#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_22
#Ariyana_Nur
দিপা বেগম কিচেনে কাজ করছে।কাজ করছে বললে ভূল হবে।কাজ করছে কম হাড়ি-পাতিলের উপর মেজাজ দেখাচ্ছে বেশি।এতোদিন যেখানে রাই আর কাজের লোককে দিয়ে বাসার সব কাজ করিয়ে নিজে রাণীর মত সারাদিন শুয়ে বসে থেকে হুকুম চালিয়েছে সেখানে এখন সংসারের সব কাজ নিজে একা করতে গিয়ে সে পুরোই হাপিয়ে উঠছে।
—কি পোড়া কপাল আমার।আমার সাথেই এটা হওয়ার ছিলো।আল্লাহ কি একটুও আমার কপালে সুখ লিখে নাই।আগে যখন কাজের লোক ছিলো তখন একের পর এক কাজ চাইতে দরজায় হামলে পরত। এখন এতোদিন ধরে কাজের লোকের খোজ করছি একটাও পাচ্ছি না।সব কয়টা কাজের লোকের দেমাগ বেড়ে গেছে।একেকজন বড় লোক হয়ে গেছে।আমার ভাগ্যই খারাপ তা না হলে কি এতো ভালো কাজের লোক কেউ হাতছাড়া করে।সব দোষ ঐ মুখপুড়ি রাই এর বাচ্চার।নিজের বাপ,মা কে তো খেয়েছেই সাথে আমার সংসারটাকে গিলে গেছে।আমি সহ্য করলেও আল্লাহ সহ্য করবে না।মিলিয়ে নিস আমার কথা।আমায় যেমন পুড়াচ্ছিস না দেখবি তুই ও একদিন এই থেকে বেশি পুড়বি।শান্তি হবে না তোর।রাস্তা রাস্তায় ঠোকর খেয়ে মরবি।এরকম বেহায়া, কুলাঙ্গার,মুখপুড়ি মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।
ফাহাদ অনেক্ষন আগেই কিচেনের দরজায় এসে দাড়িয়ে দিপা বেগম এর কথা শুনছিলো।দিপা বেগম এর কথা শুনে তার রাগ উঠলেও আজ আর রাগ দেখালো না।যা করবে সব ঠান্ডা মাথায় করবে। দিপা বেগম এর কথার মাঝেই ফাহাদ ফোড়ন কেটে বলে উঠল,
—তার জন্যই কি নিজের মেয়ে থাকতেও সবার কাছে মৃত বলে বেড়াও।
হঠাৎ ফাহাদ এর কথা কানে যেতেই দিপা বেগম এর হাত থেকে খুনতি টা নিচে পরে গেলো।দরজার দিকে তাকাতেই ফাহাদ কে দেখে দিপা বেগম ভূত দেখার মত চমকে উঠল।দিপা বেগম কাপাকাপা গলায় বলল,
—ফাহাদ বাবা তুই এখানে?
—কেন আসতে বারন নাকি?
ফাহাদ এর সোজাসাপ্টা উওর শুনে দিপা বেগম শুকনো ঢোক গিলে বলল,
—সেকি কথা বারন হবে কেন?হঠাৎ এলি তো তাই।তুই কি আমায় কিছু বললি?
—কেন?তুমি কি কিছু শুনেছো?
দিপা বেগম আমতা আমতা করে বলল,
—না মানে ঐ কাজের ধ্যানে ছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি।কিছু বলেছিস কিনা।
তাই জিগ্যেস করলাম আরকি।
ফাহাদ গ্যাস এর চুলোটা বন্ধ করে দিপা বেগম এর দু’হাত চেপে ধরে বলল,
—রাখো তো সব কাজ।নিজের হাতের দিকে দেখেছো?কাজ করতে করতে কেমন হয়ে গেছে।
—আমি কাজ না করলে কে করবে বাবা।আমার সংসার আমারই তো সব করতে হবে।
—কেন কাজের লোক কোথায়?
দিপা বেগম আফসোসের সুরে বলল,
—আর বলিস না বাবা।মনজুর মা যাওয়ার পর একটা কাজের লোকও পাইনি।বাসায় না থাকুক ছুটা কাজ করে দিয়ে যাবে তার জন্যও লোক পাই না।
—চিন্তা করো না ফুপি কাজের লোকের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।একজনের জায়গায় দু’জন রেখে দিব।দরকার হলে তারা তোমার সব করে দিবে।মুখে খাবারটা পযর্ন্ত তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব।তার পরেও তোমার এই মমতাময়ী হাত দিয়ে কোন কাজ করতে দিব না।
ফাহাদ এর কথা শুনে দিপা বেগম খুশি হয়ে বলল,
—সত্যি বাবা তুই আমার জন্য এতো চিন্তা করিস?তোর কথা শুনে খুশিতে আমার চোখ ভিজে উঠল।
কথাটা বলেই চোখের কোনে পানির ছিটে ফোটা না থাকা সর্তেও চোখের জল মোছার ভান করল।
ফাহাদ দিপা বেগম এর কাজ দেখে মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
—এটা কোন কথা বললে ফুপি?আমি তোমার চিন্তা না করলে কে করবে শুনি।তুমি ছাড়া কেই বা আছে আমার বল?কাজের চিন্তা তুমি বাদ দাও কাজের লোকের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।আর যদি না পাই তাহলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবো তোমার সেবা করানোর জন্য।তার পরেও তোমার এই হাত দিয়ে কাজ করতে দিবো না।
—আমার বাবাটা এতো ভাবে আমার কথা।একেবারে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে ফুপির সেবা করার জন্য।তা মেয়েটা কে শুনি দি- মানে ঐ মাহি?যাকে হাসপাতালে দেখেছিলাম?
ফাহাদ বাকা হেসে বলল,
—সেটা সময় হলেই বুঝতে পারবে।এখন তাড়াতাড়ি আমার পছন্দের খাবার রান্না কর তো।অনেক ক্ষুধা লেগেছে।শেষ বারের মত তোমার হাতের রান্না খেয়ে নেই আর কখনো তোমার হাতের খাবার খেতে পারবো কিনা কে জানে।
ফাহাদ এর কথায় দিপা বেগম কেমন যেন রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছে।দিপা বেগম কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলল,
—এমন কথা কেন বলছিস বাবা?
ফাহাদ হেসে বলল,
—ঐ এমনি বললাম আরকি।
দিপা বেগম মুখটা মলিন করে বলল,
—এমন কথা আর বলবি না বাবা। আমি যতদিন বেচে থাকবো ততদিন তোকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবো।
ফাহাদ তাড়া দিয়ে বলল,
—পরের টা পরে দেখা যাবে এখন যাও তাড়াতাড়ি রান্না কর।তোমার হাতের রান্নার কথা শুনেই জিভে জল চলে আসছে।তর সইছে না আর।
ফাহাদ এর থেকে নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে দিপা বেগম খুশিতে গদগদ করতে করতে রান্না করতে চলে গেলো।ফাহাদ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে মনে মনে বলল,
—যতখুশি শেষ বারের মত রান্না করে নাও ফুপি।আর রান্না করার সুযোগ ভবিষ্যতে নাও পেতে পারো।তুমি যেই খেলা শুরু করেছো সেটা আমি না হয় শেষ করব।
___________
প্রতিদিনের মত আজও তীব্র দেড়ি করে বাসায় ফিরল।মনের মাঝে এক আকাশ অভিমান এসে ভর করার কারনে সেদিনের পর থেকে তীব্র রাইকে এড়িয়ে চলে।দরকার ছাড়া কোন কথা বলে না।তাছাড়া রাই এর সামনে দাড়ানোর সাহসও তীব্র পায় না।রাই এর মলিন মুখটা দেখলে নিজেকে কেমন নিজের কাছেই ছোট মনে হয়।যাকে আগলে রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে আজ সেই তার চোখের সামনে তাকে বাচাতে গিয়ে এতো বড় একটা কান্ড করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে ভাবতেই তার বুক চিড়ে দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়ে আসে।তীব্র সব সময় এই কাজ সেই কাজের অজুহাত দিয়ে রাই এর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়।তীব্র নিজের রুমের সামনে এসে চাপিয়ে রাখা দরজা টা আস্তে করে খুলে রুমে প্রবেশ করল।রুম পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে রয়েছে।তীব্র নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের ফ্ল্যাস অন করে আস্তে আস্তে পা ফেলে সুইচ বোর্ডের সামনে গেলো।সুইচ চেপে হালকা নীল স্যাডের ড্রিম লাইটা অন করল।বিছানার দিকে তাকাতেই তার সারাদিনের ছটফট করতে থাকা প্রানপাখিটা একেবারে শান্ত হয়ে গেলো।রাই বিছানায় জড়সড় হয়ে বাচ্চাদের মত বেঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে।তীব্র রাই এর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই রাই এর দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।রাই এর ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের তৃষ্ণার্ত চোখের জ্বালা মিটাতে লাগল।রাই এর মুখের উপর কিছু অগোছালো চুল পরে আছে।যা ফ্যান এর বাতাসের তালেতালে মৃদু নড়াচড়া করে রাই এর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।যার কারনে রাই ঘুমের মাঝেই একটু পর পর চোখ মুখ কুচকাচ্ছে।তীব্র রাই এর কাহিনী দেখে মৃদু হেসে আলতো হাতে রাই এর মুখের উপর পরে থাকা চুল সরিয়ে দিয়ে রাই এর কপালে আদর একেঁ দিল।মাথা উচু করতেই রাইকে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তাকতে দেখে তীব্র হকচকিয়ে গেলো।তড়িঘড়ি রাই এর সামনে থেকে সরতে নিলেই রাই খপ করে তীব্রর কলার চেপে ধরল।রাই এর কাজে তীব্র আরেক দফা অবাক হল।তীব্র কিছু না বলে রাই এর হাত থেকে নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই রাই তীব্রর কলার টান দিয়ে তীব্রকে অনেকটা নিজের দিকে নিয়ে এল।
—সারাদিন আমার থেকে দূরে থেকে রাতের বেলা চোরের মত রুমে এসে আদর দেখানো হচ্ছে?
রাই এর রাগি গলার কথা শুনে তীব্র ছটফট বন্ধ হয়ে গেলো।রাই এর দু’পাশে দু’হাত রেখে হাতের উপর ভর দিয়ে শান্ত চোখে রাই এর দিকে তাকিয়ে রইল।ড্রিম লাইটের আলোতেও রাই অভিমানে ভীর করা চেহারায় দেখতেও তার অসুবিধা হল না।রাই তীব্রকে চুপ করে থাকতে দেখে পূনরায় বলল,
—কথা বলছেন না কেন?কোথায় ছিলেন সারাদিন?নিজে সারাদিন বাইরে থেকে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আমার খোজ খবর নেওয়ার জন্য বার বার বাসায় ফোন করে বাসার লোকদের মাথা খাওয়ার মানেটা কি?
রাই এর এই রুপ যেন তীব্রর হজম হচ্ছে না।তীব্র রাই এর কথার উওর না দিয়ে ডান হাত দিয়ে রাই এর কপালে,গালে ছুইয়ে দেখে নিলো জ্বর আছে কিনা।তীব্র এতোক্ষন ভেবেছিলো জ্বর এর ঘরে হয়তো রাই এমন ব্যবহার করছে।কিন্তু না রাই এর শরীরে জ্বরের ছিটে ফোটাও নেই।তাহলে হঠাৎ রাই এমন ব্যবহার করছে কেন?তীব্র কপালে ভাজ ফেলে নরম গলায় বলল,
—কি হয়েছে তোমার?এমন বিহেব করছো কেন?
তীব্রর এই শান্ত গলার কথাটা যেন রাই এর রাগ আরো বেড়ে গেলো।তীব্র নিজে এমন অদ্ভুত বিহেব করে উল্টো রাইকে জিগ্যেস করছে সে কেন এমন বিহেব করছে।না চাইতেও রাই এর চোখে নোনা জলে টুইটুম্বুর হয়ে উঠল।রাই এর গলা দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না।কেমন যেন সব গলার মধ্যেই আটকা পরে যাচ্ছে।রাগে দুঃখে রাই তীব্রর কলার ছেড়ে দিয়ে তীব্রকে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিজের সামনে থেকে সরিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো।কেন যেন সে তীব্রর এই অবেহেলা গুলো নিতে পারছে না।তীব্রর অবেহেলাগুলো তার ভিতরটা ভেঙে চুড়ে আসছে।অবহেলাই যখন করবে তাহলে কেন কেয়ার, ভালোবাসা দেখিয়ে মায়া বাড়িয়েছিলো?একবার মায়া বাড়িয়ে তারপর অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেওয়া যে কত কষ্টের সেটা কিভাবে প্রকাশ করবে সেই ভাষা রাই এর জানা নেই।রাই এর কাজে তীব্র বোকা বনে গেলো।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাই এর দিকে।রাই এর ছলছল চোখ তার চোখ থেকে এড়ায় নি।তীব্র মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক করতে লাগল,নিজে অনুতপ্ত করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমার চাঁদকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম নাতো?
#চলবে,