#মেঘমেদুর_মন [১]
প্রভা আফরিন
শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা। মেঘঘন আকাশের ছায়াতলে দিনটা আজ একটু ব্যস্ততার সঙ্গেই প্রস্থান করেছে। বারান্দায় মেঘলা আঁধারে একাকী বসে আছে রিমঝিম। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে শ্বেত জলের সুক্ষ্ম ফোঁটাগুলো। হঠাৎ অযাচিত দরজা ধাক্কানোর শব্দ তার নিঝুম মনের গহীনকে আন্দোলিত করে তোলে। কপালে ভাসে সুক্ষ্ম চিন্তার রেখা। সম্পূর্ণ ফ্ল্যাটে মাত্র দুজন নারী রয়েছে। বাবা সকালে গেছেন এক পারিবারিক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। রিমঝিমের শরীরটা কিছুদিন যাবত অসুস্থ বিধায় আর যায়নি ও। বাবাও বিশেষ জোর করেননি। খালার ভরসায় বাড়িতে রেখে চলে গেছেন। বিয়ে ঢাকার বাইরে নরসিংদীর মেঘনাপাড়ে। বাবার ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজবে বলে জানিয়েছেন। তাহলে এই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় কোন আগন্তুক কড়া নাড়ছে?
দরজা খোলারও নাম নেই। রিমঝিমের খালা তাহমিনা বেগম একটু বৃষ্টি দেখলেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম দেন। এখনো নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন! প্রবল বিতৃষ্ণায় উঠে দাঁড়ায় রিমঝিম। লোডশেডিং হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। অন্ধকারেই চেয়ার পেতে বসেছিল ও। এখন রান্নাঘর হাতড়ে মোম জ্বালাতে হবে। এরপর দরজা খুলতে হবে। ততক্ষণে দরজার ওপর কতবার ঢোল বাজবে কে জানে! রিমঝিম মাথায় ওড়না প্যাঁচিয়ে সচেতন পায়ে বসার ঘরে এসেই আলোর উপস্থিতি দেখল। খালা মোম হাতে ভীত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। রিমঝিমের উপস্থিতি পেয়ে ছুটে এসে ফিসফিস করে বললেন,
“ময়নারে, অসময়ে কে এলো বলতো?”
রিমঝিমের অক্ষিকোটরে বিরক্তি সঞ্চার হয়। তার বিরক্তির কারণ দুটি। প্রথমত ময়না নামটি তার একদমই অপছন্দ। তবুও খালা তাকে ময়না বলেই ডাকবেন। জন্মের পর নানি তাকে এই নামটি দিয়েছিলেন। কিন্তু সাতদিনের আকিকার সময় বাবা নাম বদলে দেন। এরজন্য নানি এক বছর বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। পরবর্তীতে ময়নাকে ডাক নামের স্বীকৃতি দিয়ে উনার রাগ ভাঙানো হয়েছে। কিন্তু এই ডাকনামে শুধু নানিই ডাকতেন। উনার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন খালা।
রিমঝিমের রাগের দ্বিতীয় কারণটা দরজা ধাক্কানোর শব্দ। নিশ্চয়ই দরজার ওপাশের আগন্তুক এক অধৈর্যবান ব্যক্তি। রিমঝিম খালার কথা প্রত্যুত্তরে বলল,
“কে এসেছে সেটা না দেখে কী করে বুঝব, খালা? দাঁড়াও, খুলে দেখি।”
তাহমিনা আতঙ্কিত মুখে নিবারণ করেন তাকে। উনার একমাত্র আদরের আমানত রিমঝিম। বড়ো বোনের মৃ’ত্যুর পর রেখে যাওয়া বাচ্চা মেয়েটিকে নিজের ছায়াতলে রেখে বড়ো করেছেন। তার কিছু হয়ে গেলে! তিনি বলেন,
“বৃষ্টির সময় চোরের উৎপাত হয়। ডাকাতও আসতে পারে। যাস না বাবু।”
রিমঝিম শুনল না বারন। খালার হাত থেকে জলন্ত মোমটা নিয়ে দরজা খুলতেই দেখল এক কাকভেজা তরুণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কাচের গায়ে জমে আছে বৃষ্টিঝরা জলবিন্দু। তরুণ রিমঝিমকে দেখে কোনো সংকোচ ছাড়াই বলে উঠল,
“একটা শুকনো তোয়ালে দেবেন? আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে। বুকে ঠান্ডা লাগলে নিশ্বাস নিতে পারি না।”
কি অকপট আবদার! রিমঝিম ভ্রু কুচকে তাকায়। এই ভদ্র পোশাকের তরুণকে খালার ভাষ্যমতে চোর বা ডাকাত কিছুই মনে হচ্ছে না। কিন্তু সন্দেহ নিশ্চয়ই হলো। ও তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“আপনি একটা শুকনো তোয়ালের জন্য বৃষ্টিতে ভিজে তিন তলায় উঠে এসেছেন?”
ছেলেটি নড়েচড়ে ওঠে। মৃদু মৃদু কাঁপছে তার পাতলা, লম্বাটে দেহ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ঠিক তা নয়, আন্টি।”
আন্টি! রিমঝিমের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে। মোমের আলোয় তার মর্মাহত মুখখানি ছেলেটি স্পষ্ট দেখতে পায় না। কারণ সে যা দেখছে সবই ঝাপসা। তাহমিনা বেগম রিমঝিমের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন,
“এই ছেলে? কে তুমি? এখানে কাকে চাও?”
ছেলেটি এবার নিজের পরিচয় দেয়,
“আমি কল্লোল। আলমগীর চাচার সন্ধানে এসেছি। ঠিকানা অনুযায়ী এটাই উনার বাসা। আমি কী ভুল ঠিকানায় চলে এলাম?”
“ঠিকানা সঠিক। কিন্তু তার সঙ্গে তোমার কী দরকার?”
“আমি চাচার গ্রামের বাড়ির লোক। উনাকে ডেকে দিন। আর আমাকে যদি একটু শুকনো হতে দিতেন। আসলে আগামীকাল আমার পরীক্ষা আছে। অসুস্থ হলে এতদূর আসাটাই বেকার হয়ে যাবে।”
তাহমিনা বেগমের স্মরণে এলো আলমগীর সাহেবের কথা। তিনি বলেছিলেন গ্রাম থেকে বাল্যবন্ধুর পুত্র আসবে। কয়েকদিন থাকবে এ বাড়িতে। তাহমিনা এবার ভয়ের খোলস ছেড়ে ফুরফুরে স্বরে বললেন,
“তুমিই কল্লোল! এই অসময়ে এলে বাবা! এসো এসো, ভেতরে এসো।”
তাহমিনা ব্যস্ত হলেন অতিথিকে নিয়ে। রিমঝিমকে নির্দেশ দিলেন,
“আলোটা ধরে ওকে ভেতরে আসতে দে।”
রিমঝিম থম ধরে আছে। চাহনী তীক্ষ্ণ। ক্ষণিক আগে ছেলেটির বলা শব্দটি তাকে যেভাবে হুল ফুটিয়েছে তা স্পষ্ট ওর মুখ ভঙ্গিতে। ছেলেটি ভেতরে ঢোকার আগেই রিমঝিম ফু দিয়ে মোম নিভিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আঁধারে তলিয়ে যায় চারপাশ। তাহমিনা অবাক স্বরে বলেন,
“কী হলোরে?”
“জানি না।” জবাব দিয়ে রিমঝিম অন্ধকারেই ধুপধাপ পা ফেলে ভেতরে ঢুকে যায়। মাঝপথে টি টেবিলের সঙ্গে সজোরে ধাক্কাও খায়। মৃদু আর্তনাদ শোনা যায়। তাহমিনা আঁতকে উঠে বলেন,
“ময়নারে… অসুস্থ শরীরে এভাবে চলাচল করিস না।”
কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। রিমঝিম নিজের ঘরে চলে গেছে। মোমবাতির ও আর প্রয়োজন পড়ল না। বিদ্যুৎ চলে এসেছে। কল্লোল বলল,
“উনার কী হয়েছে?”
তাহমিনা হাসার চেষ্টা করলেন। জবাব দিলেন,
“ও কিছু না। তুমি ভেতরে এসো। আমি শুকনো তোয়ালে দিচ্ছি।”
আলমগীর সাহেব বাড়ি ফিরলেন রাত দশটায়। মেঘ কেটে আকাশে তখন ভরা জ্যোৎস্না। তিনি বাড়ি ফিরেই একমাত্র মেয়ের খোঁজ করলেন,
“আম্মু? কোথায় আমার রিমঝিম?”
তাহমিনা বললেন,
“হুট করে কী যে হয়েছে মেয়েটার! ঘরে থম মেরে বসে আছে।”
“শরীর খারাপ করেনি তো?” কন্যার পিতা উত্তেজিত হোন। তাহমিনা বললেন,
“আপনি ব্যস্ত হবেন না, দুলাভাই। ও ভালো আছে। কোনো কারণে বোধহয় রেগে গেছে।”
আলমগীর সাহেব তৎক্ষনাৎ মেয়ের রাগের কারণ অনুসন্ধানে লেগে গেলেন। রিমঝিমের তলব হলো বসার ঘরে। খালাকে মানা করতে পারলেও বাবাকে ফেরাতে ব্যর্থ পিতাভক্ত হৃদয়। অগত্যা তাকে এসে বসতে হলো বাবার সামনে। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে আলমগীর সাহেবের হৃদয় শীতল হয়। ক্লান্তিরা ঝরে যায় অলক্ষ্যে। দিনশেষে একমাত্র সন্তান ও আঁধার জীবনের একমাত্র সলতেকে না দেখলে যেন স্বস্তি মেলে না। তিনি মেয়েকে কাছে টেনে জানতে চাইলেন,
“আমার আম্মু রেগে কেন?”
“আমি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, বাবা?” রিমঝিমের কণ্ঠ নমনীয়। মুখভঙ্গি আহ্লাদী। আলমগীর সাহেব ক্রোধ প্রকাশ করে বললেন,
“আমার মেয়েকে বুড়ো বলার সাহস করল কে?”
“তোমার অতিথি আমায় আন্টি বলেছে।”
“অতিথি?” আলমগীর সাহেব প্রশ্নাত্মক চোখে চাইলে তাহমিনা উত্তর করলেন,
“রংপুর থেকে আপনার বন্ধুর ছেলে এসেছে।”
সুতরাং কল্লোলের স্মরণ হলো বসার ঘরে। কল্লোল এলো অত্যন্ত ভদ্র ও শব্দহীন পায়ে। ভেজা ছেলেটিকে দেখে তখন নিতান্তই এক অসহায় মানব মনে হলেও ঝকঝকে আলোয় তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে রিমঝিম বাধ্য হয়। তাকায় কল্লোলও। খেয়াল করে এক সদ্য চেনা নারী তার দিকে অসন্তোষের চোখে চেয়ে আছে। আলমগীর সাহেব সৌজন্য সাক্ষাত সারলেন স্বল্প বাক্যে৷ এরপর বললেন,
“তুমি একটা অন্যায় করেছো ছেলে?”
কল্লোল আকাশ থেকে পড়েছে এমন মুখভঙ্গি করে৷ অন্যায়! এখানে এসে সজ্ঞানে ভুল করেছে বলে তো মনে পড়ে না। ভাবতে ভাবতে কল্লোলে স্মরণ হলো আলমগীর সাহেবকে কদমবুসি করা হয়নি। যদিও বিষয়টা কল্লোলের অপছন্দ। কিন্তু কিছু কিছু মুরুব্বি এটাকেই শিষ্টাচার মেনে আসছেন যুগের পর যুগ। তাদের বোঝাতে গেলে উলটে বে’য়া’দবের তকমা জুটে যাবে। কল্লোল কদমবুসি করতে ঝুকে এলো। আলমগীর সাহেব হৈ হৈ করে উঠলেন,
“আরে করো কী? থামো।”
কল্লোল থামে। মুখ তুলে চাইতেই পিতার নিকটে বসা কন্যার মুখোমুখি হয়। দূরত্ব বেশি নয়। দুজনের চোখ একই সমান্তরালে অবস্থান করে কয়েক সেকেন্ড। দমকা হাওয়া যেমন হুট করেই বয়ে যায় তেমনই কিছু বয়ে যায় চোখের পাতায়। কল্লোল মেরুদণ্ড সমান করে জানতে চাইল,
“তাহলে আমার অজান্তে কোন অন্যায় হলো, আঙ্কেল?”
“তুমি আমার মেয়েকে আন্টি ডেকেছো কেন?”
কল্লোল আরেকবার তাকায় মেয়েটির পানে। কপালে ক্ষীণ ভাজ। যেন স্মরণ করার চেষ্টা করছে। ঠোঁটে স্মিত হাসি উঁকি দিয়েও মিলিয়ে যায়। বলে,
“আসলে আঙ্কেল, আমি চশমা ছাড়া চলতে পারি না। বৃষ্টিতে ভিজে কাচ ঝাপসা ছিল বলে অল্প আলোয় সামনের নারী অবয়ব ও কণ্ঠস্বরকে আন্দাজ করে আন্টি ডেকেছিলাম। তিনি আপনার যে মেয়ে বুঝতে পারিনি।”
রিমঝিমের অপমান আরেকদফা বেড়ে যায়। কী বলল এই চশমাওয়ালা লোক! তার কণ্ঠ আন্টিদের মতো! রিমঝিম ভীষণ রেগে “বাবা!” বলে ডেকে ওঠে। আলমগীর সাহেব হো হো করে হেসে বললেন,
“আসলে আমার মেয়েটা একটু অসুস্থ। ঘন ঘন জ্বর, সর্দি লেগে কণ্ঠ ভারী হয়েছে। তাই তোমারও ভুল হয়েছে।”
রিমঝিম অপ্রতিভ হয়। সর্দি লেগে আসলেই তার কণ্ঠ ভারী হয়েছে। তাই বলে এমন বিব্রতকর মুহূর্ত হবে কে জানত! আড়ষ্টতা ঢাকতে কপট রাগের চাদরে মুখ ঢেকে রইল ও। কল্লোল সেই আরক্ততা, আড়ষ্টতা লুকানো মুখে আরো একবার পর্যবেক্ষণ করে স্মিত সুরে বলল,
“জি আঙ্কেল। তারজন্য আমি সরি।”
কল্লোলের আসার কারণ জানা গেল তখনই। পড়াশোনা শেষ করে এবার সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে ঢাকা এসেছে সে। যেহেতু ঢাকা শহর তার আত্মীয় পরিজন কেউ নেই তাই কল্লোলের বাবা পুত্রের চিন্তায় পুরোনো বন্ধু আলমগীরের সহযোগিতা কামনা করেছেন। আলমগীর সাহেব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা মেনে নিয়েছেন।
_______________
ইদানীং রিমঝিমের ইনসোমনিয়া দেখা দিয়েছে। রাতে ঘুম হয় না। প্রথম প্রথম জোর করে ঘুমাতে চাইলেও এখন সেই চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে রাতগুলো সুন্দর করার চেষ্টা করে ও। যেমন পছন্দের গান শোনা, সিরিজ দেখা। আজ সেই ধারাবাহিকতায় ও ঠিক করেছে ঘুম না আসা পর্যন্ত আকাশ দেখবে। চাঁদ, তারা, মেঘেদের চলাচল দেখবে। সেই ভাবনার সঙ্গী হিসেবে কিছু খাওয়া দরকার। নিরামিষ বসে থাকতে ভালো লাগবে না। খাবারের সন্ধানে রান্নাঘরে এসে রিমঝিম চায়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। তখনই খেয়াল করল অতিথি ঘরের আলো জ্বলছে। মাঝরাতে লোকটা জেগে কেন আছে জানার একটা অহেতুক কৌতুহল জাগল মনে। দৈবাৎ তখনই দরজাটা খুলে গেল। বসার ঘরে পড়ল এক লম্বাটে ছায়া। কল্লোল স্বল্পালোয় দেখল রান্নাঘরের দরজায় এক নারী দাঁড়িয়ে আছে। এবার আর চিনতে ভুল হলো না। চশমা পরিষ্কার আছে। অসময়ে ঘর থেকে বের হওয়ার কৈফিয়তস্বরূপ বলল,
“আসলে রাতে আমার একটু হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আছে। আপনি কি চা বানাচ্ছেন? আদার সুগন্ধ পাচ্ছি।”
রিমঝিম প্রথমে ভাবল কোনো কথাই বলবে না। পরে সিদ্ধান্ত বদলে ক্ষীণ ও গম্ভীর গলায় বলল,
“হুম।”
“আমাকে এক কাপ দেওয়া যাবে?”
আবারো নিঃসংকোচ আবদার! লোকটির বোধহয় লজ্জা জিনিসটার অভাব আছে। নয়তো অন্যের বাড়ি এসে এভাবে কেউ আবদার করে! নিজের ভাবনাকে সংযত করে রিমঝিম। না তাকিয়েই বলে,
“রাত জাগছেন কেন? অনিদ্রা সমস্যা আছে?”
“জি না। আমি পড়ছিলাম। চাকরির পড়া। আপনি জেগে কেন? আপনার বুঝি অনিদ্রা সমস্যা আছে, মিস ময়না?”
রিমঝিম বিস্মিত, আহ’ত চোখে চায়। এই লোক তাকে পেয়েছে কী? একবার আন্টি, একবার ময়না! ময়না ডাকার সাহস কই পেল! রিমঝিম শান্ত স্বরে জবাব দিলেও কণ্ঠের চাপা ক্ষোভ আড়াল হলো না,
“আমি আপনাকে চা দিতে পারছি না। এককাপ পরিমাণই বানাচ্ছি। সেটা আমারই লাগবে।”
কল্লোলের তাতে কোনো বিশেষ ক্ষতি হলো বলে মনে হচ্ছে না। তবে মেয়েটি যে তার ওপর অসন্তুষ্ট তা নিয়ে সন্দেহ নেই। চলে যাওয়ার আগে বলে গেল,
“শুনুন, তখন ভুল সম্বোধনের জন্য আমি সরি। আসলে চোখটা এত খারাপ হয়েছে যে চশমা ছাড়া দেখিই না। তখন বৃষ্টিতে চশমা ঝাপসা হওয়ায় ভুলভাল দেখেছি। আবারো সরি।”
রিমঝিমের কোমল হৃদয়। ছেলেটির এই ত্রুটির কথা শুনে বিগলিত হয়। চুলায় ফুটন্ত জলের মতোই অজান্তে বাষ্পীভূত হয় নেতিবাচক ভাবনা। নিজেই নিজেকে বলে,
“যা হয়েছে ভুল করে হয়েছে। আন্টি ডাকটা ক্ষমা করা যায়। তার জন্য এক কাপ চা দেওয়াই যায়। কিন্তু ময়না ডাকের জন্য কোনো ক্ষমা হবে না।”
অপরকে দেবে বলেই যেন একটু বেশি যত্ন করে দু-কাপ চা বানায়। প্রথমবার স্বাদ নিয়ে যেন খারাপ না বলতে পারে এই লোক। যে নিলাজ জবান! চায়ের কাপ হাতে মৃদু টোকা দেয় কল্লোলের ঘরের দরজায়। দরজা খুলে যায়। কল্লোলকে কিছু বলতে না দিয়ে রিমঝিম চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে ময়না ডাকবেন না।”
কল্লোল চায়ের কাপ নিল। রিমঝিম চলে যাচ্ছে। ও পেছন থেকে বলল,
“আপনার নাম ময়না নয়?”
“উহু, রিমঝিম। ময়না আমার নানির দেওয়া নাম। নানির পর একমাত্র খালাই ডাকতে পারে। আর কাউকে সেই অধিকার দেইনি।”
কল্লোল যেন মেয়েটির গম্ভীরতার কারণ এতক্ষণে ঠাহর করতে পারল। মুচকি হেসে বলল,
“রিমঝিম নামটা খুব সুন্দর। বৃষ্টি বৃষ্টি একটা ব্যাপার আছে। আপনার নিশ্চয়ই বৃষ্টি পছন্দ?”
“হ্যাঁ।”
“নিজের নামের সঙ্গে মিল থাকে এমন জিনিসে মেয়েদের আগ্রহ থাকে।”
রিমঝিমের মনে হলো এই নির্জন রাতে অপরিচিতা নারীর সামনে লোকটি নিজেকে বুদ্ধিমান জাহির করতে চেষ্টা করছে। বলে উঠল,
“আপনার নাম তো কল্লোল। আপনার বুঝি নদী, সমুদ্র পছন্দ?”
“আমি নদীর দেশের মানুষ। তা একটু পছন্দই।”
“চা কেমন হয়েছে?”
“ভালো তবে…”
“তবে?” রিমঝিম ভ্রু কুচকায়।
কল্লোল বলল, “চিনিটা একটু বেশি হয়েছে।”
রিমঝিম স্থির চোখে চায়। মাঝরাতে একটা অচেনা মেয়ে তাকে চা করে দিল আর বিপরীতে কিনা একটু বেশি চিনির ব্যাপারটা হজম করতে পারল না! রিমঝিম কী করে জানবে এই লোক কতটুকু চিনি খায়? তিক্ত স্বরে বলে,
“আপনার মাঝে সৌজন্যতার অভাব আছে জানেন?”
কল্লোল কানের উপরিভাগ চুলকে বলে,
“আসলে আমি রাখঢাক করে খুব একটা কথা বলতে জানি না। মিথ্যা সৌজন্যও দেখাতে পারি না৷ সে জন্য অনেকে বিব্রত হয়। দুঃখ পেলে আবারো সরি।”
রিমঝিমের আগ্রহ ফুরিয়েছে। ও চলে যাওয়ার আগে অনাগ্রহে বলে গেল,
“নিজের কাপটা ধুয়ে রেখে আসবেন। আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে। রাতে আবার পানি ধরতে পারব না।”
চলবে…