মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১৬

0
365

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৬)

কক্সবাজার থেকে বাসায় ফেরার পর, সায়রার মনে হলো মাথা ফেটে যাচ্ছে। তীব্র ব্যথায় ও কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। আমিরা ঘরে প্রবেশ করে বলল,”মিমি, কী হয়েছে?”

“শরীর খারাপ লাগছে খুব।”

“মামি কে ডেকে দিব?”

“না। তুই ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে সোনা। আমি একটু ঘুমাই। খুব দরকার না হলে ডাক দেওয়ার প্রয়োজন নেই।”

এই যে মেয়েটি ঘুমাল, তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার কিছু সময় পর। ওঠে দেখল বাইরে থেকে মৃদু চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ও চটপট ওঠে পড়ল। বেরিয়ে দেখল সোফায় আমিরার বাবা বসে আছে। সায়রার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ও সরাসরি বলল,”কী সমস্যা? এ বাড়িতে কেন এসেছেন?”

বাহাদুর শুরুতেই রাগ কিংবা উচ্চবাক্য করল না। বরং দর‍দ দেখিয়ে বলল,”কেমন আছ?”

সায়রা তার কোনো বাক্যের তোয়াক্কা করল না। জুথির দিকে তাকাল। ইশারায় জুথি তাকে কিছু বোঝাল। সেটা বুঝে নিয়ে সায়রা বলল,”দেখুন বাহাদুর ভাই, আপনার সাথে আমাদের সমস্ত সম্পর্ক শেষ। আপার মৃ ত্যু র পর আপনি ও আমাদের জন্য মৃ ত হয়ে গেছেন।”

বাহাদুরের আম্মা ও বসা ছিলেন। তিনি সায়রার কথার প্রতিবাদ করে ওঠলেন।

“এই মেয়ে। ভদ্র ভাবে কথা বলো। আমার ছেলে এখনো জীবিত। তাকে তুমি মে রে ফেলছো!”

সায়রা কথাটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল,”আপনাদের সাথে কোনো রকম কথা বলার ইচ্ছা নেই। আপনারা যেতে পারেন।”

বাহাদুর এবার জবাব দিল। “আমরা এখানে থাকতে আসি নি সায়রাহ আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি।”

সায়রা সোজাসাপ্টা বলল,”আমিরা কোথাও যাচ্ছে না।”

“কেন যাবে না? আমার মেয়ে আমি নিয়ে যাব।”

“আচ্ছা? এতদিন এই দর‍দ কোথায় ছিল? ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে যখন আপনার আম্মা বের করে দিলেন আপনি কেন নির্বাক ছিলেন?”

বাহাদুর জবাব দিতে পারল না। পাশ থেকে ওর আম্মা জবাব দিল।

“অনেক কথা হয়েছে। আমরা আমিরাকে নিয়ে যাব। এটা আমাদের অধিকার।”

“আমিরা যাবে না।”

“আমরা নিয়েই যাব।”

এ কথা বলেই তিনি ওঠে দাঁড়ালেন। সায়রা মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল।

“আন্টি আপনি আমাকে অসভ্য হতে বাধ্য করবেন না।”

“বাহাদুর, মেয়ে নিয়ে চল।”

আমিরা ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল। সে থরথর করে কাঁপছে।

“আমিরা চলো।”

আমিরা এক পা পিছিয়ে গেল। বাহাদুর ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। সায়রা হুংকার দিয়ে ওঠল।

“বাহাদুর ভাই, আপনাকে সাবধান করছি। আমিরাকে স্পর্শ ও করবেন না।”

“তুমি বলে দিবে আমি কি করব আর না করব?”

“আমিরার বিষয় হলে অবশ্যই আমিই বলে দিব।”

তর্ক চলতে লাগল। বাহাদুরের আম্মা আমিরার কাছাকাছি যেতে নিলেই আমিরা ছুটে এসে জুথির পাশে দাঁড়াল। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। মারুফ এখনো ফিরে নি। ভয়ে জুথির চোখ মুখ র ক্ত হীন হয়ে যাচ্ছে।

আমিরাকে পালাতে দেখে বাহাদুরে আম্মা চেচামেচি করতে লাগলেন।

“আমিরা এদিকে আয়। আয় বলছি।”

আমিরা ভয়ে কাঁপছে। ওকে দু হাতে জাপটে ধরল জুথি।

“আন্টি আপনি জোর কেন করছেন। ও তো যাবে না।”

“কেন যাবে না? ওকে যেতেই হবে।”

এবার সায়রা জবাব দিল,”সেটি নিশ্চয়ই আপনার জানা। আপার মৃ ত্যু শোক যাওয়ার আগেই তো ছেলের জন্য ঘরে নতুন বউ এনেছেন। সেখানে কেন যাবে ও? এই ভালো মানুষি কেন দেখাচ্ছেন আমাদের জানা আছে।”

“এই অসভ্য মেয়ে। তুমি কোনো কথা বলবে না। অনেক বেশি বেয়াদব।”

সায়রা এ কথার পৃষ্ঠে কিছু না বলে বাহাদুর কে বলল,”দয়া করে বাসা থেকে বের হোন। না হলে অন্য অপশন বেছে নিতে বাধ্য হবো।”

তার কথা শেষ হতে না হতে বাহাদুরের আম্মা এসে আমিরার হাত খপ করে ধরে ফেললেন। তার শরীরের শক্তির সাথে পেরে ওঠল না জুথি। সায়রা ছুটে গিয়ে বাঁধা দিল।

“আন্টি আপনি অনেক বাড়াবাড়ি করছেন। ওর হাত ছাড়েন।”

এ কথা বলেই আমিরার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সায়রা। তাদের এই দ্বন্দ্বে যোগ দিল বাহাদুর ও। এক পর্যায়ে ধাক্কা লাগল সায়রার বাহুতে। ও ছিটকে পড়ল অদূরে। সে সময়েই বাড়িতে প্রবেশ করল মারুফ। এই সব দেখে ও চেচিয়ে ওঠল।

“কী হচ্ছে কী এসব।”

সায়রা হাতে ব্যথা পেয়েছে। তবু ও ওঠে দাঁড়াল। ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,”আমিরাকে নিতে এসেছে ভাইয়া। এখন ভালো মানুষ সাজা হচ্ছে। আসল উদ্দেশ্য তো অন্য জায়গায়।”

বাহাদুর আর তার মায়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠল। মারুফের ফেরার পর পর ই ফিরল জুঁই আর মাহিম। এত গুলো মানুষের সাথে কিছু সময় তর্ক চলল। তারপর বাহাদুর আর তার আম্মা চলে গেলেন। তবে যাওয়ার পূর্বে বললেন তারা আইনি সহায়তা নিবে। দেখবে কী করে আমিরাকে এই বাড়িতে রাখে।

হাতের এক অংশ কে টে গেছে। র ক্ত দেখা যাচ্ছে। অথচ সেসবে ধ্যান নেই সায়রার। ওর চোখ ছলছল করছে। ও এসে কান্নারত আমিরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

“কাঁদিছ না। আমরা আছি তো।”

আমিরার কান্না থামছে না। ও ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। স্মরণ করছে বিগত দিনের কথা গুলো। মায়ের মৃ ত্যুর পরে দাদির অত্যা চার, বাবার অবহেলা। না খেয়ে থাকা। আরো কত কি। এসব আমিরার বুকের ভেতর ক্ষ ত সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষ ত কখনো যাবে না।

ব্যথাটা নামল না দুদিনেও। বরং কাঁপিয়ে জ্বর এল। এই জ্বর নিয়েই আহনাফ কে পড়াতে এসেছিল সায়রা। লিফ্টের বাটনে ক্লিক করতে গিয়ে ওর মাথা ঘুরিয়ে গেল। সেই সময়েই ছাদ থেকে নামছিল অনুভব। মেয়েটিকে দু হাতে ধরে ফেলল ও।

“সায়রা, হায় আল্লাহ, তোমার শরীরে তো জ্বর।”

সায়রার চোখ মুখ অন্ধকার লাগছে। ও কিছু দেখতে পারছে না। অনুভব ওকে এক হাতে ধরে রেখে লিফ্টের বাটনে ক্লিক করল। কিছু সময় পর লিফ্ট খুলে গেল। ও সায়রাকে নিয়ে সোজা নিজের বাসায় এল। অনুভবের মা রূপবান দ্রুত পানি পট্টির ব্যবস্থা করলেন। অনুভব নিজে সেটা সায়রার কপালে লাগিয়ে দিচ্ছে। ওর চেহারায় চিন্তার ছাপ। রূপবান ছেলের অবস্থা লক্ষ্য করলেন। তিনি বুঝলেন ছেলের মন এখানে আটকে গেছে।

সায়রা একটু সুস্থ হয়েই লজ্জায় পড়ল। তা ও অনুভব তার পথের বন্ধু। খুব বেশি দিন তো কথা হয় নি। তার পরিবারের সাথে আগে কখনো দেখাও হয় নি। সব মিলিয়ে সে লজ্জিত। তাই দ্রুত চলে যেতে চাচ্ছে। তবে রূপবান না খেয়ে যেতে দিবেন না। লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে। তাকে খেয়ে যেতেই হবে। অনুভব আর সায়রা দু প্রান্তে বসে খাচ্ছে। মেয়েটির মাথা নত করা। ও অল্প একটু খেয়ে ওঠে যেতে নিলেই অনুভব বাঁধা দিল।

“ভালো করে খাও।”

“খেলাম তো।”

“দেখলাম, কি খেয়েছ।”

“আমি এমনই খাই অনুভব।”

“আরেকটু খাও।”

জোর করে খাবার তুলে দিল অনুভব। সায়রা হতাশ হয়ে চেয়ে রইল।

সায়রাকে বিদায় দিয়ে রূপবান ছেলেকে ডেকে নিলেন। অনুভব বরাবরের মতই গা ছাড়া ভাব নিয়ে উপস্থিত হলো।

“অনুভব, মেয়েটার কথা আগে কেন বলো নি?”

“কী বলব মা?”

“তাকে পছন্দ করো।”

“না। তেমন কিছু না।”

“আমার তো তাই মনে হলো। যাই হোক, তোমার উচিত বিজনেসে জয়েন করা।”

“আমার ভালো লাগে না ওসব।”

“তবে, সারা জীবন এভাবেই থাকবে?”

“সমস্যা কী থাকলে?”

ছেলের কথা একদমই পছন্দ হলো না রূপবানের। এক মাত্র সন্তান বিধায় একটু বেশিই আদরে বড়ো করেছেন। তবে এমন অলস হলে তো ভবিষ্যতের জন্য সমস্যা। তিনি ছেলের উদাসীনতা চেয়ে দেখতে লাগলেন। এই ছেলে বুঝতে পারছে না তার ভবিষ্যত কতটা ভয়াবহ হতে চলেছে।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে