঠিনত্য বজায় রেখে বলল,
—প্রথমত আমার নাম রাইজা।ছোট করে সবাই রাই ডাকে।আপনার যদি ছোট নাম ধরে ডাকতে কষ্ট হয় তাহলে মিসেস তীব্র বলে ডাকতে পারেন।
রাই এর কথা শুনে ফাহাদ মুচকি হেসে বলল,
—বুলি তো দেখছি ভালোই ফুটছে।যাক ব্যপার না।এখন বল কেমন আছো?
—আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?
রাই এর কথা শুনে ফাহাদ মলিন হেসে বলল,
—আমার প্রান পাখিটা আমায় ছেড়ে অন্যের ঘরে বাসা বেধেছে তাহলে তুমিই বল আমার এখন কেমন থাকার কথা?যাকে মনের সবটা উজাড় করে দিয়ে জায়গা করে দিয়েছি সেই আমার নিস্ব করে ফাকি দিয়ে ঊড়াল দিয়েছে তাকে ছাড়া কি ভালো থাকা যায়?
রাই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
—কথাটা ভূল বললেন ভাইয়া।আপনি তাকে মনের ঘরে বাস করার জন্য জায়গা করে দেননি তার পায়ে শিকল বেধে পিঞ্জরে আটকে রাখতে চেয়েছিলেন।তাকে যদি পিঞ্জরে না বেধে মনের ঘরে বাস করার জায়গা করে দিতেন তাহলে আজ আর সে ঊড়ে গিয়ে অন্যের মনের ঘরে বাসা বাধার জায়গা খুজতো না।আপনার মনের ঘরেই বসবাস করতো।
ফাহাদ করুন কন্ঠে বলল,
—ফিরে আসো না পাখি আমার কাছে।প্রমিস করছি এবার আর তোমায় একটুও কষ্ট দিব না।আমার ভালোবাসার চাদড়ে মুড়িয়ে রাখবো।
—ভালোবাসার মানে বুঝেন আপনি?
—হাসালে পাখি।আমার এতোদিনের ভালোবাসা কি তোমার একটুও চোখে পরেনি।একটুও কি আমার ভালোবাসা তুমি ফিল করোনি?
—আপনার করা প্রতিটা টর্চার কে ভালোবাসা নাম দিয়ে ভালোবাসা শব্দটাকে অসম্মান করবেন না ফাহাদ ভাইয়া।
—আমার ভালোবাসায় কি এমন কমতি ছিলো?তোমায় পাগলের মত ভালোবাসার পরেও কেন তুমি আমার ভালোবাসাকে টর্চার বলছো?
—কেন বলছি বুঝতে পারছেন না?বুঝবেনি বা কিভাবে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হলে তো সহজ কথা মাথায় ঢুকবে।আপনি তো মানসিক রুগি একটা সাইকো।দিনের পর দিন ভালোবাসা নাম করে আমার উপর অধিকার খাটাতে এসে টর্চার করে গেছেন।আপনার পছন্দ মত খেতে হবে আপনার পছন্দের পোষাক পরতে হবে।একা বাহিরে যাওয়া যাবে না।বান্ধবীদের সাথে বেশি কথা বলা যাবে না।ছেলেদের থেকে একশ হাত দূরে থাকতে হবে।যদি ভূল করে কোন ছেলে এসে হেন্ডসেক করে বা কথা বলে তাহলে আমার আপনার কাছ থেকে শাস্তি পেতে হবে।এগুলোকে কি ভালোবাসা বলে নাকি টর্চার?আমিও যে কি বলি যে মানুষ নিজে নিজেকে ভালোবাসতে পারেনা সে আবার অন্যকে কি ভালোবাসবে।
রাই এর কথা শুনে রাগে ফাহাদ এর চেহারার রং পাল্টে গেলো।ফাহাদ টেবিলের উপর বারি মেরে চেচিয়ে বলল,
—আমার এই পাগলামো ভালোবাসাকে বার বার টর্চার এর নাম কেন দিচ্ছিস তুই?কি নেই আমার মাঝে?তোকে পাগলের মত ভালোবাসার পরেও কেন তুমি আমায় ভালোবাসতে পারলে না?
রাই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
—তাহলে আপনি কেন আমার দিশা আপুকে ভালোবাসতে পারলেন না?
#চলবে,