#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৮)
সুনেরাহ’র আজ ব্লাইন্ড ডেট রয়েছে। মেয়েটি ভীষণ রূপবতী বলাই চলে। সে নিজেকে যথেষ্ট ফিট করে রাখে। পঁচিশ বছরের এই জীবনে অর্জন ও কম কিছু নয়। তার নিজস্ব মেকাপ ব্র্যান্ড রয়েছে। যার সুনাম পুরো দেশ জুড়ে।
“ম্যাম গাড়ি বের করা হয়েছে।”
সুনেরাহ দারুণ ভাবে নিজের হ্যান্ডব্যাগ টা তুলে নিল। এতে করে পরিচারিকা মেয়েটার চোখ স্থির হয়ে এসেছে। তার ধারণা সুনেরাহ’র মতন ফ্যাশন সচেতন মানুষ বাংলাদেশে খুব কম ই আছে। তার যদি অভিনয়ের দক্ষতা থাকত, তাহলে সিনেমা জগত কাঁপাত।
ব্লাইন্ড ডেট’টা সুনেরাহ’র বাবা অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছেন। অনেকদিন ধরেই তিনি বলছিলেন টপ ক্লাসের একটি ছেলে রয়েছে। অসাধারণ দেখতে। কাজেও সুনাম রয়েছে। সে যেন একবার দেখা করে। বাবার এত রকমের কথা শুনেই সে মূলত রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। সে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে। অথচ ছেলেটার আসার নাম নেই। ও জুস খেতে খেতে ফোনের স্ক্রিনে টাইম দেখছে। আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে। এর বেশি এক মুহুর্ত থাকবে না সে। পাঁচ মিনিট শেষ হতে আর কিছু সেকেন্ড বাকি। সে তার ব্যাগ নিয়ে ওঠে যাচ্ছিল। সে সময়েই লম্বা,চওড়া, ফর্সা ত্বকের মানুষটির দেখা মিলল। চুলের স্টাইল, পারফিউমের ঘ্রাণ, সব অদ্ভুত রকমের সুন্দর। সুনেরাহ বুক ভরে শ্বাস নিল। অনুভব আসার পূর্বে মেয়েটি সম্পর্কে টুকটাক জেনে নিয়েছে। টপ ক্লাসের মডেলিং ও করে থাকে। যা এক নজর দেখেই বুঝে নিল অনুভব।
“সুনেরাহ জামান?”
ছেলেটার মুখ থেকে নিজের নাম শুনে একটু চমকে ওঠল ও। তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। ওর চমকে যাওয়া মুখশ্রী দেখে হাসল অনুভব।
“আমি অনুভব রহমান।”
“সরি, আমি আসলে বুঝতে পারি নি। চলেই যাচ্ছিলাম।”
অনুভব কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল,”চলে যাচ্ছিলেন?”
“পুরো ৩৫ মিনিট লেট করে এসেছেন।”
অনুভব এতে হেসে ফেলল। বলল,”আই থিংক আপনার ভুল হয়েছে। আপনি আগে চলে এসেছেন।”
সুনেরাহ ভাবল অনুভব বোধহয় মজা করে বলছে। তাই ও কফির অর্ডার করে বলল,”ইটস ওকে আমি কিছু মনে করি নি। কখনো সখনো লেট হয়েই যায়।”
বিপরীতে অনুভব চুপ রইল না। ও বরং ফোন বের করে সুনেরাহ’র দিকে এগিয়ে দিল। স্পষ্ট ৪ টা ৩ বাজে। অনুভব এসেছে কয়েক মিনিট হয়ে গেছে। ও নিজের ফোন বের করে দেখল ৪ টা ৩৮ টা বাজে। কিছু সেকেন্ড পর বিষয়টি খেয়াল হলো। গতরাতে কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ফোনের সময় পরিবর্তন করেছিল। সেটা আর মনে নেই। ও একটু বিব্রত হয়ে বলল,”সরি। আমার ফোনের টাইম পরিবর্তন করা ছিল।”
“ইটস ওকে। কফি এসে গেছে।”
ওয়েটার কফি রেখে বলল তাদের আর কিছু লাগবে কী না। ওরা নাকোচ করতেই চলে গেল। সুনেরাহ’র মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। অনুভবের সামনে লজ্জিত হতে হলো। কফি খেতে খেতে অনুভব বলল,”আপনার ব্র্যান্ডের বেশ সুনাম দেখলাম। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই দারুণ সাফল্য। গ্রেট!”
ওর কথায় সুনেরাহ হাসল। বলল,”সব জেনেই এসেছেন দেখছি।”
“সব নয়। আসার পথে রিসার্চ করে এলাম।”
“আমি কিন্তু আপনার বিষয়ে কিছুই জানি না।”
“কেন?”
“ভেবেছি সামনাসামনি জেনে নিব।”
সুনেরাহ ইচ্ছাকৃতভাবে কথা ঘুরিয়েছে। তার আসলে এই ডেটের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ই ছিল না। বাবার জোরাজুরিতে এসেছে। ভেবেই এসেছিল দু মিনিট ছেলেটার সাথে কথা বলে চলে আসবে। বাসায় ফিরে রিজেক্ট করে দিবে। কিন্তু অনুভবকে দেখার পর ওর মস্তিষ্কের চিন্তা বদলে গেছে। ও ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অনুভব টেবিলে ঠকঠক শব্দ করতেই ওর ধ্যান ফিরল।
“আপনি চিন্তিত?”
“না, না। চিন্তিত নই। আচ্ছা, আপনি সম্পর্কে কিছু বলুন।”
অনুভবের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির দেখা মিলল। সুনেরাহ আড়চোখে দেখল সেটা। ওর কেবলই মনে হলো, কোনো মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়?
সুনেরাহ’র মস্তিষ্ক জ্যাম হয়ে গেছে। সমস্ত রাস্তা অনুভবের কথা ভেবেছে। ছেলের কথা বলার ভঙ্গিমা, চুলের স্টাইল, মুখের গড়ন, ফিট শরীর আর ভীষণ লম্বা। সব ওর মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। ও বাড়ি ফিরে আরো অস্থির বোধ করছে। নিজের এই অস্থিরতা কাটাতে ফেসবুক ঘেটে অনুভবের প্রোফাইল বের করে নিল। খুব কম ই ছবি সেখানে। মনে হচ্ছে আহামরি একটিভ নয়। লাস্ট ছবি পোস্ট করেছে প্রায় আঠারো দিন পূর্বে। প্রোফাইলে যে কটা ছবি আছে সবগুলো দেখে নিল সুনেরাহ। অথচ ওর মন শীতল হলো না। এত এত অস্থির লাগছে ওর।
সায়রা ইতালির একটি স্কুলে চাকরি করছে বেশ কিছু বছর হলো। পাঁচ বছরের ও বেশি সময় ধরে ইতালির রাজধানী রোমে থাকছে সে। শুরুতে অন্য এক শহরে থাকা হলেও কিছু মাস পর ই রোমে চলে আসে। এখানকার ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেই চাকরিটি নিয়ে নেয়। পড়াশোনা চলাকালীন একটি কফি শপে জব করত। অনেক দিন পর কফিশপটায় এসেছে। ভালো লাগছে। কিছু সময় পর ভেতর থেকে পশ্চিম বঙ্গের একটি মেয়ে এল। সায়রার থেকে কম বয়সী। নাম জাফরিন।
“আপু, এত দিন পর এলে তুমি।”
জাফরিন আর সায়রা উষ্ণ আলিঙ্গন করল। সায়রা আর জাফরিনের পরিচয় এই কফি শপ থেকেই। দুজনে এক সাথেই কফি শপে কাজ শুরু করেছিল। যদিও জাফরিন ওর থেকে বেশ ছোট।
“কী খবর জাফরিন? তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“প্রচন্ড চাপ আপু। পার্ট টাইম জব আর পড়াশোনা চালানো খুবই যন্ত্রণার। বাট স্টিল ভালো করে যাচ্ছি। কজ টাকা এলে সব মন খারাপ ক্লান্তি চলে যায়।”
জাফরিনের কথায় হাসল সায়রা। মেয়েটি মোটেও মধ্যবিত্ত পরিবারের নয়। ইন্ডিয়ায় ওর বাবার বিশাল বিজনেস রয়েছে। অনেক টাকা রোজগার। তবে ওর মনে হয় নিজের টাকা খরচ করায় আলাদা আনন্দ রয়েছে। এই ব্যাপারটাই সায়রা আর জাফরিনের বন্ধনটা দৃঢ় করেছে। জাফরিন আর সায়রা কফি খেতে খেতে গল্প করল। জাফরিন বিল দিতে দিবে না। কিন্তু সায়রাও নাছোড়বান্দা। ও বিল না দিয়ে যাবে না। শেষমেশ জাফরিন কে হার মানতে হলো। তবে ও আর্জি রেখে বলল,”খুব দ্রুত আমি খাওয়াব। আমিরাকেও সাথে নিয়ে আসবে।”
“ঠিক আছে, আনব। তুমি সময় করে একদিন বাসায় এসো। ঝাল ঝাল মুরগি মাংস আর সাদা ভাত খাওয়াব।”
সায়রার কথা শুনেই জাফরিনের ক্ষিধে পেয়ে গেল। পেট জানান দিচ্ছে কত দিন হয় ভাত খাওয়া হয় না। সায়রার হাতে সময় কম। ও জাফরিনকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোম ভীষণ সুন্দর একটি শহর। অথচ ওর মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। একেই হয়তো নিজ ভূমির প্রতি টান বলা হয়।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশ