#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩১)
বাংলাদেশের মাটিতে প্ল্যান স্পর্শ করে গেল। সায়রার বুক কেমন হু হু করছে। ও চোখ বন্ধ করে নিজ ভূমিকে অনুভব করল। ছয় বছর কিংবা তার ও কিছু বেশি সময় পর দেশে পা পড়ল তার। এই ছয় বছরে স্মৃতির পাতায় ব্যস্ততার পরিমাণ ই বেশি। লড়াই করে করে সে যে ক্লান্ত। আমিরা ওর বাহু টেনে ধরল।
“মিমি, ওঠে পড়ো।”
সায়রা চট জলদি ওঠে পড়ে। ওদের পেছনের সারিতে সিট পড়েছিল জাফরিনের। আমিরা এবার জাফরিনকে টেনে তুলল। মেয়েটা পুরো ফ্লাইটেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।
“এসে গেছি?”
“হুম। পুরো ফ্লাইট ঘুমিয়ে পার করলে।”
জাফরিন আড়মোড়া ভেঙে বলল,”বলিস না রে। সব ভুলে বসেছিলাম। তাই তো আগের রাতে ঘুমাই নি। আর এখন ঘুমে ছাড়ছে না।”
“এখন চলো। গাড়িতে আবার ঘুমিও।”
“হুম।”
ওরা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বেরিয়ে পড়ল। সায়রার পা যেন চলছে না। কেমন যেন শক্তিহীন লাগছে।
“মিমি, কী হয়েছে?”
“কিছু না। চল তোরা।”
“এসো তুমি। পিছিয়ে পড়ো বার বার।”
আগে থেকেই মাহিম এয়ারপোর্টের বাইরে অবস্থান করছিল। আমিরাকে দেখতে পেয়ে এক চিলতে হাসি এল অধরে।
“মাহিম ভাইয়া!”
“তুই এত বড়ো হয়ে গেছিস?”
জবাবে লজ্জা এসে ছুঁয়ে গেল আমিরাকে। মাহিম আমিরার মাথায় হাত রেখে বলল,”চেনা যাচ্ছে না।”
“চিনবে কেমন করে? তখন ছিল ১২। আর এখন ১৮।”
“সেটাই। পিপি কোথায়?”
সায়রার কথা জিজ্ঞাসা করতে করতেই জাফরিনের দিকে নজর পড়ল মাহিমের। মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে!
“বলা হয় নি, ও জাফরিন আপু। ইতালিতে আমাদের সাথে পরিচয় হয়েছে।”
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? ঘোড়া নাকি?”
জাফরিনের এত বেশি ঘুম পাচ্ছিল যে শুরুর দিকে চোখ মেলে তাকাতেই পারছিল না। তবে শেষ কথা গুলো শুনল ও। তাই প্রতিবাদ করে বলল,”এই ছেলে, কাকে ঘোড়া বলো?”
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমালে ঘোড়া বলব না?”
জাফরিন ফের কিছু বলার আগেই সায়রা এসে পড়ল। মাহিম এগিয়ে এসে সায়রাকে আলিঙ্গন করল।
“পিপি,কেমন আছ তুমি?”
“ভালো রে। তোদের কী খবর?”
“আর খবর। ছেড়ে গিয়ে তো ভুলেই বসেছিলে।”
সায়রা মলিন হাসল। ওরা আর কথা বাড়াল না। ব্যাগ পত্র গুটিয়ে চলতে লাগল।
অনুভবের গাড়িটা এয়ারপোর্টের পার্কিং এ এসে থামল। আজ তার লন্ডনের ফ্লাইট আছে। ওর সাথে যাচ্ছে সায়েম ও।
“আমরা কী লেট করে ফেলেছি সায়েম?”
