মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-১৫

0
368

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১৫)

সায়রাদের ফেরার দিন চলে এল। ছোট্ট একটা ট্যুর হলো তাদের। সাঈদের ব্যাপারটা ছাড়া সময়টা ভালোই ছিল। সমুদ্রের গর্জন শুনেছে সে। ঢেউয়ের আদর নিয়েছে। সব মিলিয়ে খারাপ নয়। আমিরা এখনো ঘুমিয়ে। ওকে ডেকে নিল সায়রা। তারপর ব্যাগ প্যাকিং শুরু হলো। সব গুছিয়ে নিতে কিছু সময় লাগল। নাশতা করতে গিয়ে শুনল সকালে নয়,বিকেলে বের হবে। এতে অবশ্য ভালোই হলো। আরেকটু সময় পাওয়া গেল। সমুদ্রের ভালোবাসা নেওয়া যাবে। আমিরাকে আহনাফের সাথে খেলতে দিয়ে সায়রা গেল সমুদ্র পাড়ে। সেখানে আগে থেকেই অনুভব রয়েছে। তাকে দেখে মনে হলো রাতে ঘুম হয় নি। চোখ কেমন ফুলে, লাল হয়ে গিয়েছে। চাহনিতে প্রাণ নেই। সায়রা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থেমে গেল। শব্দহীন দুজন পথ চলছে। অনুভব ভীষণভাবে বুকের মাঝে ব্যথা উপলব্ধি করল। এই ব্যথাটা কোনো ঔষধের দ্বারা নিরাময় সম্ভব নয়। হঠাৎ সমুদ্র গর্জে ওঠল। সায়রা ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গেল। অনুভব পেছন ঘুরে বলল,”ভয় পেও না। চলো সামনে যাই।”

অনুভব কেমন বদলে গেল যেন। চঞ্চলতা নেই। সায়রা মৌন থেকে পথ চলতে লাগল।

“সায়রা, সমুদ্রের এই সামান্য গর্জনেই ভয় পেয়ে গেলে। আমার বুকের ভেতর যে গর্জন চলছে, সেটা আমি কেমন করে সইব বলো তো।”

কথাটা মিনমিনে সুরে বলল অনুভব। সায়রা ঠিকঠাক না বুঝতে পেরে শুধাল,”কিছু বললে?”

এক সেকেন্ড সময় নিয়ে, অনুভব জবাব দিল। “উহু।”

“আমার মনে হলো কিছু বললে।”

“না কিছু না।”

তারপর দুজনের আর কথা হলো না। সমুদ্র কেমন গর্জে ওঠেছে। সায়রার ভয় লাগছে। ভালো লাগছে না। তাই ওরা ফেরার জন্য পথ ধরল।

সমুদ্র হয়তো চেয়েছিল ওরা আরো কিছু সময় থেকে যাক। তাই নিজেকে মেলে দিয়েছে। আকাশ হুট করেই মেঘে ছেয়ে গেছে। আঁধার নেমে এসেছে। সামান্য পথটুকুও দেখা যাচ্ছে না। বালির বাতাস হচ্ছে! পথ চলতে চলতে ওরা অনেক দূর চলে এসেছিল। আবহাওয়া খারাপ হওয়াতে রাস্তা চেনা যাচ্ছে না। কি এক সমস্যার সৃজন হলো। সায়রা চিন্তিত হলো। অনুভব ও তাই। দুজনেই পথ হারিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সায়রা একটু বেশিই অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। এদিক সেদিক ছোটার চেষ্টা করলেই অনুভব ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল,”কোথায় যাচ্ছ?”

“আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি অনুভব।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এভাবে কোথায় ছুটছো?”

“জানি না। আমার ভয় হচ্ছে।”

অন্য সময় হলে অনুভব ও ভয় পেত। কিন্তু যার হৃদয়ে প্রেমের জোয়ার আসে তার হৃদয় আর ভয় পেতে চায় না। অনুভবের অবস্থাটিও তেমন হয়ে গেছে। ও একটু খেয়াল করে দেখল আশেপাশে সারি সারি ঝাউগাছ। রিসোর্টের সামনে এমন পরিবেশ ছিল না। ওরা কীভাবে যে এদিকে চলে এল। নেটওয়ার্ক ও কাজ করছে না। এদিকে সমুদ্র উতাল পাতাল করছে। আকাশ গর্জে ওঠছে। বাতাসের শনশন শব্দ কানে এসে লাগছে।

“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় অনুভব।”

“সায়রা দাঁড়াও।”

এগিয়ে চলেছে সায়রা। অনুভব ছুটে এসে ওর পাশাপাশি হলো।

“এভাবে কোথায় যাও। পথ না চিনে তো বিপদে পড়বে।”

সায়রার মাথা কাজ করছে না। দুর্যোগ ভয় পায় সে। অনেক বছর আগের কথা। এক দুর্যোগময় পরিবেশে হারিয়ে গিয়েছিল। সেখানেও এমন সমুদ্র ছিল। ঝাউবন ছিল। অন্ধকার ছিল। মেঘ গর্জন করছিল। সায়রার হৃদয়ে হুংকার বেজে ওঠল। সেই অতীত ও একেবারেই ভুলে বসেছিল। আজকের এই পরিস্থিতি হুট করেই সব জীবন্ত করে তুলেছে। সায়রা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। কান্নায় ভে ঙে পড়ল। অনুভব একজন পুরুষ হয়েও বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎকাল পর নিচু হয়ে সায়রার বাহুতে স্পর্শ করল। মেয়েটির চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। ভয়ে চুপসে গেছে সে। আকাশ আর সমুদ্র পাল্লা দিয়ে গর্জন করছে। সে গর্জনে সায়রা যেন আরো বেশি ভীত হয়ে পড়ল। ও ক্রমশ অনুভবের শরীরের সাথে মিশে যেতে লাগল। ওর মাথার ঠিক নেই। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। যেন সব কিছু ছেড়ে প্রাণটা বেরিয়ে আসবে।

সায়রাকে কোনো মতে টেনে ঝাউগাছের দিকে নিয়ে এসেছে অনুভব। বাতাসের গতি প্রচুর। তবে বৃষ্টির দেখা নেই। শনশন শব্দে কথা বোঝা যাচ্ছে না।

“সায়রা, শক্ত থাকো। শক্ত থাকো প্লিজ।”

সায়রা শক্ত হতে পারছে না। ওর অতীত ওকে নুয়ে দিচ্ছে। ভয়ের চোটে দম বন্ধ হয়ে আসছে। অনুভব এবার চিন্তিত উদ্বিগ্ন হলো। রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করতেই সায়রা ওকে টেনে ধরল। ইশারায় বোঝাল ওর ভয় হচ্ছে। অনুভব থেমে রইল। নেটওয়ার্ক নেই। আশেপাশের অবস্থাও খারাপ। একটা সময় পর অনুভবের মস্তিষ্ক শীতল হলো। ও লম্বা করে শ্বাস নিল। ভরসা হারালে চলবে না। সায়রা ভয় পেয়ে আছে। তাকে সামলাতে হবে। ও সায়রার কাছেই থেকে গেল। ইষৎ হাতে মেয়েটিকে আগলে নিল। অন্য সময় হলে সায়রা নিশ্চিত তুরকালাম করে দিত। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন যে অনুভব তাকে জড়িয়ে থাকার পর ও সে কিছু বলছে না। বরং একদম চুপসে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করা। হাত দুটো অনুভবের শার্ট খামচে আছে। যেন ভীষণ বিপদে এক টুকরো ভরসা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়াস।

অর্ধভেজা হয়ে রিসোর্টে ফিরল অনুভব আর সায়রা। আকাশ আর সমুদ্র হুট করেই গর্জে ওঠেছিল। এখন কিছুটা শীতল। সায়রাকে দেখে মনে হচ্ছে নিজের মধ্যে নেই। অনুভব ওকে আলগোছে রুমে পৌছে দিল। আমিরা চিন্তিত ছিল। তার চোখে মুখে ভয়।

“মিমি।”

সায়রাকে জাপটে ধরল আমিরা। অনুভব মৃদু সুরে বলল,”ভয় পেও না। মিমি কে ড্রেস চেঞ্জ করতে সাহায্য করো।”

কথাটি বলেই নিজের রুমে চলে এল অনুভব। এখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। অনুভব এসে ড্রেস বদলে নিয়ে কফি নিল। সায়রা তখনো স্বাভাবিক হয় নি। ওর বিষয়টা বুঝতে পারছে না অনুভব।

“একটু বাইরে আসবে?”

সায়রা শুনে নি। আমিরা ও হতবাক। সে ছোট্ট একটা বাচ্চা। আহামরি বোঝার মতন ক্ষমতা হয় নি তার। তবে ডেকে দিল সায়রাকে।

“মিমি, তোমায় ডাকছে।”

“হুম?”

বিছানায় বসেই জবাব দিল সায়রা। অনুভব দরজার বাইরে থেকেই বলল,”একটু বাইরে আসতে পারবে?”

মুখে কিছু না বলে বাইরে এল সায়রা। অনুভব সায়রাদের রুমে প্রবেশ করে নি। ওরা বাইরের সিটিং এরিয়ায় বসল। অনুভব কফি এগিয়ে দিল।

“থ্যাংকস।”

মেয়েটি যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই অনুভব খুব করে বুঝতে পারছে। তাই সে চুপ করে রইল। কফি শেষ করে সায়রা নিজ থেকেই বলল,”আমাকে অনেক সাহায্য করলে অনুভব। আমি এই ঋণ কখনো শোধ দিতে পারব না।”

অনুভব কথাটি এড়িয়ে গিয়ে বলল,”হুট করে এত প্যানিক কেন করছিলে?”

“বেশ অনেক গুলো বছর আগে। আমি চট্টগ্রামের শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে যেন আমাকে সমুদ্রের পাড়ে পাওয়া যায়। আমি সেই দুর্যোগ এ মানসিক ভাবে আ ঘা ত পাই। কিছু মাস কথা বলাই বন্ধ করে দেই। ট্রিটমেন্ট করা হয়। তারপর ঠিক হই। তবে কীভাবে হারিয়ে, সমুদ্রে এসে পৌছাই আমার আসলে মনে নেই। তারপর অনেক বছর পার হলো। হুট করে আজকে ওমন পরিস্থিতি আমায় ব্যস্ত করে দিয়েছিল। তোমাকে ধন্যবাদ, আমায় সেইফ করার জন্য।”

অনুভব শুধুই ঠোঁট একটু প্রসারিত করল। তারপর চট করেই বলল,”তোমার মাথায় তেলাপোকা।”

তেলাপোকার নাম শুনে লাফিয়ে ওঠল সায়রা। সে বিশেষ ভয় পায় প্রাণীটিকে। এদিকে অনুভব হেসে যায় যায়। সায়রা বুঝতে পারল, ছেলেটা তার সাথে মজা করেছে।

“অনুভব! তুমি এমন কেন বলো তো?”

অনুভব শুধুই হাসে। মেয়েটিকে স্বাভাবিক করার জন্যই ওমন করল সে। এদিকে সায়রা রেগেমেগে চলে যায়। মন বলে,ছেলেটার মাঝে এত কম ম্যাচিউরিটি কেন?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে