#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৩
হাতের দিকে তাক করে ঈশা তাকাল। মানুষটার চেহারা দেখেই সে চমকে উঠল। ইভানের অগ্নি দৃষ্টি সাকিবের হাতের দিকে। আর সাকিবের চেহারায় আকাশসম বিস্ময়। চোখ ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান তার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত আর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তোমাকে ঐদিকে ডাকছে। যাও।
সাকিব সৌজন্য হাসল। ইশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার গিফট টা।
ইভান সাথে সাথেই সেটা আরেক হাতে নিয়ে নিলো। সাকিব আর কথা না বলে চলে গেলো। ঈশা একবার গিফট টার দিকে তাকিয়ে আবার ইভানের মুখের দিকে তাকাল। সে সাকিবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সাকিব সম্পূর্ণ অদৃশ্য হতেই ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে খুব ঠাণ্ডা সরে বলল
–অনেক হয়েছে তোর শপিং। বাসায় ফেরার পালা এবার।
ঈশা ভয়ে ভয়ে বলল
–চাচি…।
কথা শেষ না হতেই ইভান খুব কঠিন ভাবে বলল
–রাইট নাও। আমি অপেক্ষা করছি বাইরে। ১০ মিনিট যদি ১১ মিনিট হয়েছে তাহলে সেটার শাস্তি আলাদা।
ঈশা আর কোন কথা বলল না। ইভান চলে গেলো। ঈশা কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। এখন সবাইকে যদি বলে সে বাসায় যেতে চায় তাহলে কি তাকে যেতে দেবে? যদি না বলে। আর এইদিকে সে যদি সত্যি সত্যি ১০ মিনিটের বেশী সময় নেয় তাহলে ইভান তাকে মেরেই ফেলবে। ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। ইতিমধ্যে ৩ মিনিট পার হয়ে গেছে। আর মাত্র ৭ মিনিট। এর মধ্যে খুজে বের করে অনুমতি নেয়া সম্ভব না। তাই ঈশা আর অপেক্ষা করলো না। বাইরের দিকে চলে গেলো। ইভান বাইকে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার হাতের ফোনে স্থির। ঈশাকে আসতে দেখে অবাক হল। ১০ মিনিট সময় দিয়েছিল আর সে ৫ মিনিটে চলে এলো। কিভাবে সম্ভব? কারন ইভান জানত ঈশা ১০ মিনিটে আসতে পারবে না। তাই কি শাস্তি দিবে সেটাও ভেবে রেখেছিল। ঈশা সামনে দাড়াতেই ইভান বলল
–এখনও ৫ মিনিট সময় আছে। সেই সময় টুকু এখানেই দাড়িয়ে থাক।
ঈশা দাঁত বের করে হেসে বলল
–এই ৫ মিনিটে তোমার কাজ আছে।
ইভানের ভ্রু কুচকে এলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–কি কাজ?
ঈশা আবারো হেসে বলল
–তুমি এখন ফোন করে সবাইকে বলবে যে আমাদের আরও কাজ আছে তাই এখান থেকে যেতে হবে।
ইভান শান্ত চোখে তাকাল। বলল
–তার মানে তুই বলে আসিস নি।
ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান বিরক্ত হলেও তার কাছে উপায় নাই। তাই ফোন করে বলল যে তাদের কাজ আছে যেতে হবে। কাজের কথা শুনে কেউ আর কোন কথা বলল না। খুব সহজেই মেনে নিলো। ইভান ঈশাকে নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। ঈশা নেমে দাড়িয়ে আছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে খুব সহজ ভাবে বলল
–আজ যা হয়েছে দ্বিতীয়বার যেন এমন কিছু না হয়। খেয়াল রাখিস।
ইভানের কথা শেষ হতেই ঈশা বলল
–কি এমন হয়েছে? আমার জন্য ভাবি গিফট কিনতে বলেছিল সাকিব ভাইয়া কে। তাই সে কিনে আমাকে দিয়েছিল। এটা খারাপ কি?
ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
–খুব সখ গিফট পাওয়ার তাই না? তোমার ওই সাকিব ভাইয়া কে এরপর যদি কোনদিন তোমার আশেপাশে দেখি তাহলে তোমার পরবর্তী স্পেশাল গিফটটা আমিই দেব। মনে রেখ কেমন?
ঈশা গোল গোল চোখে তাকাল। বলল
–মানে কি?
ইভান অমায়িক হাসল। বলল
–মানেটা বুঝতে পারবে যদি আবার কখন এরকম পরিস্থিতি আসে। আর না আসলে ভাগ্য ভালো। তখন বোঝার প্রয়োজন নেই।
ইভানের কথা ঈশার ভালো লাগলো না। সে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই ইভান হাত টেনে ধরল। এক টানে নিজের কাছে এনে বলল
–যেটা আমার সেটার উপরে শুধু আমার অধিকার। আমি এসব একদম মেনে নেব না। আর যদি কখনও এরকম কোন ভাইয়াকে তোর আশেপাশে দেখেছি তাহলে তোকে নদীতে ডুবিয়ে মারব।
ঈশা ভয় পেয়ে গেলো কিছুটা। ইভান বুঝতে পারল। মনে মনে হাসল। কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য ভাবটা রেখে দিলো। ঈশা ইভানের কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। ইভান ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–এখন সোজা বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবি। আর আমার কথাগুল মাথায় রাখিস। মাথা থেকে বের হয়ে গেলে কিন্তু বিপদ আসন্ন।
ঈশা মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে সব ভালভাবে বুঝতে পেরেছে। ইভান চলে গেলো। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে ভাবল। তারপর বাসায় চলে এলো।
————-
মেঘবদল আজ সেজেছে নতুন রঙ্গে। লাল নীল আলোয় ঝলমল করছে চারিদিকে। সবার হইহুল্লড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে। নাহিদের হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকে সব কাজ শেষ করে মেয়েরা এখন সাজগোজে ব্যস্ত। ফারিয়া এক ঘণ্টা সময় নিয়ে সাজছে। জারিফ বাইরে বসে আছে। সে খুব বিরক্ত। এতক্ষন ধরে ঘরে ঢুকে কি করছে সেটাই তার মাথায় আসছে না। আর এতো সাজার দরকারটাই কি সেটাও বুঝতে পারছে না। শুধু যে ফারিয়ার সাজ নিয়ে তার বিরক্তি সেটাও না। বিরক্তির আরেকটা কারন হল কয়েকদিন থেকেই জারিফ খেয়াল করছে ফারিয়া তাকে রীতিমতো এভয়েড করছে। সে প্রায় সময় অফিস থেকে এসে দেখে ফারিয়া ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু আসলেও সে ঘুমিয়ে থাকে না। আর জারিফ বাসায় থাকলে পুরো সময়টা সে রান্না ঘরেই কাটিয়ে দেয়। রাতে শোয়ার সময় খুব প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ে। জারিফ কে কথা বলার তেমন সুজগ দেয় না। জারিফ খেয়াল করেছে ফারিয়া সেদিনের সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার পর থেকেই কেমন বদলে যায়। তার মাঝে কেমন একটা বউ বউ ভাব চলে আসে। যা আগে কখনও দেখা যায় নি। মা আর শাশুড়িকে তেমন একটা কাজ করতে দেয় না। উলটা তাদের কাজ নিজেই করে দেয়। এটা নিয়ে অবশ্য বাড়ির সবাই খুশি হলেও জারিফ বেশ অবাক হয়। তার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগছে ফারিয়ার এসব আচরন। চোখের সামনে কাল অবয়ব বুঝতে পেরেই জারিফ চোখ খুলে ফেলে। সামনে তাকাতেই তার মুখ হা হয়ে যায়। হলুদ শাড়িতে ফারিয়া কে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। খোপায় তাজা বেলি ফুলের মালা। হাতে সবুজ চুরি। জারিফের দৃষ্টিতে আকাশসম বিস্ময়। সে ভাবতেই পারছে না সামনে দাড়িয়ে থাকা এতো সুন্দরি মেয়েটা ফারিয়া। জারিফের এমন অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে ফারিয়া লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলল
–তোমার পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি। পরে নাও।
জারিফ আরেকদফা অবাক হল। ফারিয়ার মুখে এমন কথা হজম করতে পারল না। টিপিক্যাল বউদের মতো আচরনের কারণ জারিফের মাথায় আসছে না। সে উঠে দাঁড়ালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আরও একবার ভালো করে দেখে নিলো। এই মুহূর্তে তার মনে ভীষণ আফসোস হচ্ছে এতদিন তার বউয়ের এই রুপ সে কেন দেখেনি? দেখলে হয়তো আরও আগেই প্রেমে পড়ে যেত। ফারিয়া আবারো বলল
–রেডি হয়ে নাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
জারিফ তার কথা যেন শুনলই না। নেশাভরা কণ্ঠে বলল
–তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। অদ্ভুত সুন্দর।
ফারিয়া হতভম্ভ চোখে তাকাল। আগে কখনও জারিফের মুখে এমন কথা সে শোনেনি। প্রথম এমন কথা শুনে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। তাই চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
জারিফ এবার শুনতে পেল। মাথা নাড়িয়ে ঘরে গেলো। ফারিয়া হতবিহবল দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। জারিফের কথাটা মাথায় আসতেই হাসল সে।
————-
হলুদের স্টেজের সব কিছু তদারকি করছে ইভান। কিছুক্ষনের মধ্যেই নাহিদকে স্টেজে বসানো হবে। ঈশা তার কাজ শেষ করে নাহিদ কে আনতে যাচ্ছিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের আয়নায় খেয়াল করলো তার খোপার ফুল খুলে গেছে। সেই আয়নায় তাকিয়ে নিজে নিজে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই পারছে না। বেশ বিরক্ত হল সে। আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। এমন কেউ নেই যাকে একটু ঠিক করে দিতে বলবে। একটা শ্বাস ছেড়ে নিজেই চেষ্টা করতে লাগলো ঠিক করতে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে।
–কোন হেল্প লাগবে?
আওয়াজটা বেশ পরিচিত। ঈশার কানে লাগতেই ভ্রু কুচকে এলো। পিছন ঘুরে তাকাল। সাকিব কে দেখে হকচকিয়ে গেলো সে। নাহিদ কে হলুদ লাগানর জন্য মৃন্ময়ীর বাড়ির লকজন এসেছে। কিন্তু সাকিবও যে এসেছে সেটা ঈশা জানত না। আর সেদিনের ইভানের হুমকির পর ঈশা আজ ভালভাবে দেখে নিয়েছে সাকিব এসেছে কিনা। কিন্তু দেখতে পায়নি। তাই সে মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিল যে আজ কোন ঝামেলা হবে না। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে কোন অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। মনটা কেমন খচখচ করছে। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাকিব আবার বলল
–তোমার হেল্প লাগলে আমাকে বলতে পারো। কোন সমস্যা নেই।
ঈশা মনে মনে ভাবল এই ছেলের কাছ থেকে হেল্প নেয়া তো দুরের কথা এভাবে কথা বলা দেখলেই আজ তাকে সত্যি সত্যি নদীতে ফেলে দেবে ইভান। আশে পাশে দ্রুত চোখ চালিয়ে নিলো। ইভান কে দেখতে না পেয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললেও তার ভয়টা কেটে গেলো না। শুকনো ঢোক গিলে বলল
–ধন্যবাদ। আমার কোন হেল্প লাগবে না।
সাকিব হাত বাড়াল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–ফুলটা ঠিক করে দেই?
ঈশা এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে একটু ঝাঝাল গলাতেই বলল
–আমি কি আপনার কাছে কোন হেল্প চেয়েছি? চাইনি তো। তাহলে কেন হেল্প করতে এসেছেন আগ বাড়িয়ে। এসব আমার একদম পছন্দ নয়। একটু মনে রাখবেন প্লিজ।
বলেই সেখান থেকে চলে গেলো। কিন্তু সামনে এগুতেই দেখল ইভান টেবিলে বসে আপেল নিয়ে সেটাকে একবার উপরে ফিকে দিচ্ছে আবার ক্যাচ ধরছে। ঈশার ভয়ে জান বের হয়ে জাওয়ার মতো অবস্থা। ইভান আপেলটাতে কামড় দিয়ে এগিয়ে আসল ঈশার কাছে। ঈশার সামনে দাড়িয়ে আপেলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়ালো। বলল
–খা।
ঈশা কেঁপে উঠল। মৃদু সরে বলল
–আমি খাব না।
ইভান শান্ত চোখে ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। তারপর হাত শক্ত করে চেপে ধরল। টেনে নিয়ে গেলো।
চলবে…..