#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৭)
সায়রা তিনদিন অসুস্থ হয়ে বাসায় ছিল। পড়াতে যেতে পারে নি। তারপর টানা তিনদিন আহনাফকে পড়িয়ে গিয়েছে। এর মাঝে অনুভবের সাথে দেখা হয় নি। ফোন নাম্বার ও নেই যে কল করবে। ছেলেটার টাকা ফেরত দিতে হবে। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ। সায়রা একটু মন খারাপ করেই বের হলো। তারপর রিকশা নিল। আজকে শাড়ি পরার কথা থাকলেও সে শাড়ি পরে নি। শরীরে নিচ্ছিল না। তবে বন্ধুদের জন্য বের হতে হচ্ছে। ও সোজা সাহবাগ গিয়ে নামল। সেখানে ফুলের রাজ্য বসেছে। শয়ে শয়ে ফুল রাখা। কী যে সুন্দর লাগছে। ও বেছে একটা গোলাপ নিল। সেটা কানের পিঠে লাগিয়ে হাঁটা লাগাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। বন্ধুদের জন্যই বই মেলায় আসতে হয়েছে তাকে। যদিও ইচ্ছে ছিল না। মেলার গেটে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল অর্পা আর সোনালী। ওদের দুজনের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন হলো।
“শরীর ঠিক আছে এখন?”
অর্পার প্রশ্নে মলিন হেসে নিল সায়রা। সোনালী আর অর্পা দুজনেই সাঈদের ব্যাপারে অবগত। মনের ভেতর অনেক কথা জমে থাকলেও ওরা বলতে চায় না। কারণ মেয়েটি নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রয়াস করছে। যদি সাঈদের কথা ওঠে তবে আবার ভে ঙে যাবে।
পুরো মেলা ঘুরে ও সায়রা কোনো বই কিনল না। সে বই পছন্দ করে। তবে তার এখন সংকট চলছে। অনেক বুঝে চলতে হচ্ছে। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে বইটা কিনল না। অথচ তার খুব ইচ্ছা ছিল একটা বই কেনার। কিনতে গিয়েও সেটা রেখে দিল। মনে হলো টাকাটা রাখা প্রয়োজন।
অনুভব আর তার বন্ধুরাও মেলায় ঘুরতে এসেছে। অনুভব বই পড়ুয়া নয়। সে গানের মানুষ। গান ভালোবাসে। সে এমনিতেই এসেছিল। তখনই সায়রাকে দেখতে পায়। মেয়েটি পছন্দ করা বইটি রেখে দিয়েছে সেটা বুঝতে পারে। তাই সে চট করে বইটা কিনে নেয়। ওর বন্ধু’রা ভীষণ অবাক হয়ে বলে।
“কী রে? তুই আর বই!”
“একজন কে দিব।”
এ কথা বলেই লম্বা কদম ফেলে অনুভব। সায়রার বান্ধবী’রা অন্য স্টলের সামনে গিয়ে বই কিনছে। ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে। কারণ স্টলের সামনে গেলেই বইয়ের প্রতি ঝোঁক হবে। কিনতে ইচ্ছা হবে।
“সায়রা।”
অনুভবের কণ্ঠটা আজকাল অনেক বেশি পরিচিত হয়ে গেছে। মুহূর্তেই চিনে নিল ও। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল লম্বা দেহের চিকন ছেলেটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে।
“অনুভব, তোমাকেই খুঁজেছিলাম এ কদিন।”
“আমাকে?”
“হ্যাঁ। তোমার টাকাটা।”
এ কথা বলেই সায়রা নিজের ব্যাগ খুলতে থাকে। সেখান থেকে টাকা বের করে নিয়ে বাড়িয়ে দেয়।
“তোমার টাকাটা।”
“দরকার নেই।”
“এটা কেমন কথা? নেও। আমি তোমার থেকে ধার নিয়েছি।”
কথাটি বলেই অনুভবের হাতে টাকাটা গুজে দিল সায়রা। এতে দুজনের হাতের দূরত্ব নেমে গেল। স্পর্শ লাগল। অনুভবের মনে হলো তার ভেতরে ঝড় ওঠে গেছে। অবাধ্য সব ইচ্ছা হচ্ছে। সামনের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরার লোভ হচ্ছে। তবে সে এমনটি করতে পারে না। আর পারে না বিধায় তার শরীরের সমস্ত লোম জেগে ওঠে। শিরশির অনুভূতি হয়। সায়রা হাত সরিয়ে নিতেই অনুভবের ধ্যান ফিরে। ও এক সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয়। তারপর হাতে থাকা ব্যাগটা বাড়িয়ে দেয়।
“কী?”
“দেখো।”
সায়রা ভ্রু কুঞ্চিত করে থেকে তারপর ব্যাগটা নেয়। খুলে দেখে বই। একটু আগেই “প্রেমানল” বইটা সে দেখে এসেছিল। পছন্দ হয়েছিল। অথচ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিতে পারে নি। সায়রা চেয়ে থাকে। অনুভব মৃদু সুরে বলল,”তোমার জন্য।”
সায়রা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়,”আমি এটা নিতে পারব না অনুভব।”
“কেন? সমস্যা কী?”
“অনেক সমস্যা।”
আসলে সায়রা চায় না কোনো উপহার নিতে। এতে ঋণের বোঝা বাড়বে। অনুভব জোর করতে লাগল। সায়রা এতে ধৈর্যহীন হলো। উপহার যেন না নিতে হয় তাই বুদ্ধি করে বলল,”অনুভব এটা আমি নিতে পারব না। এই কারণে নিতে পারব না কারণ টাকাটা তোমার বাবার। আমার মনে হয় উপহার দিতে হয় নিজের উপার্জনের টাকায়।”
কথাটা অতো ভেবে চিন্তে বলে নি সায়রা। তবে অনুভবের খুব লেগে যায়। পৃথিবী উল্টে গেলেও সে বইটা আজ দেবেই।
“ঠিক আছে। তুমি আমায় ত্রিশ মিনিট সময় দাও।”
এ কথা বলেই অনুভব এগিয়ে যায়। একটা ছেলে ফুল বিক্রি করছিল। প্রতি পিস ত্রিশ টাকা। অনুভব সেখান থেকে বিশটা ফুল কিনে নেয় পাঁচশ টাকা দিয়ে। এক সঙ্গে এত গুলো কেনায় ২৫ টাকা করে দিয়েছে তাকে। সায়রা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এই ছেলে করছে টা কী?
তারপরের ঘটনা সায়রাকে আরো বেশি অবাক করে। অনুভব ফুল গুলো নিয়ে বিভিন্ন স্টলে যায় এবং অভিনব উপায়ে লেখক লেখিকাদের কাছে পঞ্চাশ টাকা করে ফুল বিক্রি করতে থাকে। এতে চারপাশে ভীড় ও জমে যায়। ভিডিও করছে অনেকে। সায়রার মনে হলো সে মাথা ঘুরিয়ে পড়বে। এ ছেলে নিশ্চিত পাগল!
ত্রিশ মিনিট পর সব গুলো ফুল বিক্রি হয়ে যায়। পাঁচশ টাকার ফুল এক হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। অথার্ৎ পাঁচশ টাকা লাভ হয়েছে। বই মূল্য তিনশ চল্লিশ টাকা। বাকি থাকে থাকে একশ ষাট টাকা। সেই টাকা দিয়ে অনুভব ফুল কিনে আনে। সবটা ত্রিশ মিনিটে ঘটে যায়। সায়রা শুধু চেয়ে থাকে। সায়রার বান্ধবী’রা তখনো বই কিনে ফেরে নি। অনুভব কিছুটা ক্লান্ত। ও ফুল আর বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”আমার নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা। এবার নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা নেই?”
সায়রা বাড়ি ফিরে এসেও নিজেকে ঠিক করতে পারছে না। অনুভবের এমন আচরণ ওকে বিস্মিত করেছে। ছেলেটা নিশ্চয়ই পাগল। না হলে এমনটা কেন করবে? ও ফুল আর বই নিয়ে ওমনি বসে রইল। ড্রেস চেঞ্জ ও করল না। এভাবে কিছু সময় বসে থেকে ফুল গুলো রাখল টেবিলের ওপর। তারপর বসল বইটা নিয়ে। বইটা স্পর্শ করতেই নিজের অতীতের কথা স্মরণ হলো। প্রেমানল, যার অর্থ ভালোবাসার আগুন। তার জীবনটাও অনলে পু ড়ে গেল। কোথায় হারাল ভালোবাসা?
এক দমে বইটা পড়ে শেষ করেছে সায়রা। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজান পড়েছে। ও দ্রুত গিয়ে অজু করে নামাজ পড়ে নিল। তারপর গেল গোসলে। সারাদিনের ক্লান্তিটা হাওয়াই মিঠাই এর মতন মিলিয়ে গেল যেন। ভেজা চুল গুলো মুছে নিতে নিতে সায়রা ফোন অন করল। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেতেই অনেক নোটিফিকেশন এল। তারপর একটি নোটিফিকেশন এমন যে অনুভব এহমাদ আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। অনুভব নামটা দেখেই সায়রা অ্যাকসেপ্ট করে নিল। প্রোফাইলে গিয়ে দু একটা ছবি দেখল। তারপর ভাবল ছেলেটা পাগল। নতুবা মেলায় ওমনটা করত না। কোনো সাধারণ মানুষ ওমন পাগলামি করতেই পারে না।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি