#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৯)
সায়রা খুবই শীতল মস্তিষ্কে বসে আছে। এদিকে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে জুথির। ও এবার ধৈর্য হারিয়ে ফেলল।
“শোন সায়রা, এবার মনে হচ্ছে বড়োসড়ো একটা ঝামেলা হবে।”
“কিছুই হবে না ভাবী।”
“হবে রে। দেখ, বাহাদুর ভাই এবার লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে। না বুঝে শুনে তো নয়।”
“অথচ, একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে আমিরাকে মেয়ে হিসেবে অস্বীকার করে এসেছিল। আপাকে নিকৃষ্ট অপবাদ দিয়ে এসেছে। এখন শুধুমাত্র প্রপার্টি হাতানোর জন্য এমনটা করছে। এই সব তো মিথ্যে নয় ভাবী।”
সায়রার কথায় মুখ চুপসে গেল জুথির। এই বিষয়টা তাকে বার বার যন্ত্রণা দেয়। সায়রা নীরব কণ্ঠেই বলল,”অতীতে অনেক কিছু হলো ভাবী। আমার আপার আসলেই দোষ ছিল না।”
জুথির ও এখন তাই মনে হয়। সত্যিই আমেনার কোনো দোষ ছিল না। অথচ কত কিছু হয়ে গেল। কত অপবাদ সইতে হলো মেয়েটিকে।
আমিরার মতন একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে আদালতে হাজির হয়েছে সায়রা। এটি তার লড়াই। সে নিজেকে এখন মায়ের আসনে বসিয়ে নিয়েছে। ওর র ক্তে মাতৃত্বের হাওয়া। আমিরা ভীত হয়ে বসে আছে। সায়রা ওকে চেপে ধরে বলল,”ভয় পাবি না।”
আমিরা হু না কিছুই বলল না। বরং সায়রার গায়ের সাথে আরেকটু চেপে বসল। আদালতের কাজ শুরু হলো। বাহাদুরের অভিযোগ বাচ্চাটির ব্রেন ওয়াশ করা হয়েছে। আমেনার মৃ ত্যুর পর এক প্রকার জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার ছোট্ট মেয়েটিকে। মাঝে সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। যার ফলে তাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। তার মা নিজেই অসুস্থ। ছেলের যত্ন কীভাবে করবেন? তাছাড়া অনেক ব্যক্তিগত বিষয় রয়েছে। মা হয়ে তো ছেলের সব রকম যত্ন করতে পারবে না। কত রকমের সমস্যা। যার কারণে একজন মায়ের পক্ষেও বাহাদুরের যত্ন করা সম্ভব নয়। সেই জন্যই তাকে বিয়ে করানো হয়। এর ফলে আমিরা নিজেও নতুন করে মা পাবে। এই রকম নানান কথা সাজিয়ে বলা হয়। সায়রা শুধু অবাক হচ্ছে। কতটা মিথ্যুক হলে মানুষ এ রকম কথা বলতে পারে?
সায়রার পক্ষ থেকে এবার কথা আসে। আমিরা এগারো বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে। মায়ের মৃ ত্যুর পর তার দাদি তার ওপর অত্যাচার করতে থাকে। বাবা ম দ পানি খেয়ে বাসায় ফিরতে শুরু করে। এতে করে প্রায়শই বাবার হাতের আ ঘা ত ও সইতে হয় তাকে। একদিন আমিরাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। পাশের বাসা থেকে খবরটি জানতে পেয়ে আমিরাকে তার নানা বাড়িতে আনা হয়।
দু পক্ষের কথা শেষে আদালতের কাজ শেষ হয়। আমিরা ভয়ে তখনো নড়তে পারছে না। এমন পরিবেশ তার জন্য নতুন। নতুন তো সায়রার জন্য ও। ওরা দুজন আদালত থেকে বের হয়। অনুভব একটা কাজে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। তখনই ওদের দেখে। ওর কাছে মনে হয় দুজন সংগ্রামী মেয়ে হেঁটে চলেছে। এক মুহূর্তের জন্য অনুভবের সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। কেমন একটা তপ্ততা নামে।
বের হয়েই জুথিকে কল করল সায়রা। ফোন সাইলেন্ট করা ছিল। এর মধ্যে অনেকবার কল করেছে জুথি।
“হ্যাঁ ভাবী।”
“আদালত থেকে কী বলল রে সায়রা?”
জুথির কণ্ঠে ভয়। সায়রা মৃদু সুরে বলল,”কী বলবে আর।”
“কিছু বলে নি?”
“কেইস তো একদিনে সলভ হওয়ার জিনিস নয় ভাবী। দু পক্ষের বক্তব্য শুনেছে। এখনো তো অনেক কিছু বাকি।”
“আমার ভয় হচ্ছে রে।”
“ভয় কীসের। আমিরার জন্য ওর মিমি তো সব সময় ই আছে।”
সায়রার গলা দিয়ে যেন মধু ঝড়ছে। জুথির হুট করেই কান্না পেল। সে শুরুর দিকে আমিরার সাথে অন্যায় করেছে। কারণ অবশ্য ছিল। সে প্রচুর বিরক্ত ছিল সব কিছুতে। তখন মনে হয়েছিল আমেনা ম রে গিয়ে আরো বেশি অশান্তি তৈরি করে গিয়েছে। সবটা স্মরণ করে জুথির বুক হু হু করে ওঠল।
“ভাবী, জুঁই আর মাহিম ফিরেছে?”
“হ্যাঁ। মাত্রই ফিরল।”
“ঠিক আছে। ওদের জন্য আমি স্ন্যাকস নিয়ে আসব। আসতে আসতে বোধহয় সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
“সাবধানে আয়।”
কল রেখে সায়রা দেখল অনুভব নামের লম্বা ছেলেটি তার বরাবর দাঁড়িয়ে। সায়রা ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করল।
“তুমি এখানে কেন?”
দূর থেকেই জবাব দিল অনুভব। যার জন্য গলার স্বর হলো উঁচু।
“এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমায় দেখে থেমে গেলাম। কিন্তু তুমি এখানে কী করছো?”
সায়রা মৃদু হাসল। ইশারা করে কপালের অংশ টা দেখাল। অথার্ৎ ভাগ্য তাদের এখানে নিয়ে এসেছে।
অনুভবের সাথে বাইক রয়েছে। তবে সায়রা যেতে রাজি হলো না। অনুভব আমিরাকে ইশারা করল। আমিরা বুঝেও না বোঝার মতন ভান করে রইল। অনুভব মনে মনে বলল দুষ্টু বাচ্চা।
সায়রা আর আমিরা রিকশা নিয়েছে। অনুভব ও তাদের পাশাপাশি চলছে। রিকশার গতি আর বাইকের গতি কখনো এক হয়? অনুভব এত স্লো স্পিডে চালাচ্ছে যে আশেপাশের মানুষ ও কেমন করে তাকিয়ে দেখছে। সায়রার অস্বস্তি হচ্ছে। এদিকে অনুভব বিন্দাস মনে চলছে।
“এই অনুভব।”
“বলো,শুনছি।”
“স্পিড কমিয়ে দিয়েছ কেন?”
“কমালাম কোথায়?”
“মজা না? এই স্পিডে কখনো বাইক চালায় কেউ?”
“আমি চালাই।”
“না, স্পিড বাড়াও।”
“কেন?”
“দেখো না লোকজন কেমন করে তাকাচ্ছে।”
“তো!”
অনুভবের কণ্ঠে বিস্ময়। এদিকে রিকশা ওয়ালা মামা দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
“মামা, মনে হয় ভয় পাইতেছে।”
অনুভব ও তালে তাল মিলিয়ে হাসল। সায়রা প্রতিবাদ করে ওঠল।
“কীসের কী? তুমি যাও তো।”
অনুভব এবার শক্ত গলার বলল,”শুনলে না মামা কী বলল? আমি ভয় পাচ্ছি।”
এই টুকু বলে একটু থামল অনুভব। তারপর মিটিমিটি হেসে বলল,”হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলে এ যুগের মেয়ে’রা চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলতে চায়। তোমাদের মতন দুজন ঝগড়াটে মেয়ে পাশে থাকলে আর কেউ তাকাবেও না।”
সায়রা চোখ রাঙাল। এদিকে রিকশা ওয়ালা মামা হাসছে। আমিরা এবার বলল,”অনুভব খুবই ভীতু।”
সায়রা ওকে ধমকে ওঠল,”এই নাম ধরে ডাকছিস কেন?”
“ও ই তো বলেছে নাম ধরে ডাকতে।”
সায়রাকে কথা বলতে না দিয়ে অনুভব বলল,”হুম আমরা হলাম বন্ধু। তাই না আমিরা?”
আমিরা ভেংচি কেটে বলল,”বন্ধু না শত্রু।”
অনুভব হতাশ হয়ে বলল,”ভালোই না? মিমি কে দেখেই পাত্তা নেই।”
আমিরা আর অনুভবের কথা চলতে লাগল। সায়রা তীব্র হতাশা নিয়ে বসে রইল। দুজনের কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে এরা ক্লাসমেট। এই অনুভবটা আসলেই কী পাগল?
বাড়ি অবধি আসল অনুভব। সায়রা ওকে ভদ্রতা করে বাসায় আসতেও বলল না। এর জন্য কারণ রয়েছে। প্রতিবেশি’রা ভীষণ খারাপ। এমনিতেই সায়রার নামে বাজে কথা ছড়াতে ব্যস্ত। অনুভবকে নিয়ে বাসায় গেলে আরেকটা সুযোগ পেয়ে যাবে। অনুভবের উদ্দেশ্য ছিল সায়রার বাসা চিনে যাওয়া। কজ এই মেয়েটা সোশ্যাল মিডিয়ায় একদমই সময় দেয় না। এদিকে অনুভব দিন রাত সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়ে থাকে। তার একটা পেজ ও আছে। সেই পেজের ফলোয়ার প্রায় পঞ্চাশ হাজার। ভালোই আগাচ্ছিল সব। ইদানীং গান টান করে না বিধায় রিচ ডাউন হয়েছে। অনুভব চলে যেতেই সায়রা দম ফেলল। ভেতরে যেতে যেতে বলল,”কীরে অনুভব আর তোর মাঝে বন্ধু শত্রু ভাব এল কেমন করে রে?”
“আর বোলো না মিমি। আমাদের স্কুলটা তো অনুভবের বাবার ই। একদিন স্কুলে দেখা হলো। বন্ধু হলো। তারপর আবার চুল টেনে দিয়ে পালাল। এর জন্যই বন্ধু থেকে শত্রু বানিয়েছি।”
“বলিস কী রে দু মিনিটের বন্ধু ছিল তবে?”
“হুম।”
কথা বলতে বলতে ওরা ভেতরে চলে এল। সায়রা হাতের জিনিস পত্র নামিয়ে দেখল জুঁই কিচেনে। সে চা হাতে ফিরল।
“পিপি, দেখো তো চা টা কেমন হয়েছে। রিসেন্ট একটা রেসিপি দেখে শিখেছি। অনেক ভেষজগুণ রয়েছে।”
“রাখ, ফ্রেশ হয়ে আসি। আর স্ন্যাকস আছে, একটু বের কর তো সোনা।”
নির্দেশনা দিয়ে সায়রা ফ্রেশ হতে গেল। মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে সায়রা’র খেয়াল হলো অনুভবের কথাটা। আমিরার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে অনুভবের পরিবার বিশাল বড়োলোক। তবে আচরণে বোঝার উপায় নেই।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি