#মেঘমেদুর_মন [৬]
প্রভা আফরিন
বাতাসের প্রভাবে পাতা যেমন কাঁপে, কল্লোলের মুখ নিসৃত বাক্যটি শুনে তেমনই প্রকম্পিত রিমঝিমের তনু। হুট করেই কান গরম হয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নালোকিত ক্ষণে ত্বকের আরক্ততা ঠিক বোঝা গেল না। তবুও লুকানো গেল না দৃষ্টির সংকোচন। দূর থেকে উড়ে আসা হাসনাহেনার ঘ্রাণের সাথে অতি নিকটে দণ্ডায়মান পুরুষ দেহের ভারী একটা সুবাস মিশ্রিত হয়ে ঘিরে ধরেছে নারীমনকে। আবেশিত করে তুলেছে চারপাশ। এই রাত, খোলা বারান্দা, জ্যোৎস্নাময় ম্লান আলো ও দূর হতে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকাদের নিনাদে যেন গোপন এক আশকারা মিশে আছে। অজানা এক শিরশিরে, নির্লজ্জ অনুভূতি যেন খুব গোপনে মনের দ্বারে কড়া নাড়ে! চশমা ঠাসা দুর্বার দৃষ্টি এখনো অনড় মায়াময়ীকে দেখতে। সেই চোখে নেই কোনো সংকোচ, নেই ভয়। আছে অব্যক্ত অস্থিরতা। রিমঝিম কণ্ঠ পরিষ্কার করে। যেন সামলে নেয় নিজেকে। কথা ঘোরাতে এমন গলায় বলে,
“ঝিমঝিম করছে কেন? নাকি আমাকে সত্যি সত্যি ভূত ভাবছেন?”
কল্লোল অবিচল। ধীর লয়ে বলে,
“ভূত কখনো দেখা হয়নি আমার। তবে ভূত যদি আপনার মতো সুন্দরী হয় তো মানুষ ভয় না পেয়ে প্রার্থনা করবে ভূত যেন তার ঘাড়ে চাপে।”
কল্লোলের ঠোঁটে চাপা হাসি। রিমঝিম চোখ ছোটো ছোটো করে ফেলে। বলে,
“আপনার কী মনে হচ্ছে না আপনি একটু বেশিই ফ্র্যাংকলি কথা বলেন? মেয়েদের সঙ্গে বুঝি এমন করেই ভাব করেন?”
“আপনার মনে হচ্ছে না আজ আমার প্রতি একটু বেশিই বিনয়ী হচ্ছেন? দুপুর অবধি তো আমাকে দেখলেই কপাল কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। এখন সেই রাগী মুখটা দেখছি না।”
দুজনের কথাতেই বিদ্যমান সুক্ষ্ম ইঙ্গিত উভয়কেই যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল এবার থামতে হবে। দিনের বেলা একসঙ্গে পথ চলতে চলতে স্বতঃস্ফূর্ততা এসে গেছে বলেই বোধহয় এই নিঃসংকোচ আলাপন।
কল্লোল কনুইয়ের সন্ধিতে মুখ চেপে সরে গেল৷ আবারো চাপা কাশির শব্দে গমগম করে পরিবেশ। আচমকা বেসুরো শব্দের বিরামহীন কাশিতে নৈশ প্রাণেরা যেন বিরক্ত। রিমঝিম এবার সত্যি সত্যিই কপাল কুচকে ফেলল। কল্লোলের প্রশ্নের বিপরীতে ঘায়েল না হয়ে নিজের কৈফিয়ত জাহির করে বলল,
“অসুস্থ মানুষের প্রতি অবিনয়ী নই আমি। এরবেশি কিছু নয়।”
ঠিক তখনই দুজনকে চমকে দিয়ে পাশের একটি ঘরের ভারী কাঠের দরজা ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে যায়। বর্ষা বাইরে এসেছে। মনে হলো মেয়েটি থতমত খেয়ে গেছে। তারচেয়েও বেশি অবাক রিমঝিমের সঙ্গে ভাইয়াকে এই নির্জন রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। বর্ষা বলে,
“তোমরা দুজন এখানে কী করছো?”
রিমঝিম হঠাৎ অপ্রস্তুত বোধ করে বলে, “আসলে ঘুম আসছিল না, তাই একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম।”
কল্লোল সুস্থির। কৈফিয়তের ধারেকাছে না গিয়ে উলটে বক্র চোখে চেয়ে বলল,
“তুই জেগে আছিস কেন?”
বর্ষা পড়ল বেকায়দায়। রাতে বাবা ঘুমালে বাবার ফোনটা এনে চুপিচুপি সোস্যাল মিডিয়ায় ঢু মারে ও। একটা গোপন ফেইসবুক একাউন্টও আছে। এখন ফোনটা ফেরত দিতে যাচ্ছিল ও। যেটা ওড়নার তলায় লুকিয়ে ফেলেছে বাইরে বের হয়েই। ভাইয়ের তীক্ষ্ণ চোখে ধরা পড়ার ভয়ে ও তড়িঘড়ি করে বলল,
“বাথরুমে যাচ্ছিলাম, আসি।”
বলে বর্ষা বাথরুমে যাওয়ার বদলে পুনরায় ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। অপ্রস্তুত রিমঝিমও হড়বড় করে বলল,
“যাইহোক, এবার ঘুম পাচ্ছে। গেলাম।”
রিমঝিম চলে গেল। কল্লোল খেয়াল করল জ্যোৎস্নাতে ভাটা পড়েছে। চাঁদের গায়ে মেঘ এসে জড়ো হচ্ছে।
_________________
সকাল থেকেই অদ্ভুত এক জিনিস খেয়াল করছে রিমঝিম। বর্ষা তাকে দেখলেই ঠোঁট টিপে হাসছে। সেই হাসি দেখে অজান্তেই অপ্রতিভ হয়ে উঠছে ও। গতরাতের ব্যাপারটায় আবার উলটোপালটা বুঝে নিল নাকি মেয়েটা! বড়োরা জেনে গেলে আরো বিব্রত হতে হবে। রিমঝিম একান্তে ডেকে বর্ষাকে বলল,
“শোনো বর্ষা, তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই নয়।”
“আমি কী ভাবছি তুমি কীভাবে জানলে, আপু? বলো, আমি কী ভাবছি?”
বর্ষা যেন ভীষণ মজা পাচ্ছে। রিমঝিম কথার খেই হারিয়ে বসল। মেয়েটাকে যতটা সরল ভেবেছিল এখন বুঝল আসলে ততটা নয়। পেটে পেটে দুষ্টুমি। এক মুহূর্তের জন্য কল্লোল হতে ইচ্ছে হলো ওর। তাহলে এই নারীসুলভ সংকোচ ঝেড়ে এক্ষুনি মুখের ওপর জবাব দিতো বর্ষার ভাবনা ভুল। কিন্তু রিমঝিমের কেন জানি লজ্জা লাগছে। এমন বিষয়ে কৈফিয়ত দেওয়া মানেই তো আরো সন্দেহ জাগিয়ে দেওয়া। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“কিছু না, তুমি আসতে পারো।”
বর্ষা চলে যাচ্ছিল। রিমঝিম হঠাৎ পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করল,
“ইয়ে… তোমার ভাইয়ার ঠান্ডা কমেছে?”
প্রশ্নটা করেই মনে মনে জিভ কাটল রিমঝিম। আর কোনো সময় হলো না! এখনই আর বর্ষাকেই জিজ্ঞেস করতে হলো! উফ! বিপাকে পড়ে বোধবুদ্ধি বুঝি লোপ পেয়েছে! রিমঝিম নিজের ওপর রেগে যায়। বর্ষা মিটমিট করে হাসতে হাসতে জবাব দিল,
“ঠান্ডা কমতে উষ্ণতা প্রয়োজন হয়, আপু।”
বর্ষা দৌড়ে পালাল। রিমঝিম হতভম্ব। মেয়েটা কী পাকা পাকা কথা বলে গেল! রিমঝিম ঘর ছেড়েই বের হলো না সারা সকাল। বেলা বাড়তে বর্ষাই আবার ওকে টেনে বের করে। উদ্দেশ্য লুডু খেলা। খেলবে কল্লোল, বর্ষা, রিমঝিম ও বর্ষার প্রতিবেশী বান্ধবী। রিমঝিম এসবে আনাড়ি। বর্ষা তাকে শিখিয়ে দেওয়ার আশ্বাসে জোর করে সঙ্গে বসায়। চোরা হাসিটা তখনো মেয়েটির ঠোঁটে উঁকি উঁকি দিচ্ছে। রিমঝিম খেলার একফাঁকে কল্লোলকে বলল,
“শুনুন, আপনার বোন আমাদের ভুল বুঝছে। বিষয়টা অস্বস্তির। আপনি ওকে বুঝিয়ে দেবেন, প্লিজ!”
কল্লোল সঙ্গে সঙ্গে বর্ষাকে ধমকে জেরা করল,
“এই তুই উনাকে অস্বস্তিতে ফেলছিস কেন? কী বুঝছিস আমাদের ব্যাপারে?”
বর্ষা ঠোঁট উলটে বলল, “বুঝছি যে, আপু যদি আমার ভাবি হতো তাহলে কত্ত ভালো হতো। তোমার সঙ্গে খুব মানায়।”
রিমঝিম মনে মনে প্রমাদ গুনল। দুই ভাইবোন দেখি ঠোঁটকাটা! ও খেলা ভণ্ডুল করে ছুটে পালাল। কল্লোল এরপর বোনকে বেশ ধমকাল। এভাবে অতিথিকে বিব্রত করার জন্য সরি বলতে ফরমান জারি করল। বর্ষা মুখ ভার করে একরাশ নৈরাশ্য নিয়ে রিমঝিমকে সরি বলে দিল। তবে ব্যাপারটা আর ছোটোদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। সন্ধ্যায় আলমগীর সাহেবকে একা পেয়ে কথাটা তুললেন তাহমিনা,
“দুলাভাই, মুন্সি ভাইয়ের ছেলেটাকে খেয়াল করেছেন? বেশ ভদ্র, শিক্ষিত, বিনয়ী।”
“হ্যাঁ, বেশ দায়িত্বশীল। খুব সরল মনেরও। অন্তরে কোনো প্যাচ নেই।”
“আমাদের রিমঝিমের সাথে বেশ ভাব হয়েছে দেখছি। সামনে, আড়ালে ভালোমন্দের খেয়ালও রাখছে। প্রতিবেশীরাও বেশ প্রশংসা করে কল্লোলের। আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। একবার ভেবে দেখুন না।”
আলমগীর সাহেব বিস্ময়ে তাকালেন,
“কী বলছো? সত্যিই?”
“আমি আমার কথা বললাম মাত্র। আপনার মতের ওপর কিছু না।”
আলমগীর সাহেব মাথা নাড়েন। উনার মনেও কথাটা উঁকি দিয়েছে বটে। ছেলেটার আচরণ, আন্তরিকতা প্রথম থেকেই উনার ভালো লেগেছে। রিমঝিমের সঙ্গে যখন ভাব হয়েছে একবার কথা তোলা যেতেই পারে। আলমগীর সাহেব সেদিন রাতেই হায়দার মুন্সিকে নিয়ে নিয়ে উঠানে বসে নানান আলাপের মাঝে কথাটা তুললেন। রিমঝিম ভেতর বাড়ির বারান্দায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকেও আলাপের বিষয়বস্তু ঠাহর করতে পারল। এও বুঝল হায়দার মুন্সি প্রস্তাবে পুলকিত। রিমঝিমকে উনাদের প্রথম দেখা থেকেই দারুণ পছন্দ। পছন্দ হওয়ার মতোই মেয়ে ও। কিন্তু বন্ধু হলেও আর্থিক দিক থেকে হায়দার মুন্সি আলমগীর সাহেবের থেকে কিছুটা দুর্বল। তাই সাহস করে নিজে থেকে প্রস্তাব তোলার চিন্তা করেননি। এখন যখন আলমগীর সাহেবও তেমনই ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন তখন আর সংকোচ রইল না।
সারা বাড়িতে যেমন হুট করেই উত্তেজনা ছড়াল তেমন হুট করেই তা থেমেও গেল। কল্লোল বাবার মুখে কথাটা শুনে স্পষ্টই বলল,
“এখন বিয়ের ব্যাপারে ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, বাবা। চাকরিটা হয়নি এখনো। আমি বেকার। তোমার টাকায় আমি বউ পালতে পারব না। তাছাড়া রিমঝিম এখানে বেড়াতে এসেছে। দুদিনের জন্য বেড়াতে আসা আর বউ হয়ে সারাজীবনের জন্য আসা এক নয়। নতুন পরিবেশে এলে অনেকেই এক্সাইটেড থাকে চারপাশ আবিষ্কার করার। সবকিছু জানার। জেনে গেলেই আগ্রহ ফুরিয়ে যায়। সারাজীবন শহরে বাস করা মেয়ে এই গ্রামে মানিয়ে নিতে পারবে না।”
সকলেই ভেবে দেখল কথাটা যৌক্তিক। রিমঝিম আধুনিকা, উন্নত মানসিকতায় বড়ো হওয়া মেয়ে। এখানে অফুরন্ত ভালোবাসা তো পাবে কিন্তু পারিপার্শ্বিকতায় হয়তো মানিয়ে নিতে পারবে না। অতএব আলোচনা এগোলো না। হায়দার মুন্সি ছেলের ওপর কিঞ্চিৎ নাখোশ হলেন। ছেলেটা বরাবর স্পষ্টভাষী বলে কিছু চাপিয়েও দেওয়া যায় না। আলমগীর সাহেব মনে দুঃখ পেলেন। আবার ছেলেটির বাস্তবিক ভাবনায় মুগ্ধও হলেন। মজবুত মেরুদণ্ড বটে। ছেলেটি নির্লোভীও। নয়তো একে সুন্দরী স্ত্রী, দুইয়ে শ্বশুরের সমস্ত সম্পত্তির ভবিষ্যত মালিক হওয়ার সুযোগ কেউ সহজে ছাড়বে না। আর এখানেই কল্লোল সকলের থেকে নিজের আলাদা ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে।
সমস্ত কিছু রিমঝিমের অগোচরে ঘটেছে বলেই জানত সবাই। কিন্তু রিমঝিম সব জেনেই ইচ্ছাকৃত নিরব ভূমিকায় ছিল। কিন্তু যখন শুনল কল্লোল প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেছে ওর বুকে যেন কিছু একটা বিঁধল। হঠাৎই যেন ক্ষণিকের আবেগে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো রিমঝিমকে ফিরে পেল নিজের মাঝে। প্রত্যাখ্যানে সে অভ্যস্ত নয় বলেই কিনা অদৃশ্য অপমানে সর্বাঙ্গ জ্বালা করে ওঠে। তাহলে কী জ্যোৎস্না রাতের সেই চোখের নিরব আবেদন নেহাৎ মশকরা ছিল! রিমঝিমও বা কী বোকা! সেটাকে সত্যি ভেবে নিজের আত্মতুষ্টির ডানায় আরেকটা গৌরবের পালক যুক্ত করেছিল! ওর জেদি সত্ত্বা যেন তাচ্ছিল্য করে বলে উঠল,
“হায় নারী মন! কেন পুরুষের মিছে ছলনায় পথভ্রষ্ট হও, করো দুঃখযাপন!”
আর একটা দিনও এ বাড়িতে থাকা ঠিক মনে করল না রিমঝিম। পরদিন সকাল হতেই ভার্সিটির ক্লাস ও অসুস্থতার বাহানায় একপ্রকার পীড়াপীড়ি করতে লাগল বাড়ি ফিরে যেতে। তাহমিনা যেন মেয়ের অব্যক্ত কথাটা ধরে ফেললেন। একটা মেয়ের জন্য বিষয়টা কতটা লজ্জা ও অস্বস্তির তিনি অনুধাবন করতে পারেন। তাহমিনা সম্মত হলেন ফিরে যেতে। আলমগীর সাহেব এদিককার বাড়ি বানানোর কাজের দায়িত্বটা বন্ধুকে বুঝিয়ে দিয়ে শীঘ্রই আসবেন বলে মেয়েকে নিয়ে রওনা হলেন বিকেলের বাসে। কল্লোল গেল তাদের বাস কাউন্টারে পৌঁছে দিতে৷ পুরোটা রাস্তা রিমঝিম ভুল করেও চেয়ে দেখল না কল্লোলকে৷
টিকিট কেটে বাসে তুলে দেওয়ার সময় একফাঁকে কল্লোল ওকে বিনীত স্বরে বলল,
“আপনাদের ঠিকমতো আপ্যায়ন করতে পারলাম না। আবার আসবেন তো?”
রিমঝিম চোখ তুলে চায়। সূর্য ডুবন্ত গোধূলিতে সেই চোখ যেন ঝলসে দেয় অন্তর। বিড়বিড় করে বলে,
“কক্ষনো না, কক্ষনো না।”
চলবে…