মেঘের ছায়া পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
1071

#মেঘের_ছায়া ( অন্তিম পর্ব)

বিষন্নতায় আজ কয়েক টা দিন কাটছে আসফাকের।নিজেকেই দোষারোপ করছে সে। হেয়ালি করে গাড়ি না চালালে হয়তো আজ আর তার ফারাকে কষ্ট পেতে হতো না। এ*ক্সি*ডেন্টের কথা মনে হতেই আসফাকের লোমশ ক্রমাগত শিরশির করে উঠে।সেদিন বাসায় ফিরবার পথে বড় ট্রাকের সাথে আসফাকের গাড়িটা ধাক্কা লাগে যার ফলে ফারা গুরুতর আহত হয়। সেদিনের অভিমানী মুখটা ভেসে আসতেই আসফাকের কলিজায় মোচড় পড়ে। আসফাক পায়ে গুরুতর ব্যথা পায় তবে এ ব্যথা যে তার ফারাকে হারানোর ব্যথা থেকে বেশি নয়।
এই কয়েকদিনে আসফাক মহান আল্লাহ তায়ালাকে যে কতবার ডেকেছে গত জীবনে মনে হয় তার অর্ধেকবারও ডাকেনি।

আজ সকালে ফারার জ্ঞান ফিরে। ফারা গভীর নয়নে তার প্রিয়তম বরকে দেখছে। এ কয়েকদিনে মানুষটার চোখের নিচ ডেবে গেলেও সৌন্দর্য যেন একটুখানিও ম্লান হয়নি, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেন তাকে আরো মোহনীয় লাগছে।ইচ্ছে করছে ফারার তার বুকে মাথা রেখে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে।

ফারাকে চোখ খুলতে দেখে আসফাক তার ফারুকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ফারার দু’হাত নিজের বুকে জড়িয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘ তুই আমার উপর অভিমান করেছিস ফারু! কি করে পারলি তা করতে! আমি বড্ড বাজে তাই না! আমি কি তোর ঘৃণার পাত্র! তাই বলে আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিস ফারু! আমি আসফাকও নাছোড়বান্দা, মহান আল্লাহর কাছ থেকে তোকে আবারো চেয়ে নিয়ে এসেছি। এবার আর ফাঁকি দিলে চলবে না, আমাকে প্রচুর ভালোবেসে অন্ধকার জীবনকে জোছনার আলোয় আলোকিত করে দিবি, কথা দে।’

আসফাকের আদর মাখা কথা শুনে সেদিন ফারাও খুব কাঁদলো, তবে এ কান্না যে তার সুখের কান্না।

হসপিটাল থেকে ফিরে ফারাকে আসফাক খুব কেয়ার করে। আসফাকের যত্নে এবং আল্লাহর রহমতে ফারা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।

ফারা শুয়ে শুয়ে সিরাত বইটা পড়ছিল। এমন সময় তার শাশুড়ি ফারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ জানিস তো ফারা আমার আসফাক এখন আর আগের মত নেই। এখন সে একজন কেয়ারিং ছেলে, কেয়ারিং স্বামী হয়ে উঠেছে। প্রতি ওয়াক্তের নামাজ শেষে সে হসপিটালে ফিরে নফল নামাজের সিজদাতে তোর সুস্থতার জন্য অনেক কাঁদত। এ কটা দিন তোকে হারিয়ে সে যেন উ*ন্মা*দ ছিল। আমার ছেলেটাকে তুই যত্নে রাখিস মা।’

শাশুড়ি চলে যেতেই ফারা ভাবল মহান আল্লাহ চাইলে যে কেউ যেকোনো সময় হেদায়েতের পথে আসতে পারে। ফারা চিন্তা করে দেখলো আসলেই তো আসফাক অনেক পাল্টে গেছে। এমন একটা বর ই তো ফারা চেয়েছিল মহান রবের কাছে। হয়তো মহান আল্লাহ তাআলা একটু দেরিতে তার দোয়া কবুল করেছেন। দোয়া এমন এক জিনিস যা আগে পরে কবুল হয়। হয়তো কারো দোয়া একটু দেরিতে কবুল হয় আর কারোর তাড়াতাড়ি। তবে কবুল হবেই। দোয়া হলো দুনিয়া এবং আখেরাতের মূলধন, দোয়ার মাধ্যমে মূলধন জমা রাখা হয়। হয়তো সেই মুলধন কেউ ইহকালে পায় আর কেউ পরকালে।

ফারার হাতে ভারী কিছু দেখতেই আসফাক দৌড়ে এসে ফারাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ কি করতে যাচ্ছে আমার বউটা ব্যাথা লাগবে তো!’

আসফাক বুকের বাঁ পাশটা চিহ্নিত করে বলল, ‘ দেখ এই এখানেই ব্যাথা লাগবে আমার।’

আসফাকের কথা শুনে ফারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

আজ আকাশের চাঁদকে যেন গোলাকার বৃত্তের ন্যায় লাগছে। প্রেমময় হৃদয় গুলো যেন আজ ভালবাসা পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। চোখ বন্ধ করতেই ফারা কারো গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলো ঘাড়ে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আসফাক মুখে ভুবন ভুলানো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

আসফাক ফারার কানে ফিস ফিস করে বলে, ‘ এই ফারু ভয় পেয়েছিস! আমি যে তোর বর হই ; বর কে বুঝি ভয় পায়, না-কি আদর খায়!’

ফারা লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো।

আসফাক ফারার হাত সরিয়ে কপালে টুপ করে চুমু খেয়ে বললো,

‘তুই কখনো বর হিশেবে কাছে টেনেছিস আমায়, ভালোভাবে দু’খানা ভালোবাসার কথা বলেছিস?’

-‘আপনি তো লিজকে ভালোবাসেন।’

-‘শসসস! হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে আমি গুনাহ ছাড়া আর কিছুই পাইনি বরং আমার বউয়ের মিষ্টি ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা হালাল কে গ্রহণ করতে এবং হারামকে বর্জন করতে বলেছেন ; কিন্তু আমরা বো*কারা উল্টোটা করে বসি, যার ফলে আমরা ইহকাল পরকালের সুখ শান্তি থেকে বঞ্চিত ও লাঞ্চিত হই। এ কয়দিনে আমি পবিত্র কোরআন এবং হাদীস পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি, আর এ সকল কিছুর মূলেই তোর অবদান এবং মহান রবের অশেষ কৃপা রয়েছে।
বুজুর্গরা বলেন,

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা গভীর হওয়া কাম্য। ভালোবাসা হলো আল্লাহ তা’আলার দান। স্ত্রীকে ভালোবাসা প্রসঙ্গে হাদিসে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘ তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম, যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। এ হাদিসটা আমাকে খুব করে টানে আর তা হলো, হযরত খাদিজা (রাঃ) সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। (মুসলিম)

ঠিক তেমনি ফারু তোমার জন্য আমার হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করা হয়েছে। যে ভালোবাসা পেলে হৃদয়ে শীতলতা আসে।
চল আজ দুজন হৃদয় আদান প্রদান করি স্বামী স্ত্রীর পূর্ণতা এনে আল্লাহর রহমত অর্জন করি।’

ফারা কিভাবে বলবে তার হৃদয়ের অভিব্যক্তি। নিজের অপারগতায় মুষড়ে যেতে থাকে। আসফাকের প্রতি মুগ্ধতা তার সকল প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
লজ্জা পেয়ে সে আসফাকের বুকে মুখ লুকায়। আজ ফারা প্রশান্ত তার হৃদয় আজ ভালোবাসায় তীপ্ত। তীপ্ত নয় এ যেন অনন্ত বিস্ময়ের এক আবিষ্কার।

কোনো এক সকালে,
-‘এই ফারু ফারু এদিকে আসো তো।’

ফারা কাছে আসতেই আসফাক ফারার হাতে চিরুনি টা দিয়ে বললো, ‘ মহারাণী এবার আমাকে একটু ভালোবাসা দিয়ে ধন্য করুন।’

ফারা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বললো, ‘ কেন আপনার তো হাত রয়েছে। ‘

-‘তাতে কি! আমার মিষ্টি বউয়ের নরম হাত থাকতে নিজের শক্ত হাতে কেন। ‘

ফারার চোখ জুড়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।
ফারা মুচকি হেঁসে চিরুনিটা নিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে হাত দিয়ে দাড়িগুলো গুছিয়ে দিলো এবং সূরা পড়ে আসফাকের বুকে ফুঁ দিলো।

শীতল কণ্ঠে আসফাক বললো, ‘ আপনি জানেন না আমার দুচোখ সারাক্ষণ আপনাকে খুঁজে বেড়ায়। আমার হৃদয় সারাক্ষণ আপনার ভালোবাসা পেতে ব্যকুল। এখন আমার পাওনা টা যে বাকি, পরিশোধ করে দিন। আমি আবার পাওনা কিছু বেশিক্ষণ বাকি রাখতে পারি না। ‘

-‘চোখ বন্ধ না করলে আমি যে লজ্জা পাই। ‘

-‘ ওরে আমার লজ্জাবতী ফুল এই আমি চোখ বন্ধ করলাম।’

অতীতের স্মৃতি মনে হতেই আসফাক চোখের অশ্রুজল আড়ালে লুকাল।

আসফাক ও ফারার মেয়ে নূরের ডাকে আসফাক বাস্তবে ফিরে। আজ পনের বসন্ত পার হয়েছে ফারা কে ছাড়া। নূরের বয়স পনের চলছে। নূরকে পৃথিবীতে আসার দিন ফারা মহান আল্লাহর কাছে মেহমান হয়ে চলে গেছে। ফারার ইচ্ছে ছিলো সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সে যেন কোরআনে হাফেজ বা হাফেজা হয়। আসফাকও আল্লার রহমতে ফারার কথা রাখতে পেরেছে। তাদের মেয়ে কোরআনে হাফেজা হয়েছে । নূর দেখতে অবিকল তার মায়ের মত হয়েছে। বাবাকে সে যেন চোখে হারায়। মাদ্রাসা যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে সে বাবার কাছে এসে চুল আঁচড়ে দিয়ে দাড়িগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে দিল এবং ফারার মতো সূরা পড়ে বুকে ফুঁ দিল বাবা যেন সহিসালামতে থাকে।

ফারার মৃ*ত্যুর পর আসফাকের বাবা-মা তাকে বিয়ে দিতে চাইলে আসফাক না করে দেয়। কেননা আসফাক জানে স্বামী-স্ত্রী ভালো আমলের হলে তারা একসাথে জান্নাতে থাকবে। আশা তো মানুষের একমাত্র ভরসা। আসফাকও সে আশায় বুক বেঁধে আছে। সে ফারার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আসফাকের মনে হয় তার ফারা তার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।

-‘তোমাকে দেখিবার সাত জেগেছে মনে,
জানি পূরণ হবে একটু আগে পরে,
তাতে মন্দ কি, তুমি তো আমারই।’

এই বলে আসফাক চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে তার প্রিয়তমাকে।

সমাপ্ত

(আফরিন ইভা)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে