#মেঘমেদুর_মন [৯]
প্রভা আফরিন
আজ রিমঝিমকে হসপিটালে ভর্তি করার কথা। কিন্তু রিমঝিম জেদ ধরেছে আজ বাড়িতেই থাকবে। একদমই নাছোড়বান্দা। কাল সকালে এডমিট হবে হসপিটালে। এরপর অপারেশন হবে। আলমগীর সাহেব অসুস্থ মেয়েটার ওপর রাগ করতে পারছেন না। আবার আবদার শুনতেও চাইছেন না। যত দ্রুত চিকিৎসা সম্ভব ততই দ্রুত করতে চান। মনে হচ্ছে এক একটা মিনিটও বিপদজনক। যদি অসুখটা বেড়ে যায়! যদি মেয়েটার আরো কষ্ট হয়! পঞ্চাশ বছর বয়সী আলমগীর সাহেব নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন অতি আদরের জিনিস কেন জানি উনার কপালে বেশিদিন থাকে না। অল্পবয়সে মাকে হারালেন, বিয়ের কিছুদিন পর ভালোবাসার স্ত্রীও পরপারে পাড়ি দিলেন। এ জগতে রইল শুধু একমাত্র কন্যা। হৃদয়ের মণিকোঠায় যার স্থান। সেই সন্তানের জীবনেও শেষে এমন বিপদ নেমে এলো! অসহায় পিতা করুণ নিনাদ করেন মনে মনে,
“হে আল্লাহ! আমার ভালোবাসার মানুষগুলো কেন সর্বদা কষ্ট ভোগ করে? আপনি দয়ালু, করুণাময়। বান্দার জন্য যা মঙ্গলজনক তাই ফয়সালা করেন। আমার সন্তানের জন্য যা মঙ্গলজনক আপনি তাই করুন। হে পরম দয়াময়।”
রিমঝিম দুপুরের পর দুর্বল পায়ে বাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। ওকে সাহায্য করল তাহমিনা। ঘরে প্রবেশ করে রিমঝিম আগের মতো চনমনে স্বরে বলল,
“বাবা! খালা! তোমরা কী শুরু করেছ বলোতো? এই দেখো আমি দিব্যি ভালো আছি। হেসে-খেলে বেড়াচ্ছি। ছোটো একটা অপারেশন হবে এরপর আবার সব ঠিকঠাক। অথচ তোমরা সব মুমূর্ষু রোগীর মতো মুখ করে আছো! বাড়িতে রয়ে গেলাম একটু শান্তি পাব বলে এখন দেখি বাড়িটাকেই হসপিটালের মতো অসুস্থ রোগীভরা বানিয়ে রেখেছ! এমন করলে খেলব না।”
মেয়ের উচ্ছ্বল কণ্ঠস্বরে আলমগীর সাহেবের চোখে জল জমে। আর্দ্র হয় পিতৃহৃদয়। আসলেই তো, এভাবে মুষড়ে পড়ে উনারা মেয়েটাকে মনে মনে আরো ভয় দেখাচ্ছে। ওর মনের জোর কমিয়ে দিচ্ছে। এটা তো অনুচিত কার্য৷ তিনিও অভয় দিতে বললেন,
“কে রোগী? কোথায় রোগী? আমরা সবাই সুস্থ। তুইও সুস্থ। ছোট্টো একটা অপারেশন হবে। ঘুম থেকে উঠে দেখবি সব আবার আগের মতো। এসবে ভয় পেলে চলে?”
“তাই তো। এই খালা, তুমি একটু বাইরে যাও তো। বাবার সঙ্গে আমার গোপন বৈঠক আছে। ইটস্ কনফিডেনশিয়াল।”
তাহমিনা মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বললেন,
“আমার যেন আগ্রহ গলে পড়ছে তোদের গোপন বৈঠকে সামিল হওয়ার! বাপ-মেয়েতে খিচুড়ি পাকাও, হুহ!”
তাহমিনা পর্দার আড়াল হলেন। রিমঝিম ঠোঁটের হাসিটা ধরে রেখেই বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে। আলমগীর সাহেব উঠে এসে মেয়ের পাশে বসে একটা হাত ধরলেন। রিমঝিম বলল,
“একটা সত্যি কথা বলো তো বাবা।”
“কোন সত্যি জানতে চায় আমার প্রিন্সেস?”
“তুমি খালাকে বিয়ে কেন করলে না? খালা আমাদের জন্য যা করেছে তার কোনো মূল্য হয় না। নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ভালোবেসেছে। আমার মায়ের অভাব পূরণ করেছে। তাহলে তুমি কেন খালাকে বিয়ে করলে না?”
আলমগীর সাহেব মৌন হয়ে গেলেন। রিমঝিম উত্তর জানতে উদগ্রীব। আলমগীর সাহেব কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
“তুই বড়ো হয়েছিস। এখন সব বুঝিস। সত্যিটাই বলছি। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন আমার মা মা’রা যায়। আমার মুখের দিকে চেয়ে, আমার অযত্ন যেন না হয় তাই বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন। বিয়ের প্রথম প্রথম সবই ঠিক ছিল। নতুন মা আমাকে ভালোও বাসতেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই যখন মায়ের কোলে বাচ্চা এলো তখন থেকেই আমি ধীরে ধীরে ঘরের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ হয়ে উঠি। বাবা সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফিরতেন। সংসারের খুঁটিনাটি কী লাগে তদারকি করতেন। আমার কখনোই তেমন সখ্যতা ছিল না উনার সাথে। তাই আমার নিত্য প্রয়োজন জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কথাবার্তা। অথচ আমার নিত্য প্রয়োজনীয় আরেকটা চাহিদা ছিল মমতা। সেদিকে কারো বিশেষ নজর ছিল না। নতুন মা আমাকে ভালোবাসতেন না ব্যাপারটা এমন নয়, বাসতেন। তবে পেটের সন্তানের কাছে সেই ভালোবাসার পার্থক্য প্রকট। তাদের জন্য একহালি ভালোবাসা থাকলে আমার জন্য চার ভাগের এক ভাগ বরাদ্দ। অবশ্য এখানে উনার দোষ নেই। এটা প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম। নিজের সন্তান কোলে নিয়ে পরের সন্তানের যত্ন কোনো নারীই একশত ভাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না। সেখানে আমি ছিলাম নতুন মায়ের বিবাহসূত্রে পাওয়া দায়িত্ব। ভালোবাসার সন্তান ও দায়িত্বের সন্তানে পার্থক্য আছে। অন্য ভাইবোনরা মায়ের সঙ্গে যেভাবে খোলামেলা কথা বলতে পারত আমি তা পারতাম না। অদৃশ্য দেয়াল ছিল মাঝে। কথা বলতাম বুঝেশুনে যেন আমার অসংলগ্ন আচরণে তিনি রাগ না করেন। চোখের সামনে অন্য ভাইবোনকে সীমাহীন ভালোবাসা পেতে দেখতাম যখন, আমার নিজেকে খুবই তুচ্ছ মনে হতো। কষ্ট হতো, রাগ লাগত। কারণ আমি সেই সমান ভালোবাসা পাই না। একটা শূন্যতা চিরকাল আমার বুকের গহীনে জমে আছে। কেন বলছি এসব কথা? কারণ, তাহমিনা নিঃসন্দেহে চমৎকার একজন নারী। জীবনসঙ্গিনী হিসেবেও সেরাই হতো। হয়তো মা হিসেবেও। বিয়ে করলে কিন্তু ওর সাথে আমার একটা দারুণ সংসার হয়ে যেতো। দুদিন বাদে বাচ্চাকাচ্চা হতো। আমিও স্ত্রী-সন্তানকে খুব ভালোবাসতাম। তোকেও বাসতাম। কিন্তু মায়ের ভালোবাসায় পার্থক্য দেখা দিতো। গর্ভের সন্তান, যা একজন নারীর হৃদয়ে প্রকৃত মাতৃত্বের টান সৃষ্টি করে। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। পরের গর্ভের সন্তান সেই সমান উপলব্ধি কোনোদিন আনতে পারবে না। এটাতে আমি দোষের কিছুও দেখি না। শুধু বিয়ে করেছে বলে, সংসার করতে হবে বলে অন্যের সন্তান লালন করার দায় একটা মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়াও বোধহয় ঠিক নয়। মেয়েটা আসলেই মন থেকে প্রস্তুত কিনা মা হতে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। একটা নারী যেভাবে সন্তানকে নয়মাস গর্ভে আগলে মা হওয়ার প্রস্তুতি নেয়, একই সন্তানের জন্য অন্য নারী সেই প্রস্তুতি বা উপলব্ধি কোনোটাই পায় না। তাই তো আমাদের কাছে আমাদের নিজের মা সেরা, পরের মা নয়। তুই যখন চোখের সামনে এই ভালোবাসার পার্থক্য উপলব্ধি করতি তখন গুমরে কাঁদতি। বাবার ওপর অভিমান হতো। শৈশব-কৈশোরে এসব বিষয় সন্তানদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে আমি নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছি। তাই একই পরিস্থিতি আমার প্রিন্সেসের জীবনে আসুক চাইনি। চাইনি সেও শৈশবে একই ট্রমার মধ্যে দিয়ে বড়ো হোক যেখানে তারই পরিবারে দুজন সন্তানকে দু-রকম ভালোবাসা হচ্ছে। বরং সে জানুক জগতে বাবা একমাত্র তাকেই সীমাহীন ভালোবাসে। বাসে না?”
রিমঝিম ফুঁপিয়ে কেঁদে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। শুধুমাত্র তার মুখের দিকে চেয়ে এতগুলো বছর বাবা আত্মত্যাগ করল! সুখের সংসারের হাতছানি থাকা সত্ত্বেও মেয়েকে নিয়ে পড়ে রইলেন। এই ভালোবাসা যেকোনো মুনি-ঋষির সারাজীবনের তপস্যার চেয়ে কম নয়, বরং তারচেয়েও দামী। কারণ ধ্যানীরা জগত সংসারের আড়ালে গিয়ে তপস্যা করেন। সেখানে তাদের জ্বালাতন করার, প্রলুব্ধ করার কেউ থাকে না। আর বাবা এই ঝামেলাময়, প্রলুব্ধ সমাজে থেকেই মেয়ের জন্য তপস্যা করে গেছেন। রিমঝিমের মনে হলো এইসব ভালোবাসার কাছে শরীরের রোগ অতি তুচ্ছ। পৃথিবীতে সে কিছু সেরা মানুষ পেয়েছে। স্বামী, বাবা, খালার জীবনের ভালোবাসার একমাত্র নাম রিমঝিম। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়! আর কী চাই ওর!
বাবার বুক থেকে মাথা তুলে রিমঝিম চোখ মোছে। ঠোঁট উলটে বলে,
“আচ্ছা এখন তো আমি আর শৈশব-কৈশোরের অবুঝ মেয়েটা নই। আমি জানি তোমরা আমায় কত ভালোবাসো। এখন বিয়ে করতে তো অসুবিধা নেই।”
আলমগীর সাহেব অবাক চোখে চাইলেন। মুহূর্তকাল সময় লাগল মেয়ের কথাটা বুঝতে। রিমঝিম সঙ্গে যোগ করল,
“তাছাড়া এখন খালার বয়স ফোর্টি হয়ে গেছে। বাচ্চা-কাচ্চার চান্স কম। হলেও আমার আপত্তি নেই। কোলেপিঠে মানুষ করব। বিয়েটা করে নাও না। খালা কিন্তু মায়ের মতোই সুন্দরী।”
আলমগীর সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী বলবেন যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাহমিনা হঠাৎ তেড়েমেড়ে ছুটে এলেন। উনার চোখে জল। রিমঝিমের দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টি হেনে বললেন,
“মুখে লাগাম না দিলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম। অসুখ হয়েছে বলে ছেড়ে দেব না। অসভ্য মেয়ে!”
রিমঝিম খালার হাত টেনে ধরে নিজের অপর পাশে বসিয়ে দিল। জড়িয়ে ধরে বলল,
“সে আমায় তুমি অসভ্য বলে থামাতে পারবে না। আমি না বুঝে কিছুই বলছি না। একবার সত্যি করে ভাবো তো, আজ যদি আমার ক্যান্সার শুরুতে ধরা পড়ার আগেই ছড়িয়ে পড়ত! ডাক্তার তো বলেছেই শরীরে একবার ক্যান্সার কোষ পাওয়া গেলে সেড়ে ওঠার বছর পাঁচেক পর আবারো ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। মানে বাকি জীবনটা ঝুঁকিতে। তখন আমার অবস্থা যদি আরো খারাপ হয়, কিংবা আর নাই বাঁচি! আচ্ছা… আচ্ছা… ম’রার কথা বলছি না। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয়েছে। নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে যাব। তোমরা দুই মধ্যবয়সী মানুষ বাকিটা জীবন কেমন করে কাটাবে? কে হবে তোমাদের আপনজন? কেউ তো বেঁচে নেই। আমার বাবা-খালার শেষ জীবনটা চরম একাকিত্বে কাটবে এটা আমি বেঁচে থাকতে মেনে নেব? এতদিন আমার কথা ভেবে অনেক তো আত্মত্যাগ করলে। এবার একটু আত্মকেন্দ্রিক হও না। দুজন দুজনের বাকি জীবনের কেয়ারটেকার হও। ইটস্ মাই অর্ডার। তোমাদের দুটোর গতি না করে আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকব না। এন্ড দ্যাটস্ ফাইনাল।”
রিমঝিম নিজের জেদে অটল রইল। প্রথমে আলমগীর সাহেব ও তাহমিনা ওকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেন, এরপর শাসন করলেন। কোনোটাতেই কাজ হলো না। মেয়ে তাদের চেয়েও বেশি জেদি। এদিকে একজন চল্লিশোর্ধ্ব নারী এবং পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ তাদের আদরের সন্তানের জন্য জীবনের চরম বিব্রতকর মুহূর্তে এসে পৌঁছেছেন। এই বয়সে বিয়ে! যে শব্দটা কিনা জীবন থেকে একপ্রকার বাতিলের খাতায় চলে গেছিল। কল্লোলকে দেখা গেল বউয়ের দল ভারী করতে। সে শ্বশুরকে বলল,
“দেখুন বাবা, পুরুষদের বয়স পঞ্চাশ খুব একটা বুড়ো নয়। তেরো বছরের টিনেজ থেকে আশি বছরের বুড়ো সবাই বিয়ে করছে। সেখানে আপনারা স্টিল ইয়াং। আত্মীয়স্বজনের ঝামেলাও নেই। চক্ষুলজ্জাকে প্রাধান্য না দিয়ে জীবনটাকে প্রায়োরিটি দিন। রিমঝিম ভুল কিছু বলছে না।”
আলমগীর সাহেব কপাল চাপড়ান বসে বসে। যেমন মেয়ে তার তেমন জামাই জুটেছে। দুটোই ঠোঁটকাটা। জীবনের চরম বিপদের মুহূর্তেও তারা স্বভাবছাড়া হবে না। অতএব মেয়ের অপারেশনের কথা মাথায় রেখেই দুজনকে সমঝোতায় আসতে হলো। পরদিন সন্ধ্যায় কাজি ডেকে বাবা ও খালার বিয়ে দিল রিমঝিম। তার খুশি যেন ধরে না। নিজে অভিভাবক হয়ে বাবার বিয়ে দেওয়ার মতো দায়িত্ব নিয়ে যেন আহ্লাদে আটখানা রিমঝিম। পারলে ধুমধাম করে আয়োজন করে। কিন্তু বাবার চোখ রাঙানিতে সেসব করা গেল না। খালাকে অনেক জোর করেও রঙিন শাড়ি পরানো গেল না। কিছু বললেই তিনি ছ্যাঁত করে ওঠেন। রিমঝিম তখন অভিমানী স্বরে বলে,
“নট ফেয়ার। কবুল বলার আগেই সৎ মা হয়ে যাচ্ছো!”
এই কথা শুনে তাহমিনা দাঁত কিড়মিড় করেন। রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলার জোগাড়। বিয়ে পড়ানোর পর খালার কাছ ঘেঁষে বসে রিমঝিম মিনমিন করে করল,
“সব সময় তো খালা বলেই ডেকেছি। খালা ডাকটাই আমার প্রিয়। কিন্তু আজকে একটু মা বলতে ইচ্ছে করছে। জ্ঞানত কখনো ডাকিনি তো, তাই।”
তাহমিনা রিমঝিমকে জাপটে ধরে কেঁদে উঠলেন। এই কান্নার অন্তর্নিহিত কারণ কেউ বুঝল কিনা কে জানে! যে সংসারটাকে এতদিন তিনি মৃ’ত বোনের সংসার হিসেবে নিজের হাতে সামলেছেন, নিঃস্বার্থভাবে, হৃদয় উজার করে দিয়েছেন সবাইকে, আজ সেই সংসারটা উনার নিজের হলো! যে মেয়েকে আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভেবে এসেছেন, আজ সেই মেয়ে নিজের হলো! সকল গ্লানি, শোক, তাপ, না পাওয়ার আক্ষেপ যেন চোখের জল হয়ে ঝরতে লাগল। রিমঝিম তাহমিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে দেয়। কম্পিত স্বরে ফিসফিস করে ডাকে,
“মা…মা… তুমি আমার মা!”
তাহমিনা হাপুস নয়নে কেঁদে বলেন, “আমার ময়না, আমার কলিজার টুকরা, আমার সন্তান। আমি তোকে গর্ভে ধারণ করিনি। হৃদয়ে ধারণ করেছি। তুই আমার হৃদয় প্রসূত একমাত্র সন্তান।”
রিমঝিমের আজ খুশির দিন। সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসছে মেয়েটা। কল্লোল মুগ্ধ হয়ে ওকেই দেখে চলেছে। জেদি, অবাধ্য রূপের ভেতর তার একটা সরল, নিষ্কলুষ মন আছে। সে সবাইকে ভালো রাখতে জানে। সবার জন্য চিন্তা করতে জানে। স্বামীর নিষ্কম্পিত দৃষ্টি চোখে পড়েছে রিমঝিমের। এই মানুষটা যখন তার দিকে এভাবে তাকায় কোত্থেকে যে একরাশ লজ্জার আবির্ভাব হয় কে জানে! ও গুটিসুটি হয়ে গা ঘেষে বসে। শরীরে চিনচিনে যন্ত্রণার রেশ, দুর্বলতা। কিছুই পাত্তা পায় না খুশির কাছে। কল্লোলের কোকড়া চুল এলোমেলো করে দিয়ে ও বলে,
“এই যে চশমাকান্ত, এভাবে দেখবে না। আমার লজ্জা লাগে।”
কল্লোল স্মিত হাসে। বলে,
“লজ্জা ভাঙাতেই বেশি বেশি দেখা উচিত।”
রিমঝিম মুখ নামিয়ে রাখে। বিয়ের আগে যাকে ছিটেফোঁটা লজ্জাও পায়নি এখন তার সামনে এলে কত না অনুভূতি প্লাবিত হয় মনে! কল্লোল চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“তুমি ঠিক আছো?”
রিমঝিম পুনরায় হেসে ওঠে,
“একদম। জগতে খুব কম মানুষই বাবা-মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে খেতে পারে। তারমধ্যে আরো কম মানুষ সেই বিয়েটা মন থেকে ইনজয় করতে পারে। আমি পেরেছি। দেখেছো কত ভাগ্যবতী আমি!”
“হুম আর এই ভাগ্যবতী মেয়েটাকে পেয়ে আমিও ভাগ্যবান হয়ে গেছি।”
“সৌভাগ্য তোমারও! শ্বশুরের বিয়ে খেলে। নাতি নাতনিদের কাছে জমিয়ে গল্প করতে…”
রিমঝিমের জবানে আচমকা শব্দশূন্যতা তৈরি হলো। ঠোঁটের হাসি সরে ঠাঁই নিল নিকষতা। নাতি নাতনি তো আসবে না ওদের জীবনে। কল্লোল ওর মুখখানি আজলায় তুলে নেয়। বলে,
“সবার তো গতি করে দিলে। শুধু আমার গতিই করলে না। এটা কী ঠিক হলো?”
রিমঝিমের বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া শুরু হয়৷ ভীত হয় চিত্ত। ভবিষ্যতে কখনো কী কল্লোলের নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হবে না! সে চাইবে না বাবা হতে! তখন কী সে আবার বিয়ে করবে! ছেড়ে দেবে রিমঝিমের হাত! কতশত উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা উঁকি দেয় মস্তিষ্কে। ঢোক গিলে বলে,
“বলো, কী চাও?”
কল্লোল ওকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধে ফেলল,
“তোমাকে চাই। ভোরের সতেজতায় তোমাকে চাই, সন্ধ্যার ম্লানতায় তোমাকে চাই। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ঘোলা চোখে তোমাকেই দেখতে চাই। চায়ের আড্ডায় টা হিসেবে তোমাকে চাই। ঘুমের আবেশে নির্ভরতা হিসেবে তোমার কোল চাই। আমার সমস্ত অস্তিত্বে শুধু তোমাকেই চাই, রিমঝিম। দুজন মানুষ চাইলেই ভালোভাবে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়। আর তুমি ভয় পাচ্ছো আমি বাবা হওয়ার আক্ষেপে অন্য কারো সঙ্গে জড়াবো? দেখো, আমার বুকটা কেমন ঝিমঝিম করছে। এই বুকে তুমি থাকবে না ভাবতেও আমার দম আটকে যায়। সেখানে অন্য কাউকে ঠাঁই দেওয়ার কথা চিন্তা করা আমার কাছে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের সমান।”
রিমঝিম হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে,
“আমি ভীষণ হিংসুটে, ভীষণ স্বার্থপর। তোমার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারব না। ম’রে গেলেও না। কক্ষনো ছেড়ে যেয়ো না আমায়। জীবনের অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত তোমার সান্নিধ্য চাই।”
পরদিন রিমঝিমকে হসপিটালে এডমিট করা হলো। সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় কল্লোল ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব, ভীষণ একা। সুস্থ হয়ে আমার বুকে ফিরে এসো রিমঝিম। আমি অপেক্ষায় আছি। তোমায় নিয়ে একটা চমৎকার ভবিষ্যত পাড়ি দেওয়ার জন্য।”
চলবে…