#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৮)
“অনুভব, তুমি আমায় এভাবে কল করে জেরা করো কেন বলো তো?”
“এটি পুরো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার সায়রা। আমি কাকে কল করব, না করব এটি নিশ্চয়ই তোমাকে বলব না।”
“সেটি তোমার ব্যক্তিগত তখন হতো যখন তুমি যাকে কল করেছ, সেই ব্যক্তিটা আমি না হতাম।”
কথাটি মন দিয়ে শুনল অনুভব। সায়রা এপাশ থেকে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ছাড়ল।
“কল কেন করেছ?”
“জব কেন ছাড়লে?”
“সেটা তুমি জানো।”
“না, জানি না আমি। বলো জব কেন ছাড়লে?”
“এটি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। তোমায় কেন জানাতে হবে?”
অনুভব বুঝল, সায়রা তার কথাটাই ফিরিয়ে দিল। একই ভাবে অনুভব বলল,”বিষয়টা তখন তোমার ব্যক্তিগত হতো, যদি না কোম্পানির সাথে আমি জড়িত থাকতাম।”
“আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিলে?”
“একটু আগে তুমিও সেটা করেছ।”
সায়রা চুপ হয়ে গেল। অনুভব কিছু সময় পূর্বে জেনেছে সায়রা জবটা ছেড়ে দিয়েছে। অথচ মাত্র দু সপ্তাহ হয়েছে সে জয়েন করেছিল।
“সায়রা, আমাকে এতটাই অসহ্য লাগে তোমার?”
“এখানে অসহ্য লাগার কোনো বিষয় নেই অনুভব।”
“তবে?”
“তুমি ইচ্ছে করে জবটা আমার কাছে এনে দিয়েছিলে। তাই না?”
অনুভব কথা বলল না। সায়রা ঠিক ধরেছে। অনুভব ইচ্ছে করেই লোক দিয়ে সায়রার কাছে জবের অফার রেখেছিল। যাতে করে মেয়েটার সান্নিধ্য মিলে। ভালো টাকার অফার দেখে সায়রা ও রাজি হয়ে যায়। অথচ তখনই মাথায় আসে নি, কোনো রকম শর্ত ছাড়া কীভাবে কাউকে জবে নেওয়া হয়। ফোঁস করে দম ফেলল অনুভব। ফোনের এপাশে থাকা নারীটি বলে ওঠল,”সময়টা পেরিয়ে গেছে অনুভব।”
“অথচ আমি সেই ছয় বছর আগেই আটকে আছি।”
কথাটার সাথে কি,ব্যথা মিশে আছে? সায়রার কেন যেন মনে হয় ছেলেটার হৃদয়ে অনেকটা ব্যথা জমে আছে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয়। অথচ সে জীবনে বড়ো ঝড় পেরিয়ে এসেছে। জুথির বাবা বাড়ি থেকে হওয়া অশান্তিটুকু সায়রার জীবনটাই বদলে দিল। জুথির আচরণ ও তখনই কেমন মিইয়ে গিয়েছিল। পারিবারিক অশান্তিতে ঝিমিয়ে গিয়েছিল সকলে। আর তারপর বাহাদুরের আক্রমণ। আমিরাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় সায়রা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে ক্ষত হয়েছিল দেহ। সবটা স্মরণ হলেই সায়রার বুক কেঁপে ওঠে। অনুভবের প্রতি অনুভূতি জন্মানোর সুযোগ ই মিলে নি। তবে এটা সত্য যে চাইলেই ছেলেটার থেকে অনেক রকম সাহায্য নিতে পারত ও। কিন্তু সেটি অন্যায় হতো। সায়রা চায় নি ছেলেটার সাথে ওমন অন্যায় করতে। আর তারপর যখন সুযোগ মিলল, তখনই দেশ ছেড়ে গেল ও। অনেকটা দ্রুত ঘটেছিল সবটা। সেই ছোট্ট সময়টুকু সায়রার জীবনটাই বদলে দিল।
জাফরিনের যাওয়ার সময় হয়েছে। এতদিন থাকল সে। পরিবারটা ওর বড়ো আপন মনে হয়। তবে এক বুক কষ্ট নিয়ে সে বিদায় জানাল। সব থেকে কষ্টের বিষয় হলো কোথাও মাহিমকে দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটা বিদায় বেলায় দেখা দিল না। জাফরিন নিজের কান্না আটকিয়ে রেখেছে। গাড়ি চলছে। দূরত্ব বাড়ছে। জাফরিনের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে গাড়ি এয়ারপোর্টে এসে থামল। ব্যাগ পত্র নিয়ে নামল জাফরিন। আর তারপর এগিয়ে যেতে লাগল। এদিকে মাহিম আগে থেকেই এয়ারপোর্টে অবস্থান করছে। ওর ভেতরটা ভীষণ তপ্ত হয়ে আছে। রাগ, অভিমান থেকে মেয়েটিকে বিদায় জানাবে না ভেবেছিল। তবে পারল না। মেয়েটিকে দেখার লোভ ওকে টেনে নিয়ে এল।
মাহিম কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পা থেমে গেল জাফরিনের। ছেলেটা এগিয়ে এল। বিধ্বস্ত মুখখানি। এ নাকি ডাক্তার! জাফরিনের হাসি পেল। চোখের কান্নাটা দমিয়ে রেখে বলল,”তোমাকে পাগল লাগছে মাহিম। ডাক্তার ছেলেকে এভাবে মানায় না।”
“তাতে তোমার কী জাফরিন? তুমি তো পছন্দ করো না আমায়।”
জাফরিন উত্তর না দিয়ে সরল চোখে তাকাল। নিজেকে আটকে রাখতে ব্যর্থ হলো মাহিম। চারপাশের মানুষজনকে অবজ্ঞা করে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। উষ্ণতা পেয়ে জাফরিনের গাল বেয়ে এক বিন্দু অশ্রু নেমে গেল। মাহিম ভাঙা গলায় বলল,”অপেক্ষা করব জাফরিন। আমি জানি ফিরবে তুমি। ফিরবে তুমি জাফরিন।”
কি এক দায় থেকেই ছেলেটার পিঠে হাত রাখল জাফরিন। কান্না আটকে বলল,”সময় হয়ে গেছে। যাচ্ছি আমি। নিজের যত্ন নিও ডাক্তার। তোমাকে এমন বিষণ্ন মানাচ্ছে না।”
আর তারপরই চলে গেল জাফরিন। সে দিকে তাকিয়ে থেকে মাহিমের দু চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। হয়তো জাফরিন ফিরবে, কিংবা ফিরবে না। তবু আশায় থাকবে মাহিম। নিজের ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায়।
মাহিম ফিরল একটু রাত করে। সায়রা তখনো ঘুমোয় নি। সে অপেক্ষা করছিল। মাহিমের সাথে চোখাচোখি হলো।
“সাথে চল।”
কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সাথে গেল মাহিম। ওরা ছাদে এসে দাঁড়াল। আকাশ মেঘলা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।
“অনেক বড়ো হয়েছিস মাহিম। সবটা বোঝার মতন বোধ আছে জানি। আমার জীবন সম্পর্কে সবটাই তোর জানা। কত গুলো দুঃখ সয়ে আজও আমি এখানে দাঁড়িয়ে।”
“পিপি, তুমি আমিরার জন্য অনেক কিছু সেক্রিফাইজ করেছ। কিন্তু আমি কার জন্য করব?”
“নিজের জন্য। নিজের জন্য করতে হবে। জাফরিন যদি ফিরে আসে, তবে সবথেকে বেশি খুশি আমি হব। তবে মাহিম, বিপরীত জিনিসটাও ভাবতে হবে। নিজেকে ভে ঙে ফেলা আসলেই ঠিক নয়।”
মাহিম মৌন হয়ে রইল। তার ভেতরটা ক্ষত হচ্ছে শুধু। আলগোছে ওর গাল ছুঁয়ে দিল সায়রা। বয়সের তুলনায় ওর ম্যাচিউরিটি একটু বেশি।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে কি? করে না বোধহয়। সায়রা নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। আজ তাদের বাসায় মেহমান আসবে। এটি সে জানত না। শরীরটা কেমন মেজমেজ করায় ঘরে ছিল। আমিরা এসে দরজায় নক করল।
“মিমি, বসে আছ কেন? বাড়িতে মেহমান এসেছে।”
“কারা এসেছে রে?”
“জুহাদ মামা’রা এসেছে।”
জুহাদের কথাটি শুনে একটুখানি অন্ধকার ছুঁয়ে গেল সায়রার মুখখানি। সে অতীতের কথা স্মরণ করলেই কষ্ট পায়।
“আর কে,কে এসেছে?”
“ওনাদের বাড়ির সবাই এসেছে।”
সায়রা চটপট ওঠে দাঁড়াল। নিজেকে পরিপাটি করে বের হলো। বসার ঘরে তখন নাশতার আয়োজন করা হচ্ছে। জুথি প্রচণ্ড ব্যস্ত। ওর সাথে সাহায্য করতে লাগল সায়রা।
“ভাবি, একটা কথা বলব?”
“জানি কি বলবি। ওসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এখন সব ঠিক আছে। আমিরার প্রতি তাদের কোনো বাজে মনোভাব ও নেই।”
সায়রা বুঝে নিয়ে কাজে সাহায্য করতে লাগল। বসার ঘরের সবার মুখ হাসিতে ভরে গেছে। সবাইকে বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে। বিষয়টা সায়রার মনকে প্রশমিত করল।
আজ সবাই থেকে গেল। তাই আড্ডা দিতে দিতে বেশ রাত হয়ে গেছে। সায়রার চোখটায় ঘুম ঘুম ভাব। ও সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে ফিরল। এসে দেখল অনেক গুলো কল। অনুভবের নাম্বার থেকে। অন্য কেউ হলে সায়রা দিন অবধি অপেক্ষা করত। তবে অনুভব হওয়াতে সে চট করেই নাম্বারটি তে কল করল। রিসিভ ও হলো চটপট।
“সায়রা, সায়রা, এত ব্যস্ত তুমি! কল রিসিভ ও করছিলে না।”
অনুভবের কণ্ঠে উদ্বেগ। সায়রা স্থির গলায় বলল,”এভাবে কেন কথা বলছ?”
“তাহলে কীভাবে বলব বলো।”
কথাটা বলে অনুভব যেন বুক ভরে সমীরণ টেনে নিল। তারপর দুঃখের মতন করে বলল,”আমি কখনো সিগারেট খাই নি সায়রা। মদ ছুঁয়েও দেখি নি। তোমার প্রত্যাখ্যান, অবহেলা সব কিছুর পর ও আমি অন্য কোনো নেশায় নিজেকে ডুবাতে পারি নি। তোমার প্রতি আমার যে নেশা,সেটা পৃথিবীর সব নেশাকেও হার মানায় সায়রা। আমার কোনো জোর নেই। তুমি অন্য কারো হয়ে গেলেও আমি বাঁধা দিব না। তবে তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারব না। সায়রা, তোমাকে পাই বা নাই, আজীবন ভালোবাসাই হবে আমার এক মাত্র লক্ষ্য।”
চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি