#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৫)
অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে অনুভব। এত গুলো বছর ধরে ঘাস পাতা চিবিয়ে এসেছে। অথচ আজ দুটো রোস্ট অকোপটে পেটে চালান করে দিল! অনুভব খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বাইরের দিকটায় আরাম করে বসেছিল। এদিক দিয়ে মেয়ে বিদায় হয়ে গেছে। ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই মিষ্টি এক সুবাস অনুভব হলো। বুক ভরে সেটা গ্রহণ করল সায়রা। অনুভব বলল,”ভালো কথা, ২০০ শ টাকা দাও।”
সায়রা অবাক না হয়ে পারল না। ও বলল,”এক মিনিট ফোনে কথা বলার জন্য ২০০ টাকা চার্জ করছ, আর এখন যে সামনে বসে আছ।”
“দারুণ কথা মনে করালে, ওয়েট সময় কাউন্ট করছি।”
অনুভব ঠিক ই ঘড়ি দেখল। তারপর হেসে বলল,”টাকা বের করো।”
ছেলেটার কথায় ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল সায়রা। তবে অনুভব ও নাছোড়বান্দা। সায়রা কে টাকা বের করতে হলো। সে ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকা বের করতেই সেটা টান দিয়ে নিয়ে নিল অনুভব। কোনো কথা ছাড়াই পকেটে চালান করে দিয়ে বলল,”রোস্টের স্বাদ ভালো ছিল।”
সায়রা কিছু বলল না। ও অনুভবকে দেখে অবাক হয়।
“এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? প্রেমে পড়লে নাকি?”
“ত্রিশ বছর বয়সী একজন পুরুষ মানুষের মাঝে প্রেমে পড়ার মতন কিছু দেখছি না আমি।”
“ত্রিশ বছর বয়স বলে অপমান করলে?”
“ধরে নিতে পারো।”
“তোমার বয়সের হিসাব আছে?”
সায়রা সরল চোখে তাকাল। তার কিছু বলার নেই। অনুভব এক গাল হেসে বলল,”সায়রা, ঊনত্রিশ বছর বয়সী নারী তুমি। অথচ আমার কাছে অসম্ভব সুন্দরী।”
অনুভবের সরল স্বীকারোক্তি। ছেলেটার চাহনিতে ভালোবাসা মিশে আছে। সায়রার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠল। অনুভব বিদায় জানাতে বলল,”একবার বলে যেতে পারতে,তোমার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করতে পারতাম আমি। তবে তুমি অবহেলা করলে। অনেক বেশি কষ্ট দিলে সায়রা। আই হেইট ইউ, হেইট ইউ সায়রা।”
শেষ কথায় সায়রার চোখে জল চলে এল। ওর ভাঙা কণ্ঠটা শোনা গেল।
“আমাকে ঘৃণা করো ঠিক আছে। তবে সেটা বার বার কেন বলো অনুভব? কেন কষ্ট দাও আমায়? আমায় কষ্ট দিয়ে তোমার কষ্ট কী লাঘব হয়?”
অনুভব উত্তর করল না। সায়রার দু চোখ নোনা জল ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটা যখনই ঘৃণার কথা বলে, তখনই বুকের ভেতরটা তপ্ততায় মেখে যায়। কি এক শোক নামে বুকের ভেতর। কেন এই ছেলেটাকে এত বেশি মনে পড়ে তার?
জ্বরে পড়ল সায়রা। সেদিন রাতেই হাড় কাপুনি দিয়ে জ্বর এল তার। তবে মেয়েটি ডাক্তার দেখাবে না। ঔষধ ও খাবে না। এমনিই থাকবে বলে ঠিক করল। নিজের সেই ছোট্ট ঘরটায় দরজা আটকে বসে রইল। মাহিম সমস্ত সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে এসেছে। ফিরল রাত এগারোটায়। তখন এসে খবরটি পেল। এসেই পিপির দরজার কাছে নক করল। সায়রা ভেতর থেকে জবাব দিল।
“আমি ঠিক আছি। তোরা বেশি চিন্তা করছিস।”
“আমাকে একটু দেখতে দাও পিপি। আমি একটু দেখি তোমায়।”
“ডাক্তার গিরি দেখাতে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।”
“তাহলে ডাক্তার হয়ে কী লাভ হলো? যদি ঘরের লোকের চিকিৎসা না করতে পারি।”
সায়রা জবাব দিল না। তার কান্না পাচ্ছে শুধু। সে অনবরত কেঁদেই চলেছে। ওর এই কান্নাটা সব থেকে বেশি বুঝতে পারল আমিরা। মেয়েটির সাথে সব থেকে বেশি সময় সে কাটিয়েছে। ছয় বছর আগে ছোট ছিল বিধায় অনেক কিছুই ধরতে পারে নি। তবে এখন, এখন তো সে বড়ো হয়েছে। বিষয় গুলো মনে হলেই ওর বার বার মনে হয় সামথিং ইজ রং। এই চিন্তা থেকেই সে অনুভবকে কল করে বসল। ছেলেটার সাথে অনুষ্ঠানে আজ দেখা হয়েছিল। নাম্বারটি নিয়ে রেখেছে। আমিরার কণ্ঠটি শুনতে পেয়ে হাসল অনুভব।
“কী ব্যাপার, মিষ্টি বন্ধু? এই মাঝ রাতে একেবারে হুট করে কল করলে যে।”
“দুষ্টু বন্ধু, তুমি মিমি কে কী বলেছ?”
“কী বলেছি বলতে?”
“তার খুব জ্বর হয়েছে। কাউকে সামনে যেতে দিচ্ছে না। ঔষধ খাচ্ছে না।”
অনুভব চুপ করে রইল। আমিরা মন খারাপের সুর টেনে বলল,”মিমি কেঁদেছে অবধি।”
“এর সাথে আমার কী সম্পর্ক মিষ্টি বন্ধু?”
“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।”
“সে কী বলেছে, আমার জন্য তার শরীর খারাপ হয়েছে?”
“বলে নি।”
“তাহলে?”
“আমার মনে হয়েছে।”
অনুভব গলার স্বরটি সামান্য কঠিন করে বলল,”তোমার মিমির কাছে আমি এতটাও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই যার ফলে তার জ্বর হবে। বরং সে আমাকে যথেষ্ট অবহেলা করে। তাকে ঔষধ খাওয়াও।”
কলটি কেটে দিল অনুভব। আমিরার মন খারাপ হয়ে গেল। প্রথমত অনুভব না বলে কল কেটে দেওয়ায়। দ্বিতীয়ত অনুভবের অনেক কথাই সে বুঝতে পারে নি।
সায়রার অসুস্থতার কথা শুনে কল না করে থাকতে পারল না অনুভব। তার হৃদয়ে দং শ ন হয়েছে। সেখান থেকে লাল তরল নেমে যাচ্ছে। ও চোখ বন্ধ করে নিজের শ্বাসের গতি ঠিক করল। কল করল। তবে প্রথম বারেই কলটি রিসিভ হলো না। দ্বিতীয় বারে কল রিসিভ হওয়ায় অনুভবের ইচ্ছে হলো কিছু কথা শোনাবে। তবে কান্নায় ভা ঙা কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে কিছু বলতে পারল না। সায়রা ভা ঙা কণ্ঠে নাক টেনে শুধাল,”কল কেন করেছ?”
অনুভব জবাবহীন। জবাব না পেয়ে আরো একবার নাক টানল সায়রা। বার বার নাকে পানি এসে জমছে। কি এক বেদনা!
“সময় কিন্তু যাচ্ছে অনুভব। তুমি কল করেছ, এক মিনিট হতে চলল। আবার ২ শ টাকা চার্জ করে না বসো।”
এবার অনুভবের হাসি পেল। ও নিজের হাসি আটকে বলল,”না চার্জ করব না। আমি ২ শ টাকা চার্জ করায় যেভাবে কান্নাকাটি করে জ্বর বাঁধিয়েছ।”
শেষ কথায় সায়রার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠল। ও তড়িঘড়ি করে শুধাল,”তুমি কীভাবে জানলে আমার জ্বর হয়েছে?”
স্মিত হেসে অনুভব বলল,”ঘৃণার পরিমাণ বেশি, তাই দৈবক্রমে জেনে গিয়েছি।”
ছেলেটা সব কথায় যেন ঘৃণা টানে। সায়রার কী যে খারাপ লাগল। অনুভব এবার কণ্ঠটা গুমোট করে বলল,”দ্রুত ঔষধ খাও। শেষে আমাকে ফাঁ সি য়ে না দাও।”
সায়রাও কম নয়। সে ও সুন্দর করে জবাব দিতে জানে। তাই তো রস মিশিয়ে বলল,”খাব না। বরং তোমাকে ফাঁ সি য়ে দিব। জেল হবে তোমার, আমাকে ঘৃণা করার অপরাধে।”
মেয়েটির শেষ কথার সাথে অনুভব তাল মিলিয়ে বলল,
“যদি তুমি সঙ্গে থাকো সখী,
রাখো হৃদয় ও গভীরে।
যাবত জীবনেও শোক হবে না,
আমার এই হৃদয় ও মাঝারে।”
জাফরিন ভীষণ রেগে গিয়েছে। মাহিমকে সে বোঝাতে পারছে না এটা সম্ভব নয়। অথচ মাহিম তাকে ছাড়ছে না। এই যে যেমন একটু আগেই তার হাত স্পর্শ করেছে। ছেলেটার এহেন আচরণে ওর রাগ পৌছে গেল সপ্তম আকাশে। চেচিয়ে ওঠল।
“তোমাকে নিষেধ করলাম মাহিম। আমায় স্পর্শ করবে না।”
আহত দৃষ্টিতে তাকাল মাহিম। তার কোনো বাজে উদ্দেশ্য নেই। শুধুমাত্র মেয়েটার হাত সারাজীবনের জন্য চায় সে।
“সরি, আর হবে না। তবে তুমি আমায় কেন ইগ্নোর করছ?”
“সেটা তোমার বোঝা উচিত। আমি তোমায় পছন্দ করি না।”
“অথচ আমার মনে হয় তুমি পছন্দ করবে।”
“ফিউচারের কথা চিন্তা করা বন্ধ করো। এসব কেবল স্বপ্ন।”
“যদি বাস্তব হয়?”
“জোর করতে চাও?”
“না। ভালোবাসতে চাই। অনেক বেশি।”
মাহিমের মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা দারুণ শোনায়। জাফরিন করুণ চোখে তাকায়।
“প্লিজ, এভাবে জ্বালিও না। আমি মাত্র কটা দিন থাকব এখানে।”
“এ কথা বলো না প্লিজ। আমার হৃদয়ে যন্ত্রণা হয়। তোমাকে যদি হৃদয়টা দেখাতে পারতাম, তবে বিশ্বাস করো কেঁপে ওঠতে তুমিও।”
বুকের বাঁ পাশ দেখিয়ে কথাটা বলল মাহিম। ছেলেটার মুখ আঁধারে মিশে গিয়েছে। জাফরিন ফোঁস করে দম ফেলে। তার মাথা কাজ করে না। কে জানে হয় কি হয় ভবিষ্যতে।
চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি