মেঘের ভেলায় চড়ে পর্ব-২০

0
956

#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_20
#Ariyana_Nur

মাঝরাস্তায় থ’মেরে হাটু গেড়ে বসে রয়েছে ফাহাদ।পাশেই তার রিভলবারটা পরে রয়েছে।রাইকে হাসপাতালের উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেকক্ষন আগেই।তারপরেও সে ভাবেসশীল ভাবে রাই এর যাওয়ার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রয়েছে।ফাহাদ তখন রাইকে মাটিতে লুটিয়ে পরতে দেখেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়।কি হচ্ছে ব‍্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগে।যখন পুরো ব‍্যাপারটা মাথায় আশে তখনি তার হাত থেকে রিভলবারটা নিচে পরে যায়।কি করল সে?শেষে কিনা নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন‍্য নিজ হাতেই নিজের ভালোবাসা কে…..।আর কিছুই ভাবতে পারে না ফাহাদ।তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।শরীর ক্রমাগত অবস হয়ে আসে।নিজের দাড় করিয়ে রাখতে না পেরে ধপ করে বসে পরে।অনুভূতিহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে রাই এর দিকে।

—এবার শান্তি হল তো?নিজ হাতে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে দুনিয়ার বুক থেকে বিদেয় করে খুশি তো?

মাহির কর্কশ গলার কথা শুনেও ফাহাদ কোন কথা বলল না।আগের মত একি ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।মাহি ফাহাদ এর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

—কি হল মিঃ এমন থুম ধরে বসে রয়েছেন কেন?শোক দিবস পালন করছেন নাকি খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন?আমার তো মনে হচ্ছে নিজ হাতে নিজের ভালোবাসাকে খুন করতে পেরে আপনি এতোই খুশি হয়েছেন যে কথা বলার ভাষাই হাড়িয়ে ফেলেছেন।একটা কথা কি জানেন?আপনি কখনোই রাইকে ভালোবাসেননি।রাই কে নিজের সাথে বেধে রাখা ছিলো আপনার জেদ।যদি আপনি রাইকে কখনো বিন্দু পরিমানের ভালোবাসতেন তাহলে আজ কিছুতেই রাইকে নিজের হাতে শেষ করতে পারতেন না।কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে আর যাই করুক না কেন তাকে নিজ হাতে শেষ করা যায় না।তাকে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতেই বুক কাপে।আমিও যে কাকে কি বলছি।আপনি তো একটি পাষাণ লোক।রাইকে খুন…..।

মাহি বাকি কথা শেষ করার আগেই ফাহাদ মাহির গলা চেপে রক্ত চক্ষু করে মাহির দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল,

—অনেক বলেছিস আর না।আর একটা কথা বলবি তো চিরতরের জন‍্য তোর কথা না বলার ব‍্যবস্থা করে দিব।

ফাহাদ এতো জোরেই মাহির গলা চেপে ধরেছে যে মাহির জান যায় যায় অবস্থা।মাহি ফাহাদ এর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন‍্য ছোটাছুটি করতে লাগলো কিন্তু ফাহাদ এর শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠল না।একটু পর ফাহাদ নিজ থেকেই মাহিকে ছেড়ে দিল।ফাহাদ এর হাত থেকে ছাড়া পেতেই মাহি কাশতে লাগলো।কোন রকম নিজেকে সামলিয়ে জোর গলায় বলল,

—আপনি একটা পাষাণ লোক।দয়া,মায়া বলতে কিছুই নেই আপনার মাঝে।রাইকে তো মেরেছেন সাথে আমাকেও মারতে চাচ্ছেন।

ফাহাদ চিৎকার করে বলল,

—স্টপ।আই সে স্টপ।আমি আমার রাই পাখিকে মারিনি।শুনেছো তুমি আমি আমার পাখি মরতে পারি না।নিজে মরে যাব তার পরেও আমার পাখিকে আমি মারতে পারবো না।

____________

রাইকে স্টেচারে করে ওটিতে ঢুকাতে নিলেই তীব্র বাধা দিয়ে বলল,

—আপনার কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার চাদ কে?

