মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৩

0
341

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৩)

বাড়িতে এত বছর পর বিয়ে। তাই সব রকমের অনুষ্ঠানই করা হবে। আজ মেহেদির অনুষ্ঠান। ছেলে পক্ষ থেকেও কিছু মানুষজন আসবে। পুরো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে বাড়ি থেকে একটু দূরের সেন্টারে। এ রকম অনুষ্ঠানে অনেক দিন পর থাকছে সায়রা। আজ তার মন ভীষণ ফুরফুরে। সে বসে বসে মেহেদির ডালা সাজাচ্ছে। ভিডিও করা হবে। আয়োজন ছোট হোক, তবে স্মৃতিরা তোলা থাক। আমিরা আর জাফরিন ঘুরঘুর করে সব দেখছে। লাইটিং ঠিক আছে কী না। ফুল গুলো তাজা কী না। এসব দেখতে দেখতে নজরে এল কিছু ফুল শুকিয়ে গেছে। আমিরা চেচিয়ে ওঠল,”এখানে শুকনো ফুল দিয়েছ কেন?”

আশেপাশে সবাই ব্যস্ত। আমিরা হতাশ হয়ে বলল,”তুমি থাকো, আমি এই ফুল গুলো সরানোর ব্যবস্থা করি।”

আমিরা চলে গেল। জাফরিন এখন একা। ও একাই চারপাশ ঘুরতে লাগল। সেন্টারের মাঝে ফোয়ারা আছে। সেখান থেকে পানি নামছে ক্রমাগত। জাফরিন সেদিকেই এগোল। ফোয়ারার কাছে এসে পানি স্পর্শ করল। শীতল পানি হাত ছুঁয়ে যেতেই এক চিলতে হাসি এল অধরে।

“একা হাসছ কেন?”

মাহিমের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে রইল জাফরিন। এসে থেকে ছেলেটার সাথে ওর বনিবনা হয় না। বার বার ঝগড়া লেগে যায়।

“হাসতে মানা নাকি?”

“রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকলে, অবশ্যই হাসতে মানা।”

“তোমার সমস্যা কী বলো তো?”

“আমার?”

“হুম।”

“কোনো সমস্যা তো নেই।”

“সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকো।”

“তাই? আমি তোমার পেছনে লেগে থাকব কোন দুঃখে।”

“কোন দুঃখে সেটা তো জানি না। তবে তোমায় সুবিধার লাগে না।”

“কেন লাগে না?”

“তোমার দৃষ্টিতে অশ্লীলতা।”

“অশ্লীলতা! তা কীভাবে?”

“কীভাবে সেটা তো তুমি জানো।”

“আমি জানি? আচ্ছা, তাহলে একটু জেনেই নিই।”

কথাটা বলে মাহিম সামনে এগোল। জাফরিন ভীতু মেয়ে নয়। সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ও ভেবেছিল এতে করে মাহিম পিছিয়ে যাবে। তবে তেমনটা হলো না। মাহিম বড়ো অসাধ্য এক কাজ করে ফেলল। জাফরিনের নিকটে এসে একদম গালে চুমু খেল। ছেলেটার উষ্ণ ঠোঁট গাল ছুঁয়ে যেতেই জাফরিনের সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠল। জমে গেল বরফের মতন। মাহিম এক চিলতে হাসি রেখে বলল,”এমন অশ্লীল হয়ে যদি চুমু খাওয়া যায়। তবে কেন অশ্লীল হব না?”

সায়রা মেহেদির ডালা নিয়ে বের হচ্ছিল। ওমন সময় দেখতে পেল অনুভব দাঁড়িয়ে। ওর পা থমকে গেল। অনুভব দৃষ্টি ফেরাতেই মেয়েটিকে নজরে ঠেকল। সুন্দর একটি শাড়ি পরেছে সায়রা। উজ্জ্বল ত্বকে মানানসই মেকাপের ছোঁয়া। লিপস্টিক সামান্য ছড়িয়ে গিয়েছে। অনুভব চট করেই কাছে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা যেমন লম্বা, তেমনই বলিষ্ঠ। বরাবরের মতই সায়রার মাথাটা অনুভবের বুক বরাবর হলো। এতে করে দুজনের মাঝে বেশ দূরত্বের দেখা মিলল। সায়রার দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। অসহায় লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে। ওর অস্বস্তি আরেকটু বাড়াতে সামান্য ঝুঁকল অনুভব। এতে করে ছেলেটার ত্বকের উষ্ণতা, পারফিউমের ঘ্রাণ স্পষ্ট নাকে এসে ধরা দিচ্ছে। সায়রার বুকের ভেতর ধীম ধীম হলো। ওর সমস্ত দেহ আন্দোলিত হলো। অনুভবের কণ্ঠটা শোনা গেল এবার।

“তুমি আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছ সায়রা। অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছ। আই হেইট ইউ সায়রা। আই হেইট ইউ।”

কথাটা বলেই অনুভব চলে গেল। সায়রার হাতে থাকা ডালা পড়ে গিয়েছে। চোখ দুটো ইষৎ জ্বালা করছে। ঘৃণা পাওয়া কী স্বাভাবিক নয়? তবে দু চোখ বেহায়ার মতন কাঁদছে কেন?

জাফরিন হতভম্ব। মাহিম এটা কী করে গেল! ওর মস্তিষ্ক খালি হয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। আমিরা এসে দেখল অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে জাফরিন।

“এই জাফরিন আপু।”

মেয়েটির বাহু টেনে ধরল আমিরা। জাফরিন তাকাল। দৃষ্টিতে অসহনীয় ব্যথা।

“চলো না আমরা মেহেদি পরে আসি।”

“আমি দিব না রে আমিরা। তুই যা।”

“না, তোমায় যেতে হবে। প্লিজ চলো আপু।”

টেনে জাফরিনকে নিয়ে গেল আমিরা। মেহেদি পরাল। কিন্তু ওর মনোযোগ নেই এখানে। ও বরং চেয়ে রইল গভীর দুটো চোখে। মাহিমের চোখের দৃষ্টি, ঠোঁটের দুষ্টুমি। সব মনে হতেই শিউরে ওঠল শরীর। মেহেদি তখন প্রায় শুকিয়ে এসেছে। মাহিম কে দেখা গেল ফোনে কথা বলছে। আলগোছে ওর সামনে এসে দাঁড়াল জাফরিন। মেয়েটিকে দেখে কল রাখল ও। দৃষ্টি ফিরিয়ে শুধাল,”কী?”

“তখন ওটা কী করলে?”

“চুমু খেয়েছি।”

“এটা ফাজলামি নয় মাহিম।”

“তোমার মনে হয়,আমি ফাজলামি করেছি?”

“তবে?”

“আমি সিরিয়াস হয়েই চুমু খেয়েছি।”

“তোমার মাথা খারাপ?”

“মাথা খারাপ কী না জানি না। তবে তোমাকে না পেলে পাগল হয়ে যাব।”

জাফরিনের ইচ্ছে করল ছেলেটার গালে ঠাস করে দুটো চ ড় বসিয়ে দিতে। এ ছেলে নিজেকে কী মনে করে!

“মাহিম, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো প্লিজ।”

“স্বপ্ন তো ঘুমিয়ে দেখতে নেই জাফরিন। ঘুমিয়ে দেখলে, সেটা বাস্তব হবে কেমন করে?”

জাফরিন বিহ্বলের মতন তাকিয়ে রইল। এদিকে মাহিমের ঠোঁট জোড়া হাসি।

সায়েম গাড়ি বের করল। অনুভব এখনই বের হবে। ও প্রায় ওঠেই যাচ্ছিল, সে সময়েই সুবর্ণ এসে বলল,”স্যার এখনো তো অনুষ্ঠান শেষ হয় নি।”

“আমার একটু তাড়া আছে সুবর্ণ।”

“আপনি বলেছিলেন পুরো সময়টায় থাকবেন।”

“আজ হলো না। অন্য এক সময় হবে।”

সুবর্ণকে আলিঙ্গন করল অনুভব। তারপরই বেরিয়ে পড়ল। সুবর্ণ চেয়ে রইল গাড়িটির পানে। সে খুব সাধারণ ঘরের ছেলে। পড়াশোনা চালানো কষ্টসাধ্য ছিল। তখনই অনুভবের অফিসে চাকরিটা পেল। সে সময় চাকরিটা পেয়ে ওর মনে হয়েছিল পৃথিবী বুঝি স্বর্গ হয়ে গেছে। আসলে সাধারণ মানুষ গুলো এমনই হয়। এদের চাওয়া, পাওয়া খুবই সামান্য।

সায়রার চোখে ঘুম নেই। অনুভবের কথা গুলো খুব বেশি প্রভাবিত করল তাকে। রাগে দুঃখে কাঁদল কতক্ষণ। তারপর ঠিক করল ছেলেটার সাথে সরাসরি কথা বলবে। তাকে কীভাবে কষ্ট দিয়েছে সায়রা? সে কি প্রণয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল? দেখায় নি তো। তাহলে, তাহলে কীসের এত ঘৃণা?

অনুভব মাত্রই শাওয়ার শেষ করল। এসে দেখল ফোন বাজছে। নাম্বারটি পরিচিত না। ও কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গমগমে কণ্ঠে সায়রা বলল,”তোমার সমস্যা কী অনুভব? কেন ঘৃণা করো আমায়? আমার দোষ কী? তোমাকে প্রত্যাখান করাই কি আমার দোষ?”

মেয়েটির কণ্ঠে তেজ রয়েছে। কমে নি। অনুভব একবার হেসে নিল। তারপর আরশির সামনে এসে দাঁড়াল। অত্যন্ত সুপুরুষ লাগছে নিজেকে। মনে মনে সে নিজেই নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো।

“আমি এত সহজে কারো সাথে কথা বলি না সায়রা। আমার মাসিক আয়ের হিসাবে প্রতি মিনিটে ২০০ টাকা করে রোজগার। তোমাকে ৫ মিনিট সময় দিব। অথার্ৎ ১ হাজার টাকা পাওনা থাকবে। যদি রাজি থাকো তাহলে কথা কন্টিনিউ করা যেতে পারে।”

ছেলেটার কথায় আকাশসম বিস্মিত হলো সায়রা। অনুভব শীতল কণ্ঠে বলল,”অলরেডি ১ মিনিট খরচ হয়ে গেছে। ২০০ টাকা পাওনা রইল।”

সায়রার ইচ্ছে করল ছেলেটাকে কিছু খারাপ ভাষায় গালি দিতে। তবে সেটি করল না ও। কল রেখে দিল। তারপর ভাবতে লাগল এই অনুভব আর ছয় বছর আগের অনুভব, ঠিক কতটা পার্থক্য দু সময়ে মাঝে।

কল কেটে দেওয়ায় হেসে ফেলল অনুভব। ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে সে। ও আরশির সামনে এসে নিজের চুল গুলো হাত দিয়ে সেট করে নিল। গায়ে পারফিউম দিয়ে তারপর ঘুমাতে এল। তবে ঘুম হলো না। মেয়েটি তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কল দিয়ে একদমই উচিত করে নি।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে