#মেঘমেদুর_মন [৭]
প্রভা আফরিন
শরতের রোদেরা দুপুর। নীলাম্বর থেকে সূর্যটা যেন শাসাচ্ছে পৃথিবীর বায়ুকে। উত্তপ্ত বাতাবরণে কাহিল রিমঝিম। ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা গলায় উপুর করে সবটুকু পানি নিঃশেষ করেও যেন শান্তি লাগছে না। ভার্সিটিতে আজ প্রোগ্রাম ছিল ওর। সেই সুবাদে মিষ্টি একটা সাজ বহন করতে হয়েছে। পরনে বেগুনী রঙা রাজশাহী সিল্ক মসলিন শাড়ি, সঙ্গে সাদা রংয়ের ওপর সাদা ফুলতোলা ফুল স্লিভ ব্লাউজ। খোপা করা চুলে সযত্নে প্যাচিয়ে আছে জুঁই ফুলের মালা। কপালে ও কানের পাশে কিছু এলোমেলো চুল ছড়িয়ে আছে কিছুটা ইচ্ছাকৃত অগোছালো রূপ নিয়ে। ঠোঁটে লেপ্টানো ম্যাকের রুবি উ-এর রংটা প্রসাধনহীন মুখশ্রীতে বোল্ডনেস এনে দিয়েছে। অসম্ভব মাথা যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় প্রোগ্রাম স্পট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ও। বাড়ি ফিরে একটা লম্বা গোসল নিলেই সতেজ লাগবে মনে হচ্ছে। যেই ভাবা সেই কাজ। রিমঝিম রিকশা ধরে সোজা বাড়ি চলে এলো। গেইটের সম্মুখে নামতে গিয়ে কুচিতে পা লেগে একটা হোঁচট খেলো। কোথা হতে যেন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভারী স্বর ভেসে এলো, “সাবধানে!”
রিমঝিম রিকশা ধরে নিজেকে সামলে নিল। বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। ব্যগ্র চোখে তড়িৎ আশেপাশে তাকায় ও। কিন্তু এই স্বরের মালিককে কোথাও দেখা গেল না। রিমঝিম পথের এদিক-ওদিকে দুই কদম এগিয়ে দেখে নেয়। উহু, যাকে ভেবে এই উচাটন সে তো নেই। তবে ব্যস্ত পথের মাঝে কে তাকে সাবধান হতে বলল! নাকি মনের ভুল! কিংবা কেউ চলন্ত গাড়ি থেকে আওয়াজ দিয়েছিল। যখন পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ নেই তখন রিমঝিম তাই ভেবে নিল। নিজের মনকে একবার ভর্ৎসনা করল। সেই লোক কোথা থেকে আসবে! তাকে নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে নাকি ওই চশমাকান্তের! রিমঝিমেরও তাকে ভাবতে বয়েই গেছে, হুহ!
রাগে ধুপধাপ পা ফেলে তিনতলায় নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে উঠল ও। ক্রমাগত কলিংবেল বাজাল যতক্ষণ না দরজা খুলছে। তাহমিনা তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন। দরজা খুলে উত্তেজিত স্বরে বললেন,
“কী হলোরে, ময়না? এভাবে বেল বাজাচ্ছিস কেন?”
এমনিতেই গরমে তিক্ত মেজাজ, এরপর আবার অযাচিত ব্যক্তিটিকে স্মরণ। সব মিলিয়ে ক্ষোভ যথেষ্টই জমেছিল। এখন আবার খালার আদরের ময়না ডাক। নাক কুচকে, চোখ উলটে ঝগড়া করার ভঙ্গিতে কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
“যেভাবে খুশি বাজাব। আমার ইচ্ছে।”
“বললেই হলো?” তাহমিনাও কোমড়ে হাত দিলেন।
“হলো, তুমি যেমন বারণ সত্ত্বেও নিজের ইচ্ছেয় ময়না ডাকো। তেমন আমিও নিজের ইচ্ছেয় বেল বাজাব। তা ধিন ধিন!”
রিমঝিম সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। তাহমিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। গ্রাম থেকে ফিরে মেয়েটার যে কী হলো! আচরণে এই মেঘ তো এই রোদ্দুর।
______________
কল্লোলের ইদানীং নতুন এক অসুখ হয়েছে। এই অসুখের নাম ঝিমঝিম করা। রিমঝিমকে স্মরণ হলেই অনুভূতিগুলো ঝিমঝিম করে। বুকের ভেতরটা শূন্য, ফাঁপা মনে হয়। সেই যে মেয়েটি অভিমান ঝরা দৃষ্টি ফেলে চলে গেল, এরপর আর একটা দিনও সে শান্তিতে থাকতে পারেনি। রিমঝিমের জ্যোৎস্নামাখা মায়াবী মুখ কিংবা রোদের প্রতাপে প্রজ্জ্বলিত রূপের চেয়েও অভিমানী মুখটা যেন ওকে বেশি ঘায়েল করে দিয়ে গেছে। যেন এক ঘূর্ণিঝড় নিভৃতে মন পিঞ্জরে হামলা করে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। কল্লোল নিজের মনের কাছেই আজ বাস্তুহারা। দিনগুলো ম্লানতার সঙ্গে কেটে যাচ্ছিল। ছেলের উদাসী মুখ, অনিদ্রায় আক্রান্ত চোখ ও অরুচি দেখে সাবিনা শঙ্কিত। আবার কীসের অসুখ বাধিয়ে বসল! কল্লোল কিছুই বলে না। এরমাঝে ওর চাকরিরবভাইবার জন্য ডাক পড়ল। রাতের বাসে গিয়ে, দিনের বেলা ভাইবা দিয়ে আবার সেদিনেরই বাসে ফেরত এলো সে। মাঝে একটুকরো সময় উঁকি দিয়েছিল মিরপুরের বাড়িটায়। সেখানেই সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হলো। গলা শুকিয়ে বুক ধড়ফড়িয়ে উঠেছিল শাড়ি পরিহিতা রমনীর এক ঝলক দেখেই। মেয়েটা তাকে খুঁজছিল। কল্লোলের সেই বেহাল অবস্থা সামলাতে গিয়ে সামনে যাওয়ার সাহস হলো না। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই৷ ক্রমাগত অস্থিরতায় নিমজ্জিত অন্তর। সপ্তাহখানিক বাদেই চাকরিটা হয়ে গেল ওর। জয়েনিং মেইল পেয়েই কল্লোল মাকে গিয়ে বলল,
“আম্মা, তোমার জন্য বউমা আনব।”
সন্ধ্যা হতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে রিমঝিমের ঘরের বারান্দা। সেদিকে খেয়াল নেই মেয়েটির। নিবিড় চোখে বৃষ্টি ও সন্ধ্যার মেলবন্ধন দেখছে সে। হঠাৎই কানের পর্দায় আঘাত হানে কলিংবেলের শব্দ। আজ বাড়িতে খালাও আছে, বাবাও আছে, বিদ্যুৎ মহাশয়ও নিরবচ্ছিন্ন। তবুও রিমঝিমই উঠে গেল দরজা খুলতে৷ দরজার ওপাশের লম্বাটে ব্যক্তিটি আজও সেদিনের মতো বৃষ্টিতে ভেজা। অকপট স্বরে আবদার করল,
“একটা শুকনো তোয়ালে হবে?”
রিমঝিমের নিশ্বাসের বেগ বেড়েছে। চোখ টলমলে। দরজা ধরে নিজেকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে ঝাঝালো গলায় বলল,
“এতদিন পর শুকনো তোয়ালে চাইতে এসেছেন?”
ব্যক্তিটি অধরে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে সুবোধ বালকের মতো মাথার ঘন কোকড়া চুল ঝাকিয়ে সম্মতি দেয়। তাতে যেন আগুনে ঘি ঢালা হলো। রিমঝিম রোষাগ্নি চোখে চেয়ে বলল,
“এটা তোয়ালের দোকান নয়। বেটার হয় আপনি মার্কেটে যান।”
“শুনুন তো, আরো একটা জিনিস চাইতে এসেছি। সেটা মার্কেটে পাওয়া যাবে না। এখান থেকেই নিতে হবে।”
মেয়ের উত্তপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে আলমগীর সাহেব উদ্বিগ্ন মুখে বেরিয়ে এলেন। মেয়েকে দরজার সামনে চোখ ভরা জল নিয়ে রুদ্রমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কলিজাটা মোচড় দেয় উনার। কিন্তু এগিয়ে এসে কল্লোলকে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলেন। ভ্রুকুটি করে বললেন,
“কল্লোল! অসময়ে তুমি কোত্থেকে এলে?”
কল্লোর বিনীত স্বরে বলল,
“দিনের গাড়িতে রংপুর থেকে এসেছি, আঙ্কেল।”
“বাইরে কেন? ভেতরে এসো। হঠাৎ কোনো দরকারে…”
“ইয়ে…মানে… আঙ্কেল, আপনার মেয়ের জামাই হওয়ার অফারটা কী এখনো আছে? আমি একান্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সেটা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।”
বিস্ময়ে, লজ্জায়, ক্রোধে রিমঝিম স্থবির হয়ে রইল। মুহূর্তকাল হা করে তাকিয়ে রইল নির্লজ্জ পুরুষের মুখপানে। এরপর রাঙা মুখটা লুকাতে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল৷ তাহমিনা ও আলমগীর সাহেব মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। ঠোঁট টিপে হেসেও ফেললেন সঙ্গে সঙ্গে। কল্লোল মুখ নামিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে আলমগীর সাহেব বললেন,
“এই অফারটা তখনই কার্যকর হবে যখন মেয়ের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।”
“আমি কী একবার রিমঝিমের সঙ্গে কথা বলতে পারি?” কল্লোল সংকোচে আবদার করল।
তাহমিনা হাসি লুকিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশ করলেন,
“আগে ভেজা কাপড় বদলে নাও।”
ভেজা কাপড় বদলে কল্লোল যখন রিমঝিমের সঙ্গে দেখা করতে যাবে তার আগেই দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে কেউ ওর ঘরে ঢোকে। কল্লোলকে ভাবনার অবকাশ না দিয়ে এক ক্ষিপ্ত বাঘিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর। কল্লোল আগেই আত্মসমর্পণ করে বসে। তাতে কাজ হলো না। রিমঝিম গর্জে উঠে বলে,
“আপনার মধ্যে কী লজ্জাশরম বলতে কিছু নেই? এভাবে নির্লজ্জের মতো কেউ বিয়ের জন্য আবদার করে? ঘুরিয়ে বলা গেল না?”
কল্লোল অসহায় মুখ করে বলল,
“আমি ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলি না।”
রিমঝিম কপাল চাপড়ায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,
“সোজাসুজি বলে ভীষণ সম্মানের কাজ করেছেন! কী ভাবছে বাবা আমাদের?”
“ভাবনার ভার আপনাকে দিয়েছে৷ আপনি রাজি হলেই আমার ইচ্ছে মঞ্জুর হয়।”
“আমি কেন রাজি হবো? আমার কোনো আত্মসম্মান নেই? খুব তো নাকচ করে দিয়েছিলেন। এখন কেন ছুটে এসেছেন? চশমাকান্ত কোথাকার!”
রিমঝিম মুখ ফিরিয়ে রাখে। অভিমানে আরক্ত, আহত মুখখানি দেখে কল্লোলের অন্তরে মায়া জাগে। বলে,
“আমি শুধু বলেছিলাম চাকরি না পেয়ে বিয়ে করব না।”
“এখন চাকরি হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাতে আমার কী?”
রিমঝিমের স্বর কম্পিত। কল্লোল যেন বুঝে গেল মেয়েটির মন। এগিয়ে এসে জড়তাহীন হাতে রিমঝিমের হাত চেপে ধরে ও। উষ্ণতা বিনিময় হয় দুটি হাতের। আকুল হৃদয় নিংড়ে মৃদু গলায় বলে,
“আপনার কী জানি না। তবে আমার অনেক কিছু। আপনি চলে আসার পর থেকে আমার শান্তি গায়েব হয়ে গেছে। বুকের ঝিমঝিমানিটা ভূমিকম্পে রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত প্রলয় সামলাতে হচ্ছে। এই যে এখন আপনি আমার সামনে, আপনাকে দেখছি, অনুমতি ছাড়া ছুঁয়ে ফেলেছি, এতে আমার সেই ঝিমঝিম করাটা প্রশান্তি রূপে ফেরত এসেছে। আমি শান্তি পাচ্ছি। এই শান্তিটা ধরে রাখতে হলেও আপনাকে চাই।”
রিমঝিমের মনে হলো দীর্ঘদিন বুকে চেপে রাখা পাথরটা সরে গেল। ওই গভীর চোখের স্নিগ্ধতায় মনের গুমোট অনুভূতি সরে গিয়ে ক্রমশ সতেজ, সবল, অপ্রতিরোধ্য এক অনুভূতি মনের অলিন্দটা দখল করে নিচ্ছে। রিমঝিম এই সরল ভাষ্যকারের ওপর রাগ ধরে রাখতে চেয়েও পারছে না। মুখটা তবুও শক্ত রেখে বলল,
“চাইলেই সব পাওয়া যায় না। আপনিই বলেছেন আমি আপনার গ্রামে মানিয়ে নিতে পারব না।”
“চাকরিটা আমার শহরেই মিলে গেছে। এখানেই থাকব যেহেতু তাই ভাবছি শহরের রাগিনীটা যদি কপালে জুটে যায় তো…”
“থাকবেন কী ঘর জামাই হয়ে?”
কল্লোল গম্ভীর হয়ে বলল,
“এতটা অযোগ্যতা নিয়ে আপনার কাছে হাত বাড়াইনি। রাজপ্রাসাদের রাজকুমারীকে চাইতে হলে তাকে সর্বোচ্চ ভালো রাখার যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। যদিও একই সমান পারব না। তবে অবহেলাও করব না।”
“আর রাজকুমারীর মনটা?”
“যদি সাহস দেন তবে সেটাও দখল করে নেব। দেবেন? প্লিজ!”
দুজনের দূরত্ব মিটল। রিমঝিম ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল প্রশস্ত বুকে। কল্লোল আঁকড়ে ধরল সযত্নে। কখনো কখনো কিছু স্পর্শ না বলা ভাষা হয়ে ওঠে। বুঝিয়ে দেয় মনের বার্তা। ওরাও বুঝে নিল। জানল, আজকের পর দুটি প্রাণে একই প্রণয়ের সুর বাজবে।
চলবে…