নার্সঃ পেশেন্টের অনেক ব্লিডিং হচ্ছে।এখনি অপরেশন করতে হবে।তা না হলে পেশেন্টকে বাচানো…..।

নার্সকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে তীব্র রাগি গলায় বলল,

—কিসের অপরেশন?ওকে পাশের কোন এক কেবিনে নিয়ে যান।গুলিটা বের করে একটু সেভলন দিয়ে ড্রেসিন করে দিন।দেখবেন ও ঠিক হয়ে যাবে।অপরেশন টপরেশনের কোন দরকার নেই।

তীব্রর মুখে এমন কথা শুনে সবাই অবাক চোখে তীব্রর দিকে তাকিয়ে রইল।এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে তীব্রর মুখে এমন কথা যেন কেউ আশা করেনি।তিহান উওেজিত গলায় বলল,

—ভাই পাগলামো করিস না।এখন পাগলামি করার সময় না।তাদের কে তাদের কাজ করতে দে।

তীব্র তিহানকে ধমক দিয়ে বলল,

—তুই চুপ থাক।বেশি কথা বলিস না।আমি কিছুতেই ঐ রুমে আমার চাদকে নিয়ে যেতে দিব না।আমি জানি তারা আমার কাছ থেকে আমার চাদকে কেড়ে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য ঐ রুমে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

ফাইজা কন্দনরত গলায় বলল,

—ভাইয়া এমনিতেই রাইজুর অনেক ব্লিডিং হয়েছে।এদের কে এদের কাজ করতে দিন।তা না হলে রাইজুর ক্ষতি হতে পারে।

ফাহাদ রাগি গলায় বলল,

—আমি বুঝছিনা ফাইজা তুমিও কেন এই তিহান গাধাটার মত কথা বলছো।তুমি জানোনা ঐ রুমে ঢুকলে কেউ আর বেচে ফিরে না তুমি কি চাও আমার আম্মুর মত আমার চাদও আমায় একা করে চলে যাক।

তীব্রর মায়ের ব্রেন টিউমার হয়েছিলো। আপরেশ সাকসেস ফুল না হওয়াতে সে মারা যায়।তীব্র তখন ছোট ছিলো।মায়ের মৃত্যুতে সে পুরো ভেঙে পরে।ছোট মাথায় একটা কথাই গেথে যায় তার ভালো মাকে ঐ রুমে নেওয়ার পর তার মা আর বেচে ফিরেনি।অপরেশন থিয়াটার নাম শুনলেই যেন তার পাগলামো শুরু হয়ে যেত।চিৎকার করে একটা কথাই বলত,এই রুমে মানুষ খুন করা হয়।এখানে আমার ভালো আম্মুকে নেওয়ার পর তাকে মেরে ফেলেছে।এতো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও তীব্র মন থেকে অপরেশন থিয়াটারের ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।তীব্রকে নানান ভাবে বুঝিয়েও কোন লাভ হল না।তার একটাই কথা সে তার চাদকে ঐ রুমে ঢুকতে দিবে না।এদিকে রাই এর অবস্থাও খারাপ হচ্ছে।উপায় না পেয়ে তিহান তীব্রর ঘারের পিছনে অজ্ঞান করার জন‍্য জোরে চাপ দেয়।তীব্র অজ্ঞান হয়ে ঢলে পরে যেতে নিলেই তিহান তীব্রকে ধরে ফেলে।

__________

হাসপাতালে সাদা ধবধবে বেডের উপর অচেতন অবস্থায় সুয়ে রয়েছে তীব্র।মাথায় উপররের দ্রুত গতিতে চলতে থাকা ফ‍্যান এর বাতাসের তার এলোমেলো চুলগুলো বার বার তার কপাল ছুয়ে দিচ্ছে।।তীব্রকে অজ্ঞান করার পর পাশের এক কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়।জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে হাসপাতালে বেডে অবিস্কার করাতে কিছুটা অবাক হয়ে যায় তীব্র।মাথায় একটু জোর খাটাতেই সব মনে পরে যায়।সাথে সাথেই ধরফরিয়ে উঠে বসে।তীব্রর পাশে তিহান বসা ছিলো।তীব্রকে ধরফরিয়ে উঠতে দেখে তিহান বলল,

—ভাই তুই ঠিক আছিস?

তীব্র তিহান এর কথার উওর না দিয়ে উওেজিত গলায় বলল,

—তিহান আমার চাদ?আমার চাদ কোথায়?ও ঠিক আছে তো?

তিহান তীব্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

—ভাইয়া তুই শান্ত হ।ভাবি ঠিক হয়ে যাবে।

তীব্র চেচিয়ে বলল,

—আমার চাদ কোথায়?

—ভাবি ওটিতে আছে।তুই শান্ত হ।

তিহান এর কথাটা শুনতেই তীব্রর মুখ ভয়ে সাথে এক রাশ রাগ এসে ভর করল।তীব্র আগের থেকে দ্বিগুণ চেচিয়ে বলল,

—ওটিতে মানে?কাকে বলে ওকে অটিতে নেওয়া হয়েছে?আমি বলেছিনা ওকে ঐ রুমে না নিতে।

—ভাই পাগলামো করিস না। ভাবি ঠিক হয়ে যাবে।

তীব্র তিহান এর কথা না শুনে তিহান এর সাথে সাথে রাগারাগি করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।তিহান শত চেষ্টা করেও তীব্রকে আটকাতে পারল না।

___________

ওটির দরজার পাশে রাখা চেয়ারে বসে অঝোরে কান্না করে চলেছে ফাইজা।মুনিয়া বেগম ফাইজাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আর একটু পর পর আচল দিয়ে ভিজে যাওয়া চোখ মুছছে।

—আমার জন‍্য আজ রাইজুই এই অবস্থা মা।সব আমার জন‍্য হয়েছে।আমি যদি রাইজুকে বাহিরে যাওয়ার জন‍্য জোর না করতাম না ও আজ বাহিরে যেত আর না এই অবস্থা হত।সব দোষ আমার মা সব দোষ আমার।কেন যে আমি রাইজু জোর করতে গেলাম।

কথাগুলো বলতে বলতে রাই আরো কান্নায় ভেঙে পরল।মুনিয়া বেগম ফাইজাকে সান্ত্বনা দিয়ে কন্দনরত গলায় বলল,

—শান্ত হ মা।নিজেকে কেন দোষারোপ করছিস তুই?যা ভ‍‍্যাগে ছিলো তাই তো হয়েছে।ভ‍্যাগের লিখন কেউ খন্ডাতে পারে না।আল্লাহর উপর একটু ভরসা রাখ মা।দেখবি তিনি সব ঠিক করে দিবেন।

—বাবা আমার চাদ কোথায়?

ওটির দরজার সামনে দাড়িয়ে হাটাহাটি করছিল ফরিদ খান।তীব্রর ধরাগলার কথা শুনে সে তীব্রর দিকে তাকালো।তীব্রর দিকে তাকাতেই তার কলিজা কেপে উঠল।হাসিখুশি উজ্জ্বল থাকা চাদ মুখটা আর উজ্জ্বল নেই।চাদ মুখে গ্রহন লেগে ফ‍্যাকাসে রুপ ধারন করেছে।ফরিদ খান দ্রুতপায়ে তীব্রর দিকে কদম বাড়িয়ে তীব্রর কাধে হাত রেখে বলল,

—বউ মা ওটিতে আছে।চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।

তীব্র চেচিয়ে বলে উঠল,

—আমি বুঝতে পারছি না কেন তোমরা আমার চাদকে ঐ মরন রুমে পাঠিয়েছো?তোমরা কি আমার চাদকেও আম্মুর মত মেরে ফেলতে চাও?এখনি বল তাদের আমার চাদকে বের করতে নাইলে কিন্তু আমি দরজা ভেঙে আমার চাদকে বের করব।

ফরিদ খান তীব্রর মুখে এমন কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।এতো বছর পরেও যে তার ছেলের মন থেকে ভয় কাটেনি সেটা সে বুঝতে পারল।ফারুক খান এগিয়ে এসে তীব্রর কে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

—শান্ত হ বাবা।আল্লাহকে ডাক।দেখবি আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে।

তীব্রঃছোট বাবা তুমি বুঝতে পারতাছো না ঐ রুমে গেলে কেউ ফিরে আসে না।

ফারুক খানঃআল্লাহ উপর ভরসা নেই তোর?বলছি তো আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে।

তীব্র কথা না বাড়িয়ে ওটির দরজার দিকে তেড়ে যেতেই তিহান তাকে বাধা দিল।তীব্র যেন আজ নিজের মধ‍্যে নেই।কারো কোন কথা কোন বাধাতেই যেন সে বুঝ মানছে না।তিহানের সাথে চিৎকার চেচামেচি করতে লাগলো।তীব্রর চিৎকার শুনে হাসপাতালের লোকেরা এসে তাকে কথা শোনাতে লাগলো।তাতেও যেন তার কিছু যায় আসে না।সে তার পাগলামি করেই চলেছে।মুনিয়া বেগম তীব্রকে বহু কষ্টে টেনে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

—শান্ত হ বাবা।আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।সব ঠিক হয়ে যাবে।

তীব্র মুনিয়া বেগমকে জরিয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠল।বিরবির করে বলতে লাগল,

—ছোট মা আমার চাদ। আমার চাদকে তুমি আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসো ছোট মা।কেউ তো আমায় বুঝে না।অন্তত তুমি আমার কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা কর।ওরা আমার চাদকে মেরে ফেলবে ছোট মা।বাচতে দিবে না আমার চাদকে।আমায় তো ওর কাছে যেতে দিচ্ছে না।তুমি যেয়ে ওকে আমার কাছে নিয়ে।ওর কিছু হলে আমি মরে যাব ছোট মা।আমি মরে যাব।

তীব্র কান্না ও পাগলামো দেখে সবার চোখ ভিজে উঠল।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া তীব্রকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কারো মুখেই কোন কথা নেই।

তীব্রর এই পাগলামো বন্ধ করতে তার চাদ তার কাছে ফিরে আসবে তো?

_________

—আই এম সরি রাই।আই এম ভ‍্যারি সরি।প্লিজ আমায় মাফ করে দিও তোমায় কষ্ট দেওয়ার জন‍্য।প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ আমার উপর রেগে থেকো না।তোমায় কষ্ট দেবার জন‍্য ছোট বোন হিসেবে আমায় ক্ষমা করে দিও।কি করবো বল,তুমি তো জানো আমি আমার জিনিসের প্রতি কতটা সেনসিটিভ।সাধারন আমার একটা পছন্দের চকলেটেই আমি কাউকে ভাগ দেই না সেখানে আমার ভালোবাসার মানুষের মনে বসবাস করার আমায় যায়গায় কিভাবে অন‍্য কাউকে ভাগ বসাতে দিব বল?আমি জানি তুমি তাকে চাওনা কিন্তু সে তো তোমায় চায়।যেভাবেই হোক ধরে বেধে জোর করে তোমাকে তার কাছে রাখতে চায়।এখানে আমার দোষ কি বল?আমি জানি তুমি বলবে তোমার দোষ কই?তুমিও তো তার কাছে থাকতে চাও না।কিন্তু কি জানো?আমার মনের আদালতে দোষ না করেও সব থেকে বড় দোষী তুমি।কেন তুমি এতো মায়াবী হতে গেলে আর কেনই বা আমার জান এর সামনে পরলে।একটু কম মায়াবী হলে কি হত তোমার।একটু কম মায়াবী হতে পারলে না।তাহলেই তো সব সমস‍্যা সমাধান হয়ে যেত।

হাতে থাকা রিভলবারটা ঘুড়াতে ঘুড়াতে ফোনের স্কিনে ভেসে থাকা রাই এর একটি হাস‍্যজ্জল ছবির দিকে তাকিয়ে এতোক্ষন কথাগুলো বলছিলো মাহি।মুখে ফুটে উঠেছে তার প্রতিহিংসার ছাপ।তার এই হিংসায় কি সে কাউকে পুড়াবে নাকি নিজেই ধংস হবে?

(রহস‍্য কমাতে গিয়ে এখন আরো বাড়ছে😵)

#চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে