#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২১
হাতে পায়ে তেল মালিশ করা হচ্ছে ফারিয়ার। বিছানায় অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে সে। দুই পাশে মা আর শাশুড়ি বসে আছে। সবাই ভীষণ চিন্তায় অস্থির। মেয়েটা তো ভালই ছিল। হুট করেই এমন কি হল যে জ্ঞান হারিয়ে গেলো। ফারিয়া খুব সাবধানে চোখ মেলে তাকাতেই সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ফারিয়া কয়েকবার শ্বাস নিয়ে উঠে বসলো। জারিফ বলল
–আমি পানি আনছি।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো পানি আনতে। ফারিয়ার মা জিজ্ঞেস করলেন
–তোর কি হয়েছে মা? এরকম জ্ঞান হারিয়ে ফেললি কেন?
ফারিয়া পিছনে খাটের সাথে মাথা এলিয়ে দিলো। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
–জানিনা। হঠাৎ করেই কেমন বমি পাচ্ছিল। আর বমি করতে যেতেই মাথাটা ঘুরে উঠল।
ফারিয়ার শাশুড়ি আর মা দুজনেই তাঁর কথা শুনে একে অপরের দিকে তাকালেন। তারপর কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল
–এরকম কি আজকেই হয়েছে নাকি আগে থেকেই এমন লাগে।
ফারিয়া আবারো ক্লান্ত গলায় বলল
–কয়েকদিন থেকেই এমন লাগছে। আজ শরীরটা একটু বেশীই খারাপ লাগছে।
ফারিয়ার কথা শুনে দুজনেই আবারো একে অপরের দিকে তাকাল। চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। শব্দ করে হেসে ফেললো। তাদের হাসি দেখে ফারিয়া বেশ বিরক্ত হল। ভ্রু কুচকে বলল
–এভাবে হাসছ কেন তোমরা? শরীর খারাপ হলে এভাবে হাসতে হয়?
ফারিয়ার শাশুড়ি হেসে তাঁর মাথায় হাত দিয়ে বলল
–আরে বোকা মেয়ে এটা শরীর খারাপ না। খুশীর খবর।
ফারিয়া অবাক হয়ে তাকাল। এরকম অসুস্থ হলেও যে খুশি হতে হয় সেটা সে প্রথম শুনল। তাঁর মা এবার হেসে বলল
–এখনই সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে হবে। খুশীর খবর।
ফারিয়া বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলল
–মিষ্টি কেন? আর কিসের খুশীর খবর? আমি তো তোমাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু স্পষ্ট করে বলবে।
তাঁর শাশুড়ি হেসে ফেললো। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস রেখে বলল
–তুমি মা হবে আর জারিফ বাবা। তাই এতো খুশীর খবর।
জারিফ মাত্র ঘরে ঢুকেছিল পানির গ্লাস নিয়ে। এই কথা কানে আসতেই হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেলো। শব্দ শুনে সবাই সেদিকে তাকাল। জারিফ বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ফারিয়ার দিকে। জেনো সে মাত্র অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছে আর কাউকে চিনতে পারছে না। ফারিয়ারও একই অবস্থা। তাঁর শাশুড়ি আর মা ভেবেছে খুশীর খবর শুনে জারিফ এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তাই তারা হেসেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিছুক্ষন অভাবেই হাসাহাসি করে ঘর থেকে বাইরে চলে গেলো তারা। বাইরে যেতেই জারিফের ঘোর কাটল। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফারিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–তুমি প্রেগন্যান্ট?
ফারিয়া জেনো আকাশ থেকে পড়লো। কিছুক্ষন আগের বিষয়টা এমনিতেই তাঁর মাথায় ঢুকছে না। তাঁর উপর আবার জারিফের এমন প্রশ্ন। চেচিয়ে বলল
–কি যা তা বলছ?
জারিফ বসে পড়লো বিছানায়। বলল
–মা যে বলল।
–মা বললেই তুমিও বলবে?
ফারিয়া চিৎকার করতেই জারিফ মুখ চেপে ধরল। বলল
–একেই তো কেলেঙ্কারি করে ফেলেছ। এখন আরও চিৎকার করে কি প্রমান করতে চাও।
ফারিয়া জোর করে জারিফের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বলল
–কেলেঙ্কারি করেছি মানে? কি বলতে চাও তুমি? আমি কিছুই করিনি। এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। সবার সাথে কথা বলে আমি এখনই ক্লিয়ার করে ফেলছি।
জারিফ বিরক্তির সরে বলল
–তাই করো। বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই সবটা ঠিক করে ফেলা উচিৎ।
ফারিয়া আবারো মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। জারিফ তাঁর দিকে তাকাল। ফারিয়ার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। বিদ্ধস্ত লাগছে তাকে। জারিফ নরম সুরে বলল
–হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলে কেন? কি হয়েছে তোমার?
ফারিয়া চোখ বন্ধ রেখেই বলল
–কয়েকদিন উলটা পাল্টা অনেক কিছু খেয়েছি। তাই হয়তো এসিডিটি হয়েছে।
–আমাকে বলনি কেন? ঔষধ না খেলে ঠিক হবে কিভাবে?
ফারিয়া ক্লান্ত চোখ মেলে তাকাল। জারিফ শান্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ফারিয়ার মনে হল তাকে এভাবে দেখে জারিফের একটু হলেও খারাপ লাগছে। তাই খুব শান্ত কণ্ঠে বলল
–তুমি তো ব্যস্ত ছিলে। তাই আর বিরক্ত করতে চাইনি। এমনিতেই তোমার অনেক কাজ থাকে।
জারিফের মুখভঙ্গি গম্ভীর হয়ে গেলো। একটু কঠিন গলায় বলল
–আমি যতই ব্যস্ত থাকি না কেন তাই বলে তুমি আমাকে তোমার অসুস্থতার কথাও বলবে না? যদি মা আর আনটি না থাকত তাহলে তো আমাকেই দেখতে হতো। তখনও কি এমন কথা বলতে?
ফারিয়া শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। আচমকাই মনটা হালকা হয়ে গেলো। মুচকি হেসে বলল
–ঠিক আছে বলব।
জারিফ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল
–এখন কিছু খেয়ে নাও। আসো।
বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো। ফারিয়া পলক ফেলে তাকাল। কি মনে করে নিজেও হাত বাড়িয়ে দিলো। জারিফ আলতো করে খুব সাবধানে তাকে ধরে নিয়ে বের হল ঘর থেকে। কিন্তু বের হয়েই চোখ কপালে উঠে গেলো দুজনের। তাঁর মা আর শাশুড়ি ইতিমধ্যে পাশের বাড়ি থেকে ঈশাদেরকে ডেকে এনেছেন খুশীর খবর দিতে। ফারিয়া আর জারিফ কে দেখে ঈশার মা রাহেলা বলল
–আরে ফারিয়া তুমি বিছানা থেকে উঠে এলে কেন? রেস্ট নাও। এই সময় তোমার রেস্টের প্রয়োজন।
ফারিয়া আর জারিফ হা হয়ে তাকিয়ে আছে। সবাই তাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তারপর নিজেদের মতো আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। জারিফ একটু ঝুকে ফিসফিসিয়ে ফারিয়া কে বলল
–এটা কি হল? কতটুকু সত্যি সেটা জাচাই না করেই পাড়া প্রতিবেশি সবাইকে বাসায় ডেকে আনল।
ফারিয়া কোন কথা বলল না। সামনে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। জারিফ বিরক্ত হয়ে বলল
–আমি আর নিতে পারছি না।
বলেই ঘরে চলে গেলো। ফারিয়াও তাঁর পিছে পিছে ঘরে চলে এলো। জারিফ ফারিয়া কে দুই হাতে চেপে ধরে বলল
–এসব নাটকের মানে কি? বিষয়টা বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না।
ফারিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল
–আমি কি জানি? আমি তো তোমার সাথে ঘরেই ছিলাম।
–ঘরে ছিলে বলে কি তোমার সব দায়ভার শেষ। প্রথমেই কেন বলতে পারলে না। শুরুতেই যখন মা বলল তখনই বলে দিতে যে সেরকম কিছুই না। তাহলেই তো এতকিছু হতো না। আর আগেই আমি তোমাকে এটা বলেই দিয়েছিলাম যে মা আসলেই এরকম কথা উঠবে। তুমি তখন তো আমার কথার গুরুত্ব দাও নি। তখন যদি দিতে তাহলে আজ একটা উপায় বের করেই ফেলতে। এখন কেন চুপ করে আছ? সত্যি কথা বলতে ভয় পাও?
ফারিয়া বুঝতে পারল জারিফ অনেক রেগে আছে। আর রাগ করাটাই স্বাভাবিক। সে খুব শান্ত সরে বলল
–এখন তো বলা সম্ভব না। আমি ভেবে রেখেছি। সময় মতো সবটা সামলে নেবো। তুমি ভেবনা জারিফ।
জারিফ ভ্রু কুচকে তাকাল। তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–সিরিয়াসলি ফারিয়া! তুমি কি বুঝতে পারছ না? সামলে নিবে? কতদিন? কতদিন তুমি সামলে নিবে? দুই বছর? তিন বছর? তারপর? ভেবেছ তারপর কি বলবে? যখন আবারো সবাই এই বিষয়ে কথা বলবে তখনও আবার সামলে নিবে। এতো নাটকের কি দরকার? সত্যিটা বলে দাও না? বলে দাও যে আমরা কেউই এখনও এই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারিনি। আমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক নেই। আর বাচ্চা তো দুরের কথা।
শেষের কথাটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল সে। ফারিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। জারিফ এভাবে তাঁর সাথে কখনও কথা বলেনি। ফারিয়া কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জারিফ বলল
–আমি টায়ার্ড ফারিয়া। আর পারছি না। এভাবে জীবন চলতে পারেনা। আমাদের একটা ডিসিশনে আসতে হবে। এসব নাটক আর আমাকে দিয়ে হবে না। আমি মুক্তি চাই।
ফারিয়ার বুক কেপে উঠল। মৃদু সরে বলল
–মুক্তি চাই মানে?
–তুমি যদি মনে করো আমার সাথে সংসার করতে তোমার আপত্তি আছে তাহলে আমরা এই রিলেশন থেকে বের হয়ে যাই। এতে আমাদের দুজনের জন্যই ভালো হবে। যতদিন যাচ্ছে আমাদের এই সম্পর্ক নিয়ে পরিবারের লোকজনের প্রত্যাশা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে ধোঁকা দেয়ার কোন মানেই হয় না। তাই আমাদের খুব তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জারিফ খুব ঠাণ্ডা মাথায় কথা গুলো বলেই থামল। ফারিয়া স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জারিফের কথাগুলো তাঁর মাথায় ঢুকল। তাঁর কথা এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। জারিফ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ফারিয়া বিছানায় বসে পড়লো।
————
সময়ের নিয়মে কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। নিয়াজ রহমান সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছেন। আজ আসর বসেছে নাহিদদের বাসায়। তাঁর বিয়ের আলচনায় ব্যস্ত সবাই। মৃন্ময়ীকে আগে আংটি পরিয়ে বিয়ের তারিখ ঠিক করার কথা থাকলেও নিয়াজ সাহেবের অসুস্থতার জন্য সেটা ক্যান্সেল হয়ে যায়। এখন একবারেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে। তাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে। বেশ অনেক কথার পর নুরুল সাহেব বললেন
–আগামি শুক্রবার বিয়ের দিন ঠিক করা হোক। সবার ছুটি আছে। কারো ঝামেলা হবে না।
তাঁর কথায় মোটামুটি সবাই সম্মতি দিলো। সাথে সাথেই ফোন করে মৃন্ময়ীর বাড়িতে জানিয়ে দেয়া হল। তারাও জানিয়ে দিলো তাদের কোন সমস্যা নেই। তাই শুক্রবারের দিনটাই ঠিক করে ফেলা হল। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো আরেক জায়গায়। এতো কাজ এক সপ্তাহেই সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে। সবাই মিলে করলে সময় মতো করতে পারবে। কিন্তু সব কাজ তো আর বয়স্কদের দিয়ে হয় না। তাই কে করবে এসব সেটা নিয়েই সবাই ভাবছিল। সবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তহীনতার মাঝেই নিয়াজ সাহেব গম্ভীর গলায় বলে উঠল
–এতো চিন্তার কি আছে? ঈশা তো বসেই থাকে বাড়িতে। এখন তাঁর তেমন কোন কাজ নেই। সে কাজগুলো সামলে নিবে।
নুরুল সাহেব আপত্তি জানিয়ে বললেন
–সে মেয়ে মানুষ। একা কিভাবে কাজ করবে? তাঁর হেল্প প্রয়োজন।
–ঈশার নাম বলেছি বলেই সে একা কাজ করবে সেটা আমরা কেন ভাবতে যাব। ইভান কি তাকে একা কাজ করতে দেবে? কেউ না চাইলেও সে নিজ দায়িত্তে হেল্প করবে। তাই আমার মনে হয় ওদের দুজনের উপরে দায়িত্বটা দিয়ে দেয়া উচিৎ।
নিয়াজ সাহেব অত্যন্ত শান্ত ভাবে কথাটা বলতেই সবাই তাঁর দিকে তাকাল। ঈশা আর ইভান বেশ অবাক হল। ঈশা ভাবতেও পারছে না বাবার সুর পরিবর্তন হয়ে গেলো কিভাবে। ইভান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিয়াজ রহমানের দিকে। নিয়াজ সাহেব ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি আর ঈশা মিলে সবটা সামলে নিও। মনে রেখো আমি কিন্তু কোন ভুল মেনে নেবো না। যা দায়িত্ব দেয়া হবে সেটা ঠিক ভাবে পালন করবে। তোমার জীবন নিয়ে তুমি যেমন হেয়ালি করো। এবার কিন্তু এসবের আর কোন সুযোগ তোমাকে দেয়া হবে না।
ইভান উঠে দাঁড়াল। কণ্ঠে তীব্র আত্মবিশ্বাস রেখে বলল
–আমি তোমাকে কোন অভিযোগের সুযোগ দেব না। একবার বিশ্বাস করেই দেখ।
নিয়াজ রহমান গম্ভীর সরে বললেন
–এতো কথা না বলে কাজ করে দেখাও। আমি বেশী কথা পছন্দ করি না। কাজ পছন্দ করি।
ইভান মাথা নাড়াল। ঈশা এখনও আগের অবস্থাতেই দাড়িয়ে আছে। সবাই বিয়ে বাড়ির কাজের লিস্ট করতে শুরু করেছে মাত্র। এর মাঝেই কলিং বেলের তীব্র আওয়াজে সবার বিরক্তি ধরে গেলো। ঈশা বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলেই দেখে ফারিয়ার মা দাড়িয়ে আছে। ঈশা কিছু বলার আগেই তিনি মুখে আচল চেপে কেদে উঠলেন। ঈশা কিছু তাকে ধরে জিজ্ঞেস করল
–কি হয়েছে আনটি?
তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন
–জারিফ। জারিফের অফিসে আগুন লেগেছে।
চলবে……
#মেঘবদল
লেখক – এ রহমান
পর্ব ২২
হাসপাতালের করিডোরে সবাই অপেক্ষা করছে। সবার চোখে মুখে আতংক। জারিফের মা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে বাড়িতে। বাড়ির মেয়েরা তাকে সামলাচ্ছেন। হাসপাতালে ফারিয়ার সাথে ইভান ঈশা এসেছে। জারিফের অবস্থা ঠিক কি সেটা তারা এখনো জানে না। কারণ খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। ডাক্তার জারিফকে দেখছেন। ফারিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে এক পাশের চেয়ারে। দৃষ্টি তার স্থির নিচের দিকে। ঈশা তাকে ধরে বসে আছে। ভেতরে ঠিক কি হচ্ছে সেটা জানার অপেক্ষায় সবাই অস্থির। ইভান ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর ইভান বের হয়ে এলো। ঈশা উঠে দাড়ালেও ফারিয়া চুপ করেই বসে থাকলো। ইভান সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
— সব ঠিক আছে। ধোঁয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এখন জ্ঞান ফিরেছে।
ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
— ফারিয়া জারিফ তোমার সাথে কথা বলতে চায়। ভেতরে যাও।
ফারিয়া চোখের পানি মুছে ভেতরে চলে গেলো। ভেতরে ঢুকেই দেখে জারিফ শুয়ে আছে। ফারিয়ার দিকে তাকাল। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক কেঁদেছে। জারিফ কি বুঝে মৃদু হাসলো। ফারিয়া পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি কথা বলবে বুঝতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। চোয়াল ভারী হয়ে আসছে। কথা বললেই কান্না শুরু হয়ে যাবে। জারিফ ক্লান্ত সরে বলল
— ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাছে আসো।
ফারিয়া চোখ তুলে তাকাল। পানিতে চোখ ভর্তি হয়ে আছে। টুপ করে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা মাত্র। জারিফ ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
— কাদঁছো কেনো?
ফারিয়া উত্তর দিতে পারলো না। কেঁদে উঠলো। গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিশব্দে কাদছে। জারিফ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে বলল
— কাছে আসো।
ফারিয়া ধির পায়ে কাছে গিয়ে দাড়াল। জারিফ হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে বলল
— এভাবে কাদছো কেনো? কারণটা বলবে?
ফারিয়া জারিফের চোখে নিজের দৃষ্টি স্থির করলো। বলল
— ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমার খারাপ কিছু হয়ে গেছে।
জারিফ মৃদু হেসে বলল
— কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। ইনফ্যাক্ট সবাই ঠিক আছে। কারোরই কিছু হয়নি। সময় মতো ফায়ার সার্ভিস কে খবর দেয়া হয়েছিল। আর ওনারা এসেই সবাইকে বের করে। আমরা কয়েকজন উপরে আটকে ছিলাম। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
কথা শেষ করে ফারিয়ার দিকে তাকাল। সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জারিফ শান্ত হয়ে বলল
— খারাপ কিছু হয়ে গেলেও বা কি এমন ক্ষতি হতো?
ফারিয়ার দৃষ্টি আরো অসহায় হয়ে উঠলো। চোখ বেয়ে আবারও পানি গড়িয়ে পড়লো। বুকটা অজানা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। জারিফ কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো। জারিফ ফারিয়াকে আলতো করে ধরলো। আদুরে ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— আমি ঠিক আছি ফারিয়া। কিছুই হয়নি আমার। এই যে দেখো। এভাবে কেঁদোনা প্লিজ। তোমার কান্না আমার ভালো লাগেনা।
ফারিয়া থেমে গেলো। মাথা তুলে শান্ত চোখে তাকাল। অদ্ভুত দৃষ্টি তার। জারিফ তাকিয়েই আছে। ফারিয়া চোখ মুছে বলল
— তুমি ঠিক আছো তাহলে তো বাসায় যেতে পারবে এখন।
তার কথা শেষ হতেই ইভান ভেতরে ঢুকলো। বলল
— পারবে। কোন সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে।
ডাক্তারের সাথে কথা বলে তারা বের হয়ে আসলো।
————
জারিফ বিছানায় বসে আছে গোল হয়ে। দৃষ্টি তার ফারিয়ার দিকে। সে ঘরের এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছে আর তার সাথে সাথে জারিফের দৃষ্টিও ঘুরছে। ফারিয়ার আচরণ তার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগছে। হাসপাতাল থেকে আসার পর ফারিয়া হুট করেই কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলো। চোখে মুখে কোন বিরক্ত ভাব নেই। দায়িত্ব বোধটা কেমন বেড়ে গেছে। সব থেকে বড় কথা আগের মত আর রাগ করছে না। একদমই না। কিছু বললে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। তার এমন পরিবর্তন জারিফের কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে। কারণ সে এত বছর ধরে যে ফারিয়াকে চিনতো তার মধ্যে এসব কিছুই ছিল না। চোখেও পড়েনি কখনো। ফারিয়া শেষ কাপড় টা আলমারিতে গুছিয়ে রেখে কোমরে গুজা ওড়নাটা ঠিক করে নিলো। জারিফের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুচকে এলো তার। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বাইরে চলে গেলো। তারপর অল্প সময়ের ব্যবধানে ফিরে এলো এক বাটি গরম সুপ নিয়ে। ধোঁয়া ওঠা গরম স্যুপের বাটি টা নিয়ে জারিফের সামনে বসল। খুব যত্ন করে চামচে তুলে জারিফের মুখের সামনে ধরল। জারিফ নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে। বেশ অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করল না। চুপচাপ খেয়ে নিল। খাওয়া শেষ করে ফারিয়া নিজের আঁচল দিয়ে জারিফের মুখ মুছে দিল। জারিফ ফারিয়ার এই ব্যবহার দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। জারিফের এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ টা ফারিয়ার মাথায় আসলো না তাই জিজ্ঞেস করলো
— ওভাবে কি দেখছো?
জারিফ কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
— তুমি কি সুস্থ?
ফারিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাল। জারিফ আবারও বলল
— না মানে তোমার আচরণ আমার খুব বিরক্ত লাগছে ফারিয়া। আমাকে যেভাবে ট্রিট করছো আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি। আমার কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আমি সুস্থ। কিন্তু তোমাকে দেখে এবার আমার অসুস্থ মনে হচ্ছে।
এগিয়ে এসে জারিফের সামনে বসলো। শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল
— কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো। এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই।
জারিফ সহজ ভাবে বলল
— এই নাটকের মানে কি?
ফারিয়া কথাটা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল
— কিসের নাটকের কথা বলছো?
— তুমি যেসব নাটক শুরু করেছো সেসব। এতদিন এক রকম রূপ দেখেছি। আর আজ আরেক রকম দেখছি। ঠিক হজম করতে পারছি না। কি চাও তুমি?
ফারিয়া উঠে দাঁড়ালো। পানির গ্লাসটা জারিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
— আমি আসছি।
ফারিয়া বের হয়ে যাওয়ার আগেই জারিফ গম্ভীর গলায় বলল
— আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি ফারিয়া। উত্তরটা পেলাম না।
ফারিয়া ঘুরে তাকাল। মিষ্টি হেসে বলল
— তোমার সব কথার উত্তর পেয়ে যাবে। আমাকে একটু সময় দাও।
জারিফ আর কথা বলল না। ফারিয়া চলে গেল। জারিফ অনেকক্ষণ ঘরে বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হলো। ফারিয়া ঘরে এসে দেখে জারিফ বাইরে যাবে। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো
— তুমি কোথায় যাচ্ছো?
জারিফ দুই হাতে চুল ঠিক করতে করতে বলল
— বাইরে যাচ্ছি।
বলেই দরজার দিকে পা বাড়াতে গেলেই ফারিয়া সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গম্ভীর গলায় বলল
— আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না। তুমি এখন রেস্ট নেবে।
জারিফ খুব শান্ত চোখে তাকাল। বলল
— তুমি আটকাবে আমাকে? কোন অধিকারে?
ফারিয়া আরো কাছে এসে দাড়ালো। দুই হাতে জারিফের কলার চেপে ধরলো। তাদের মাঝে দূরত্ব নেই বললেই চলে। জারিফ সরু চোখে তাকাল। সে দেখতে চায় ফারিয়া কি করতে চাইছে। ফারিয়া কলার চেপে ধরে বলল
— আমি তোমার বউ। আর সব থেকে বেশি অধিকার আমার আছে। আমি চাইলেই তোমাকে আটকাতে পারি। দেখতে চাও।
জারিফ হতভম্ভ হয়ে গেলেও নিজেকে যথেষ্ট সাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল
— আমাকে আটকানোর ক্ষমতা তোমার নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট…।
জারিফ আর কথা বলতে পারলো না। কোমল অধর দুটো দখল করে নিয়েছে তার অধর যুগল। ফারিয়া ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো ঘর থেকে। সে আর কিছুতেই জারিফের সাথে চোখ মেলাতে পারবে না। এটা এখন অসম্ভব। জারিফ বরফের মতো শীতল হয়ে দাড়িয়ে আছে একই জায়গায়। এই অনুভূতিটা ক্ষণিকের হলেও শরীর আর হৃদয় জুড়ে ছেয়ে গেল। অজানা এক ভালোলাগার শুরু।
————–
পুরো শপিং মল ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এক পাশে দাঁড়ালো ঈশা। পাশেই সুন্দর একটা বসার জায়গা দেখে বসে পড়লো। সায়রা বিরক্ত হয়ে বলল
— এখানে কেনো বসলি? আমাদের কাজ শেষ হয়নি তো এখনো।
ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
— আমাকে মাফ করো চাচী। আমি ভীষন টায়ার্ড। তুমি শেষ করে আসো। আমি এখানে বসে আছি।
সায়রা গম্ভীর গলায় বলল
— তুই এখানে একা একা বসে থাকবি কেনো?
— টেনশনের কিছু নেই আন্টি। আমি আছি।
দুজনেই পাশ ফিরে তাকাল। মৃন্ময়ীর খালাতো ভাই সাকিব হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এলো। সায়রা সৌজন্য হেসে বলল
— তুমি থাকবে এখানে?
সাকিব হেসে মাথা নাড়লো। সায়রা চলে গেলো। কিন্তু ঈশা খুব বিরক্ত হলো। বিয়ের কাজকর্মের সুবাদে তাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হচ্ছে। কিন্তু সাকিবের তার প্রতি এতো কেয়ার ঈশার মোটেই ভালো লাগছে না। সেই পরিচয়ের দিন থেকেই ঈশা বুঝতে পারছে সাকিব একটু বেশিই তার খেয়াল রাখছে। সে মুখ ফিরিয়ে বসলো। সাকিব এক পাশে বসে বলল
— আপনি তো নিজের জন্য কিছুই কিনলেন না। কিছু কি পছন্দ হয়নি?
ঈশা ঘুরে তাকাল। তার চোখ মুখে বিরক্তির শেষ নেই। তবুও বাধ্য হয়ে হেসে মৃদু সরে বলল
— না হয়নি।
সাকিব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল
— এতো জিনিসের মাঝেও আপনার কিছুই পছন্দ হয়নি? এটা কি সম্ভব?
ঈশা বিরক্তকর সরে বলল
— সব অসম্ভব বিষয় গুলো আমার কাছে এসেই সম্ভব হয়।
সাকিব একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে বলল
— যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমার পছন্দের কিছু একটা আপনাকে দিতে চাই। নিলে খুব খুশি হবো।
ঈশা অবাক চোখে তাকাল। বলল
— আমি কেনো এটা নেবো?
সাকিব অমায়িক হাসলো। বলল
— বিয়ে উপলক্ষে আপনার জন্য ছোট্ট উপহার। তেমন কিছুই না।
ঈশা তীব্র আপত্তি জানাল। বলল
— ধন্যবাদ। তবে এই উপহার আমি নিতে পারবো না।মাফ করবেন।
সাকিব মন খারাপ করে বললো
— আসলে মৃন্ময়ীর আবদার ছিল এটা আমার কাছে। ও তো অফিসে। আসতে পারেনি তাই আমাকে বলেছিল আপনার জন্য আমার পছন্দে কিছু একটা কিনে নিতে। আমিও ভেবেছিলাম আপনি আপত্তি করবেন না। আপনি যখন চাইছেন না তখন আমি মৃন্ময়ী কে বলে দেবো। ভাববেন না।
ঈশা কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল
— ঠিক আছে দিন।
সাকিব হাত বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু ঈশা হাত বাড়াতেই তার হাত কেউ একজন ধরে ফেললো।
চলবে.….