“নো স্যার। আমরা সময়ের দু মিনিট পূর্বেই এসেছি।”
“ঠিক আছে। নামো তাহলে।”
অনুভব আর সায়েম গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আকাশে আজ রোদ খেলা করছে। ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ। অনুভব চোখে রোদ চশমা লাগাল।
একই পাশে সায়রাদের গাড়িটাও দাঁড় করানো। সায়রা ক্লান্ত শরীরে গাড়ির কাছে আসছে। ঠিক সে সময়েই ফোন কল আসায় উল্টো পাশ ঘুরল অনুভব। সায়রা ওর গাড়িটা ক্রস করে নিজেদের গাড়িতে ওঠে বসল। অনুভবের কথা তখনো শেষ হয় নি। সায়রাদের গাড়ি পার্কিং ছেড়ে বের হবে। হর্ণ পেয়ে একটু পেছনে সরল অনুভব। একবার চাইল গাড়ির পানে। তবে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা মেয়েটির মুখশ্রী দর্শন হলো না ওর।
জুথি অনেক আয়োজন করেছে। সায়রা আর আমিরার সাথে জাফরিন কে দেখে একটু অবাক হলেও ক্রমেই এক গাল হেসে জাফরিনকে আপন করে নিয়েছে। জাফরিন ও খুব মিশুক প্রকৃতির। তবে মাঝে একটি সমস্যা হয়ে গেল। জুথি কে কী বলে ডাকবে জাফরিন সেটাই বুঝতে পারছে না। সায়রাকে সে আপু বলে ডাকে। এদিকে আমিরা তাকে আপু ডাকে। সেই জন্য জুঁই ও আপু ডাকে। ডাকাটাও স্বাভাবিক। ওদের বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি তো নয়। ও একটু সমস্যাতেই পড়ল। মুখ চোখ অন্ধকার। মাহিম গাড়ি পার্ক করে রেখে এসেছে। বসার ঘরে আসতেই দেখল ওর অবস্থা। জুঁই শরবত এনে রাখছে।
“ভাইয়া, শরবত দিব?”
“না। ঘরে যাই আমি।”
জুঁই এক গ্লাস শরবত নিয়ে জাফরিনকে দিল। জাফরিন হেসে শুধাল,”তোমার বিয়ে?”
“হুম আপু।”
“বাহ, অভিনন্দন।”
“থ্যাংক ইউ।”
ওরা দুজন গল্প করছে। সায়রা তখন নিজের ঘরে অবস্থান করছে। ওর ঘরটা নিচ তলায়। অনেক দিন তালাবদ্ধ ছিল। ওরা আসবে বিধায় পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে বিশেষ কোনো পরিবর্তন করা হয় নি কক্ষটির। সব আগের মতন। সায়রার বুক ভারী হয়ে আসছে। বুক শেলফে নজর পড়তেই হৃদয়টা হু হু করে ওঠল। একটি বইয়ে চোখ আটকে গেল ওর। বইটা হাতে নিয়ে দেখল ধুলোয় ভরে গিয়েছে। ও ধীরে ধীরে বইয়ের মলাট থেকে ধুলো সরিয়ে নিল। ভেসে ওঠল “প্রেমানল” নামটি। সহসাই ওর চিত্তে একটা ব্যথা শুরু হলো। মনে পড়ে গেল সেই স্মৃতির কথা। সম্ভবত অনুভব প্রথমবারের মতন রোজগার করে তাকে “প্রেমানল” বইটি কিনে দিয়েছিল।
জাফরিনকে কক্ষ দেখিয়ে দিল জুঁই। এই বাড়িতে মোট ৬ খানা কক্ষ রয়েছে। আমেনার ঘরটিতে এখন আমিরা থাকছে। জুঁই কে যে ঘর দেওয়া হলো তা মূলত গেস্ট রুম হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। ঘরটি আজ ই পরিষ্কার করা দেওয়া হয়েছে।
“কোনো অসুবিধা হলে ডেকে নিও আমায়?”
“ঠিক আছে।”
জুঁই চলে গেল। জাফরিন ঘরটা একটু দেখে নিল। বাড়িটা যে মধ্যবিত্তদের তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। তাতে অবশ্য ওর অসুবিধা নেই। ও তো এত বিলাসিতা এমনিতেও পছন্দ করে না। তাই এখানে ওর অসুবিধা হবে না। ওর চোখে এখনো ঘুম রয়েছে। তবে এর আগে শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন। ও একটু জিরিয়ে নিয়ে শাওয়ার নিতে গেল। শাওয়ার শেষে যখন বারান্দায় কাপড় মেলতে এল তখনই সমস্ত পরিবেশ অন্ধকারে ভরে গেল। লোডশেডিং হয়েছে। অন্ধকার ভীতি রয়েছে ওর। ও চিৎকার করে ওঠল। ছুটতে লাগল দিক বেদিক। আর মাঝে ধাক্কা খেল কারো সাথে। যার ফলে পড়ে গেল ও।
ফোনের ফ্লাশ জ্বালাতেই মাহিমের মুখশ্রী ভেসে ওঠল। জাফরিন পা ধরে বসে আছে।
“পাগলের মতন ছুটছিলে কেন?”
“আগে ওঠাও আমায়।”
“ওয়েট।”
ফোনটা পাশে রেখে জাফরিনকে টেনে ওঠাল মাহিম। জাফরিনের পা ব্যথা করছে। চলতে পারছে না।
“আমার পা…” বলে আর্তনাদ করে ওঠল জাফরিন। মাহিম চোখ মুখ শক্ত করে বলল,”এই ঘরে থাকতে দিয়েছে তোমায়?”
জাফরিন নিরুত্তর। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মাহিম হেসে বলল,”মেয়ে মানুষের যত ঢং।”
“এই ছেলে। কীসের কী বলছ তুমি?”
“এই সামান্য ব্যথায় কেউ কাঁদে নাকি?”
“এটা সামান্য ব্যথা?”
“তো?”
জাফরিন কিছু বলল না। পা ধরে দেয়ালে ঠেস ধরে রইল। মাহিম পুরো হতাশ। কারেন্ট আসে নি তখনো।
“হাত সরাও।”
নিচু হয়ে কথাটা বলল মাহিম। জাফরিন অবাক হয়ে বলল,”কী করবে? এই আমার পা স্পর্শ করবে না।”
“চুপ করে থাকো।”
এক প্রকার অবজ্ঞা করেই মেয়েটির পা স্পর্শ করল মাহিম। জাফরিন চেচিয়ে ওঠল,”ব্যথা পাব আমি। ব্যথা পাব।”
কে শুনে কার কথা। মাহিম ওর পা ধরে ইষৎ টান দিল। এতে অবশ্য জাফরিন ব্যথা পেল। তবে ওর চেচানো শুনে মনে হচ্ছে কেউ খুব মে রে ছে। ওর এমন চেচানো দেখে মাহিমের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হলো। এই মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন? দাঁড়িয়ে ঘুমায়, একটুতেই কেঁদে ফেলে। এখন আবার ব্যথা না পেয়েও চেচামেচি করছে!
“না চেচিয়ে পা নাড়িয়ে দেখো।”
কে শুনে কার কথা। জাফরিন সমানে চেচিয়ে চলেছে। মাহিমের ইচ্ছা করছে মেয়েটির মাথায় ঠাস করে চ ড় বসিয়ে দিতে।
“থামবে তুমি? পা নাড়িয়ে দেখো। ঠিক হয়ে গেছে।”
জাফরিন প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,”নিজেকে ডাক্তার ভাবো নাকি?”
অন্তিমক্ষণেই জাফরিন অনুভব করল পায়ের ব্যথাটা নেই। সে চলতে পারছে। মাহিম এক গাল হেসে বলল,”ডাক্তার ভাবি না। আমি ডাক্তার ই।”
চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি