#মেঘের_ভেলায়_চড়ে
#Part_02
#Ariyana_Nur
আকাশের বুকে চকচক করতে থাকা থালার মত বিশাল বড় চাঁদটা আজ মেঘদের সাথে লুকোচুরি খেলছে।কখনো মেঘের আড়ালে ঢাকা পরছে তো কখনো মেঘের আড়াল থেকে উকি দিয়ে নিজের রুপালি আলো পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ছাদের রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে খুব মনোযোগ সহকারে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখছে একজন লোক।ফোনের রিংটন বেজে উঠতেই লোকটার চেহারার বিরক্তের ছাপ চলে এল।এক রাশ বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কলটা কেটে দিল।সাথে সাথেই রাই এর হাস্যজ্বল চেহারার পিক ফোনের স্কিনে ভেসে উঠল।রাই এর পিক দেখে লোকটার চেহারার বিরক্তির ছাপ মুহূর্তেই দূর হয়ে গেলো।ফোনের স্কিনে রাই এর হাস্যজ্বল পিকটির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল……
—এই মেঘদের মত তুমি আমার সাথে লুকোচুরি খেলছো তাই না?আমার আকাশ সম্পূর্ণ রুপে আলো করতে কবে তুমি আমায় ধরা দিবে চাঁদ?তুমি হীনা এই অন্ধকার জীবন আর কত কাটাবো বলতে পারো?
_______
কাচা ফুল আর ফেইরি লাইট দিয়ে সুন্দর করে দিপা বেগমদের পুরো বাসা সাজানো হয়েছে।ড্রয়িং রুমের এক পাশে সুন্দর করে বর,বউ এর জন্য ছোট করে স্টেজ সাজানো হয়েছে।আত্নীয়-স্বজন,সামার্থ্য থাকা শর্তেও ফাহাদ বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই করছে।কেননা ফাহাদ তার সম্পত্তিকে পুতুল বানিয়ে সবাই কে দেখাতে চায় না।
স্টেজে বর বেসে বসে রয়েছে ফাহাদ।যদিও বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হচ্ছে তার পরেও নিজেকে বর রুপে পরিপাটি করতে কোন কমতি রাখেনি সে।ফাহাদ মাশাল্লাহ্ দেখতে অনেক সুন্দর।মেরুন কালার এর শেরওয়ানীতে বর বেশে নিজেকে পরিপাটি করাতে যেন আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে ফাহাদকে।
দিপা বেগম ফাহাদের সামনে এসে নিজের চোখের থেকে কাজল নিয়ে ফাহাদের কানের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে বলল……
—মাশাল্লাহ।আমার ফাহাদ বাবাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।কারো যেন নজর না লাগে।সাথে আমারও।আজ এতো সুন্দর লাগছে যে আমিই আমার বাবার দিক থেকে চোখ সরাতেই পারছি না।
দিপা বেগম এর এমন তারিফ শুনে ফাহাদ ঠোটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলল…..
—একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না ফুপি?
—কিসের বেশি বেশি।যা বলছি তা তো আরো কম হচ্ছে।আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোর বন্ধুদেরকেই জিগ্যেস করে দেখ।
—হয়েছে আর ওদের জিগ্যেস করতে হবে না।ওরা তো এমনিতেই সব সময় আমায় তেল মারে।
—তেল মারার কি আছে?আমার ফাহাদ বাবা আসলেই অনেক সুন্দর।সুন্দরকে কি এরা সুন্দর বলবে না?
—হয়েছে তোমার আর আমার প্রশংসা করতে হবে না।তুমি কথা না বাড়িয়ে তোমার মেয়েকে নিয়ে আসো।দেখি তুমি তোমার মেয়েকে কিভাবে সাজিয়েছো।আমার উপযুক্ত করে সাজিয়ে তুলতে পেরেছো কিনা।
ফাহাদ এর কথা শুনে ফাহাদ এর পাশে বসে থাকা ফাহাদ এর এক লোক দাত কেলিয়ে হেসে বলল…….
—ভাই এর দেখি ভাবিকে দেখার জন্য তর সইছে না।এতো উতালা হলে কেমন হইবো ভাই?ভাবি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।
ফাহাদ লোকটার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই লোকটা দমে গেলো।হাসি থামিয়ে কাচুমাচু করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।সামনের বসে থাকা কাজি কে উদ্দেশ্য করে বলল…..
—কাজি সাহেব!আপনার কাগজ পত্র সব রেডি হয়েছে তো?ভাই এর তো ভা….না মানে কনেকে ডেকে আনবে?
কাজি সাহেব নিজের চোখের চশমাটা বাম হাতের আঙুল দিয়ে একটু উপরে উঠিয়ে বলল……
—কাগজ পত্র সব ঠিকঠাক আছে।আপনারা কনেকে ডেকে আনুন।
কাজি সাহেবের কথা শুনে ফাহাদ দিপা বেগমের দিকে তাকাতেই দিপা বেগম মুচকি হেসে বলল……
—আমি মেয়েকে নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে এক মুহূর্ত দেড়ি না করে দিপা বেগম রাই এর রুমের দিকে পা বাড়ালো।
______
রাইকে বধূ রুপে এক নজর দেখার জন্য রাই এর পথ চেয়ে তাকিয়ে বসে বসে ছটফট করছে ফাহাদ।অনেকক্ষন অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন রাই এর দেখা মিলল না তখন ফাহাদ ধর্য্য ধরে বসে থাকতে না পেরে গলার আওয়াজ উচু করে দিপা বেগমকে ডাকতে লাগলো।ফাহাদ এর কাজে ফাহাদ এর লোকেরা হাসি মজা করতে লাগলো।ফাহাদ কেন যেন তাদের কাজে আজ রাগলো না।নিজের লোকদের টিজ শুনে মিটমিট করে হাসতে লাগল।
ফাহাদ এর বাজখাই গলার ডাক শুনে দিপা বেগম তড়িঘড়ি ফাহাদ এর সামনে এসে উওেজিত কন্ঠে বলল…….
—ফাহাদ বাবা!রাই বাড়িতে নেই।ওর রুমের ওয়াশরুম,বেলকনিতে সব জায়গায় ভালো ভাবে খুজেছি।কোথাও রাইকে পাইনি।
দিপা বেগম এর কথাটা শুনে মুহূর্তের মধ্যে ফাহাদ এর হাসিখুশি চেহারার মধ্যে রাগ এসে ভিড় করল।ফাহাদ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে শীতল আওয়াজে বলল……
—নেই মানে?কোথায় ও?
ফাহাদ এর শীতল কন্ঠের কথা শুনে দিপা বেগম শুকনো ঢোক গিলে কাপাকাপা গলায় বলল…….
—মনে হয় পালিয়েছে।
_______
নিস্তব্ধ রাস্তার এক কোনে ভয়ে জড়সড় হয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে রাই।হাতে থাকা সেলফোনটি দিয়ে রাই বার বার একটা নাম্বারে ডায়াল করছে আর প্রতিবারই ভেসে আসছে,আপনি যেই নাম্বারে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে।তখন রাই এর রুমে আগমন করা আগুন্তক লোকটি রাই এর বেস্ট ফ্রেন্ড ফাইজা এর হেল্প নিয়ে রাইকে পালাতে সাহায্য করেছে।ফাইজা রাইকে যেখানে এসে দাড়াতে বলেছে রাই ঠিক সেইখানে এসেই ফাইজার জন্য অপেক্ষা করছে।
—এই যে মিসঃ তাড়াহুড়ো!এতো রাতে মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে কি করছো?
পিছন থেকে কথাটা কানে ভেসে আসতেই রাই চমকে পিছন দিকে তাকালো।ল্যাম্প পোষ্টের আলোতে সেদিনের ভার্সিটির সেই ছেলেটাকে চিনতে রাই এর ভুল হল না।রাই ছেলেটিকে দেখে অবাক কন্ঠে বলল…….
—আপনি?
ছেলেটি বাকা হেসে বলল…….
—কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলে?
ছেলেটির কথার প্রতিউওরে রাই কোন কথা না বলে শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে কাচুমাচু করে দাড়িয়ে রইল।আড়চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে পালানোর রাস্তা খুজতে লাগল।এমনিতে বাসা থেকে পালিয়ে এসে ভয়ে এ রাই এর জান যায় যায় অবস্থা।তার উপরে এই উটকো ঝামেলা।রাই এর মাথা কাজ করা যেন বন্ধ করে দিয়েছে।মাথা কেমন ভন ভন করে ঘুরছে।
—মিস তাড়াহুড়ো!বউ সাজে তোমায় কিন্তু দারুন লাগছে।নিস্তব্ধ রজনীতে বউ সেজে হাতে সেলফোন নিয়ে তৃষ্ণার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে খুজে চলেছো?তোমার আশিক কে?তা তোমার ঐ পাগল আশিক কোথায়?বউ সেজে কি তার জন্য পালিয়েছো নাকি তার থেকে?
ছেলেটির কথায় রাই আরো ঘাবরে গেলো।কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে ঠাই দাড়িয়ে রইল।মনে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে লাগল।
ছেলেটি রাইকে ভীত হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মিটমিট করে হেসে আফসোসের সুরে বলল……
—আহারে!বেচারী বউ সেজে বিয়ের আসন থেকে আশিকের জন্য পালিয়েছে অথচ তার আশিকই আসেনি।চিন্তা করো না।তোমার আশিক আসেনি তো কি হয়েছে?সঙ্গী হিসেবে আমি কিন্তু খারাপ না।হবে নাকি আমার চলার পথের সঙ্গী?
কথাগুলো বলে ছেলিটি বাকা হেসে রাই এর হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতেই রাই নিজের হাতে থাকা সেলফোনটি ছেলেটির নাক বাড়িয়ে ছুড়ে মারল।রাই এর হঠাৎ আক্রমনে ছেলেটি নাক ধরে আর্তনাদ করে দু’কদম পিছিয়ে যেতেই রাই তড়িঘড়ি সামনে পরে থাকা ভাঙা ইটটি হাতে তুলে নিল।ছেলেটি নাক ঢলতে ঢলতে বলল…..
—কি করলে এটা?
রাই দু’কদম পিছিয়ে বলল…….
—এখন তো শুধু নাক ফাটিয়েছি।দ্বিতীয় বার আমার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে মাথা ফাটাবো।
ছেলেটি অবাক হয়ে বলল……
—একটু আগে না ভয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে ছিলে?মুহূর্তের মধ্যে এতো সাহস কোথায় পেলে?এজন্যই বোধ হয় লোকে বলে মেয়েদের রুপ আকাশের রং এর মত পাল্টায়।
রাই রেগে কিছু বলার আগেই রাই এর সামনে একটা গাড়ি এসে থামল।গাড়ি থেকে দ্রুত ফাইজা নেমে এল।ফাইজাকে দেখেই যেন রাই এর কলিজায় পানি চলে এল।রাই নিজের হাতে থাকা ভাঙা ইটটা ছেলেটার পায়ে ছুড়ে মেয়ে দৌড়ে গিয়ে ফাইজাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠল।ফাইজাও রাই কে আগলে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
______
রাই এর রুমের কোন জিনিস তার জায়গা মত নেই।সব কিছু এলোমেলো হয়ে রয়েছে।ফ্লোরের জাগায় জাগায় কাচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।রাই এর রুমের এক কোনে ফাহাদ রনমূর্তি হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে।ফাহাদের ডান হাত দিয়ে টপ টপ করে রক্ত গড়িয়ে পরছে।কিন্তু সেদিকে তার কোন খবর নেই।সে তার সামনে পরে থাকা রাই এর একটা ছবির দিকে রক্ত চোখ করে তাকিয়ে রয়েছে।ফাহাদ রাই এর ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে বিরবির করে বলল……
—ভালো করিস নি পাখি।কাজটা মোটেও ভালো করিস নি।আমার খাচা থেকে ঊড়ে পালানোর চেষ্টা করে বড্ড ভুল করেছি।ঊড়ে আর যাবি কোথায় বল?একদিন না একদিন তো তোকে আমার খাচায় বন্দি হতেই হবে।তখন বুঝবি এই ফাহাদ কি জিনিস।
#চলবে,
(বানান ভূলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ।)