মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-২৭

0
341

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৭)

সময় যাচ্ছে আবার। অনুভবের উদাসীনতাও বাড়ছে। আজকাল ওর ছটফট চোখে লাগার মতন হয়ে গেছে। একটু খানি কথা বলার জন্য মন পাগলামি করে। নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে গেছে। এই যে যেমন এখন মধ্যরাতের ও বেশি সময়। সমস্ত কাজ শেষ করে সায়রা ঘুমানোর জন্য এসেছে। অনুভবের কলটি এল তখনই। ও রিসিভ করতেই অনুভবের জ্বলন্ত কণ্ঠ।

“অফলাইন কেন থাকো সব সময়?”

ছেলেটার এহেন কথায় একটু যেন থমকাল সায়রা। এতটা অধিকার বোধ কেন দেখায় অনুভব? ও শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। একই ভাবে শুধাল,”তোমায় কেন বলতে হবে?”

“অবশ্যই বলতে হবে।”

“কেন বলতে হবে? সেটাই তো জানতে চাচ্ছি আমি।”

“কারণ…..’

অনুভব থমকাল। সায়রা ও আজ জ্বলে ওঠেছে। এর পূর্বেও অনুভব অধিকার দেখিয়েছে। কী বোঝাতে চায় ছেলেটা?

“বলো অনুভব, কারণ টা বলো আমায়।”

“কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি।”

শীতল হাওয়া এসে সায়রার সমস্ত দেহ ছুঁয়ে যায়। অনুভব পরপর বলে ওঠে,”আমি তোমায় পছন্দ করি সায়রা। ভালোবেসে ফেলেছি। কবে, কখন জানি না। জানি না আমি।”

সায়রার মাথাটা ফাঁকা লাগছে। এর পূর্বেও অনুভবের আচরণ গুলো ওকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছে। তবু তারপর ই ও পাত্তা না দিয়ে বিষয় গুলো এড়িয়ে গেছে। কিন্তু আজ, আজ কেমন করে এড়িয়ে যাবে সে? অনুভব অপেক্ষা না করেই বলল,”বলো, বলো সায়রা। তুমিও আমায় পছন্দ করো সায়রা। বলো প্লিজ। আনসার মি, সায়রা।”

সায়রা নিরুত্তর। ওর কাছে উত্তরটি দেওয়ার মতন শক্তি নেই। ও কল কেটে দিল। তারপর অনেকবার কল করল অনুভব। তবে সায়রা, সায়রা পাত্তা দিল না। ওর শুধু মনে হলো মাথার ওপর বিশাল সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়ল। আর এই সমুদ্রের জলেই হারিয়ে যাচ্ছে ও।

দুদিন আহনাফকে পড়াতে যায় নি। বাড়ি থেকেও বের হয় নি। তবে কতদিন এমনটা চলবে? কতদিন সায়রা অনুভবের মুখোমুখি হবে না। আজ যে ওকে বের হতেই হলো। আর বের হয়েই অনুভবের সামনে পড়তে হলো। অনুভব রিকশা থামিয়েছে। আশপাশটা ফাঁকা। সায়রা নেমে গিয়ে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিল। অনুভবের লম্বা দেহ। সায়রা ওর বুকের সমান ঠেকেছে। মাথা উঁচু করে চাইল ও। দেখল ছেলেটার চোখ মুখ আঁধারে নিমজ্জিত। দুদিনেই যেন কেমন হয়ে গেছে। না ঘুমানোর জন্য?

“কী বলবে?”

সায়রার সরাসরি প্রশ্ন। অনুভব ও বলল,”আমি কিন্তু উত্তরটি পাই নি সায়রা।”

“তোমার বুঝে যাওয়ার কথা।”

“আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

“কী শুনতে চাও?”

সায়রা সরাসরি অনুভবের চোখের দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টি একত্র হয়ে গেল। অনুভব যেন কোনো মতে নিজেকে আটকিয়ে রেখেছে। ওর কান্না পাচ্ছে ভীষণ। সায়রা নিজের মাথাটা ঠান্ডা করল। কেউ কাউকে পছন্দ করতেই পারে। রিজেক্ট করার ও অপশন আছে। সায়রা সেটাই করল। কণ্ঠ নামিয়ে পুনরায় বলল,”আমাদের কিছু হবে না অনুভব।”

“কেন হবে না?”

“আমরা প্রায় সমবয়সী অনুভব।”

“ভুল, আমি তোমার পুরো এক বছর দুই মাসের বড়ো।”

ছেলেটার এহেন কথায় সায়রা যেন জবাব হারিয়ে ফেলল। অনুভব বলল,”বয়স সম্পর্ক তৈরির জন্য ঠিক কতটা ম্যাটার করে সায়রা? বলতে পারবে তুমি?”

সায়রা হতাশা ভরা কণ্ঠে বলে,”এর কোনো ব্যাখা নেই।”

“আমি তোমায় ভালোবাসি সায়রা। তবে কেন কোনো ব্যাখা নেই? ছয়টা মাস আমি প্রতিটা মুহূর্ত তোমায় ভালোবেসেছি। আর তুমি বলছো আমাদের কিছু হবে না। বয়সের তুলনা করছো।”

অনুভবের কথায় সায়রা অবাক হলো না। ও বরং বাস্তবতা ওঠিয়ে বলল,”অনুভব, ছয় বছরের দ্বিপাক্ষিক ভালোবাসা ভেঙেছে। আর তুমি ছয় মাসের একপাক্ষিক ভালোবাসার কথা বলছো?”

বিপরীতে অনুভব ও থেমে নেই। ও নিজের সবটুকু ভালোবাসা দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টায় বলে ওঠল,”সম্পর্ক তৈরির জন্য ছয় বছর কিংবা ছয় মাসের প্রয়োজন হয় না সায়রা। একটি সম্পর্কে তৈরির জন্য, মুগ্ধতা আনার জন্য একটি বিকেল ই যথেষ্ট। শুধুমাত্র এক বিকেল।”

সায়রা যেন খেই হারিয়ে ফেলল। ওর শব্দ ভান্ডার রিক্ত। ভালোবাসা হারানোর পর সায়রা আর কখনোই নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখে নি। কখনোই না।

সায়রা ঠিক যতটা ম্যাচিউর অনুভব ঠিক ততটাই বিপরীত। একটা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ও যেন পাগল হয়ে গেছে। অথচ সায়রা ভেবে পাচ্ছে না। ও অনুভবের জন্য কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না। শুধু অনুভবই নয় ওর হৃদয়ে আর কোনো অনুভূতিই বেঁচে নেই। এ যেন রিক্ততায় ভরা এক খন্ড হৃদয়ভূমি। অনুভব আজ আবার কল করেছে। ওর নিজের খামতি গুলো নিয়ে প্রশ্ন করেছে। সায়রার মন মানসিকতা হীন নয়। কাউকে বাহ্যিক দিক দিয়ে শুরুতেই বিচার করে না সে। বরং ভেবে দেখলে দেখা যাবে অনুভব অনেকক্ষেত্রে তার থেকে এগিয়ে। ওর কোনো ভাবনাই ছিল না। ও এতটা বিরক্ত হচ্ছিল যে এক পর্যায়ে আচমকাই বলে ওঠল,”শোনো অনুভব, তুমি খুবই অলস একটা ছেলে। উদাসীন থাকো সব সময়। কখনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস না। দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় অনেকবার দিয়েছ। তোমার বাবার টাকা পয়সা আছে। কিন্তু এসব তোমার অর্জনের নয়। তুমি বলতে পারো জীবনে কী অর্জন করেছ? আমি কোন ভরসায় তোমার হাতটা ধরব?”

কথা গুলো বলার পর সায়রা নিজেই থমকে গিয়েছিল। কীভাবে কী বলে ফেলল সে। তবে এগুলোকে সংশোধনের চেষ্টাও করল না। ওর খুব খারাপ লাগতে লাগল। কান্না পেল। অনুভব কেন বুঝতে পারছে না, তার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতন সাধারণ নয়। কিংবা হবে না।

জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। না সায়রার জন্য থেমেছিল, আর না অনুভবের জন্য। দুজন আজ পৃথিবীর দুটো প্রান্তে বাস করছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ঘোর ভাঙে সায়রার। ও চট করে জানালা গুলো বন্ধ করে দেয়। নিজের অতীতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে কখন সময় পেরিয়ে গেছে ওর খেয়াল ই নেই। ঘড়িতে তখন বিকেল শেষ হতে চলল। আমিরা’র ফেরার সময় হয়েছে। ও চলল নাশতা বানাতে। নাশতা বানানো শেষ হতেই কলিং বেজে ওঠল। আমিরা এসেছে। কিছুটা ভিজে গেছে। সায়রা তোয়ালে এনে মেয়েটার মাথা মুছিয়ে দিল।

“ভিজে কেন এলি?”

“লেট হয়ে যাচ্ছিল তো।”

“ইস, তাই বলে এভাবে ভিজে আসবি। বছরের প্রথম বৃষ্টি। শরীর না খারাপ করে।”

“উফ মিমি, তুমি একটু বেশি বেশি চিন্তা করো।”

“হুম, আমি তো বেশি বেশি চিন্তাই করি। বড়ো হয়ে গেছিস। তাই এখন মিমি বেশি বুঝে।”

সায়রা যেন মন খারাপ করল। আমিরা ওকে জড়িয়ে ধরল। গালে চুমু খেয়ে বলল,”উফ, আমার মিষ্টি মিমি। রাগ করে না। আমি তো ছোট।”

ওর কথায় হেসে ওঠল সায়রা। আমিরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলল,”আপনি আর ছোট নেই। কিছু দিন পর ই আঠারো তম জন্ম দিন আসতে চলেছে।”

আমিরা সংখ্যাটি হিসেব করল। তারপর মন খারাপ করে বলল,”ইস,কেন যে বড়ো হচ্ছি।”

“থাক, এখন আর এসব চিন্তা করতে হবে না। যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।”

আমিরা চলে গেল। সায়রা ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে হাসল। সময় পেরিয়ে গেছে। হ্যাঁ আরো অর্ধ যুগ পেরিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বাকি মানুষ গুলোর ও জীবন বদলেছে।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে