#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৮)
তখন মধ্যরাত। সায়রা পড়ছে। ভীষণ মনোযোগে। টিউশনির কারণে তার সময়ের ঘাটতি ঘটেছে। পড়াশোনাটা ঠিক ঠাক হচ্ছে না। বাচ্চা পড়াতে ব্রেনের খরচ হয় বেশি। শরীরে ক্লান্তি আসে। তবে পড়াশোনা তো ছাড়া যাবে না। টিউশনি ও ছাড়া যাবে না। সেই জন্যে অধিক রাত অবধি পড়ছে সে। সি জি পি এ ভালো না হলে সামনে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। এ রকমের চিন্তা থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে মেয়েটা। ওর ঠিক পাশেই ঘুমিয়ে আছে আমিরা। মেয়েটার বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে কত রকমের প্রতিবন্ধকতা আছে। ওর দিকে চাইলেই কেমন মা মা অনুভূতি আসে সায়রার। অথচ দেখতে গেলে আমিরা আর তার বয়সের পার্থক্য এক যুগের ও কম। তবে মমতার দিক থেকে তার বয়স যেন ঢের বেশি। ঐ যে তার আপার বয়সের কাছাকাছি। যদি তেমনটা না হতো তবে সে কি পারত এই সংগ্রামে অংশ নিতে? উহু পারত না। সায়রা আমিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কফি আনতে গেল। অনেক রাত অবধি জাগতে হবে। চোখে বেশ ঘুম ঘুম একটা ভাব রয়েছে। ও চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ফোন অন করতেই দেখল, বেশ অনেক গুলো ম্যাসেজ এসেছে। সাঈদের একাউন্ট থেকে! ও একবার ভাবল ম্যাসেজ গুলো দেখবে না। আবার ভাবল, দেখাই যাক। কিংবা লোভ সামলাতে পারল না। ও ম্যাসেজ সীন করতেই সরাসরি কল এল সাঈদের থেকে। তার মানে ছেলেটা এখনো জেগে আছে! অপেক্ষা করছিল কী? সায়রা একটু ভরকে গেল। তবে রিসিভ করতে ও বিলম্ব হলো না।
“সায়রা, তুমি কি একটু বাইরে আসতে পারবে।”
অদ্ভুত! এত রাতে সে বাইরে কেন যাবে। হুট করেই প্রশ্ন করাতে কিছুটা মৌনতা এসে গেল ওর মাঝে। সময় নিয়ে নিজেকে শক্ত করে ও পাল্টা জবাব দিল।
“এত রাতে, বাইরে কেন যাব?”
“আমি আসছি।”
“তুমি আসছো মানে! পাগল নাকি। কটা বাজে দেখেছো? আর শীতের তীব্রতা দেখো না?”
বেশ কিছু দিন ধরেই শীত বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে বরফ পড়বে। দিনে যা ও সহনশীল থাকে রাত হলে মনে হয়, পৃথিবীটা বুঝি ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার সাথে শির শির বাতাস। সব মিলিয়ে ভীষণ যন্ত্রণার।
“একটু আসবে প্লিজ?”
“সাঈদ, এখন অনেক রাত। তুমি ফিরে যাও। এসো না।”
“প্লিজ একবার আসো।”
সায়রার হৃদয় ধক করে ওঠছে। ওদের দুজনের কথা হলো প্রায় দু মাস পর। এই দু মাস যেন কীভাবে পার হয়ে গেল। হয়তো নানান ব্যস্ততা সংগ্রামে সায়রা টের পায় নি। কিংবা পেয়েছে, পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি। সায়রা অবশ্য সেই দুঃখ, যন্ত্রণা স্মরণ করতে চাইল না। ও মিনমিনে কণ্ঠে বলল,”ঠিক আছে। আমি আসছি।”
দু কাপ কফি বানিয়ে বের হলো সায়রা। খুব গোপনে। যাতে বাসার অন্য কেউ জেগে না ওঠে। ওদের এই ছোট্ট দোতলা বাসাটার জন্য আলাদা কোনো দারোয়ান নেই। তাই, বের হতে সমস্যা হলো না একদমই। ও বের হয়েই দেখল সাঈদ দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে কোনো শীতবস্ত্র নেই! জাস্ট একটা পাতলা টি শার্ট। চুল গুলো অগোছালো। মনে হচ্ছে অনেকদিন পরিচর্যা হয় না।
“এভাবে কেন এসেছো? জ্যাকেট কেন আনো নি?”
ওর কথার জবাব দিল না সাঈদ। সায়রা কিছু সময় অপেক্ষা করে কফি বাড়িয়ে দিল। সাঈদ সেটা নেওয়ার পর বলল,”আমি চাদর নিয়ে আসছি।”
সায়রার হাতটা ধরে ফেলল সাঈদ। কি এক সংকট তার হৃদয়ে। সায়রা থমকে রইল। ওর বুকের ভেতর কেমন ধীম ধীম করছে। ও শুকনো ঢোক গিলছে। যেন গলাটা ভীষণ তৃষ্ণায় কাঠ হয়ে আছে।
সাঈদের চোখ মুখ কেমন শুকনো। দু মাস পরের দর্শনের সায়রার মনে হলো অনেক কিছু বদলে গেছে। কিংবা বদলায় নি, তার দৃষ্টির বদল ঘটেছে। কে জানে। সায়রা তো বুঝে ওঠতে পারছে না। ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, ও হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। প্রায় অনুভূতি আসে না। আবার কখনো সখনো ভীষণ কান্নায় বুক পাঁজর ভে ঙে আসে।
“কিছু বলবে?”
সায়রার কণ্ঠে যেন সাঈদের ঘোর ভা ঙে। ও ভীষণ ক্লান্ত, বিভ্রান্ত, অসহায়।
“হ্যাঁ।”
ছোট্ট শব্দটি উচ্চারণ করেই সায়রার দিকে অগ্রসর হলো সাঈদ। মেয়েটির মুখশ্রী ভালো মতন পরখ করে নিয়ে বলল,”তোমাকে এত ভালোবাসি কেন বলো তো?”
সায়রার অনুভূতি সব বের হতে চায়। তবে ও সেসব কে পাত্তা না দিয়ে বলে,”এটা বলার জন্য এই মাঝ রাতে চলে এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
সায়রা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মানুষটা পাগল নাকি? সময়ের সাথে সাথে কেমন বাচ্চামি চলে এসেছে! নাকি এসব খুবই স্বাভাবিক, কেবল ওর কাছেই অস্বাভাবিক লাগছে।
“অপেক্ষা করো, আমি চাদর নিয়ে আসি।”
“না,লাগবে না।”
“ঠান্ডা লাগছে না?”
“না।”
“সাঈদ।”
“আমাকে বিয়ে করবে?”
সায়রা চমকে তাকাল। ভালো মতন দেখল সাঈদের মুখশ্রী। বিভ্রান্ত, কষ্টের সাগরে ভেসে যাওয়া এক মুখ।
“বলো, বিয়ে করবে আমায়?”
সায়রা উত্তর না দিয়ে মৌন থাকে। সাঈদ আবার একই প্রশ্ন করে, তবে মৌনতা যায় না সায়রার।
“কী বলতে চাও?”
“আমি তোমাকে নিয়ে দূরে চলে যেতে চাই। আমিরাকেও নিয়ে যাব। আমরা অনেক দূরে চলে যাব সায়রা। অনেক দূরে।”
সায়রা চুপ। সাঈদ ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে পুনরায় একই কথা বলতে থাকে। সায়রার থেকে উত্তর আসে না। ও হাত সরিয়ে নিয়ে অন্য পাশে তাকিয়ে থাকে। আরো কিছুটা সময় পার হলে সায়রা বলে,”এটা সম্ভব না। তুমি চলে যাও সাঈদ। প্লিজ চলে যাও।”
সাঈদ খোলা চোখে তাকিয়ে থাকে। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছে। সায়রা এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে না। চলে আসে বাড়ির ভেতরে। সাঈদ তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে সে। পলকহীন ভাবে। বিভ্রান্ত, আর করুণ চোখে। এই তাকিয়ে থাকার যেন শেষ নেই।
বাড়িতে প্রবেশমাত্রই একটি ছায়ার মুখে পড়ে সায়রা। ভীতি ঠেকে ওর মুখশ্রী জুড়ে।
“একটু বাইরে গিয়েছিলাম ভাবি।”
“সাঈদ এসেছে?”
জুথির কণ্ঠে কঠোরতা নেমে এসেছে। সায়রা হেসে বলে,”এমনি। পাগল সে। চলে যেতে বলেছি।”
এ কথা বলেই পালানোর মতন করে চলে যেতে নেয় সায়রা। জুথি ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো মতন দেখে।
“বিয়ে করতে চাচ্ছে?”
সায়রা জবাব দেয় না। মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। জুথি আবার বলে,”যাচ্ছিস না কেন?”
সায়রা এবার ও চুপ থাকে। জুথি ওর মুখশ্রী হাতে নেয়। এই মেয়েটিকে সেই কত ছোট দেখেছে। আজ কত বড়ো হয়ে গেছে!
“আমিরাকে আমি দেখব। কথা দিলাম। তুই নিজে সুখী হ। সাঈদ কে ফিরিয়ে দিস না।”
এ কথা বলতেই সায়রা এবার হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। জুথির ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্ব ল তে থাকে।
“ভাবি, আমি যে শেষ হয়ে গেলাম। শেষ হয়ে গেলাম আমি।”
সায়রা ওভাবেই কাঁদতে থাকে। জুথি ওকে আগলে নেয়। ওর চোখেও জল চলে এসেছে। পরিস্থিতি, সংকট, এ এক বড়ো কঠিন সত্য।
সমস্ত রাত ঘুম হয় নি সায়রার। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি এক আশ্চর্য ব্যথা ওকে মে রে ফেলছে একটু একটু করে।
সকাল বেলাতেই প্রচন্ড জ্বর হলো সায়রার। ও কাঁপতে কাঁপতে রনুকে কল করল।
“হ্যাঁ সায়রা কেমন আছ?”
“কিছুটা অসুস্থ আপু। আমি আহনাফকে কিছুদিন পর পড়াতে আসব। কোনো সমস্যা হবে?”
“না না, সমস্যা কেন হবে। তুমি বরং সুস্থ হয়ে আসো।”
“ঠিক আছে আপু।”
“তুমি নিজের খেয়াল রেখো। সুস্থ না হয়ে আসবে না।”
“জি আপু, ধন্যবাদ।”
কল রাখতেই দেখল, জুথি গরম গরম চা নিয়ে এসেছে। সায়রা মৃদু সুরে বলল,”খেতে ইচ্ছা করছে না ভাবি।”
“গলা তো বসে গেছে। না খেলে তো সমস্যা।”
“কিছু হবে না ভাবি।”
“বেশি কথা বলিস না তো।”
জুথি চা এগিয়ে দেয়। তারপর বিছানাও গুছিয়ে দেয়। আমিরা হাত মুখ ধুয়ে আসলে তাকে ডাইনিং এ যেতে বলে। সায়রা উদাসীন ভরা নয়নে সামনে তাকিয়ে আছে। আহারে জীবন!
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি