মেঘের ছায়া পর্ব-০৯

0
817

#মেঘের_ছায়া (৯)

‘রাগ লাগছে ভীষণ, উনিও কিভাবে পারছেন আমার পিছু পিছু শশুর বাড়ি আসতে লজ্জা নেই বললেই চলে।
ভদ্রভাবেই বিছানা করে দিলাম শত হোক উনি তো আমাদের বাসার মেহমান। মশারী টাঙাতে গিয়ে পড়লাম বিপদে।ইনিয়ে বিনিয়ে দেখলাম মশারীতে মস্ত বড়ো ফুটো।
এতো রাতে মশারি সেলাই করবো সেই ধৈর্যটাও নেই এতো রাতে।’

উনি ফুটোটা দেখতে পেয়ে বললো, ‘ এই ফুটোর জন্য তো আর আমার বউ এতো রাতে আমাকে ফেলে সেলাই করতে পারে না, আমিও চাই না আমাকে নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে এই মশারী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরুক। তাই আমার মত দায়িত্বশীল স্বামীর উচিত বউয়ের জন্য কিছু করা।’

এই বলে উনি ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো।

‘এটুকু বলেই উনি যা করল তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। উনি আমার মাথার সেফটিপিন দিয়ে আরেকটা ফুটো করে দিল।’

নিশ্চিন্ত মনে বলল, ‘যাক ভালই হলো এবার মশারা এক ফুটো দিয়ে আসবে আরেক ফুটো দিয়ে চলে যাবে।’

‘আমি অবাক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আর কোন উপায় না পেয়ে শুয়ে পড়লাম। খানিক বাদে পড়লাম মহা বিপদে আমার ঘরে তো কোল বালিশও নেই। মাঝখানে দিবো কি ভাবতে ভাবতে খানিক বাদে ঘুমিয়ে গেলাম।’

ঘুম ভাঙতেই ফারা চমকে উঠলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল, রাত তিনটে বাজে। ঘুম ঘুম চোখে অজু করে সে তাহাজ্জুদের সালাতে দাঁড়িয়ে গেল তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য। তাহাজ্জুদ ফারার প্রিয় ইবাদত। কেননা রাতের শেষাংশে মহান রব দুনিয়ার আকাশে নেমে মানুষকে নামাজের জন্য তাকে ডাকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার জন্য আহ্বান করেন। ফরজের পর আল্লাহ তায়ালা রাতের নামাজের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাই মুমিন মুসল্লির কাছে রাতের নামাজ তাহাজ্জুদ এর গুরুত্ব ফজীলত অনেক বেশি।
মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই ফারা জায়নামাজ থেকে উঠে আসফাককে ডাকলো কিন্তু সে আজও কোন সাড়া দিল না। ফারা হতাশ হয়ে ফিরে আসলো। ফজরের সালাত আদায় করে আসফাকের হেদায়েতের জন্য মহান রবের কাছে দোয়া করলো

ফারা মনে মনে ভেবে ঠিক করেছে আসফাকের সাথে সে আর কথা বলবেনা। ফারা মনে মনে বললো, ‘ অতীতে যা করার করেছেন উনি কিন্তু এখন তো উনি বিবাহিত এবং আমি ওনার স্ত্রী হিসেবেও তো আমারও দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করে আমার মনে অভিমান জমা হয়েছে।’

সকাল সকাল ফারা আসফাকের সব কিছু আগে আগে রেডি করে রেখেছে তবুও যেন আসফাকের সাথে কথা বলতে না হয়।

আসফাক রুমে চোখ বুলাতেই দেখলো বিছানায় একটা চিরকুট এবং তাতে লেখা নাস্তা করতে নিচে আসেন সবাই অপেক্ষা করছে। আসফাক ও নাছোড়বান্দা সে ফারার এমন কাণ্ডে মনে মনে হাসলো। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে দেখল সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে।

দাদু পাশের চেয়ারটায় আসফাক কে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন ঘুম হয়েছে ইয়ং ম্যান?’

আসফাক বাঁকা চোখে ফারার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘ তোমার নাতবউ থাকতে খারাপ ঘুম হবে কেন।’

এটুকু শুনে হেঁচকি উঠে গেল ফারার।

আসফাক পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে ফারার কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ এই যা এটুকু শুনেই তুই শেষ আরো যে অনেক বাকি।’

ফারা চোখ বড় বড় করে তাকালো আসফাকের দিকে।

দাদু খেতে খেতে বললো, ‘ বিয়েতো হলো শুধু কি তোদের দুজনকেই দেখবো! নতুন অতিথির খবর কবে পাবো?’

আসফাক খেতে খেতে খুব স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো, ‘ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দুজন।’

এ কথা শুনে লজ্জায় ফারার কান গরম হয়ে গেল। ফারার ইচ্ছে করছে এই লোকটার মুখে টেপ মেরে দিতে।ইনিয়ে বিনিয়ে দাদুর সাথে তাল মিলিয়ে মিথ্যা বলছে অনবরত।

নীরব চাহনিতে ফারা বাহিরে তাকিয়ে আছে। নীল আকাশ আজ কালো অন্ধকারে গুমোট ধরে আছে। অভিমানী আকাশ যেন তার সৌন্দর্য আজ লুকায়িত রেখেছে।

আসফাক গলা খাকারি দিতেই ফারা তাকালো। মুহূর্তেই ফারা চোখ ফিরিয়ে নিল।

-‘আজ এমন একটা অভিনয় করছিস মনে হয় সেরা অভিনেত্রীর পুরষ্কারটা তোকেই দিতে হবে।’

আসফাকের কথা শুনলেও যেন ফারার কাজ পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে কোন কথা না বলেই আগের মত চুপ করে রইল।

আসফাকের আর সহ্য হলো না। সে দাঁতে দাঁত চেপে ফারার হাত চেপে ধরলো।
আসফাক এতোটাই জোরে ধরলো ব্যথায় ফারা কুঁকড়ে উঠলো।

আসফাক কটু স্বরে বললো, ‘ তোর এত দেমাগ কেন? আমার সাথে কথা বলছিস না কেন! আমি কি এতটাই পাপী আমার সাথে কথা বললে তোর গায়ে ফোস্কা পরবে!’

ফারা আর কিছু বলতে পারলোনা। ব্যথায় সে কেঁদে ফেললো।ফারার কান্না আসফাকের বুকের বাঁ পাশে এসে লাগলো, বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠলো।
ফারার চোখে অশ্রু দেখে আসফাক ফারার গালে আলতো করে হাত রাখলো। ফারার অগোছালো চুল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বললো, ‘ ফারু এই ফারু আমার দিকে তাকা।’

ফারা টলমল চোখে তাকালো আসফাকের দিকে।

-‘ কি হয়েছে আমাকে বল ফারু? কি করেছি আমি? কি নিয়ে তুই আমার উপর রাগান্বিত? খুব বেশি ভুল করে ফেলছি! মাফ করবি না আমায়!’

আসফাক চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রইলো ফারার দিকে।কিছু বলার অপেক্ষায় সে।

ফারা গাল ফুলিয়ে নাক টেনে টেনে বললো, ‘ নামাজ পড়বার জন্য আপনাকে কতবার ডেকেছি আমি, আমার আবদারের কি একটুখানিও মূল্য নেই। আমি না হয় তুচ্ছ মানুষ আমার মহান আল্লাহর কথা ভেবে তো নামাজ পড়তে পারেন। সুসময়ে আমাদের বন্ধু অনেকেই হয়, দুঃসময়ে হয়তো আমরা কাউকে পাবো না কিন্তু মহান আল্লাহর রহমত আমাদের উপর সব সময় আরোপিত। ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হল নামাজ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার নামাজের তাগিদ পেয়েছেন। পবিত্র কোরআন পাকে বিভিন্ন জায়গায় ৮২ বার সালাত শব্দ উল্লেখ করে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক বা ফরজ। তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো আর নিঃসন্দেহে তা বড়ই কঠিন বিনীতদের জন্যে ছাড়া।’

( সূরা বাকারাহ- আয়াতঃ৪৫)

আসফাক ভেতরে ভেতরে যেনো অনুতাপের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে। ফারার হাত নিজের গালে ঘষে মিষ্টি আলতো ছোঁয়ায় কপালে চুমু খেয়ে বললো,
‘ আমাকে এভাবে কেউ বলেনি ফারু, নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে এতোদিন জানতাম না আমি। অনেক বড় ভুল করেছি আমি, অনেক সময় অপচয় করেছি আমি।’

এই বলে দু’ফোঁটা অশ্রুজল মুছে নিলো।

আসফাকের কথা শুনে ফারা স্তব্ধ হয়ে রইলো।

-‘ রেডি হয়ে নে বাসায় যাব।’
এই বলে আসফাক উঠে গেল।

ফারা আর কিছু বললো না সেও রেডি হয়ে নিলো।

আসফাক আনমনে গাড়ি চালাচ্ছে। কেউ কারো সঙ্গে একটি কথাও বলছে না। ফিনফিনে নিরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎ এমন একটা কান্ড ঘটলো যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলোনা।

চলবে–

( আফরিন ইভা)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে