মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৪

0
383

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৪)

অনুভব হলুদের অনুষ্ঠানে আসে নি। সায়রার মনে হয়েছিল তার জন্যই আসে নি। তবে বিষয়টি তেমন নয়। ছেলেটার কাজ পড়ে গিয়েছিল। তাই আসতে পারে নি। কিন্তু আজ এসেছে। বেশ সেজে এসেছে। তাকে দেখতে রূপকথার রাজকুমারের মতন লাগছে। অধিক লম্বা হওয়ায় আকর্ষণ বেশি পাচ্ছে। সায়রা আজ শাড়ি পরেছে। অনুভব কে দেখে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল। ছেলেটা এত বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে কেন! বয়স যেন বাড়ছে না, কমছে!

এদিকে জাফরিন হতাশ। মাহিম ছেলেটা তাকে বিরক্ত করছে। আজ একদম টেনে সবার থেকে আড়ালে নিয়ে এসেছে। এখন দুজনের মুখশ্রীর মাঝে দূরত্ব বেশি নেই। মাহিম এক চিলতে হাসি রাঙিয়ে বলল,”কী সমস্যা তোমার?”

“সমস্যা তো তোমার। মাথা খারাপ কোথাকার।”

ছেলেটাকে ঠেলে বের হতে নিল জাফরিন। তবে পারল না। স্বাভাবিক ভাবেই ওর শক্তি কম। ও অসহায় বোধ করলেই কটমট করে তাকাল।

“এই তেজের জন্যই এত ভালো লাগে।”

“বাদরামো শুরু করেছ? এসবের কোনো মানে হয় মাহিম? আমি এ রকম মজা পছন্দ করি না।”

“তোমার কেন মনে হয় আমি মজা করছি?”

“তুমি সিরিয়াস?”

“হুম।”

পরপর জবাব দিয়েছে মাহিম। ওর আচরণে অনেক কিছুই পরিষ্কার। জাফরিন বুক ভরে সমীরণ টেনে নিল।

“তুমি কী জানো আমি তোমার থেকে এক বছরের বড়ো?”

“জানি।”

“তাহলে এমন কেন করছ?”

“না করার কী আছে?”

“তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।”

“জানোই যখন তবে গ্রহণ কেন করছ না?”

জাফরিন ওকে পাত্তা দিল না। অনেকটা জোর করেই চলে এল। তবে ওর যে ভীষণ মন খারাপ করেছে।

জুঁইকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। সকাল থেকে জুথির কান্না শুরু হয়েছে। এত দিন মেয়ে বিদায়ের জন্য পাগল হয়েছিল আর এখন কান্নাকাটি করে যা তা অবস্থা। ওর এমন অবস্থা দেখে সায়রার খারাপ লাগে। তবে করার কিছু নেই। মেয়েদের যে বিদায় দিতেই হয়। এদিকে মারুফ কিন্তু একদম ই শোক দেখাচ্ছে না। বরং উত্তেজনা নিয়ে কাজ করছে। অথচ সায়রা স্পষ্ট বুঝতে পারে ভাইয়ের হৃদয়টা জ্বলে যাচ্ছে।

“ভাইয়া।”

ব্যস্ত ভঙ্গিতে আগাচ্ছিল মারুফ। সায়রার ডাকে ফিরে এল।

“হ্যাঁ বল।”

“তুমি একটু রেস্ট করো ভাইয়া।”

“রেস্ট কী করব রে। এখন তো রেস্টের সময় নেই। কত কাজ বল।”

সায়রা দু চোখ ভরে ভাইকে দেখতে থাকে। মানুষটার বয়স হয়েছে। সংখ্যায় সায়রার থেকে ১৫ বছরের বড়ো। ৪৪ এ পা দেওয়া মারুফ যেন মাত্র কদিনেই বয়সের ভার অনুভব করছে। অথচ আগে এমনটা মনে হয় নি।

মাহিম পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সায়রা ডেকে বলল,”ভাইয়ার রেস্ট প্রয়োজন। কী কাজ যেন বাকি আছে। একটু দেখ তো।”

মাহিম চলে গেল। মারুফ আর সায়রা নীরবে পথ চলছে। ক্লান্ত হয়ে আছে মুখশ্রী।

“ভাইয়া, মেয়েদের তো বিদায় দিতেই হবে তাই না। মন কে ভা ঙ তে দিও না।”

“ভা ঙ তে দিচ্ছি না রে।”

“সেটা ঠিক আছে। তবে তুমি যে ভেতরে কষ্ট পুষে রাখছ ভাইয়া।”

মারুফের যেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। দু চোখ টলমল করছে। সায়রার মাথায় হাত রাখল সে।

“মাত্র ২১ বছর বয়সে বাবা হয়েছিলাম। মাহিমকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। তার ঠিক দু বছর পর ই জুঁইয়ের জন্ম। তখন অতটা আবেগ কাজ করে নি। পরিবার টানার চাপে মেয়েটার যত্ন নিতে পারি নি। এখন মনে হচ্ছে বড়ো ভুল হয়ে গেছে। হৃদয়ে ক্ষ ত করে মেয়েটাকে বিদায় দিতে হবে। এ যন্ত্রণা কেমন করে সইব রে বোন? কেমন করে সইব?”

একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মারুফ। ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সায়রা। ভা ঙা কণ্ঠে বলল,”জুঁই অনেক সুখী হবে ভাইয়া। অনেক বেশি সুখী হবে।”

তোড়জোড় চলছে। বর পক্ষকে খাওয়া দাওয়া করানো হবে। সায়রা ভীষণ ব্যস্ত। চারপাশ থেকে ব্যস্ততা ওকে চেপে ধরেছে। ও নিজেই রোস্টের প্লেট তুলে নিল। সামনের টেবিলে সার্ভ করতে লাগল ক্রমাগত। সার্ভ করার এক পর্যায়ে একটি কণ্ঠ শোনা গেল।

“একটা রোস্ট কেন? মেয়ে পক্ষের বুঝি হাত ভারী?”

কণ্ঠটি অনুভবের। সায়রা ব্যস্ততায় তাকে খেয়াল করে নি। ওয়েটার গুলো কোথায় পড়ে আছে কে জানে। বাড়ির মানুষ গুলোকেই সার্ভ করতে হচ্ছে।

“কী হলো? আরেকটা রোস্ট দাও।”

সায়রা রোস্ট দিল। অনুভব ও তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। ছেলেটার আচরণ এত অবাক করে সায়রা কে।

মাহিম ছুটে এসে বলল,”পিপি, সব নবাবের দল বাইরে গিয়ে সিগারেট টানছে।”

“এখন কি সিগারেট টানার সময়। আশ্চর্য লাগে! সবাই কে ডেকে নিয়ে আয়।”

মাহিম ফের ছুটল। ছেলেটার ওপর দিয়ে আজ বিশাল ধকল যাচ্ছে। জাফরিন অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে দেখছে সব। ওর শরীর টানছে না। মাহিম ছেলেটা মস্তিষ্কে ঝামেলা সৃষ্টি করেছে।

আমিরা গিয়ে সুবর্ণের ছবি তুলে এনেছে। সেটাই দু চোখ ভরে দেখছে জুঁই। ছেলেটার সাথে হুট করেই প্রণয় ঘটে গেল। সব কেমন দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। জুঁইয়ের চোখ ছলছল দেখে আমিরা শুধাল,”কান্নাকাটি করে মেকাপ নষ্ট করলে হবে? শেষে তোমার বর পাত্তাই দিবে না।”

ওর কথায় হাসল জুঁই। চোখের জল মুছে নিয়ে বলল,”দিবে, না দিলে মে রে ফেলব না?”

“ভাইয়া খুব ভালো তাই না?”

“হুম, খুব ভালো। আমার ভীষণ যত্ন করে। জানিস, সারাটা জীবন মধ্যবিত্ত হয়ে ভেবেছি স্বামীর সংসারে অনেক বেশি বিলাসিতা করব। তবে শেষমেশ এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়লাম, যে কী না খুব সাধারণ। কিন্তু বিশ্বাস কর, এক চুল ও আপসোস নেই। ও যখন ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে দেখা করতে আসত, তখন আমার মনে হতো পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান মানুষ আমি। বৃষ্টিতে ভিজে এগিয়ে দিত, নিজে ভিজে আমাকে শুকনো রাখত, তখন আমার কান্না পেত। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হতো। একটা মানুষ, যে কী না নিজের সবটুকু ভালোবাসা আমায় দিয়েছে, তাকে না ভালোবেসে পারা যায় বল?”

কথা গুলো বলতে বলতে জুঁইয়ের দু চোখ ভিজে ওঠল। আমিরার চোখে মুখে খুশির মেলা বসেছে। জুঁই আপুর ভালোবাসার কথা শুনে তার ভালো লাগছে। স্মরণ হচ্ছে নিজের পছন্দের ব্যক্তিটি। ইস কতদিন হয় দর্শন হয় না।

অনেকটা তাড়াহুড়োতেই জুঁইয়ের বিয়েটা হয়ে গেল। মেয়ে বিদায় দিতে এসে জুথির অবস্থা প্রাণ যায় যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে সে। প্রথম দিকে সকলে চোখের পানি ফেললেও, এখন সব অতিরিক্ত লাগছে। এক ঘন্টা ধরে মেয়েকে চেপে ধরে কেঁদে চলেছে জুঁই। মারুফ ও বিরক্ত। শোক তো তার হৃদয়েও আছে। তাই বলে মেয়েকে ধরে রাখলে চলবে? স্ত্রীকে এক প্রকার টেনে সরিয়ে নিলেন তিনি। জুথির অবস্থা ভালো নয়। তাই মেয়ে বিদায়ের দায়িত্ব পড়ল সায়রার ঘাড়ে। ও সমস্ত নিয়ম মেনে মেয়ে বিদায় দিল। জুঁই গাড়ির ভেতর ওঠে বসেছে। দু চোখ ছলছল করছে। সায়রা ওর কাছে এসে কপালে চুম্বন করল। আদুরে হাতে গাল ছুঁয়ে বলল,”দোয়া করি,অনেক বেশি ভালো থাক তুই। তোর সংসারে সমস্ত সুখ এসে পড়ুক।”

পিপির হাত টা জাপটে ধরল জুঁই। ছলছল নয়নে চেয়ে রইল।

“তোমার দোয়া যেন ফলে যায় পিপি। সব যেন ঠিক হয়।”

মাহিমের হৃদয় ভে ঙে যাচ্ছে। দু ভাই বোন পিঠাপিঠি হওয়াতে জীবনের অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। তাই দুঃখটা তার একটু বেশি। সেই দুঃখ আড়াল করতেই দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত শ্বাস নিচ্ছে। জাফরিন ও এসেছে পিছু পিছু। বিষয়টা একেবারে অনিচ্ছাকৃতভাবে। খেয়াল হওয়ার পর চলে যেতে চাইছিল। তবে মাহিমের কণ্ঠটি শুনতে পেয়ে পা থমকে গেল। মাহিম এগিয়ে এসে জাফরিনের মুখোমুখি হলো। কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই জাপটে ধরল মেয়েটিকে। জাফরিনের সমস্ত শরীর আন্দোলিত হলো। ও চেয়ে ও পারল না ছেলেটাকে নিজের থেকে আলাদা করতে।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে