মেঘমেদুর মন পর্ব-০৫

0
612

#মেঘমেদুর_মন [৫]
প্রভা আফরিন

সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার। দিনের পিঠে ভর করে আঁধার নামছে চারপাশে। নীড়ে ফেরা পাখপাখালি ও নাম না জানা পোকামাকড়ের সৃষ্ট মূর্ছনায় শ্রবণেন্দ্রিয় ভার হয়ে আসে। গম্ভীর হয়ে রয় পরিবেশ। রিমঝিম কাঠের বারান্দায় ওড়না জড়িয়ে বসে দেখছে সেই মিলনক্ষণের বৈচিত্র্যময়তা। মনটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ডুবে যায়। দূরের বনঝোপ থেকে ভেসে আসা সদ্য প্রস্ফুটিত হাসনাহেনার সুবাসে মাতাল হয় ঘ্রাণেন্দ্রিয়। তাহমিনা কন্যাকে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন। নৈশব্দে নিকটে দাঁড়িয়ে কপালে ও গলায় হাত রেখে তাপমাত্রা অনুধাবন করলেন। দুপুরে বৃষ্টির জল গায়ে লাগিয়ে ফিরেছে। না জানি আবার ঠান্ডা-জ্বর লাগে। খালার উৎকণ্ঠা বুঝে রিমঝিম গোলাপের পাপড়ির ন্যায় আভা ছড়ানো ঠোঁটজোড়া ছড়িয়ে হাসে। বলে,
“আমাকে নিয়ে এত ভেবো না তো। নিজের গ্রামে এসেছো, ইনজয় করো।”

“ভেবেও তো ঠিক রাখতে পারি না। না ভাবলে যে কবেই ভেসে যেতে এ নিয়ে সন্দেহ নেই!”

“জীবনটা যদি একটা নদী হয়, তুমি আমায় সেই নদীতে ভাসিয়ে রাখা ভেলা। আর বাবা হলো হাল ধরা মাঝি।”

রিমঝিম খালার পেট জড়িয়ে ধরে নাক ঘষে। যেন এক আদুরে বিড়ালছানা। তাহমিনার বুকের ভেতর স্নেহের ফোয়ারা ছোটে৷ ভালোবাসা প্রকাশে মাঝে মাঝে কী সুন্দর কথা বলে মেয়েটা! হৃদয়ে শিশির ছুঁয়ে যায় যেন। তিনি বললেন,
“এবার একটা জাহাজসহ নাবিক পেলে সেখানে তুলে দেব তোমায়।”

ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না বিড়ালের ন্যায় আদরলোভী মেয়েটির। চেহারায় কপট রাগ ভাসিয়ে বলে,
“এরপর সেই নাবিক হবে জ্যাক৷ আর আমি রোজ। আটলান্টিক সাগরে ভেসে ভেসে প্রেম করে শেষে ডুবে…”

কথা শেষ করার আগেই তাহমিনা বোনজির মাথায় চাপড় দিলেন। বিরক্ত গলায় বললেন,
“ভর সন্ধ্যায় যতসব বাজে কথা। থা’প’ড়িয়ে কথা শেখাব তোমায়!”

বকা খেয়ে রিমঝিম গাল ফুলিয়েছে। খালার পেট ছেড়ে ঘুরে বসেছে। এমন সময় বর্ষা উপস্থিত হয় সেখানে। হাতে চায়ের পেয়ালা। রিমঝিমের কাঠের চেয়ারের পাশে অবস্থিত ছোটো টেবিলে তা নামিয়ে বলল,
“আপুর জন্য চা এনেছি। আজ নাকি দুপুরে গায়ে বৃষ্টি লাগিয়েছো? তাই ভাইয়া বলল আদা-তুলসী দিয়ে চা করে দিতে। ঘরে মাথাব্যথা, জ্বরের ওষুধ আছে, লাগলে বোলো।”

ভাইয়া বলেছে! কথাটা কানে লাগল ভীষণ। রিমঝিমের স্মরণ হলো কল্লোলের ঠান্ডার ধাত আছে। বৃষ্টিতে ভিজলেই বুকে ঠান্ডা জমে যায়৷ তার কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে এর আগেই বর্ষা মায়ের ডাক পেয়ে ভেতরে চলে গেল। রিমঝিম ভাবে দেখা হলেই জানা যাবে। রাতে খাবার খাওয়ার সময় কল্লোলকে দেখা গেল না। রিমঝিম এবার অবাক হয়। বর্ষাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস কর,
“তোমার ভাইয়া খাবে না?”

“ভাইয়া ঠান্ডায় কাহিল হয়ে গেছে। ঘরেই আছে। জিভে স্বাদ পাচ্ছে না বলে খাবে না বলেছে।”

রিমঝিমের হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। রাতে ঘুমাতে গিয়ে চোখের পাতায় ঘুম নেই। এখানে সবাই নয়টা-দশটার মধ্যেই দুয়ারে খিল দেয়৷ অন্যদিকে রিমঝিম রাতজাগা পাখি। এত সহজে অভ্যাস কী বদলাতে চায়! পাশেই খালা কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।

মহা জ্বালা হলো! অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল ও। একসময় অতিষ্ট হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল৷ শোবার ঘরের বাইরে বাড়ির ভেতরকার টানা বারান্দা। মুন্সি বাড়ির ভেতরকার একঘর থেকে অন্যঘরে যেতে বারান্দা ব্যবহার করা যায়। রিমঝিম বাইরে এসে অভিভূতপ্রায়। আকাশে থালার মতো মস্ত চাঁদ। রুপালি জ্যোৎস্না যেন চুয়ে এসে পড়ছে রিমঝিমের গায়ে৷ আজ পূর্ণিমা নাকি! প্রশ্নটা সহসাই মনে উঁকি দিল। বিরক্তি ভুলে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল ও। জ্যোৎস্নালোকিত চারপাশ যেন চাঁদের রূপে মুগ্ধ। নিভৃতে ছুঁয়ে যাওয়া বেসামাল হাওয়ার তালে ছন্দ তুলেছে গাছের পাতা। রিমঝিম যখন আশপাশ ভুলে কল্পজগতে বিভোর ঠিক তখনই ভারী কণ্ঠের বিশ্রামহীন কাশির নৈশব্দে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। রিমঝিমের মোহ কেটে গেল। ভ্রুর মাঝে লম্বা হয়ে ভাজের রেখা ফোটে৷ কণ্ঠস্বর তার চেনা। শব্দকে অবলম্বন করেই এগোয় রিমঝিম। বর্ষার ডিঙিয়ে পরের ঘরটা থেকেই শব্দ আসছে। একবার খোঁজ না ওর নিলে মনটা খচখচ করছে। তার আবদার রাখতেই তো লোকটাকে ভিজতে হলো। দায় এড়াতে পারছে না। দরজার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রিমঝিম। এত রাতে দরজা ধাক্কানো কী ঠিক হবে? ঘরে যদি আরো কেউ থাকে? বিব্রতকর মুহূর্ত তৈরি হবে। দ্বিধায় ভুগে চলে যেতে উদ্যত হয় ও। কয়েক কদম চলে যাওয়ার পর হঠাৎ খট করে একটা শব্দ হয়। আপন খেয়ালে থাকা রিমঝিম প্রায় চমকে ওঠে শব্দ শুনে। দেখে দরজা ঠেলে আঁধার ঘরের ভেতর হতে একটি অস্পষ্ট মানব মূর্তি বের হচ্ছে। চাঁদের আলো তার গায়ে পড়তেই চেনা গেল। কল্লোল! রিমঝিম হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

অন্যদিক কল্লোল বারান্দায় নারীছায়া দেখে ভড়কে গেছে। অবাক স্বরে বলে,
“এত রাতে এখানে কী করছেন?”

“ভূতের সঙ্গে বৈঠক করছি। গোল টেবিল বৈঠক। কারো ঘাড় মটকানো যায় কিনা আলোচনা চলছে।”

“আমার এলাকার ভূতের সঙ্গে আপনার ভাব হয়েছে তাহলে? বলতেই হচ্ছে রতনে রতন চেনে।” কল্লোল হেসে ফেলল।

রিমঝিম ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“বলতে কী চাইলেন আপনি? আমি ভূত?”

“এই রাতে একা একা হেঁটে বেড়ালে তো মানুষ তাই ভাববে।” কল্লোল মুখ চেপে কাশতে লাগল।

রিমঝিমের রাগ পড়ে গেল। নিভু নিভু গলায় বলল,
“দুঃখিত! আমাকে নদী দেখাতে নিয়ে গিয়ে অসুখ হয়ে গেল আপনার।”

কল্লোল পূর্ণ চাঁদের মায়াময় আলোয় দৃষ্টির সবটুকু মনোযোগ ঢেলে দেয় মেয়েটির পানে। হয়তো ভাবছে এই অবস্থা ওকে সঙ্গ দিতে গিয়ে হয়েছে, তাই ভরা জ্যোৎস্নায় অমাবস্যা ছেয়েছে উজ্জ্বল মুখখানায়। রাগী, মুডি হলেও যে তিনি ভীষণ নরম মনের সেটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। কল্লোল ক্ষীণ হাসি চাপে। আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আসার পর থেকেই বৃষ্টিতে ভেজা হচ্ছে ঘন ঘন। এটা তারই সম্মিলিত ফল। আজকের জন্য নয়।”

“রাতে খাননি?”

“খেয়েছি অল্প। মা আমাকে না খায়িয়ে ঘুমাতে যাবেন তা আজ অবধি হয়নি। কিন্তু আপনি জেগে কেন? নতুন পরিবেশে মানাতে পারছেন না?”

“অনেকটা তেমনই। আবার এত দ্রুতও ঘুমাই না।”

“রাত জাগার বাজে অভ্যাস হয়েছে আপনার। আপনাদের বাড়িতেও দেখলাম মাঝরাতে পিপড়ার মতো পিলপিল করে পুরো বাড়ি ঘোরাঘুরি করেন! স্লিপিং সাইকেল ঠিক রাখবেন সব সময়। ফোন, ল্যাপটপ থেকে দূরে থাকবেন ঘুমানোর আগে। স্ক্রিণের ব্লু লাইটও অনিদ্রার জন্য দায়ী।” কল্লোল এমন স্বরে বলল যেন এক অভিভাবক শাসন করছে অবাধ্য মেয়েকে।

রিমঝিম বুকে হাত গুজে বলল,
“খুব তো জ্ঞান বিতরন করছেন। তা আপনি কেন জেগে আছেন শুনি?”

“এতদিন পড়াশোনার জন্য রাত জাগতাম। এখন অভ্যাসটা ছাড়াতে চেষ্টা করছি। তাই অভ্যাস ত্যাগ করতে একটু সময় লাগছে।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিমঝিম জিজ্ঞেস করল,
“আপনার চাকরি যদি না হয়? ঢাকায় যাবেন না আর?”

“চাকরি যদি না হয় ব্যবসা করব ঠিক করেছি। যদিও আমি এখনো পর্যন্ত চাইছি না বাবার কাজের ভার নিতে। আরোপিত কিছু আমার অপছন্দ। নিজের যোগ্যতায় কিছু করার ইচ্ছে আছে। স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগও আছে। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে।”

দুজনের মাঝে হঠাৎ নিরবতা নেমে এলো। কথা ফুরালো নাকি শব্দ ভাণ্ডারে সংকট কেউ জানে না। তবে দৃষ্টিতে সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়নি। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকে কল্লোল তখন ড্যাবড্যাব করে রিমঝিমকেই দেখে চলেছে। রিমঝিম অস্বস্তিতে পড়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

কল্লোল দৃষ্টি না সরিয়ে বেশ সাবলীল স্বরেই উত্তর দিল,
“পরিবেশের সঙ্গে আপনার রূপ বদলায় নাকি? সকালে মনে হলো রোদের মতোই তেজি, আবার নদীর ধারে মনে হলো স্রোতের মতোই উচ্ছল। আর…”

“আর কী?”

“এখন আপনাকে মনে হচ্ছে চাঁদের মতো উজ্জ্বল, জ্যোৎস্নার মতো মায়াবী।”

রিমঝিম স্থানুবৎ হয়ে আছে। সৌন্দর্যের জন্য বহু পুরুষের কাছ থেকে বহু প্রশংসাবাক্য শুনেছে ও। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে এহেন উপমা ইহকালে শোনেনি। এই নির্জন, নয়নাভিরাম, নিকষিত মুহূর্তে এক পুরুষের ভানহীন, অকপট চোখে নিজেকে আবিষ্কার করে ওর চিত্তে উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে। এই লোকের মাঝে কেন যে রাখঢাক নেই! রিমঝিম আরক্ত মুখখানি থমথমে করার চেষ্টা করে বলল,
“একা পেয়ে ফ্লার্ট করছেন?”

রিমঝিম রেলিংয়ের সঙ্গে হেলে দাঁড়িয়ে ছিল। কল্লোল হঠাৎ তার নিকটে এলো। ক্ষীণ দূরত্বে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাওয়ার মতোই ফিসফিসিয়ে বলল,
“রিমঝিম, আপনাকে দেখলে বুকের ভেতরটা ঝিমঝিম করে কেন?”

চলবে…
(ভুল থাকলে ধরিয়ে দেবেন)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে