#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৫
ঈশা আর সায়রা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে নাহিদের উত্তরের জন্য। ঈশা বড় বড় চোখে নাহিদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সায়রার মনে হচ্ছে তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। নাহিদ যদি কোনভাবে না বলে দেয় তাহলে সত্যি সত্যি তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। সামনে গ্লাসটা তুলে পানি খেয়ে আবার রেখে দিলো। ভিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–তোর পছন্দ হয়নি বাবা?
নাহিদ খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–একটা মানুষকে চিনতে সারাটা জীবন পার হয়ে যায় মা। মানুষটার প্রতি অনুভূতিটা ঠিক কতটা তীব্র সেটা বুঝতে মানুষের অনেক সময় লেগে যায়। কয়েক ঘণ্টার আলাপে সেটা বুঝতে পারা অসম্ভব।
নাহিদের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারল না সায়রা। কয়েক মুহূর্ত নিরবতায় কেটে যেতেই ঈশা উত্তেজিত হয়ে বলল
–তোমার এরকম কথা বলা এখন বন্ধ রাখ ভাইয়া। এই ব্যাপারে মেয়ের বাড়ি থেকে যখন ফোন করে জিজ্ঞেস করবে যে তোমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা তখন আমরা কি বলবো?
নাহিদ পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–তোমার কথা অনুযায়ী যদি তখন বলা হয় যে কয়েক ঘণ্টার আলাপে ভালো লাগা খারাপ লাগা বোঝা সম্ভব হয় নি। আরও সময় প্রয়োজন তাহলে মেয়ের বাড়ির লোকজন কি ভাববে বুঝতে পারছ? তাই সহজ ভাবে বলে দাও তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?
নাহিদের ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা ধরেই কিছুক্ষণ কথা বলেই উঠে চলে গেলো। কথোপকথন শুনে মনে হল খুব জরুরী কাজে যাচ্ছে। কিন্তু এইদিকে ঈশা আর সায়রা খুব বিরক্ত হল। হতাশ হয়ে দুজনেই তাকিয়ে থাকলো নাহিদের দিকে। ঈশা একটু ভেবে বলল
–তুমি ভেব না চাচি। আমি তোমার ছেলের পেট থেকে কথা বের করেই ছাড়বো।
সায়রা ঈশার কথা শুনেও নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কারন তার ছেলে বরাবর এমন। কোন কথাই স্পষ্ট বলে না। এবারও যে কিছুই বলবে না সেটা সে জানে।
————–
নুরুল রহমান সকালের চায়ে চুমুক দিতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি বেশ বিরক্ত হলেন। এতো সকালে নিশ্চয় দারোয়ান কোন বার্তা নিয়ে এসেছে। গ্রাম থেকে একটা ছেলেকে এনে দারোয়ানের চাকরি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ছেলেটা অত্যন্ত বোকা। খুব তুচ্ছ বিষয়েও ছেলেটি নিজের বুদ্ধি খাটাতে পারে না। ছেলেদের এতো বোকা ভাব মানায় না। এখন তার মনে হচ্ছে তিনি ভুল করেছেন। কারন দারোয়ানের চাকরির জন্য বিচক্ষন ব্যক্তি নির্বাচন করতে হয়। যাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অতি বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তিনি দরজা খুলতে গেলেন। নুরুল সাহেব দরজা খুলতেই ঈশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন
–এতো সকালে তুই?
ঈশা অত্যন্ত নরম সুরে বলল
–তোমাদের জন্য মা খাবার পাঠিয়েছে। বড় মার নাকি শরীর খারাপ?
নুরুল সাহেব আরেকদফা অবাক হলেন। কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বললেন
–তুই কিভাবে জানলি তোর বড় মার শরীর খারাপ?
ঈশা ভেতরে ঢুকে স্যান্ডেল খুলতে খুলতে বলল
–মা ফোন করেছিল। তখন শুনেছে বড় মার প্রেসার বেড়েছে। তাই আমাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল।
তারপর নুরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার বলল
–চা কি তুমি বানিয়েছ? বড় মা কোথায়?
নুরুল সাহেব হ্যা সুচক মাথা নাড়লেন। মৃদু সরে বললেন
–ঘরে শুয়ে আছে।
ঈশা টেবিলে নাস্তা রেখে ঘরের দিকে গেল। মাহমুদা শুয়ে আছে। ঈশা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো
–বড় মা কেমন আছ এখন?
মাহমুদা চোখ মেলে তাকাল। ক্লান্ত গলায় বলল
–তুই এসেছিস?
ঈশা পাশে বসল। মাহমুদা উঠতে চাইলে ঈশা বাধা দিলো। শুয়ে দিয়ে বলল
–তোমাকে উঠতে হবে না। কি করতে হবে সেটা বল আমাকে। এখন কেমন লাগছে?
–ভালো লাগছে না রে।
ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুমি একটু ঘুমাও বড় মা। আমাকে বল কি করতে হবে।
মাহমুদা ক্লান্ত গলায় বললেন
–তোর বড় বাবা আর ইভান কে খেতে দে। ওরা বাইরে যাবে।
ঈশা মাথা নেড়ে বের হয়ে এলো ঘর থেকে। এসে দেখে ইভানের বাবা খাবার নিয়ে বসে পড়েছেন। ঈশা এগিয়ে এসে বলল
–তোমার কি লাগবে বড় বাবা?
নুরুল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন
–আমার আর কিছু লাগবে না রে মা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি তুই বরং ইভান কে খেতে দে।
ঈশা মাথা নাড়াল। নুরুল সাহেব চলে গেলেন নিজের কাজে। ঈশা রান্না ঘরে গেলো রান্না করতে। বেশ কিছুক্ষণ পর ইভান ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এসেই টেবিলে বসে গলা ছেড়ে বলল
–মা খেতে দাও।
ঈশা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকাল। ঈশাকে দেখে মুহূর্তেই তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি। রাগ আবার ভালো লাগার সংমিশ্রন। ঈশা প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে দিতেই বলল
–বড় মা অসুস্থ। প্রেসার বেড়েছে। শুয়ে আছে।
ইভান অস্থির হয়ে বলল
–মার প্রেসার বেড়েছে আমাকে বলে নি কেন?
ঈশা ইভানের কথার উত্তর না দিয়ে বলল
–এখন ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে। তোমার কি লাগবে আমাকে বল?
ঈশার কথা শুনে অদ্ভুত ভাবে ইভানের মন ভাল হয়ে গেলো। ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো ঠোটের কোনে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে চেপে গেলো। চেহারায় গাম্ভীর্যতা এনে চুপচাপ বসে থাকলো। ঈশা খাবার বেড়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভান কিছু একটা ভেবে হেসে ফেললো। ঈশাকে এভাবে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। ঈশা তার ফোন ইভানের পাশে রেখে চলে গেছে রান্না করতে। ইভান খাওয়া শুরু করতেই ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে রাতুল নাম দেখেই ইভানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ফোনটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে দিলো। ঈশা রান্না ঘর থেকে এসে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার ফোন বাজল?
–না।
ইভানের সোজা সাপটা জবাব ঈশার বিশ্বাস হল না। সে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে বলল
–আমি স্পষ্ট আমার ফোনের রিংটোন শুনতে পেয়েছি। একবার বেজেই বন্ধ হয়ে গেলো।
ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ভারি গলায় বলল
–তাহলে কি বলতে চাচ্ছিস আমি শুনতে পাই না? নাকি আমি তোর সাথে মজা করছি।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–আমি এটা কখন বললাম?
–আমি এখানে বসে আছি। ফোন বাজলে অবশ্যই শুনতে পেতাম।
ঈশা ভাবল তার মনের ভুল হতে পারে। তাই আর গুরুত্ব দিলো না চলে গেলো নিজের কাজে। ইভান বাকা হেসে নিজের খাওয়ায় মন দিলো। খাওয়া শেষ করে রান্না ঘরে গেলো। ঈশার সমস্ত মনোযোগ তার রান্নায়। তাই ইভান কে খেয়াল করলো না সে। ইভান ধির পায়ে ঈশার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। উপস্থিতি টের পেয়ে ঈশা পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি এখানে? কিছু লাগবে?
–চা খাব।
ইভান খুব সহজ ভাবে উত্তর দিলো। ঈশা পেয়াজ কাটছিল। সেদিকে তাকিয়ে বলল
–এটা শেষ করেই চা বানিয়ে দিচ্ছি।
–থাক। আমি বানাচ্ছি। তুই তোর কাজ কর।
বলেই ইভান চা বানাতে চুলা জালিয়ে দিলো। ঈশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান বলল
–এভাবে দেখার কি আছে? তোর কি ধারনা আমি কোন কাজ করতে পারি না?
ঈশা নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল
–আমি এরকম কিছু বলি নি। আমি ভাবছিলাম তোমার আজ অফিস নেই? যাবে না?
ইভান দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে বলল
–অফিসে এখন যেতে হবে না। ট্রেনিং শুরু পরশু থেকে। তারপর শেষ হলেই দেশের বাইরে চলে যাবো।
ইভানের কথা শুনে ঈশার খুব কষ্ট হল। ইভান চলে যাবে ভাবতেই চোখ ছলছল করে উঠলো। অসাবধানতায় ছুরি দিয়ে চাপ দিতেই হাত কেটে গেলো। মৃদু আর্তনাদ কানে আসতেই ইভান অস্থির হয়ে হাত ধরে ফেললো। খুব বেশী কাটেনি হালকা চামড়া উঠে গেছে। কিন্তু প্রচুর রক্ত ঝরছে। ঈশার হাতটা পানির নিচে ধরল। তারপর চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল
–এভাবে ধরে থাক। আমি আসছি।
ঈশা চেপে ধরে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই ইভান তুলা আর ডেটল নিয়ে আসলো। ডেটলের ঢাকনা খুলতেই ঈশা হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো। ভারি হয়ে উঠলো মাথা। তার এমন অবস্থা দেখে ইভান অস্থির কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে? এমন করছিস কেন?
ঈশা কথা বলতে পারল না। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। মাথাটা আচমকাই ঘুরে উঠতেই ইভানের গায়ে পুরো ভর ছেড়ে দিলো। ইভান দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডাকতে লাগলো
–ঈশা কি হয়েছে? কথা বল? খারাপ লাগছে তোর?
ততক্ষনে ঈশা সম্পূর্ণ ভাবে নিস্তেজ হয়ে গেছে। কোন জ্ঞান নেই তার। ইভানের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। হুট করে ঈশার এরকম জ্ঞান হারানর কারন কি হতে পারে। সামান্য কেটে যাওয়ার কারনে এমন হওয়ার তো কথা নয়।
চলবে……