মেঘবদল পর্ব-০৬

0
806

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬

ফ্যানের খটখট আওয়াজ কানে আসলো ঈশার। মনে হচ্ছে সে কিছু সময়ের জন্য গভির ঘুমে ছিল। চোখ খুলতেই ঝাপসা আভা দেখতে পেলো। চোখ বন্ধ করে পুনরায় খুলে ইভান কে পাশে বসে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো। অস্থির দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলে বুঝতে চেষ্টা করলো কোথায় আছে। সবটা মনে পড়তেই উঠে বসলো। ইভান সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছিস?

ঈশা মাথা নাড়াল। সে ঠিক আছে। ইভান আবারো জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছিল তোর?

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। বলল
–তুমি জানো আমার ডেটলের গন্ধে মাথা ঘুরায়। আমি শ্বাস নিতে পারি না।

ইভানের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। চিন্তিত চেহারায় অসহায়ত্ব ভিড় করলো। অপরাধীর মতো তাকিয়ে বলল
–সরি। আমি জানি কিন্তু মাথায় ছিল না। আসলে ঐ অবস্থায় মাথা কাজ করছিল না। তাই এতো কিছু খেয়াল করিনি।

ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–এটা নতুন কিছু না। আমার কথা কোনদিনই তোমার মাথায় ছিল না। তোমার মাথায় রাখার মতো অনেক কিছুই আছে। আমার জন্য তোমার মনে কোন জায়গা নেই।

হতাশ শ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে গেলো। ঈশার কথার ধরন আর অর্থ কোনটাই ইভান বুঝতে পারল না। কিন্তু অভিমানটা ঠিক বুঝতে পারল। ঈশা রান্না ঘরে গিয়ে আবারো কাজে লেগে পড়ল। ইভান একটু ভেবে সেও রান্না ঘরে চলে গেলো। ঈশা আবারো হাতে ছুরি ধরতেই সে হাত থেকে ছুরি নিয়ে বলল
–আমি কেটে দিচ্ছি।

ঈশা বেশ রাগ করেই বলল
–আমাকে নিয়ে তোমার এতো ভাবতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো। আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। বিরক্ত করছ তুমি আমাকে।

ইভান শান্ত ভাবে তাকাল। বেশ নরম সরে বলল
–আমাকে দেখলেই তোর মেজাজ এরকম খারাপ হয়ে যায় কেন?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে। ঈশার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ছুরিটা ঈশার গলার কাছাকাছি ধরে বলল
–সমস্যা কি তোর? কথা বলছিস না কেন?

ঈশা সরে দাড়াতে চাইলে ইভান তাকে টেনে ধরে আবারো বলল
–পুরো সমস্যা খুলে বলবি। আর খুব তাড়াতাড়ি। খুব বেশী সময় তুই পাবি না।

ইভানের এমন আচরনে ঈশা মোটেই ভয় পেলো না। কারন সে জানে আর যাই হোক ইভান তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাই ঠোট বাকিয়ে হাসল। ঈশার সেই হাসি দেখেই ইভান বুঝতে পারল যে সে তাকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না। তাই ছুরিটা রেখে ঈশাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। অনেকটা কাছে এসে বলল
–আমাকে ভয় পাস না তাই না? কিভাবে ভয় পাওয়াতে হয় সেটা আমার জানা। দেখাবো?

ইভানের আচরন বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ। কি করবে সেটা ভেবেই ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। ইভান বুঝতে পারল সে এবার ভয় পাচ্ছে। তাই আর একটু কাছাকাছি যেতেই ঈশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–কি…কিসের সমস্যা? আমার কোন সমস্যা নেই।

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–আমাকে কেন সহ্য করতে পারিস না তুই? আমি কি করেছি তোর সাথে?

শুকনো ঢোক গিলে ফেললো ঈশা। জোরে শ্বাস টেনে বলল
–সহ্য করতে পারি না কে বলেছে?

ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–এতো রাগ কেন? তোর কিসের এতো অভিমান আমার উপরে?

ঈশা অসহায় চোখে তাকাল ইভানের দিকে। চোখ ভরে এলো তার। ঠিক সেই সময় মাহমুদার ক্ষিন কণ্ঠ কানে আসতেই ঈশা চলে গেলো রান্না ঘর থেকে সেদিকে। ইভান বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ল। এভাবে সব কিছু চাপিয়ে রাখলে ইভান বুঝবে কিভাবে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হল তার। ঈশার সাথে কথা বলেও লাভ হচ্ছে না। কিভাবে সব কিছুর সমাধান হবে।

————
নিজের বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম একটা সপ্তাহ কেটে গেলো ফারিয়ার। বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। চুপচাপ বসে আছে একা ঘরে। জারিফ ব্যস্তভাবে এসে ঘরে ঢুকল। ফারিয়া ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই সে বলল
–তোমার বাবা এসেছে।

ফারিয়া মুখে হাসি ফুটে উঠলো। উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–বাবা এসেছে?

জারিফ মাথা নাড়ল। কোন কথা বলল না। ফারিয়া আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের কাপড় ঠিক করে চুল হালকা আঁচড়ে নিলো। পিছন ঘুরে জারিফের দিকে তাকিয়ে বলল
–চল বাইরে যাই।

জারিফ গভির ভাবনায় ডুবে ছিল। ফারিয়ার কথা শুনতে পেলো না। ফারিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। জারিফকে কোন কথা না বলতে দেখে কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে বলল
–কি ভাবছ?

জারিফ চমকে তাকাল। নরম কণ্ঠে বলল
–কিছু না। তুমি বাইরে যাও। আমি আসছি।

ফারিয়া চলে গেলো। জারিফকে একটু অন্যরকম মনে হলেও সে খুব একটা পাত্তা দিলো না। বাইরে গিয়ে তার বাবার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফারিয়াকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। মেয়েকে এত হাসিখুশি দেখে তার বাবার বেশ ভালো লাগলো। তারা কিছুক্ষণ কথা বলতেই জারিফ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। সোফায় বসে বলল
–তোমাদের সাথে আমার একটা কথা আছে।

সবাই জারিফের কথায় মনোযোগ দিলো। এরকম মলিন চেহারা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো সবাই। জারিফের বাবা চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–কোন সমস্যা হয়েছে কি জারিফ?

জারিফ বিচলিত হয়ে বলল
–না বাবা। তেমন কোন সমস্যা না। আসলে আমি বিয়ের আগে একটা চাকরিতে এপ্লাই করেছিলাম। বেশ ভালো চাকরি। আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।

জারিফের চাকরির কথা শুনে সবাই বেশ খুশী হল। ফারিয়ার সেদিকে কোন মনোযোগ নেই। জারিফের চাকরি হওয়া না হওয়াতে তার কোন যায় আসে না। তাই সে চুপচাপ থাকলো। জারিফের বাবা হাস্যজ্জল মুখে বললেন
–এটা তো খুবই ভালো কথা। আমরা সবাই চাই তুমি ভালো কিছু একটা করো। বিয়েটা তো হয়েই গেলো এখন একটা চাকরিও হয়ে গেলো। বাহ! আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে।

জারিফ এবার অতি নরম সরে বলল
–সে ঠিক আছে বাবা কিন্তু আমার পোস্টিং ঢাকায়। আমাকে দুই একদিনের মধ্যেই ঢাকা যেতে হবে।

জারিফের কথা শুনে এবার সবাই চিন্তিত হয়ে গেলো। চাকরি সুত্রে তাকে ঢাকা যেয়ে থাকতে হবে। আর ঢাকায় তাদের সেরকম কাছের আত্মীয় কেউ নেই। সবাই ভাবনায় ডুবে গেলো। সবার ভাবনাটা এক রকম হলেও ফারিয়ার বাবার ভাবনাটা ভিন্ন। কারন জারিফ ঢাকায় চলে গেলে ফারিয়া কোথায় থাকবে সেটা তার মাথার ব্যাথা হয়ে দাঁড়াল। তিনি চান না যে জারিফ আর ফারিয়া আলাদা থাকুক। এদিকে জারিফের ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে সব থেকে বেশী খুশী ফারিয়া। সে ভাবছে জারিফ চলে গেলে সে আর এই বাড়িতে থাকবে না। বাবার বাড়িতে চলে যাবে। আবার সেই আগের মতো জীবন যাপন করবে। কিন্তু তার সব চিন্তায় পানি ঢেলে দিয়ে ফারিয়ার বাবা গম্ভির ভাবে বললেন
–তুমি ঢাকায় গিয়ে কোথায় থাকবে সেটা নিয়ে কিছু ভেবেছ?

জারিফ হতাশ হয়ে বলল
–এখনও কিছু ভাবিনি। তবে আমার পরিচিত কয়েকজন বন্ধু আছে। গিয়ে তাদের সাথেই প্রথমে উঠবো। তারপর চাকরিতে জয়েন করে কিছুদিন পর ভাববো।

ফারিয়ার বাবা কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর জারিফের বাবার উদ্দেশ্যে বললেন
–ভাই সাহেব আমার মনে হয় জারিফের ফারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।

তার কথা শেষে পিনপতন নিরবতা চলল কিছুক্ষণ। এই কথায় সব থেকে বেশী আহত হল ফারিয়া। মনে মনে বাবার উপরে ভীষণ রাগ হল। তারপর ভাবল এখন শেষ ভরসা জারিফ। সে যদি একবার বলে এখনই ফারিয়াকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাহলেই কাজ হবে। তাই জারিফের দিকে তাকাল। আর তার ধারনা অনুযায়ী সত্যি সত্যি জারিফ বলল
–আসলে আমি নিজেই ওখানে গিয়ে কি অবস্থায় থাকবো সেটা জানি না। আর এই অবস্থায় ফারিয়াকে নিয়ে যাওয়া ঝামেলা। তাই আমি বলছিলাম কি ফারিয়া নাহয় থাকুক। আমি পরে সব ঠিক করে তাকে নিয়ে যাবো।

ফারিয়ার বাবা এমন ভাব করলেন যেন জারিফের কথা শুনতে পেলেন না। তিনি আবারো জারিফের বাবার উদেশ্যে বললেন
–আমার এক বন্ধুর বাড়ি আছে ঢাকায়। খুব কাছের বন্ধু। আমি ওর সাথে কথা বললে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর শুধু ব্যবস্থা না একদম বাড়ির মতই থাকতে পারবে তারা। কোন অসুবিধা হবে না। আপনি যদি বলেন তাহলে আমি কথা বলে দেখব?

জারিফের বাবা সস্তি পেলেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন
–আপনি যা ভালো বোঝেন। যদি এরকম সুবিধা থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। আমি আসলে এটা নিয়েই ভাবছিলাম যে দুজন দুইদিকে থাকবে বিষয়টা কেমন দেখায়।

ফারিয়ার বাবার বেশ উতফুল্ল্য কণ্ঠে বলল
–তাহলে আমি আজই কথা বলে নেবো। আর আমার বন্ধু অবশ্যই কোন ব্যবস্থা করে দেবে। জারিফ ফারিয়া তোমরা যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।

ফারিয়ার ভীষণ মন খারাপ হল। চোখ ছলছল করে উঠলো তার। এখনই গাল বেয়ে পানি পড়বে। তাই দ্রুত পায়ে সেখান থেকে ঘরে চলে এলো। সাথে সাথেই কেঁদে ফেললো সে।

————-
নাহিদ গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল তার গন্তব্যে। জ্যামে আটকে আছে সে। হঠাৎ করে রাস্তার এক পাশে ফুচকার দোকানে চোখ পড়ল তার। মৃন্ময়ী একজন ছেলের সাথে বসে কথা বলছে আর ফুচকা খাচ্ছে। বেশ হাসিখুশি দুজনেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের মাঝে সম্পর্ক বেশ ভালো। নাহিদ একবার ভাবল মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলবে। কিন্তু পরক্ষনেই তার মনে হল এভাবে আগ বাড়িয়ে তার কথা বলা মৃন্ময়ীর যদি পছন্দ না হয়। যদি অন্য কিছু ভেবে বসে। আর ছেলেটার সাথে তার সম্পর্ক কি। এমনও তো হতে পারে সে তার বয়ফ্রেন্ড! এই অবস্থায় কথা বলা শোভনীয় নয়। তাই আর সময় নষ্ট না করে নাহিদ চলে গেলো।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে