#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩২)
জুঁইয়ের বিয়ের কেনাকাটা করা হবে। তার জন্য সায়রা কেও যেতে হবে। সায়রা দেশে ফিরে একটু রিল্যাক্স সময় কাটাচ্ছিল। অথচ এরা সেটা হতে দিল না। এক প্রকার জোর করে মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে বসে সায়রা বলল,”তোরা কি বল তো। আমার কি আর সে বয়স আছে নাকি?”
আমিরা প্রতিবাদ করে বলল,”মিমি, সব সময় নিজেকে বুড়ো বোঝাও কেন?”
“তো বুড়ো হয়ে গেছি না?”
“আশ্চর্য! তোমার ঊনত্রিশ মাত্র।”
সায়রা মলিন হাসল। ঊনত্রিশ হয়ে গেছে তার। বিষয়টা ভাবলেই কেমন গা শিউরে ওঠে।
সুনেরাহ দু হাত ভরাট করে ড্রেস কিনেছে। অনুভব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। একটা মেয়ে কি করে এত ড্রেস কিনতে পারে!
“সুনেরাহ, এবার লেট হয়ে যাচ্ছে। এত ড্রেসে কী হবে?”
“লাগবে না? কী বলো!”
“ঠিক আছে, এবার প্লিজ আসো। আমাদের মিটিং আছে। সায়েম গাড়ি নিয়ে বসে আছে।”
“ওকে, ওকে। আর একটা।”
কথাটা বলেই আরেকটা ড্রেস তুলে নিল সুনেরাহ। অনুভব ব্যাগ গুনে দেখল তেরো টা।
“প্লিজ চলো এবার।”
ওরা বিল পেমেন্ট করছিল। অনুভব বার বার ঘড়ি দেখছে। সুনেরাহ এটা ওটা বলছে। তবে কিছুই কানে যাচ্ছে না তার। ওর মস্তিষ্ক জুড়ে সময়ের খেলা। একটা সেকেন্ড প্রচন্ড দামি ওর কাছে।
সায়রা ব্যাগ গুলো রেখে বলল,”বিলটা রেডি করবেন কাইন্ডলি।”
অনুভব ফোনে মগ্ন ছিল। কণ্ঠটা শুনে নজর ফেরাল। সায়রা ও নজর ঘুরিয়েছিল। দুজনের চোখাচোখি হলো।
“অনুভব, চলো।”
সুনেরাহ খুব সুন্দর ভাবে অনুভবের হাতটি ধরে নিল। সায়রা দ্রুত নজর সরিয়ে বলল,”বিলটা রেডি করুন। আমি আসছি।”
সমস্ত রাস্তা মাথা ব্যথার ছুতোয় চোখ বন্ধ করে রইল সায়রা। অনুভব কে চিনতে তার অসুবিধা হয় নি। ছেলেটার গঠনে অনেক পরিবর্তন এসেছে তবে মানুষটা তো বদলে যায় না। সায়রা এক সেকেন্ডেই চিনে নিয়েছে।
অনুভব কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল। সায়েম গাড়ি ড্রাইভ করছে। সেটা দেখে বলল,”এনি প্রবলেম স্যার? আপনার শরীর খারাপ? মিটিং ক্যানসেল করব?”
“না সায়েম। মিটিং ক্যানসেলের দরকার নেই।”
কথাটা বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল অনুভব। মৃদুমন্দ হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল মুখশ্রী। অনুভব চোখ বন্ধ করল। ভেসে ওঠল অতীতের স্মৃতি।
সায়রার বলা কথা গুলো অনুভবের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলল। মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যানে যেমন কষ্ট পায়। ঠিক তেমনই কষ্ট পায় যখন মানুষটার থেকে ছোট হতে হয়। সায়রা বলেছিল অনুভব অলস একটা ছেলে। তাকে কীভাবে ভরসা করবে। এই বিষয় গুলো ওর ঘুম কেড়ে নিল। ও সব ছেড়ে দিল। নিজের ভেতর জেদ হলো। নিজেকে পরিবর্তন করার প্রয়াসে ছেলেটার মস্তিষ্ক তপ্ত হতে ওঠেছিল। এতটা পরিশ্রম করতে হতো ওর। তবু ও থেমে ছিল না। নিজেকে গড়ার চেষ্টা করছিল। তিন মাসে বেশ পরিবর্তন করে ফেলল নিজেকে। তারপর যখন সায়রার সাথে যোগাযোগ করতে গেল তখন শুনল মেয়েটা দেশে নেই। চলে গিয়েছে। অনুভব তখন পাগলপ্রায়। সায়রা চলে গেল। একবার বলল না তাকে। সুযোগ দিল না কোনো। এই বিষয় গুলো অনুভবের ভেতরে ক্রোধের সৃজন করল। নিজেকে আ ঘা ত করল। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হলো। নিজেকে বোঝাল। পরিবর্তন করল নিজেকে। সেই হেংলা, অলস অনুভব হয়ে ওঠল ভীষণ পরিশ্রমী, বলিষ্ঠ। গাড়ির ব্রেক ধরায় ধ্যান ফিরল অনুভবের। সায়েম লুকিং গ্লাসে স্যারকে দেখে নিয়ে শুধাল,”স্যার মিটিং ক্যানসেল করি? আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।”
“না সায়েম। ঠিক আছি।”
সায়েম চেয়ে রইল অনুভবের দিকে। ছয় বছরের ও বেশি সময় ধরে মানুষটাকে দেখে আসছে সে। একটু হলেও মন পড়তে পারে।
সুনেরাহ’র সাথে বিজনেস শুরু করেছে অনুভব। মেয়েটার গুণ ওকে মুগ্ধ করে। দুজনের আজ এক মিটিং রয়েছে। ওরা খুব দ্রুত নতুন প্রডাক্ট লঞ্চ করবে। তার জন্য মার্কেটিং টিম করা হবে। কীভাবে কোনটা করবে সেটার জন্যই ছিল আজকের মিটিং। অনুভব পুরো মিটিং ভীষণ মনোযোগে করেছে। যদিও কোথাও কোথাও মনটা থমকে গিয়েছে। তবু সে সর্বোচ্চ চেষ্টায় মিটিং শেষ করল। রুমে এখন সায়েম, অনুভব আর সুনেরাহ। তিনজন ই বসল চেয়ার টেনে। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবার এমন অবস্থা দেখে সুনেরাহ বলল,”কফি খাবে?”
অনুভব নাকোচ করতে গিয়েও হ্যাঁ বলে দিল। সায়েম হাসি হাসি মুখে বলল,”তাহলে আমিও খাব।”
“ওকে।”
সুনেরাহ চলে গেল। সায়েম আর অনুভব বসা এখন। এক পর্যায়ে অনুভব বলল,”একটা কথা বলবে সায়েম।”
“জি স্যার।”
“অতীত কেন এত কষ্ট দেয়?”
প্রশ্নে থমকে গেল সায়েম। অনুভবের দিকে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা সমানে ঘামছে।
“কী হয়েছে স্যার? শরীর খারাপ?”
“শরীর খারাপ হলে তো চিন্তা হতো না সায়েম। খারাপ তো মন।”
কথার আগা মাথা সায়েমের বোধগম্য হলো না। সে চেয়ে রইল ভ্যাবলার মতন। ততক্ষণে কফি নিয়ে এসেছে সুনেরাহ।
“হাবুলের মতন না তাকিয়ে ধরো।”
কথাটা সায়েমকে বলল সুনেরাহ। ও প্রায় লাফিয়ে কফি কাপ ধরল। অনুভব বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,”শুনেছি, তুমি কখনো কাউ কে কফি বানিয়ে খাওয়াও না। আজ কেন বানালে?”
“কথাটা ভুল। স্পেশাল মানুষ হলে বানিয়ে খাওয়াতে অসুবিধা নেই।”
কথাটার পৃষ্ঠে আরো কিছু বলতে পারত অনুভব। তবে বলল না। ওর ভালো লাগছে না তেমন। ও কফি কাপ তুলে নিয়ে চুমুক বসাল। তবে সত্য, মনের দ্বন্দ্বে কফির স্বাদ কেমন পানসে লাগছে।
এত এত শপিং করা হয়েছে। সেগুলোই মেলে দেখানো হচ্ছে। এদিকে সায়রার মন ভালো নেই। তার দৃষ্টিতে উদাসীনতা। জুথি সবার জন্য চা নিয়ে এল।
“যে যার কাপ তুলে নে তো।”
সবাইকে এ কথা বলে সায়রার কাপটা তুলে নিল জুথি। পাশে বসে বলল,”তোর মন খারাপ?”
সবাই মনোযোগ দিয়ে জামা কাপড় দেখছে। তাই কথাটা শুনে নি। সায়রা মৃদু সুরে জবাব দিল।
“না ভাবি।”
“তোকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে।”
“তাই?”
“হুম।”
সায়রা চট করেই ফোনটা বের করল। ক্যামেরায় নিজেকে দেখে নিল।
“ঠিক ই আছে ভাবি।”
“না, ঠিক নেই। শপিং থেকে ফিরেই এমন হয়ে গেছিস।”
ও কিছু বলল না। কথা এড়াতে চায়ের কাপ তুলে নিল। চুমুক বসাল।
“চা ভালো হয়েছে। ভাইয়া কোথায়?”
“বাজারে গেল। কাজের চাপ খুব। একা সামাল দিচ্ছে।”
“রাতে লিস্ট করব নে। সবাই মিলে করলে এতটা চাপ হবে না।”
“তুই কথা ঘোরাচ্ছিস?”
“না ভাবি।”
“আমি বুঝতে পারি সায়রা।”
সায়রা আবার চুপ। জুথি ওর কাছে ঘেঁষে বসল।
“কী হয়েছে?”
সায়রার ভেতরটা আনচান করে ওঠল। কেঁপে ওঠল শরীর।
“বল, কী হয়েছে।”
“অনুভব কে দেখলাম ভাবি।”
জুথি চুপ হয়ে গেল। সায়রা ভাঙা কণ্ঠে বলল,”দেশে না এলেই ভালো হতো ভাবি।”
“সব সময় পালিয়ে বাঁচা যায় না সায়রা।”
ও জবাব দিতে পারল না। দুটো চোখ জ্বলতে শুরু করেছে। কলিং বাজায় জুথি চলে গেল। সায়রা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ পরিষ্কার নয়। মেঘ দেখা যাচ্ছে। আর মেঘের বুক ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।
চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি