#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৭)
ছোট্ট আমিরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সায়রাকে। মনে হচ্ছে কোনো ছোট্ট ছানা তার মা কে শক্তপোক্ত হাতে জড়িয়ে আছে। ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে যেন। কথায় আছে মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। যদিও বাক্যটির প্রেক্ষাপট বিপরীত তবে সায়রার ক্ষেত্রে বাক্যটি ঠিকঠাক। বলা চলে শতভাগ সত্য। এই যে মা হীনা মেয়েটিকে নিজের সবটুকু দিয়ে মায়ের মতন আগলে রেখেছে সে। এই অনুভূতি অবশ্য ছোট থেকেই ছিল। আমিরা যখন দু বছরের তখন একবার বাচ্চাটির ভীষণ জ্বর হয়েছিল। জ্বরের সাথে লাগাতার বমি। চোখ মুখ ভয়ানক লাগছিল। তখনই তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়। সেই জ্বরে প্রায় ম র তেই বসেছিল দু বছরের আমিরা। সায়রার বয়স ই বা তখন কত? ১২ কি ১৩। ঐ টুকু বয়সেই সে প্রায় তোলপাড় করে দিয়েছিল। হসপিটালের করিডোরে সে কী কান্না ওর। সেদিনই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমেনাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তার চলে যাওয়ার পর ও আমিরাকে আগলে নেওয়ার মানুষ আছে। সে নিজের সব দিয়ে হলেও মেয়েটিকে আগলে রাখবে। আর তাই হয়তো এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, নিজের বাচ্চাটিকে ফেলে সে চলে গেল সাত দিনের পেট ব্যথা আর জ্বরে। না ফেরার দেশে। একটা গভীর নিশ্বাস নেমে এল সায়রার ভেতর থেকে। আপুর মৃ ত্যু টা ভীষণ বেদনার। কি যে রোগ হয়েছিল কে জানে। সায়রার মনে পড়ে, আমেনা ওকে ফোন করে প্রায় বলত আমি বোধহয় আর বাঁচব না রে। আমার আমিরা এতিম হয়ে যাবে। ওকে কে দেখবে। আর কত কথা বলত আমেনা। সায়রা কি জানত, আপা মিথ্যে আশঙ্কা করে নি। সবটাই ছিল সত্যি। সায়রার বুকের ব্যথা বৃদ্ধি হয়। চোখ দুটো শুকিয়ে গেছে। কান্না আসছ না আপুর জন্য। বার বার মনে হচ্ছে আপু নিষ্ঠুর। নতুবা তাকে এত বড়ো দায়িত্ব দিয়ে কীভাবে ঘুমিয়ে আছে মাটির ঘরে? সায়রা চোখ বন্ধ করে। আপন মনে কিছু সময় আমিরার চুলে বিলি কাটতে থাকে। তারপর আদুরে কণ্ঠে ডাকে।
“আমিরা, আমিরা। ওঠ, বেলা হয়েছে।”
আমিরা ঘুমের কণ্ঠেই জবাব দেয়। “আরেকটু ঘুমাই মা।”
‘মা’ শব্দটি বলতেই কোথাও একটা আর্তনাদ শুরু হয়ে যায়। সায়রা কথা বলে না চুপ করে থাকে। যেন মেয়েটিকে বুঝতে দিতে চাইছে না তার মা পাশে নেই। সে চলে গেছে বহুদূরে। যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়।
আমিরার ঘুম ভা ঙে আরো কিছু সময় পর। ও চোখ থেকে ঘুমের ভাব সরিয়ে বলে,”মিমি কটা বাজে?”
“আট টা।”
“আরেকটু ঘুমাই?”
“না রে। আর ঘুমানো যাবে না। তোকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাব।”
“এখনই?”
“হ্যাঁ।”
আমিরার অধর কোণে হাসির দেখা মিলে। ও চট জলদি ওঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সায়রা ততক্ষণে বিছানা গুছিয়ে ফেলে।
নাশতার টেবিলে সায়রা বলল,”আমিরাকে জুঁই,মাহিম স্কুলে ভর্তি করাতে নিচ্ছি।”
“এত টাকা খরচ না করলেই কী হয় না? আশে পাশের স্কুল কিন্তু খারাপ না।”
জুথির কথায় আমিরা মুখটা শুকিয়ে আসে। সায়রা সেটা দেখে জুথির দিকে করুণ করে তাকায়। বলে,”না ভাবি, আমিরা ঐ স্কুলেই পড়বে।”
“দেখ, তুই হয়তো আমার কথাটা বুঝতে পারিস নি। যদি সব টাকা এখানেই খরচ করে ফেলিস, তবে তোর ভবিষ্যত টা কী?”
“আমার তো ভবিষ্যত একটাই ভাবি। আমিরা, ওকে নিয়েই এখন আমার সব।”
জুথি হতাশ হয়ে চেয়ে থাকে। যত যাই হোক, সায়রার প্রতি বিশেষ স্নেহ তার আছে। সে চায় সায়রা সুন্দর একটি সংসার পাক। কিন্তু এভাবে কিছু কী সম্ভব?
লুকিয়ে পাঁচশ টাকা দিল মারুফ। আমিরা নিতে চাচ্ছে না। তবে মারুফ নিচু স্বরে বলল,”চুপ। এটা রাখ, পরে কাজে লাগবে।”
আমিরা চুপ করে থাকে। মারুফের খারাপ লাগে। বোনের মেয়েটিকে সে ও ভালোবাসে। তবে নিজের সংসার গুছিয়ে আসলেই সব সম্ভব হয় না।
আমিরার জীবনের সবথেকে সুন্দর দিন আজ। সে আবার স্কুলে যাবে। মিমি তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। এখন তারা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনতে। ব্যাগ, স্কুল ড্রেস, জুতো, বোতল, টিফিন বক্স। সব কিছু কিনতে হবে। সায়রা তার জমানো টাকা বের করে এনেছে। আহনাফ কে পড়ানোর জন্য আট হাজার টাকা দিয়েছে এ মাসে। যদিও অর্ধেক মাস ছিল, তবু ও পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে। আগের টিউশনি থেকে পাঁচ হাজার করে দেওয়া হয়। আহনাফ যেহেতু স্পেশাল চাইল্ড তাই তার জন্য বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে হিসাব করলে আমিরাকে পড়াতে সমস্যা হবে না। বরং ভালো ভাবেই সব করা যাবে। সায়রা আমিরার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। তারপর রিকশা নিল।
“মিমি,তুমি কক্সবাজার গিয়েছিলে?”
“গিয়েছিলাম তো।”
“মা ও গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। বাবা – মা, আপু,ভাইয়া সবাই। তখন ভাবি ছিল না। কিন্তু কেন বল তো?”
আমিরা চুপ করে রইল। সায়রা ওর দিকে চেয়ে বুঝল মেয়েটির মন খারাপ। ও বলল,”কেন? তোর যেতে ইচ্ছা হয়?”
আমিরা এবার ও চুপ। মা থাকলে নিশ্চয়ই আবদার করে বসত। তবে মিমির কাছে কথাটা বলতে পারছে না। তার হৃদয়ে সংকোচ হচ্ছে।
“বুঝেছি, সময় করে একবার যাব। ঠিক আছে?”
আমিরা কেবল মাথা দোলাল। গত রাতে জুঁই আপু আর মাহিম ভাইয়া ফটো অ্যালবাম বের করেছিল। কিছু বছর আগে তারা ও কক্সবাজার গিয়েছিল। আনন্দ করেছে খুব। ওসব দেখার পর থেকেই ওর কক্সবাজার যেতে ইচ্ছা করছে। তবে যার মা নেই, বাবা থাকতেও বাবা নেই। তার শখ, ইচ্ছা কতটা প্রাধান্য যোগ্য? ও শক্ত হাতে মিমিকে জড়িয়ে ধরল। সায়রা ও মেয়েটি ভরসা দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।
“যখন যা ইচ্ছা করবে আমাকে বলবি, আমি সবটা পূরণ করব। দেখিস, তোর সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করব আমি।”
আজ আবার অর্পা কল করেছে। সায়রা পড়ছিল। স্কুলে ভর্তি করিয়ে প্রয়োজন জিনিস নিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। তাই আমিরাকে নিয়ে বাসায় ফেরার পর থেকেই সে পড়ছে। তার অনেক পড়া বাকি। এদিকে টানা কল করে চলেছে অর্পা। সায়রা না ধরে পারল না। এক হাতে ফোন আরেক হাতে কলম।
“হ্যাঁ অর্পা। বল কেমন আছিস?”
“চলছে। তোর কী খবর?”
“আমারো চলছে। আল্লাহ যেমন রেখেছেন।”
“তুই কী করছিস এখন?”
“পড়ছিলাম।”
“পরে কল করি তাহলে?”
“না, না এখনই বল। সমস্যা নেই।”
“আসলে…..”
সায়রা ওর সংকোচ অনুভব করে হাসল। মৃদু হেসে বলল,”আরে বল না কি বলবি।”
“ইটস আ ব্যাড নিউজ। পরে বলি, তুই এখন পড়।”
“না তুই এখনই বল। এমনিতেও আমার জীবনে ব্যাড এর শেষ নেই।”
“অ্যাকচুয়ালি সাঈদ ভাইয়ার মা, মেয়ে দেখতে গিয়েছেন। এবার হয়তো কিছু একটা ফাইনাল করেই আসবেন।”
সায়রার মাথায় আকাশ ভা ঙা র কথা থাকলেও তেমনটি হলো না। ও বরং মুখের হাসি বহাল রেখেই বলল,”এই ব্যাপার।”
“দোস্ত, তুই ভে ঙে পড়িস না।”
“না, ভা ঙ ব কেন? আমি আসলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাছাড়া আরো আগে থেকেই ওনারা আমাকে পছন্দ করছিলেন না। তাদের ছেলে আরো ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে কী না।”
“দোস্ত এভাবে বলিস না। তোর কমতি কী বল তো?”
“কমতি আমার বাবা-মা নেই। ভাবির সংসারে আছি। নিশ্চয়ই স্বভাব খারাপ। শাসন করার মানুষ নেই। নিজের টাকায় চলি। চাকরি করতে চাই। সংসার হলেও মন টিকবে না। আর কত কমতি আমার।”
অর্পা কী বলবে বুঝতে পারছে না। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এসব কথা সাঈদের মা ই বলেছেন।
“ওনি আসলে এমনই রে। আশে পাশের কারো সাথেই সম্পর্ক ঠিক নেই।”
“যাক, তারপর বল তোর কী খবর? অনেক দিন দেখি না তোকে।”
“একদিন সময় করে আসব। আমিরাকেও দেখার আছে। বাচ্চাটা খুব মিষ্টি।”
সায়রা হাসল। দুজনের কথোপকথন চলল কিছু সময়। কল রেখে সায়রা পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দিল। তবে কিছুতেই শব্দ গুলো উচ্চারণ করতে পারল না। বরং তার চোখ দিয়ে নোনা জল নামতে লাগল। এই অশ্রু তার জন্য বরাদ্দ হয়ে গেল যেন।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি