#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৩)
অনুভব মায়ের কাছে এসে নালিশ করতে লাগল। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে।
“মা, বাবা কী শুরু করেছে!”
“কী করেছে?”
“কী করে নি? আমার বন্ধুদের পিকনিকে সায়েমকে এড করতে বলছে!”
রূপবান ছেলের কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না। কাজ করতে লাগলেন। অনুভব রাগ দেখিয়ে চলে গেল। কিচেনের দরজার সামনে গিয়ে বলল,”আমি নাশতা করব না।”
“অনুভব, এই অনুভব।”
কে শুনে কার কথা। অনুভব রাতের পোশাক পরেই বেরিয়ে গেল। ছেলেটা যে আজ সমস্ত দিনেও বাড়ি ফিরবে না তা একেবারেই নিশ্চিত।
পার্কে এসে বসে রইল অনুভব। বাবার মতলব কী? সে কি চায় আসলে। ওর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু। এদিকে বেশ ক্ষিধেও পেয়েছে। পকেটে কোনো টাকা নেই। ভুলে ওয়ালেট ফেলে এসেছে। মেজাজ বেশ গরম। ও হতাশ হয়ে বসে রইল।
অনেকক্ষণ পর একটা কণ্ঠ শোনা গেল,”অনুভব।”
সায়রার গলার স্বর চিনতে ভুল হবে না ওর। ও চট করে দাঁড়িয়ে গেল। আহনাফকে নিয়ে পার্কে এসেছে ও।
“আজ পড়াতে এসেছিলে?”
“না, আহনাফকে বলেছিলাম ভালো রেজাল্ট করলে খেলতে নিয়ে আসব। তাই নিয়ে এসেছি।”
“আচ্ছা। তা আহনাফ কেমন রেজাল্ট হলো?”
আহনাফ হাসি হাসি মুখে বলল,”আমি, গড়ে নব্বই মার্ক পেয়েছি।”
অনুভব হা হওয়ার ভান করে বলল,”বাপ্রে! এত ভালো স্টুডেন্ট।”
সায়রা হেসে আহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এত গুলো মাসে আহনাফ ভীষণ উন্নতি করেছে। এই যে ছেলেটা এখন ঠিক ঠাক কথা বলতে পারে। আগে সেটাও পারত না। কারো সাথে মিশতেও পারত না। এখন সাধারণ বাচ্চার মতই তার আচরণ।
আহনাফ, অনুভব, সায়রা। তিনজন বল নিয়ে খেলছে। অনুভব দুষ্টুমি করে সায়রার মাথায় বল লাগিয়ে দিল। সায়রা চোখ ছোট ছোট করে বলল,”এটা কী করলে?”
“কোথায় কী করলাম?”
“অনুভব, আমি ব্যথা পেয়েছি।”
“আচ্ছা, সরি,সরি। চলো আবার খেলি। আহনাফ আমি বল ছুড়ে দিব, দেখব তুই কত দ্রুত আনতে পারিস।”
কথা মতন বল ছুড়ে দিল অনুভব। বলের পেছনে ছুটল আহনাফ। সায়রা হেসে বলল,”বাচ্চা’রা হয় মাটির মতন। তাদের যেমন রূপ দেওয়া হবে তারা তেমনই হবে।”
“কথাটা কোথায় যেন শুনেছিলাম। কপি করে বললে নাকি?”
“এটা প্রচলিত একটা কথা অনুভব। এখানে কপির কিছু নেই।”
“আমি মজা করেছি। শোনো, কাল ভোরে বের হবো সবাই।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আহনাফ বল নিয়ে এসেছে। অনুভব বুঝল ক্ষিধেয় তার পেট জ্বলছে। কাল রাতেও কিছু খাওয়া হয় নি।
অনুভব দুপুরেই বাড়ি ফিরে গেল। আর সহ্য হচ্ছে না। ক্ষিধেয় টনটন করছে শরীর। সে সোজা রান্না ঘরে গিয়ে খাবার নিয়ে এল। রূপবান নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন। শব্দ পেয়ে ওঠে এলেন।
“কখন ফিরেছিস?”
“কথা বোলো না। ক্ষিধেয় পেট জ্বলছে।”
“আগে কেন এলি না? না খেয়ে তো চলে গিয়েছিলি।”
“কী করব মা। বাবা যা তা শুরু করেছে। এভাবে চলে নাকি? অফিসের স্টাফকে নিয়ে যাব, বন্ধুদের পিকনিকে!”
“তোর বাবা চাইছেন যাতে সায়েমের সাথে তুই মিশতে পারিস।”
“তাতে কী লাভ হবে?”
“লাভ আছে। কাজের জন্য স্টাফদের সাথে মেশা ভালো।”
“উফ মা, তুমি সব সময় বাবার সাপোর্ট নাও। আমায় একটু ও ভালো বাসো না।”
ছেলের কথায় রূপবান হেসে ফেললেন। আরেক টুকরো মাছ ওঠিয়ে দিয়ে বললেন,”একটু স্বাস্থ্যের দিকে নজর দে বাবা। হয়েছিস তো তালগাছ, অথচ শরীরে কিছু নেই।”
“আমি তো শক্তিশালী মা।”
রূপবান চেয়ে রইলেন। সুদর্শন ছেলে তার। শক্তিশালী ঠিক আছে। তবে শরীরের যত্ন নিলে আরো বেশি শক্তিশালী হবে। এই কথাটিই বুঝতে চায় না অনুভব। ছোট থেকেই ছেলেটা একদম অলস প্রকৃতির।
গোছানোর কাজ চলছে। অর্পা আসবে একটু বাদেই। শুরুতে কথা হয়েছিল সায়রা গিয়ে অর্পাকে রিসিভ করবে। তবে পরে প্ল্যান চেঞ্জ হয়। অর্পা আর সাঈদ’রা প্রতিবেশী। ওদের বাড়িতে গেলে দেখা হওয়ার একটা সুযোগ থাকবে। যা চায় না সায়রা। এটা সত্য ভালোবাসাটা এখনো মরে যায় নি। তবে অন্যের স্বামীর প্রতি অনুভূতি দেখানোর মতো মেয়ে নয় সায়রা। হয়তো মন কে সামলানোর সাধ্য নেই তবে শরীর, সেটাকে সামলানোর সাধ্য তো আছে। ও মন থেকে চায় সাঈদ ভালো থাকুক এবং আর কখনো ওদের দেখা না হোক। সায়রা বিষয় গুলো ভাবছিল। ও মেনে নিয়েছে সবটা। সৃষ্টিকর্তা চান নি ওদের দুজনের পথচলা দীঘল হোক। নতুবা এত বাঁধা কেন থাকবে? পেয়ে গিয়েও কেন পাওয়া হবে না? সেদিন সাঈদ আর সায়রার জন্য ভাগ্য ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। ও নিজেকে সামলে নিল। এখন অনেক ভোর। পাঁচটা বাজে। রান্না ঘর থেকে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জুথি নিশ্চয়ই রান্না করছে। সায়রা গিয়ে দেখল, সত্যিই তাই।
“ভাবি, ওঠতে গেলে কেন?”
“তুই না খেয়ে যাবি নাকি।”
“না খেয়েই যেতাম।”
“সকালে বের হচ্ছিস, না খেয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অল্প কিছু খেয়ে যাবি।”
জুথিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সায়রা। ওদের দুজনের সম্পর্ক সত্যিকার অর্থে বোনের মতই। তবে মাঝে মধ্যে টানাপোড়ন চলে। যা অস্বাভাবিক কিছু না। জুথি রান্না শেষ করে সায়রার ঘরে এল। সায়রা তখন জানালা খুলতে ব্যস্ত। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভোরের বাতাসে অন্য রকম এক গন্ধ থাকে। সায়রা চোখ বন্ধ করে বলল,”ভাবি, জীবন আসলে খারাপ নয়।”
জুথি হাসল। সে অল্প কিছু খাবার প্যাকেট করে দিয়েছে। সেটাই ব্যাগের ভেতরে রাখল।
“সত্যি বলতে, জীবনে খারাপ সময় না এলে ভালো সময় কোনটা সেটা অনুভব করা যায় না।”
অনুভব শব্দটি শুনে সায়রার খেয়াল হলো ছেলেটাকে কল করা হয় নি। ও চট করে কল করল। অনুভব কল রিসিভ করে বলল,”এই মেয়ে, কল রিসিভ করছিলে না কেন?”
সায়রা তাড়াহুড়োয় খেয়াল করে নি অনুভব কল করেছিল কী না। ও দেখে নিল অনেক গুলো মিস কল দেখাচ্ছে।
“ফোন সাইলেন্ট করা ছিল।”
“আচ্ছা, আমি তোমার বাসার কাছেই আছি।”
অনুভব বাসার কাছে চলে এসেছে! সায়রা দ্বিধায় পড়ল। তারপর মিনমিনে স্বরে বলল,”তুমি গেটের কাছে আসো, আমি নামছি।”
কল রেখে সায়রা বলল,”ভাবি, একটু হাল্কা কিছু খাবারের ব্যবস্থা কোরো তো।”
কথা গুলো বলেই নেমে গেল সায়রা। খুব ভোর হওয়ায় মানুষ জন নেই। অনুভব সায়রার বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। চার পাশে নজর বুলাচ্ছে।
“অনুভব।”
মেয়েটার কণ্ঠ কেমন সতেজ। অনুভব চোখ বন্ধ করে নিল।
“এই অনুভব।”
আবার সেই কণ্ঠ। অনুভবের মনে হলো এটা শুধু কণ্ঠই নয়, যেন কোনো মাতাল করা যন্ত্রের সুর। অথচ বিষয়টি তার মনের ভুল কেবল। প্রেমে পড়ার অনুভূতি মাত্র। লোকে বলে প্রেমে পড়লে পেত্নিকেও ভালো লাগে। আর সায়রা তো ভীষণ সুন্দরী এক মেয়ে। যাকে দেখলেই বুকের ভেতর ধীম ধীম করে।
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি