#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৬)
জুথির বাবা বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। ওর বড়ো ভাই জুহাদের আবার সন্তান হয়েছে। অনেকদিন ধরেই বাবার বাড়িতে যাওয়া হয় না। তাই এবার বেশ কিছুদিন থাকবে বলে ঠিক করেছে। এদিকে সায়রাও ব্যস্ত। মেয়েটির সময় হচ্ছে না। ও যখন টিউশনি করিয়ে ফিরল তখন সবাই বসার ঘরে বসে আছে। চা পান চলছে। সায়রাকে দেখে বলল,”এসেছিস?”
“হ্যাঁ ভাবি। সবাই কী আলোচনা করছ?”
“জুহাদ ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে। সবাইকে যেতে বলেছে।”
আমিরা চা পান করছে। সেই সাথে টিভিতে কার্টুন দেখছে। সায়রা জবাব নিচু রেখে বলল,”ভাবি, এখন কীভাবে যাব?”
“কিছু হবে না। তুই এত ভাবিস না।”
“তবু আমার….”
“আমি বলছি কিছু হবে না।”
অনেক কথার মাঝে সায়রা রাজি হয়ে গেল। পরেরদিন ই জুথির বাবার বাড়িতে গেল ওরা। আয়োজনের কোনো ক্রুটি নেই। তবে এক পর্যায়ে পাশের বাড়ি থেকে একজন বলে ওঠল,”জুহাদের মেয়ের সাথে আমিরার চেহারার বেশ মিল। দেখলে মনে হচ্ছে দু বোন।”
কথাটা একদম পিঞ্চ করে বলা। সায়রার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠল। জুথি কথা কাটিয়ে বলল,”আরে তেমন কিছুই না। বাবু তো এখনো ছোট। চেহারার মিল বোঝা যায় নাকি।”
কথাটা এখানে থেমে গেলেও জুহাদের বউ রাবেয়া প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলো। সে জুহাদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলল। ঝগড়াটা সামান্য থেকে ভয়াবহ রূপ নিল। রাগে আক্রোশে জুহাদের শক্ত হাতটি রাবেয়ার গাল ছুঁয়ে গেল। হতভম্ব সকলে। সায়রা বিষয়টি মানতে পারল না। ও তৎক্ষণাৎ আমিরাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
জুহাদ মাথা চেপে আছে। ওর মস্তিষ্কের ঠিক নেই। বার বার একই কলঙ্ক শুনে সে বিরক্ত। রাবেয়া কান্নাকাটি করে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। জুহাদ ফোঁস করে দম ফেলে। ওঠে এসে রাবেয়ার পাশে বসে।
“রাবেয়া, আমায় ক্ষমা করো।”
রাবেয়া কাঁদছে। সে মানতে পারে না এসব। জুহাদ ওর হাতটি ধরে।
“মাথার ঠিক ছিল না। তাই ওভাবে থা প্প ড় দিয়ে ফেলেছি।”
ঘর ভরা মানুষের সামনে থা প্প ড় দিয়েছে জুহাদ। স্মরণ হতেই রাবেয়ার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে। ও আক্রোশ থামাতে পারে না।
“কথা বলবে না তুমি। পুরনো প্রেম এখনো যায় নি। ম রে ও আমায় শান্তি দিচ্ছে না। আমার সংসারটা শেষ করে দিল।”
জুহাদ চুপ করে থাকে। রাবেয়া প্রায়শই এ রকম কথা বলে। ও নিজেকে কত ভাবে যে সামলে রাখে।
“তুমি স্বীকার করো আর না করো, আমি জানি আমিরা তোমার ই মেয়ে। তুমি আর আমেনা সে রাতে…..”
রাবেয়া হু হু করে কেঁদে ওঠে। জুহাদের মুখ র ক্ত হীন হয়ে পড়ে। কলঙ্কের প্রহার আর কত দিন সইবে সে? মৃত্যুর পর ও তো মুক্তি নেই। নতুবা আমেনা কেন ম রে ও কলঙ্কমুক্ত হলো না?
ঘটনার শুরু হয় জুথির বিয়ে থেকে। জুথি আর মারুফ ভালোবেসে বিয়ে করে। তবে সেটি মানতে পারেন না মারুফের বাবা। এর প্রধান কারণ জুথি’রা ছিল খুবই গরিব। তাছাড়া বংশ মর্যাদার দিক থেকেও নিচু। এই কারণেই জুথিকে মেনে নিতে পারেন নি তিনি। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বউ হয়ে আসে জুথি। আর মারুফের বয়সই বা কত? ঊনিশ বিশ। এই ছোট্ট বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করে তারা। দুজনেই পড়াশোনা করছিল। বছর পেরিয়ে গেলেও জুথিকে মানতে পারেন না মারুফের বাবা। এর ই মধ্যে মাহিমের জন্ম হয়। মারুফের বাবা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন তিনি আর খাওয়াতে পারবেন না। মারুফের ওপর তখন দায়িত্ব চড়াও হয়। ছেলেটা পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি শুরু করে। সে যে কি কষ্টের সময়। এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক কান্ড। আমেনার সাথে জুহাদের প্রণয় ঘটে যায়। দুজন একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসলেও পাওয়া হয় না। বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে জুহাদের হাত ধরে পালিয়ে যেতে পারে নি আমেনা। জুহাদ তখন পাগল প্রায়। নিজেকে আ ঘা ত করে হসপিটালেও থাকতে হয়েছে। কত অশান্তি যে চলছিল সে সময়। জুথি নিজের ভাইয়ের অবস্থা দেখে নিজেও বিপদে পড়ে যায়। বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির দ্বন্দ্বে অশান্তি ছেয়ে যায় ওর মস্তিষ্কে। বলা বাহুল্য আমেনার জীবন ও সহজ ছিল না। তবে সত্য হলো সে মানিয়ে নিয়েছিল। বাহাদুরের ভালোবাসা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল জুহাদ নামের শুদ্ধ মানুষটিকে। ধীরে ধীরে তাদের সংসারে সুখ বর্ষণ ঘটে। আমেনা সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করে এমন সুন্দর সংসার দেওয়ার জন্য। জুহাদ ও মেনে নিতে শিখে। তার ও বিয়ে হয়ে যায়। আমেনা আর জুহাদের কোনো যোগাযোগ ই ছিল না। বেশ কিছু বছর পর এক ঝড়ের সন্ধ্যায় আমেনা আর জুহাদকে অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। জুহাদ এসেছিল বোন আর বোনের সন্তানদের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে। তবে তারা সবাই সেদিন কেনাকাটার জন্য বাইরে গিয়েছিল। বিষয়টি সে জানত না। না জানিয়ে এসেছিল। আমেনার শরীর বিশেষ ভালো লাগছিল না। তাই সে যায় নি। ঝড়ের কারণে আটকে যায় জুহাদ। ওদিকে বাড়ির বাকিরাও শপিংমল থেকে ফিরতে পারছিল না। ঝড় ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। জুহাদ চলে যেতে চেয়েছিল। তবে এমন ঝড়ের মাঝে চলে গেলে তা অমানবিক আচরণ হয়ে যেত। আমেনা বলল থেকে যেতে। জুহাদ ও থেকে গেল। অপেক্ষা করতে লাগল। সব থেকে বড়ো সত্য তারা দুজন দুজনার প্রতি সামান্য দৃষ্টিও দেয় নি। তবে বিপদ যে ঘনিয়ে এসেছিল। প্রতিবেশিদের কেউ একজন দুজনকে এক বাড়িতে দেখে কটাক্ষ করে মন্তব্য করতে লাগল। ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে যেতে লাগল। সেটা সহ্য না করতে পেরে মাঝ রাতে, ঝড় বৃষ্টির মাঝেই চলে যায় জুহাদ। ঘটনা এখানেই থেমে গিয়েছিল। তবে বহু বছর পর আমিরা যখন বড়ো হয়ে গেল তখন ঘটনাটিকে খারাপ ভাবে দেখানো হয়। বলা হয় আমিরা নাকি জুহাদের সন্তান! এর কারণ সেই রাতের কিছু সপ্তাহ পর ই জানা যায় আমেনার শরীরে আরেকটি প্রাণ বেড়ে ওঠেছে। এই ঘটনাকে টেনে ধরেই রাবেয়া আর জুহাদের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। এমন এক পরিস্থিতির জন্ম হয় যার ফলে দুজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিচ্ছেদের। অথচ তাদের দুজনের একটি সন্তান ও রয়েছে। এই সন্তানের দোহাই দিয়েই কোনো মতে টিকে থাকে সম্পর্কটি। এদিকে ঘটনাটি কোনো এক ভাবে বাহাদুরের কানেও পৌছে যায়। তার মা কখনোই আমেনাকে দেখতে পারতেন না। তিনি ঘটনাটি এমন ভাবে সাজান যার ফলে বাহাদুরের ভেতর সন্দেহের বীজ বপন হয়। খবর নিয়ে বাহাদুর জানতে পারে আমেনার সাথে জুহাদের প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। সেই থেকে আমেনার প্রতি তার ভালোবাসা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়। বাহাদুর মোটেও খারাপ মানুষ নয়। স্বামী হিসেবেও দারুণ। তবে এই সন্দেহ তার চোখে পর্দা ফেলে দেয়। স্ত্রী ও কন্যার প্রতি তার আচরণ হয়ে ওঠে ভয়াবহ। নেশায় ডুবে যায় সে।
সায়রার সমস্ত শরীর কাপুনি দিয়ে জ্বর নেমে গেল। সে ধরমরিয়ে ওঠল। ঘুমের ঘোরে ছয় বছর আগের সেই অতীত দেখেছে সে। ভয়ে আর জ্বরে তার শরীর ঘেমে গিয়েছে। ও দেখল ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। ফোনের এলার্ম বেজে চলেছে। সেটি বন্ধ করে শ্বাস নিতে থাকল। ধীরে ধীরে শরীর স্বাভাবিক অবস্থান ফিরে পেলে হাত মুখ ধুয়ে নিল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে আরশির সামনে এসে দাঁড়াল। দেখতে লাগল নিজেকে। অনুভবের বলা কথাটার সাথে মিলিয়ে নিল। সে ঊনত্রিশ বছর বয়সী নারী,তবে দেখতে এখনো বেশ সুন্দর। কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়।
চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি