“মেঘনাদ” পার্ট 1

0
1511

“মেঘনাদ” পার্ট 1

যে জঙ্গলটায় বসে আছি, তাতে আজ ঘন আঁধার। এমনটা নয় যে, আঁধারকে আমি ভয় করি। কিন্তু আজ কোথাও যেন ফাঁকা রয়েছে। আজ বসে থাকাটায় মজা পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত জঙ্গলটার ডানপাশে এসে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা বসে থাকি। এই জায়গায় গাছ খুব একটা বেশি নেই। আজ মনটা অহেতুকই বিচলিত হয়ে আছে। কেন যেন লাগছে, আজকের দিনটা ভিন্ন হবে। কাছে কোথাও আচমকা শেয়াল ডেকে উঠায় আমার কিছুটা ভয় হলো। না, আমাকে এই মুহূর্তে কেউই দেখতে পারবে না। আমি কাউকে ভয়ও পাই না। কিন্তু আচমকা সামান্য ডাকে ভয় কেন পেয়েছি? ভয়ের আশংকা নেই। আমি নিজের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস করি। গর্বিত এইজন্যই, কেউ এই আটটি বছরে আমার সত্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। এমনকি বর্তমান পরিবারের লোকগুলোও!
যখন একটু-আধটু আলো ফুটতে থাকে, কুয়াশার ঘনঘটা কমতে থাকে, আমি জঙ্গল থেকে বেরুই। আমি দ্রুতগতিতেই রওয়ানা দিই। না, এবারও আমার এই চলন কেউ দেখছে না। অথচ গাড়ির যাতায়াত শুরু হয়েছে। আমি এক রহস্যময় হাসি হাসলাম। মানুষগুলো জানেই না, পৃথিবীতে কত কী লুকিয়ে আছে!
তাদের অর্থাৎ আমার বর্তমান পরিবার প্রতিপত্তিশালী। সামনে এক বড় বাগান। কর্তা নিজেই ওই জায়গাটার দেখাশোনা করেন। আমি তার চোখের সামনে দিয়ে তাদের উপরের তলার আমাকে দেওয়া রুমটার খোলা জানালা গলিয়ে আমার বাতাসগুলো ঢোকালাম। এরপর বাতাসগুলো টেবিলের দিকে যায়। চট করে বাতাসগুলো আলোয় পরিণত হলো। সাথে সাথে আমি নিজের গঠনে চলে এলাম। আমি একবার আমার আঙুলের সুতাটি ঘঁষলাম। একটা সুরেলা আওয়াজ মস্তিষ্কে শোনা গেল, “ধ্রুব, আমার ছেলে, ওখানে কী এমন শান্তি পাচ্ছ বলো তো? রোজ রোজ এতগুলো বই বহন করা, কলেজে যাওয়া, সমভাবে বসে মনোযোগী ছাত্রের ন্যায় ক্লাস এটেন্ড করা, আবার বাসায় ফিরে আসা। এখানে মজার কিছু তো দেখি না।”
আমি মনে মনেই হাসলাম, “অন্তত এই জায়গাটা আকাশের মতো নয়। এখানে একেকদিন একেক রং দেখতে পাই। খুব ভালো লাগে মা।”
“নিজের খেয়াল রেখো।”
মায়ের স্বর্গীয় চেহারাটা মুছে গেল। আমি রুমে থাকা একমাত্র অ্যাকুরিয়ামটির দিকে তাকিয়ে হাসলাম, বিড়বিড় করলাম, অন্তত কারও অহেতুক রাগের শিকার আমার কাছে ভূমিতে হতে হয় না।
আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচে গিয়ে জিসানের জন্য দাঁড়ালাম। সে এখনও ব্রেকফাস্ট সারেনি। আর আমি! সবাইকে বলে রেখেছি, কেউ ঘুম থেকে উঠার আগেই ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলি। কিন্তু আদৌ কেউ জানে না, জিসানের একমাত্র পোষা কুকুর টমি প্রতিদিন সকালে কিছু খেতে চায় না কেন। কেউ জানে না, তার পেট আমার ভাগের খাবারে আগে থেকেই পরিপূর্ণ থাকে।
ড্রাইভার পলাশ ভাই গাড়ি বের করলে আমি আর জিসান উঠে পড়ি। নিত্যদিনের মতো কলেজে গেলাম। আজ ক্লাসমেট আসিয়ার পাশে একটি নতুন মেয়েকে দেখছি। বাকি ক্লাসমেটের চিন্তা পড়ে বুঝলাম, নতুনই জয়েন হয়েছে। রীতিমতো আসিয়ার ন্যায় সেও ইতোমধ্যে ক্লাসে পপুলার হয়ে গেছে। কেন হবে না? দুইজনই যে বড়লোক আসগর সাহেবের মেয়ে! এবং দেখতে-শুনতে আকর্ষণীয়ও বটে! লোকটি বাবার মতোই এখানের ধনী ব্যক্তিবর্গের লিস্টে। আলিয়াকে আসিয়া মেয়েদের সাথে ক্লাসে পরিচয় করিয়ে দেয়। ছুটির শেষে সে ছেলেদের সাথে আলিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিতে যায়। আমার কারও সাথে পরিচিত হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুত্ব-পরিচয় হওয়া ছাড়াই যেভাবে সবাইকে চিনেছি, আলিয়াকেও সেভাবে চেনে ফেলব। যখন ছেলেরা দল বেঁধে তাদের দু’জনের সামনে দাঁড়িয়েছিল, তখন আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের ক্লাসের দুষ্টু ছেলে সাঈদ ভাবছে, “ওয়াও, কি অপূর্ব মেয়েটি!” আমি হাসলাম। সে কুৎসিতকেও অনেক সময় অপূর্ব বলে। সাঈদের কথায় তাকিয়ে দেখলাম, আলিয়া সত্যিই অপূর্ব। ওর সাথে আমার চোখাচোখি হয়। মেয়েটি কী যেন ভাবছে। কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছি না, ওর মস্তিষ্ককে কেন পড়তে পারছি না। তার পাশে থাকা আসিয়ার মস্তিষ্ক খুব সহজভাবে পড়তে পারছি। সে ভাবছে, “বাহ্! ধ্রুব দেখি পরিচিত হওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে। এটা আমি আশা করিনি। নট বেড।”
কিন্তু নতুন এই মেয়েটি.. আলিয়া কী ভাবছে? তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ছেলেরা তার সাথে হ্যান্ডশেকের পর্ব শেষ করে চলে গেল, বুঝতে পারিনি। আমিই হাত পকেটে রেখে কলেজে একা রয়ে গেলাম, দুটো মেয়ের সাথে। আসিয়া এখনও ভাবছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি আলিয়ার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। তারা যখন মুখোমুখি হয়, তখনও আমি আলিয়ার মস্তিষ্ককে পড়ার চেষ্টা করলাম। সে আমার দিকে ভ্রূ কুঞ্চিত করে কেন চেয়ে আছে? হাসতে গিয়েও কেন হাসছে না? কিছুই না বুঝে আমি হতাশ হই। এমনটা এই পর্যন্ত কোনোবার হয়নি।
‘ও ধ্রুব।’ আসিয়া গলা খাঁকার দিয়ে রসিকতা করে বলল, ‘সবসময় ধ্রুবই থাকে।’
আর সে কেন এটা বলেছে, তা আমি তার মস্তিষ্ক পড়ে বুঝেছি।
আসিয়া আলিয়াকে বলল, ‘মানে ও মেয়েদের ব্যাপারে সবসময় একই থাকে। আজ পর্যন্ত মেয়েদের ফ্রেন্ড বানায়নি।’ সত্য.. একদম খাঁটি সত্য। ‘ইউ নো, ফিজিক্স ম্যামও ওকে কন্সটেন্ট বলে ডাকে, সবসময় একই অবস্থায় থাকায়। এক জায়গা থেকে সহজে নড়ে না। নিয়মিত ক্লাসও করে। ভদ্র একটা ছেলে।’ হ্যাঁ, ভর্তির শুরুতে আমার কাঠির ন্যায় সোজা গড়নে বসে থাকা নিয়ে সকলে হাসাহাসি করত। পরে আমার মেধার পরিচয় পেয়ে কেউ আমার ব্যাপারে উল্টাপাল্টা ভাবতে যায়নি। এখন সবাই আমাকে অতিমাত্রায় ভদ্র ভাবে।
আসিয়া আমাকে বলল, ‘ও আলিয়া সিকদার। আ.. আমার… বোন।’
আলিয়া নামটা সবার মুখে শুনেছি। কিন্তু সিকদার? বোন হলে সিকদার কেন হবে? আসিয়ার শেষের নাম তো আসগর। আগ্রহ দেখালাম, ‘বোন? সিকদার?’
‘আমার বাবার প্রথম স্ত্রীর মেয়ে।’ তার কথাগুলো মুখ থেকে বেরুনোর আগে থেকেই তার মস্তিষ্ক পড়ার মাধ্যমে আমি জেনে ফেলছি, ও এখন কী বলতে যাবে। ‘আমার বাবার প্রথম স্ত্রীর মেয়ে। আমাদের দু’জনের বয়সে একমাসেরই ডিফারেন্স।’ বোধই হয়।
হেসে বললাম, ‘তোমাদের চেহারায় সিমিলারিটি কিছুটা আছে বলা যায়।’
আমি লক্ষ করলাম, আলিয়া একটা কথাও বলেনি, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে এবং আমাকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কী ভাবছে সে? আমি দ্বিধাবোধ করতে লাগলাম। ও আমার রূপের অবিশ্বাস্য কিছু নিয়ে ভাবছে না তো? এটাই স্বাভাবিক, যে মানুষই আমাকে প্রথম দেখেছে, সে সর্বপ্রথম আমার রূপ নিয়ে ভেবেছে। কিন্তু আলিয়া কেবল ভাবছেই না, আমার লাগছে, ও এর পেছনের তত্ত্ব বের করার চেষ্টা করছে। এটা কিন্তু আমার জন্য খুবই ক্ষতিকর। ভূমিতে থাকা আমার জন্য আরও দুঃসাধ্যকর হয়ে পড়বে। কেউ যদি আমার রূপের রহস্য বের করে ফেলতে পারে, তবে শীঘ্রই আমাকে আমার ভুবনে ফিরে যেতে হবে। কারণ যদি সর্দার জেনে ফেলতে পারেন, কেউ একজন আমার সম্বন্ধে জেনে ফেলতে পেরেছে, তবে তিনি নিজেই এসে আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে নিয়ম ভঙ্গের কারণে নিয়ে যেতে পারেন। এমনটা হলে আমি আর কখনও পৃথিবীর ভূমিতে আসতে পারব। কখনও এই রঙিন মানুষকে আর দেখতে পারব না। আমি যেহেতু মেয়েটির মস্তিষ্ককে জানতে পারছি না, সেহেতু আমাকে জানতে হবে মেয়েটির ব্যাপারে। কে সে? কেমন মেয়ে?

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

আমি আর কিছু বলছি না দেখে আসিয়া ওকে টেনে গেইটের কাছে নিয়ে গেল। আমি একা হয়ে পড়লাম। আমাকে একা পেয়ে যদি আলিয়া কিছু জিজ্ঞেস করে বসে? আমি তড়িঘড়ি করে আমার ভারকে হালকা করলাম। এতই হালকা করলাম যে, আমি বায়ুর সাথে বাতাসের ন্যায় মিশে গেছি। এভাবে আমি সাধারণ মানুষের তুলনায় খুব দ্রুত চলতে পারি। এতই দ্রুত চলতে পারি যে, আলিয়ারা গেইটের কাছে পৌঁছার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। তারা আরেক পা ফেলে গেইটের কাছে পৌঁছলে আমি গেইটের কাছে পৌঁছে গেলাম। যেই আমি অদৃশ্য অবস্থায় আলিয়াকে অতিক্রম করে গেইটের বাইরে রাস্তায় চলে এলাম, আলিয়া ঘুরে পেছনে বারান্দার দিকে তাকাল। ইশ! মারাত্মক একটা ভুল করে বসেছি। সে সম্ভবত আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার কথা ভাবেনি, কেবল আমাকে একবার দেখতে চেয়েছিল। আমি সহজভাবে ওর মুখোমুখি হতে পারতাম। তা না করে, আমি অদৃশ্য হওয়ার মতো অনেক বড় একটা ভুল করেছি। ও যদি গেইটে আসা অবধি আমার কথা না ভাবে, তবে হয়তো আমার উধাও হয়ে যাওয়ার কথা খেয়াল করেনি। না.. আমার ভয় হতে শুরু করল। কারণ আসিয়া তাদের গাড়িতে উঠে গেছে। আলিয়া তখনও গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেকেন্ড কলেজকে দেখল। আমার ভুলটা আমাকে শুধরাতে হবে। আমার কাছে জানতে হবে, ও কোনোকিছু নিয়ে সন্দেহ করেছে কিনা। যদি করে থাকে, তবে সেই সন্দেহ দূর করতে হবে। কিন্তু এটা সঠিক সময় নয়। সে ইতোমধ্যে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ফেলেছে। আমাকে দেখেনি। এই সময় জনসমক্ষে দৃশ্যমান হয়ে ওর কাছে যাওয়া বড্ড বোকামো হবে।
আমি জিসানের অপেক্ষা না করেই বাসায় চলে এলাম। আজকের দিনটা খুব খুব খারাপ। একটি মেয়ে হয়তো আমাকে সন্দেহ করেছে। এই আট বছরে এই প্রথমবার। আমি কিনা মিথ্যা বলতে পারি না। কি যে হবে! আমার কাছে মেয়েটির গতিবিধি লক্ষ করতে হবে। সারাটা রাত টেনশনে কেটে গেল। প্রতিদিন চারটায় ঘুম ভেঙে গেলে জঙ্গলে যাই। আজ চিন্তায় ঘুমাতে দেরি হওয়ায় বাইরে যাওয়া হলো না।
আজ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসটা আমি আলিয়ার মানসিকতা আন্দাজ করার জন্য নীরবে করলাম। শুরুতেই ওর সাথে কথা বলতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আগে দেখতে হবে, ও আমাকে নিয়ে আদৌ ভাবছে কিনা। ভাবলে.. এটাই নিশ্চিত যে, মেয়েটিকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু সে আমার দিকে তেমন তাকায়নি। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে তার সাথে কথা বলার পরিকল্পনা বাতিল করে আইসিটি ক্লাসে গেলাম। আজকে স্যার সি প্রোগ্রামিং বোঝাবেন। আমার কাছে এটেনটিভ থাকতে হবে। আমি রীতিমতো ক্লাসে অনেক মনোযোগী ছিলাম। আমি এতই মনোযোগী যে, আশেপাশে আমাকে নিয়ে কে কী ভাবে তা ভাবতে যাই না। কারণ ভাবার অনেক সময় ক্লাসের বাইরে পাব। একসময় আবির স্যার তার লেকচার বন্ধ করে একটি মেয়ের দিকে তাকালেন। আমি তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আর কারো তাকানোর আগেই তাকিয়ে দেখলাম, আলিয়ার কপালের দিকে স্যার মার্কারের ঢাকনা ছুঁড়ে মেরেছেন। সন্দেহ হলো, মেয়েটি কি এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিল? আলিয়ার গাল তখন লাল দেখাল। মেয়েটি লজ্জা পেলে তাকে খুব সুন্দর দেখায়, ঠিক মায়ের মতো। তখন আমার সামনে মায়ের হাত বাবা ধরলে মা লজ্জায় মাথা নিচু করতেন, আলিয়া এখন যেমনটা করেছে।
আর দেরি করলে চলবে না। মেয়েরা অতিরিক্ত আড্ডাপ্রিয়। যদি আমার কথা সে এদিক-ওদিক ছড়ায়! মেয়েটির সাথে এখনই কথা বলতে হবে। ক্লাস শেষে আমি তড়িঘড়ি করে বেরুলাম। সে তখন আবির স্যারের সাথে কথা বলছিল। স্যারের মস্তিষ্ক পড়ে বুঝলাম, আলিয়া সত্যিই তখন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তার সাথে কথা বলার প্রস্তুতি নিই। তার সাথে ফ্রেন্ডলি আচরণ করতে হবে, যাতে তার সম্বন্ধে জানতে পারি। আমি যতটুকু পারি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করব, যাতে আমার অস্বাভাবিকতা নিয়ে এই মেয়েটি না ভাবে। স্যারের সাথে মেয়েটির কথা বলার ধরন দেখে বুঝলাম, সেও পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেকটা এটেনটিভ। যারা পড়াশোনায় এটেনটিভ, তারা একটু কমই আড্ডাবাজ হয়। একটু স্বস্তি পেলাম। আবির স্যার চলে গেলে আমি ক্লাসের বাইরে এসে কথা বলার জন্য ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম। ধ্যাৎ! ও আবারও আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এভাবে একটি মেয়ে তাকালে, যে কেউ ভাববে মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু এমনটা নয়, আমি স্পষ্ট বুঝছি, ওর ভ্রূজোড়া মৃদুভাবে নড়ছে। পছন্দের ইঙ্গিত নয়!
আমি কথোপকথন শুরু করলাম, ‘উমম.. হাই।’
‘হ-হ্যালো।’ ও হয়তো আমার এভাবে কথা বলতে আসাটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে।
‘ইজ এনিথিং রং?’ প্লিজ, বলো। জানা খুবই জরুরি।
সে ঠোঁট কামড়াল, ‘না। তুমি জানো, তুমি পুরাই একটা মেইল মডেলের মতো?’
ওহ্.. ভাগ্যিস। ও এতক্ষণ আমার রূপের কথাই ভাবছে। কিন্তু যদি ওর এই কথার পেছনে অন্য কোনো কথাও লুকিয়ে থাকে? কী চলছে এই মেয়ের মস্তিষ্কে? আমি সহজ হওয়ার চেষ্টা করে হাসলাম। আমরা হাঁটতে লাগলাম। ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে স্বর নিচু করে বললাম, ‘আমার ভাইয়া বলেছে, আমার মডেলিং-এর পথে যাওয়া উচিত।’
‘হুম.. পারবে তো। তোমার বয়স কত?’ মডেল হওয়ার জন্য কি বয়স লাগে?
‘আঠারোতে পড়লাম।’
সে অবাক হয়, ‘তোমাকে দেখে বিশ-বাইশ প্লাস মনে করেছি।’ আহ্, সবাই কেন একই ভুল করে? তবে বাকিরা আমায় চব্বিশ প্লাস ভাবলেও, আমার বয়স আঠারো। কয়েক মাস পর আমার গড়ন শেষ। আমি সবসময় এখনের মতোই থাকব। ভেবে আমি হাসলাম, আমি কখনও বয়স্ক হব না।
কবে আমি মানুষের ন্যায় সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারব? এইবারও সত্য না বলে পারলাম না। ‘আমার পরিবারের লোকের শারীরিক বৃদ্ধিই এমন।’ হ্যাঁ, আমাদের ভুবনে সবাই লম্বা। বয়স অনুযায়ী সবার একই সাইজ। মানুষের ন্যায় বয়স সাপেক্ষে কেউ লম্বা, কেউ খাটো নয়। ‘তুমিও কিন্তু কম লম্বা নও।’ ভেবে হাসলাম, বিজলী ওর সমবয়সী। মেয়েটির উচ্চতা হয়তো বিজলীরই সমান হবে।
‘তোমার সমবয়সী হওয়া সাপেক্ষে আমার আরেকটু লম্বা হওয়া উচিত ছিল।’
মেয়েটি বোকা। দু’জন সমবয়সী হলেও, ছেলেরা সর্বদা মেয়েদের চেয়ে লম্বাই থাকবে। আমি আবারও হাসলাম, ‘মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই ছেলেদের চেয়ে খাটো হয়। এতে তোমার দোষ নেই।’
আমি আর কথা বলতে পারলাম না, আলিয়ার অঙ্গভঙ্গি দেখে। সে হঠাৎ সজাগ হয়ে গেছে, যেন কোনো এলার্ম বেজেছে।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় দু’জনই নীরব ছিলাম। বারান্দায় যাওয়ার পর আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। আমি করব করব করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘তোমার কি রক্তের প্রতি দুর্বলতা আছে? মানে.. তুমি কি রক্তকে ভয় পাও?’
আচমকা সে আমার এমন প্রশ্ন শোনে আমতা আমতা করল, ‘না তো। কেন?’
সত্য বলছে তো? ও কথাটা বলার অনুভব করে বলেছে। হ্যাঁ, ও সত্যই বলছে। কিন্তু কী করে সম্ভব? আমি দেখে এসেছি, যারা সাধারণত রক্তকে ভয় পায়, তাদের মস্তিষ্ক দুর্বল হয়। আর এই দুর্বল মস্তিষ্ক আমি পড়তে পারি না। তবে পড়তে না পারলেও, উক্ত মানুষের অঙ্গভঙ্গি দেখে তার ভাবনার সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করে ফেলতে পারি। কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললাম, ‘না কিছু না।’
আসিয়ার ডাকে আলিয়া পেছনে ফিরল। এই ফাঁকে আমি আমার চিন্তা ধরা পড়তে না দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি চলে গেলাম। যত দ্রুত পারি, মানুষের ন্যায় হেঁটে অন্য ভবনে চলে এলাম। জিসানেরও এইমাত্র ক্লাস শেষ হয়েছে। ও বন্ধুদের বিদায় দিচ্ছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভেতরের উদ্বিগ্নতাকে যতটুকু সম্ভবত দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু যেই এই ভবনের দিকে আলিয়া এবং আসিয়াকে আসতে দেখলাম, আমার মাথায় সেই পুরনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব শুরু হলো। এই মেয়েটি কি আমার পিছু ছাড়বে? আর সে কী ভাবছে? রক্ত নিয়ে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটা ওকে বিচলিত করেনি তো? আমার জানতেই হবে ওর মনের কথা। তার কেবল একটাই উপায়।
খেয়াল করিনি, কেন আসিয়া চলে গেছে। সুন্দর একটা সুযোগ পেয়ে আমি আলিয়ার কাছে যাব, তার আগেই সে আমার কাছে তেড়ে এলো। এটারই ভয় ছিল। সে হয়তো এখন এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে, যেটার উত্তর আমি দিতে চাই না। কারণ আমি মিথ্যা বলতেই জানি না। ও আসার সাথে সাথে ওকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে ওর হাতটা আমার হাতের তালুয় নিলাম। চোখ বন্ধ করে ও হাতের শিরার মাধ্যমে তার মস্তিষ্কের সাথে সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করলাম। কারো মস্তিষ্ক চোখ দেখে পড়তে না পারলে এটিই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ওর শরীরের প্রতিটি উদ্দিপনা আমি অনুভব করতে পারছি। ওর রক্ত চলাচল, ওর কম্পন, ওর উত্তেজিত মস্তিষ্ক, ওর হৃদস্পন্দন সবকিছুই আমি অনুভব করতে পারছি। কিন্তু আসল কাজটা আমি করতে পারছি না। আমি ওর মস্তিষ্কের সাথে কমিউনিকেট করতে পারছি না। ওর মস্তিষ্কের কথাগুলো পড়তে পারছি না। কী আছে ওর মাইন্ডে? কী ভাবছে সে? এই পদ্ধতিতে সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। মায়ের সূত্রে পাওয়া আমার এই শক্তি কাজে কেন আসছে না? জীবনে কখনও এতটা অসফল, এতটা ব্যর্থ হইনি। আমি ওর হাত ছেড়ে দিলাম। এখন আর কোনো পথ নেই। হাত ধরার অধ্যায়টার পর থেকে সে অন্তত চুপ থাকবে না। গেলাম আমি! দুই-কূল থেকে আমার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। মেয়েটি যদি কাউকে এই অস্বাভাবিক কাজগুলোর কথা বলে, কেউ যদি আমাকে পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে সত্যটা বের করে তবে ভূমিতে থাকা আর সম্ভব হবে না। যদি মারাত্মক কিছু ঘটে যায়, তবে আমাকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। নয়টি বছর আমি আমার মতো করে স্বাধীনভাবে চলতে পেরেছি। বিগত মাত্র দুইটি দিনে মেয়েটির আসার কারণে আমার জীবনে বিপদ নেমে আসার সংকেত দেখছি। কেউই মরনকে পছন্দ করে না।
আমি এক মুহূর্তও তার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে জিসানের জন্য আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লাম। কারণ মেয়েটি এখন যে প্রশ্নগুলো করবে, তার মিথ্যা উত্তর আমি দিতে পারব না। বলতে পারব না, আমি মানুষ নই। তাই পালালাম।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার