মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-০৬

0
427

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৬)

আয়োজন চলছে। লুকিয়ে, লুকিয়ে। জুঁই ঘর সাজানোয় ব্যস্ত। ছোট ছোট কালারফুল লাইট। আর বেশ কিছু বেলুন।অল্পতেই দারুণ সাজানো হচ্ছে। মাহিম গিয়েছে কেকের দোকানে। আমিরার ভীষণ পছন্দ রেড ভেলভেট। তবে আশেপাশের দোকানে লাল রং মাখিয়ে রেড ভেলভেট বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। সায়রা বার বার করে বলে দিয়েছে ভালো কেক আনতে। এদিকে আমিরা প্রায় ঘুমিয়ে জল। মেয়েটা রাতের খাবার খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। জন্মদিনের কথা হয়তো মনে ও নেই। কিংবা আছে। তবে পরিস্থিতি তাকে সেই আনন্দটা দিচ্ছে না। সায়রার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আপা কি দেখে না, তার মেয়েটা আজ কত অসহায়? বাবা, নামক মানুষটি ফিরেও দেখে না। মাত্র তো কিছু দিন, এরই মধ্যে মানুষটা বদলে গেল। নাকি বদলে ফেলা হয়েছে। সায়রার চোখ জ্বলছে। কান্না আসতে চায়। তবে ও কাঁদে না। নিজেকে শক্ত করে। শক্তি জোগায়। নিচু হয়ে আমিরার কপালে চুম্বন করে। যেন আমিরা তার বোনের নয়, বরং নিজের সন্তান।

বাড়িতে যে কিছু হচ্ছে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে জুথি। সে চোখ কান খাড়া করে বিষয়টা বের করার চেষ্টা করছে। তবে সঠিক কিছু বুঝতে পারছে না। সায়রা প্লেট গোছাচ্ছে। নীরব ভাবে।

“বাড়িতে কী চলছে বল তো।”

“কী চলবে?”

“কোথাও তো কিছু হচ্ছেই।”

“কিছুই না। তুমি গিয়ে ঘুমাও ভাবি।”

“আগে বল কী চলছে? তোরা কী মতলব করছিস?”

“উফ, কিছু না ভাবি।”

জুথি দমে থাকার নয়। সে কিছু সময় ঘুরে ফিরে এসে বলল,”মাহিম কোথায় রে?”

সায়রা ভণিতা ছাড়া স্বাভাবিক ভাবেই বলল,”বাইরে গেছে।”

“রাত দশটা বাজে। এখন বাইরে কেন?”

“আমি পাঠিয়েছি।”

“কেন?”

“কেক আনতে।”

“কেক….”

এটা বলেই তারিখের দিকে নজর গেল জুথির। খুব ভালো করেই বুঝল আমিরার জন্মদিনের জন্যেই কেক আনা হচ্ছে। আর সন্ধ্যায় পায়েস ও বানানো হয়েছে। সে একটু টিপ্পনি কেটে বলল,”কী লাভ জন্মদিনে কেক কেটে পায়েস করে? বাপ টা তো ফিরেও দেখছে না মেয়েকে। এতিম করে রেখেছে। বাপ থাকতেও বাপ ছাড়া।”

সায়রার একটু খারাপ লাগল। তবে কিছু বলল না। ও যদি কথা বাড়ায় তবে ভাবি আরো কথা শোনাবে। অবশ্য এর পেছনের, ইতিহাস ও কম নয়।

একটা মৃদু শব্দ কানে যেতেই ধরমরিয়ে ওঠল আমিরা। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে আলো জ্বলে ওঠল। ভেসে এল অনেক গুলো মানুষের মুখশ্রী, ও আওয়াজ।

“শুভ জন্মদিন আমিরা।”

একটা ঘোরে ডুবে গেছে আমিরা। এই মানুষ গুলোকে চিনতেও যেন ওর সময় লাগছে। ও একটু সময় নিয়ে স্মরণ করল। তারপর বুঝল, সময়টি তার জন্য বিশেষ। তার এগারো তম জন্মদিন! আমিরা কে একে একে জড়িয়ে ধরল সবাই। আদর করে দিল। জুথি ও উপস্থিত আছে। সে অতটা খুশি কী না বোঝা গেল না। তবে এক চামচ পায়েস এনে ঠিকই খাওয়াল। আমিরাকে নেওয়া হলো সাজানো নির্দিষ্ট কক্ষে। তারপর কেক কাটা হলো। ভীষণ সুন্দর সে মুহূর্তটি। আমিরা মুচকি হাসল। এই টুকু বয়সেই কত কিছু দেখল সে। তারপরই আকাশের পানে তাকাল, ভাবল মায়ের কথা। অথচ তার স্মরণ হলো না বাবা নামক মানুষটিকে। কেনই বা স্মরণ হবে, যেই বাবা মেয়েকে গলা ধা ক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। সেই বাবাকে কেনই বা স্মরণ হবে?

মারুফ অনেকটা সাহস করেই এক হাজার টাকা দিয়েছে আমিরাকে। জুথিও কিছু বলে নি। সব মিলিয়ে সময়টা সুন্দর। উপহার ও মানুষ গুলোর ভালোবাসা পেয়ে আমিরা খুশি। তবে বাচ্চা মন হলেও মায়ের কথা যে বড়ো স্মরণ হয়। প্রতি বছর মা সব থেকে দারুণ উপহার দিয়েছে তাকে। কত সুন্দর আয়োজন করে জন্মদিন হয়েছে। সময় আজ অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। তবে এই সময়টা মন্দ নয়। সবাই ভীষণ ভালোবাসা দিয়েছে। এমনকি মামি ও পায়েস এনে খাইয়েছে। সব মিলিয়ে আমিরার দিনটি সুন্দর। বেলা তখন নয়টা। সায়রার পড়ানো রয়েছে। আহনাফকে টানা পড়াচ্ছে সে। যাতে করে বাচ্চাটা ওর সাথে মিশতে পারে। তাছাড়া আহনাফকে গতকাল বলেছিল ভালো করে পড়লে বাইরে নিয়ে গিয়ে বল খেলাবে। সব মিলিয়েই যাচ্ছে,সে। রিকশায় ওঠার সময় রাস্তায় কিছু কাঠগোলাপের দেখা মিলল। সাদা, আর হাল্কা হলুদের আভা মেশানো ফুল। বিছিয়ে আছে। সুন্দর খুব। সায়রার মন ভালো হলো। ফুলটি একটু বেশিই সুন্দর যেন। ও কিছু ফুল তুলে নিয়ে রিকশায় ওঠল।

আহনাফকে নিয়ে বাসার পাশের মাঠটায় এসেছে সায়রা। আহনাফ,কে ভীষণ খুশি মনে হচ্ছে। বহু দিন পর সে হয়তো পরিবারের বাইরে খেলার সাথী পেয়েছে। কেউ তো তার সাথে খেলে না। কথা বলে না। তাই হয়তো উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি। আহনাফের দিকে বল দিতেই আহনাফ সেটা লুফে নিল।

“গুড আহনাফ, এবার আমার দিকে দেও।”

আহনাফ কিয়ৎকাল চুপ করে রইল। সায়রা আবার বলল,”আহনাফ দাও।”

আহনাফ বল তো ছুড়ল তবে সেই বল গেল আরেক জায়গায়। সায়রার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আহনাফ। ওর কাছে এসে সায়রা বলল,”ইটস ওকে। এরপর থেকে সামনে ছুড়ে দিবে।”

আহনাফ চুপ। সায়রা ওকে নিয়ে বল খুঁজতে গেল। তবে বল যে কোথায় গেল। এদিকটা আবার ঘাস দিয়ে জঙ্গলের মতন হয়ে আছে।

“কোথায় গেল বলটা, বলো তো।”

আহনাফ ভয় পাচ্ছে। ও পথ চলতে চাইছে না। সম্ভবত ভেবেচে সায়রা তাকে বকা দিবে। তাই চোখ মুখ থম করে রাখা। সায়রা ওর হাত আগলে নিয়ে বলল,”ভয় পেও না। আমরা বল খুঁজে নিব।”

আহনাফের ভয় কমল কী না কে জানে। তবে দু এক মিনিট পর ই বল খুঁজে পেল সায়রা। বল তুলে নিয়ে ঘুরতেই দেখল আহনাফের সাথে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব। কী যেন বলছে। সায়রা কাছে এগিয়ে এল। অনুভব বলছে,”একা কেন? সাথে কে এসেছে?”

আহনাফ চুপ। সায়রা পাশ থেকে জবাব দিল,”আমি।”

অনুভব ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। এই নিয়ে ওদের চতুর্থবার দেখা হলো।

“তুমি?”

“আমি ওর টিউটর।”

“অহ। টিউটর এখন খেলা ধুলো ও করায়!”

সায়রা অনুভবের দিকে তাকাল। ছেলেটার চেহারা ভরাট নয়। রোগা পাতলা গড়নের।

“যা আহনাফ, এখন এখানে বড়োরা খেলবে। ছোটরা এখানে খেলে না।”

আহনাফ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। সায়রা ওর কাছে এসে হাতটা ধরল।

“এভাবে কেন বললে? ও স্পেশাল চাইল্ড, জানো না?”

অনুভব মনে করার চেষ্টা করল। আসলেই সে জানে না আহনাফ যে স্পেশাল চাইল্ড। ওর ভাবনার মাঝেই আহনাফকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে সায়রা। সেদিকে তাকিয়ে অনুভবের মনে হলো সে দিন দুনিয়ার কোনো খবর ই রাখে না। এই যে আহনাফরা দু বছর হয়েছে এই বিল্ডিংয়ে। অথচ সে জানেই না বাচ্চাটা স্পেশাল!

বাড়িতে ফিরতেই জুথি বলল,”আমিরার বাবা একবার ও কল করে নি।”

“করবে না এটা তো আগে থেকেই জানা ভাবি।”

“কেন করবে না? মেয়ের জন্মদিন অথচ কোনো দায়িত্ব জ্ঞান নেই।”

সায়রা করুণ চোখ তাকাল। তারপর বলল‍,”এই বিষয়ে আরো কিছু বলতে হবে ভাবি? তুমি তো জানোই সমস্যাটা কোথায়। কী নিয়ে।”

জুথি তবু দমল না। আমিরার বাবার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল। সায়রা ও হতাশ। সে একটা রাগ থেকেই আমিরার বাবা বাহাদুর কে কল করল। এক চোট কথা শুনিয়ে তবেই সে থামল। কথা শেষ করে সায়রা দেখল আমিরা ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই সবটা শুনেছে।

“এদিকে আয়।”

আমিরা এগিয়ে এল। সায়রা ওর কাপলের চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,”মন খারাপ করবি না। তোর বাবা, মা সব আমি। বুঝলি?”

ছোট্ট আমিরা, সে জবাব দিতে পারল না। তবে তাকিয়ে রইল মমতাময়ী আরেক মায়ের দিকে। যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাকে একটি সুন্দর সুস্থ জীবন দেওয়ার।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে