#মেঘের_ছায়া (৪)
ফজরের আযান কানে ভেসে আসতেই ফারা উঠলো নামাজ পড়তে। ফারা আহত দৃষ্টিতে আসফাকের দিকে তাকালো, গভীর ঘুমে মগ্ন উনি।ভাবলো তবুও একবার ডেকে দেওয়া উচিত। ফজরের নামাজ বলে কথা। দিনটাই তো শুরু হয় আমাদের ফজর দিয়ে। ফজর হীন একটি দিনও ভালো হতে পারে না। কেননা যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়বে সেই আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়েও আসফাককে দু’বার করে ডাকলো ফারা, কিন্তু তার ডাককে উপেক্ষা করে আসফাক আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। ফারা বুঝতে পারলো ফজরের নামাজের প্রতি আসফাকের কোন তাগিদ নেই। মনে মনে আফসোস করলে সে।
ফজরের নামাজ শেষে ফারার ঘুম হলো না আর। সে শাশুড়ির রুমে গিয়ে দেখল, শাশুড়ি বসে বসে তসবিহ গুনছে। ফারা গিয়ে শাশুড়ির কোলে মাথাটা রেখে বলল,
‘ ফুফু আমাকে একটু দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দাও তো!’
ফারার শাশুড়ি মুখে হাসি রেখে বললেন,
‘ পাগলি মেয়ে আমি কি এখন তোর ফুপু নাকি আমি তো এখন তোর মা হই। আজ থেকে তুই আমাকে মা ডাকবি।’
ফারা মনে মনে উনার ছেলের কথা ভাবলো। মনে মনে বললো,’
আসফাক ভাইতো আমাকে সে অধিকারটুকু দেয়নি।’
তবুও মুখে জোরপূর্বক হাসি হেসে ফুফুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে আস্তে আস্তে চেষ্টা করব।’
কিচেনে গিয়ে শশুর শাশুড়ির জন্য চা নিয়ে আসলো ফারা। ফুপাকে শ্বশুর ভাবতে ফারার কেমন যেন একটা লজ্জা লাগছে। তবুও সে নিজেকে মানাতে চেষ্টা করছে। আসফাক ভাইয়ের বাবা ফারাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ এ বাড়িতে তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?’
যদিও ফারার মনে অনেক সমস্যার উদ্রেক বসে আছে। মাথা নেড়ে না জানালো তার কোন সমস্যা হচ্ছে না।
ফারার শশুর শাশুড়ির সাথে গল্প শেষে আসফাকের জন্য চা নিয়ে গেল রুমে। গিয়ে দেখলো আসফাক ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে ভীষণ ব্যস্ত। ইনিয়ে বিনিয়ে এমনভাবে দেখছেন উনি যেনো আয়নায় আজ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে বড্ড ব্যস্ত।
মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারা বেশ কিছুক্ষণ। কল্পনা রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া রানী যেন লজ্জায় প্রেম নিবেদনের বৃথা চেষ্টা করছে। রাজার তৃপ্ত করা রূপ যেন রানীকে কাছে টানছে খুব করে। হঠাৎ উচ্চ কন্ঠে কারোর আওয়াজ পেয়ে ঘোর ভাঙলো ফারার।
কি ব্যাপার মহারানী! আপনি কি যু*দ্ধ ময়দানে হারিয়ে গেলেন! আর আমার জন্য চা কে ঠান্ডা বানিয়ে শরবত বানাছেন।চায়ে এক চুমুক দিয়ে আসফাক চোখ বন্ধ করে রাখলো মিনিট দুয়েক। তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে লাগলো, ‘ কি বাজে খেতে! সাঁজ সকালে এমন পানসে চা খাইয়ে আমার জীবনখানা করে দিলি পানসে।চা পানসে হলো বুঝলাম।
উনি ফারার দিকে উপর নিচে একবার পরখ করে বলতে লাগলো, ‘ আমার তো মনে হচ্ছে তুই নিজেও পানসে। টেস্ট করে দেখলে ভালো হতো।’
তুই তো আর খাবার নয় যে খেয়ে দেখব এই বলে তিনি হাহা করে হাসতে লাগলো।
আসফাক ভাইয়ের এমন হাসির শব্দ শুনে ফারার শরীর জ্ব*লতে লাগলো। ফারার এক মুহূর্তের জন্য মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিটি হল আসফাক ভাই। ফারা ভেবে পাচ্ছে না আমেরিকা থাকা একজন শিক্ষিত ছেলে অন্তত একটু তো ভালো কিছু শিখবে কিন্তু উনি কিভাবে এত ছেচরামি করতে পারে তা অবাকের চরম পর্যায়ে। পরক্ষণেই ফারার মনে পরলো বিদেশ গিয়ে অনেকেই তো নিজেদের সভ্যতা, ঈমান বিসর্জন দেয় হয়তো উনিও তাই দিয়েছেন।
আসফাক ভাই উনি হয়তো জানেন না সুন্দর আচরণও নেক আমল জানলে হয়তো এমন আচরণ করতেন না।
-‘কি ব্যাপার তুই আমার দিকে এমন ভাবে চা খাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছিস যে, মনে মনে বদদোয়া দিচ্ছিস যেনো তোর পানসে চা খেয়ে আমার জীবন খানা পানসে হয়ে যায়। শোন আমার লিজ থাকতে এ জীবনে এমনটা সে হতে দিবে না।’
বাঁকা চোখে তাকিয়ে আসফাক ভাই এক নজর ফারার দিকে তাকিয়ে মুখে দুষ্ট হাসি রেখা টেনে বলল, ‘ লিজ কে জানিস তো! ওই যে তোকে বললাম না, আমার আমেরিকার স্বপ্নের রানী, জানিস তো সে আমাকে এমন এমন কিছু দেয় জীবনখানা যেন তখন মিষ্টতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়।মনে হয় যেনো জীবন আমার ষোল আনা পরিপূর্ণ।’
ফারা আর কোন কথা বলতে পারল না। বুকের ভেতর ভয়ের শিহরণ বইতে লাগলো। আসফাক ভাইয়ের এমন কান্ড সব ফারার বাবা-মা শশুর শাশুড়ি জানতে পারলে তারা কতই না কষ্ট পাবে। ভেবে তার গলা শুকিয়ে আসছে। স্বামীর মুখে পরনারীর গল্প শুনতে পারার ভালো লাগছেনা, ঘৃণায় গা গুলিয় আসছে তার।
ফারা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ একাকী থাকতে চায় এখানে। স্বামীর মুখে আর সে ওই নামটা শুনতে চায় না। বারান্দা থেকে সামনে একটা দীঘি দেখা যায় যার নাম রূপসী দিঘি। নামের সাথে যেন তার রূপেরও মিল রয়েছে। যদিও পানির কোন নিজস্ব রঙ নেই কিন্তু রূপসী দিঘির পানির রঙ দূর থেকে গাঢ় সবুজের ন্যায় পানির উপরে ভেসে ওঠা শৈবাল। যেন ফারা নিজেই আসফাকের জীবনে শৈবালের মতো করে ভাসছে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। হঠাৎ ঘাড়ে তার গরম নিঃশ্বাস অনুভূত হচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো আসফাক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।
-‘ কি ব্যাপার তুই কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলি! তোকে না দেখলে জানতেই পারতাম না মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও ঘুমাতেও পারে! তা এই রূপসী দিঘীকে নিয়ে কি কবিতা লিখবি ভাবছিস, এমনভাবে তাকিয়ে আছিস যে ?’
বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মন খারাপ করে ফারা জবাব দিল, ‘ এমনি।’
যদিও ফারার এই মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আসফাকের সাথে।
যাই হোক তোকে মা খেতে ডাকছে।
ফারা খুব ভালো করে লক্ষ্য করল আসফাক বাবা মায়ের সামনে খুব ভালো ব্যক্তিত্ব নিয়ে রাখে এবং ফারাকে তেমন মন্দ কথা বলেনি এই মুহুর্তে। এটুকু ভেবে ফারা একটু স্বস্তি পেল।
ফারা সব গুছিয়ে এসে দেখলো, টেবিলের উপর ভাঁজ করা একটা চিঠি। কাঁপা হাতে সে চিঠিটা নিল চিঠিটা পড়তে গিয়ে তার গলা ভারী হয়ে আসছে, নিশ্বাস আটকে যাচ্ছে, ঠোঁট কাঁপছে, চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।
প্রিয় মেঘবতী ,
তোমাকে কাছে পেতে চাই, যতটা কাছে আসলে দু’জন ‘মেঘের ছায়ায় লুকিয়ে যাবো দূর আকাশে, হারিয়ে যাবো মেঘবতীর আকাশে।
উষ্ণ কাপটা বলে দেয় তোমার স্পর্শহীন চায়ে কোনো স্বাদ নেই।
ইতি
আসফাক
চলবে–
(আফরিন ইভা)